বাঁধন যতই শক্ত হবে…
বিগত সপ্তাহের প্রথম দিনে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর সম্পাদকমণ্ডলী যখন সপ্তাহ শেষের সাম্প্রতিকীর পরিকল্পনা করিতেছিলেন, সে বড় সুখের সময় ছিল না। সবেমাত্র কয়দিন হইল সংসদের অভ্যন্তরে ক্ষীণবল বিরোধী গোষ্ঠী ও বাহিরে আপামর দেশবাসীর উপর শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মার পড়িয়াছে। বিতর্কিত বিল ক্যাব (Citizenship Amendment Bill 2019) দেশের আইনসভার দুই কক্ষে উত্তীর্ণ হইয়া রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর প্রাপ্তিতে আইন ক্যা-তে (Citizenship Amendment Act) পরিণত হইয়াছে৷ ফলত উত্তরপূর্বে বিক্ষোভ, অসমে কার্ফু, বাংলার স্থানে স্থানে গোলমাল, মূলত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি হইতে পরস্পর তীব্র প্রতিক্রিয়ার সংবাদ আসিতেছিল৷ রাজপথে অবরোধ, ট্রেনে-স্টেশনে অগ্নিসংযোগ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংসের বিবিধ সংবাদে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নাগরিকদের একাংশ ট্রামে-বাসে-চা পানের গুমটিতে বসিয়া বক্র হাসিয়া কটাক্ষ ছুঁড়িতেছিলেন, “দেশে এনআরসি-সিএএ-র যে কতখানি প্রয়োজন ছিল, এই হিংসাত্মক বিক্ষোভগুলি তারই প্রমাণ।” এই মতের বিরুদ্ধে জোরের সহিত কিছু বলিবার চেষ্টা সফল হইতেছিল না, কারণ দেশে বিগত সত্তর বৎসরের গণতন্ত্র-চর্চায় আর যাহাই হউক না কেন, একটি কথা জনমনের গভীরে প্রোথিত করিয়া দেওয়া গেছে যে, হিংসার যাবতীয় অধিকার একমাত্র রাষ্ট্রের।
ইহা সত্য ছিল, কিন্তু শেষ সত্য ছিল না।
ক্রমে, টেস্ট ক্রিকেটের পরিভাষায়, খেলা ঘুরিল। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়-সহ দেশের প্রায় চল্লিশ-অধিক প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হইতে সিএএ-এর বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিবাদের প্রথম সংঘবদ্ধ কণ্ঠস্বরটি শোনা গেল৷ সিএএ যে নিছক বহিরাগতকে নাগরিকত্ব প্রদানের নিরীহ একটি আইন নহে, বরং আইনটির নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কেন্দ্রিক বৈষম্যবাদী চরিত্র যে আদতে ভারতবর্ষকে হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করিবার লক্ষ্যে একটি চতুর ও চোরা শঙ্খনাদ, এবং ইহার আঘাতের মূল অভিমুখ যে ভারতবর্ষের উদার ও ‘Inclusive’ সংবিধানটির প্রতি, এই জরুরি বার্তাটি আকাডেমিক পরিসরের বাহিরেও দেশের নানা কোণ হইতে চিৎকৃত হইতে শোনা গেল। দেশবাসী, সহর্ষে, এবং কেহ কেহ প্রবল বিষাদে, দেখিলেন, দেশের ছাত্র-যুবসম্প্রদায় জাতিধর্মশ্রেণিনির্বিশেষে সংবিধানের শুদ্ধতা রক্ষার্থে পথে নামিয়াছে। একটি অগ্নিশলাকা যেমন স্থির ও দৃঢ় থাকিলে অনেকগুলি বর্তিকাকে আলোকসংযোগে সক্ষম, এই প্রতিবাদ এক-দুই দিনে দেশের প্রায় সবকয়টি প্রধান শহর এমনকি দেশের বাহিরেও ছড়াইয়া পড়িল। অসহিষ্ণু শাসক অবশ্য হাত গুটাইয়া বসিয়া ছিলেন না। কিছু পূর্বেই যে কথা বলিতেছিলাম, হিংসার অধিকার যেন সর্বতোভাবে রাষ্ট্রের। