![sandip](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2019/12/sandip.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
সন্দীপ পাণ্ড্যে ও রাহুল পাণ্ড্যে
ভারতীয় জনতা পার্টি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের রথের চাকা, কিছুক্ষণের জন্য হলেও, হয়তো কাদায় আটকে রয়েছে এই মুহূর্তে। নির্বাচনী রাজনীতিতে ব্যবহার করার জন্য সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পদ্ধতিটি নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করেছে তারা। সে পদ্ধতি গুজরাতে এবং জাতীয় স্তরেও বেশ কিছুটা কাজ করেছে তাদের অনুকূলে। সে কারণেই তারা হয়তো ভেবেছিল উত্তর-পূর্বে এবং জম্মু-কাশ্মিরেও তাদের এই তুরুপের তাস সমানভাবেই কাজ করবে। কিছুটা সময়ের জন্য সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা কণ্ঠস্বরগুলোকে সফলভাবে চুপ করিয়ে দেওয়ার পর, পদ্ধতিটি কাজ করছে বলে মনেও হয়েছিল। অসম বিধানসভায় জিতে, উত্তরপূর্বের বেশিরভাগ রাজ্যে জোট সরকার গড়ে, এমনকি জম্মু-কাশ্মিরেও অপ্রত্যাশিত ফল করে বিজেপি। তবে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তার সীমা অতিক্রম করে গেলে কী হতে পারে, সেই অভিজ্ঞতাও বিজেপি-র হয়েছে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমাজ বহু-জাতিভিত্তিক, সেখানে প্রতিটি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা খুব বেশি নয়। তাই তারা সর্বদা বহিরাগতদের প্রভাব এবং আধিপত্যের আশঙ্কায় থাকে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসীদের স্বার্থ, বিশেষত তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করা। বহিরাগতদের প্রতি এই অনুভূতিকে ব্যবহার করেই বিজেপি অসমে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। তবে এনআরসি থেকে বাদ পড়ে যাওয়া মানুষের তালিকায় বেশিরভাগই যে হিন্দু হবে, তা আশা করা যায়নি। ফলে তার পরেই বিজেপি নাগরিকত্ব সংশোধনের সাম্প্রদায়িক তাসটি খেলে। তবে তারা এটা বুঝতেও পারেনি যে, অসম বা সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং জম্মু ও কাশ্মির, যেখানে মানুষকে কেবলমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করা যেতে পারে না, সেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গা নেই। সেখানে স্থানীয় পরিচয়, কাশ্মিরিয়তের মতোই, অনেক বেশি প্রভাবশালী।
উত্তর-পূর্ব থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভগুলি এখন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দেশ জুড়ে এনআরসি-র আয়োজন করা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপরিসীম জেদ সমস্ত ভূমিহীন, সম্পত্তিহীন দরিদ্র মানুষের মনে এই আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে যে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ-দেশে বাস করেও তারা তা প্রমাণ করতে সক্ষম না-ও হতে পারে। নাগরিকত্ব সংশোধন আইনটি মুসলমানদের মাথার ওপর একটি ঝুলন্ত তরোয়ালের মতো, কারণ তারা যদি তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম না হন, তবে তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে ঘোষণা করা যেতে পারে এবং অপরাধীদের মতো আটক শিবিরে রাখা হতে পারে। গত কয়েক দশকে দেশের বাইরে থেকে আসা মুসলমানদের মধ্যেই কেবল নয়; ভারতীয় মুসলমান, যারা অন্য ধর্মের ভারতীয়দের মতো বংশপরম্পরায় এখানে বাস করে আসছে তাদের মধ্যেও এই ভয় ছড়িয়ে পড়েছে।
তিনটি দেশের মুসলমান অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দাবি করা থেকে বাদ দেওয়ার কাজটি একটি সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক হাতিয়ার। এটি যেকোনও ব্যক্তির আইনের চোখে সমতার সংবিধানের গ্যারান্টিযুক্ত অধিকারকে ধ্বংস করবে, যা কেবল দেশের নাগরিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পাকিস্তানের মতো অনানুষ্ঠানিক গ্রেড নাগরিকত্ব তৈরি করার পদ্ধতির এটি প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। পাকিস্তানে লাহোরের পঞ্জাবিরা রাজ্যের সবচেয়ে অনুগত নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হয়, লাহোরের বাইরের পঞ্জাবিদের আনুগত্য তার চেয়ে কিছুটা কম, অ-পঞ্জাবিদের আনুগত্য আরও নিচে এবং পঞ্জাব ও সিন্ধের বাইরের লোককে সেখানে সবসময়ই সন্দেহের চোখে দেখা হয়। আরএসএস-বিজেপিকে যদি কিছু সময়ের জন্য এই দেশের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা পরিচালনা করতে দেওয়া হয়, নাগপুরের ব্রাহ্মণরা দেশের সর্বাধিক বিশিষ্ট নাগরিক হিসাবে স্বীকৃত হতে পারে, তারপরে স্থান পাবে নাগপুর এবং মহারাষ্ট্রের বাইরে ব্রাহ্মণরা, অ-ব্রাহ্মণদের নাগরিকত্বের অবস্থান আরও নিচে থাকবে এবং দলিত, আদিবাসী, মহিলা এবং হিন্দু গোষ্ঠীর বাইরের প্রত্যেকে, বিশেষত মুসলমানরা চিরকাল সন্দেহভাজন হয়ে থাকবে। বিচারব্যবস্থা, ধরে নেওয়া যেতে পারে, এই শ্রেণিবিন্যাসকে নিঃশব্দে সমর্থন করবে কারণ হিন্দুত্ববাদ নিয়ে তার কোনও সমস্যা নেই।
কিন্তু সেই ব্যবস্থায় এই দেশের সংবিধানের চেতনা এবং সামাজিক কাঠামোর যা ক্ষতি হবে, তা অকল্পনীয়। সাম্য, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধগুলিকে সম্মান করে এমন একটি আদর্শ সমাজের দিকে যতটুকু এগিয়েছি আমরা, তার বিপরীত দিকে হাঁটতে হবে আমাদের। তাই, হিন্দুত্ববাদের অগ্রযাত্রা রোধের একমাত্র উপায় হল প্রগতিশীল রাজনীতির পতাকাবাহককে ক্ষমতায়িত করা।
ভারতবর্ষের সংস্কৃতির ইতিহাসে এই প্রথমবার বিদেশিদের প্রবেশে শর্ত চাপানোর চেষ্টা হতে দেখছি আমরা। শিকাগো-র বিশ্ব ধর্মমহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দ বিখ্যাত ভাষণে হিন্