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে প্রতিবাদী জনতার উপর নিক্ষিপ্ত হইল পুলিশি অত্যাচার, শান্তিপূর্ণ জমায়েতে ধরপাকড় চলিল, খোদ রাজধানীতে জামিয়া মিলিয়া-র ছাত্রাবাসে, গ্রন্থাগারে পুলিশের হাতে বর্বর আক্রমণের শিকার হইলেন প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রীরা। পুলিশের লাঠির আঘাতে বাম চোখের দৃষ্টি হারাইয়াছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আইনের ছাত্র, অন্য চোখটিও বাঁচিবে কিনা তাহা বলা কঠিন। ম্যাঙ্গালোরে আন্দোলনকারীদের পশ্চাৎধাবন করিয়া ওখানকার এক হাসপাতালেও ঢুকিয়াছিল পুলিশ, হাসপাতাল চত্বরে কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করিতেও তারা দ্বিধা করে নাই। এই সম্পাদকীয় লিখিত হইবার পূর্ব পর্যন্ত সারা দেশে পুলিশের গুলিতে নিহত সিএএ-প্রতিবাদী নাগরিকের সংখ্যা ২৬। প্রতিটি গুলিচালনা আশ্চর্যজনকভাবে, অথবা বিন্দুমাত্র আশ্চর্যের নহে, শুধুমাত্র বিজেপি পরিচালিত রাজ্যেগুলির ঘটনা। মোট ১৬ জন নিহতের তালিকা নিয়ে এদের মধ্যে শীর্ষস্থানে সন্ন্যাসী-শাসিত রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, এবং সংখ্যাটি এখনও বাড়িতেছে। শুধু উত্তরপ্রদেশেই ১৭টি জেলায় ইন্টারনেট স্থগিত, গ্রেফতার হইয়াছেন সাতশোর বেশি মানুষ। গণতন্ত্রে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি বর্তমান শাসকের হাতে কতখানি সুরক্ষিত, এই সংখ্যাতত্ত্ব তারও এক নির্ভুল নির্দেশকও বটে।
এতদসত্ত্বেও, গত উনিশে ডিসেম্বর, ভারতের স্বাধীনতা সেনানী ও দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু কবি রামপ্রসাদ বিসমিল ও আসফাকউল্লা খানের শহিদ বার্ষিকীর পুণ্যলগ্নে, এনআরসি-সিএএ বিরোধী প্রতিবাদ তুঙ্গ স্পর্শ করিল। ভারতবর্ষের মতো সুবিশাল দেশে কোনও একটিমাত্র তাহরির স্কোয়ারের গৌরবগাথার নির্মাণ সম্ভবপর নহে, অথবা অন্যভাবেও বলা যায়, উনিশে ডিসেম্বর সন দুই সহস্র উনিশ তারিখে, ভারতের প্রতিটি রাজপথের চারিমাথার সংযোগস্থলই যেন একেকটি জায়মান তাহরির স্কোয়ার। কলিকাতা হইতে কালিকট, মুর্শিদাবাদ হইতে ইয়াবৎমল, শাসকের চোখে চোখ রাখিয়া দেশের সচেতন মানুষ একথা সুস্পষ্ট বুঝাইয়া দিলেন যে দেশের আত্মাকে ভাঙিয়া-চুরিয়া বদলাইয়া লইবার অপচেষ্টা এত সহজে সফল হইবার নহে। নতুন দিল্লির ৭ নম্বর লোককল্যাণ মার্গের বাসিন্দা দেখিলেন, গণতন্ত্রের জনাদেশ মানেই তা স্বেচ্ছাচারের জনাদেশ নয়। দেখিলেন বটে, কিন্তু কিছু শিখিলেন কিনা সেই বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ রহিয়া গেল। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষটি দেখিলেন, এই লড়াইয়ে তাঁহারা একাকী নহেন, হিন্দু সহোদরটির দক্ষিণ হস্ত তাঁহার কাঁধ সজোরে বেষ্টন করিয়া আছে। সারা বিশ্ব দেখিল, ভারতবর্ষ তাঁহার সত্তর বৎসরের গণতান্ত্রিক অর্জনকে হেলায় ত্যাগ করিতে কদাপি প্রস্তুত নহে। প্রকৃতিদেবী দেখিলেন, মরসুমের শীতলতম দিবসটিও কীভাবে, মানুষ ইচ্ছা করিলে, উন্নীত হয় উজ্জ্বল উষ্ণ বসন্তদিনে।
এই সর্বজনীন বসন্তদিনের সুনির্বাচিত কিছু চিঠি, রহিল, ‘ভারত উদয়’, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর এই বিশেষ সংখ্যায়। এই সংখ্যায় লিখিলেন র্যামোন ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক সন্দীপ পাণ্ড্যে। অসমের অগ্নিগর্ভ বাস্তবতা বিশ্লেষণ করিলেন সঞ্জীব দেবলস্কর। নানা দৃষ্টিকোণ হইতে সিএএ-র যৌক্তিকতা বিচারে প্রতিভা সরকার এবং অশোক মুখোপাধ্যায়। উনিশ তারিখে মৌলালির মহামিছিল থেকে নিজের ভালোবাসার শহরকে পুনরায় খুঁজিয়া লইলেন সুমিত দাস। ছাপা হইল, দুটি প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি প্রবন্ধের অনুবাদ, লেখকেরা যথাক্রমে সুদীপ চক্রবর্তী এবং নাতাশা বাধওয়ার। এছাড়াও চার নম্বর নিউজডেস্কের একটি প্রতিবেদনে ধরা থাকিল দেশবিদেশের নানা বিশিষ্টজনের মতামত ও প্রতিবাদগুলি।
সেইদিন শহরে এক মিছিলবালিকার হস্তে ধরা ছিল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ছবি। ভারতের জাতীয় পতাকায় মোড়ানো ছিল রামলীলা ময়দান প্রাঙ্গন। এই প্রজন্ম কলিকাতার রাজপথে বঙ্গভঙ্গ রোধে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃত্বের রাখীবন্ধন উৎসব দেখে নাই। এই প্রজন্ম মোহনদাস গান্ধির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন দেখে নাই। তবে ঠেলাচালকের পাশে দাঁড়াইয়া তথ্যপ্রযুক্তির শ্রমিকের একযোগে শাসক-বিরোধী স্লোগান দেওয়া দেখিল। একইভাবে, দিল্লিতে দেশের বৃহত্তম জামা মসজিদ হইতে তেরঙ্গা হাতে এক দলিত নেতার উদয় হইতেছে, গতকালের এই চিত্র চূড়ান্ত অসম, শ্রেণিবিভক্ত ও বিপন্ন ভারতকে পুনরায় নবতম উদ্বোধনের বোধে জারিত করবে, সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই।
ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে, প্রিয় পাঠক, পক্ষ নির্বাচনের গুরুদায়িত্ব আপনার শ্রেণিচেতনা ও শুভবোধের উপরেই ন্যস্ত।
সূচি:
সিএএ, এনআরসি এবং অসমের জাতিসত্তার বিচিত্র ব্যঞ্জন — সুদীপ চক্রবর্তী
সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ কি সীমা অতিক্রম করেছে — সন্দীপ পাণ্ড্যে ও রাহুল পাণ্ড্যে
ছাত্রদের থেকে আদর্শবাদ ফের একবার শেখার সময় এখন — নাতাশা বাধওয়ার
রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি-ক্যাব এবং বাঙালির দুর্ভাবনা — সঞ্জীব দেবলস্কর
নতুন জোড়া আইনের নাগপাশে নারী — প্রতিভা সরকার
উত্তাল ভারত— এবার এনআরআইসি-প্রকল্পের কবরস্থান হতে চলেছে — অশোক মুখোপাধ্যায়
হকচাচার মিছিল নামে তেহাইয়ের শহরে — সুমিত দাস
“রিফিউজ টু রিমেইন সাইলেন্ট” — ভারতবর্ষের নয়া ফ্যাসিবাদ বনাম ইন্টেলিজেন্সিয়া — চার নম্বর নিউজডেস্ক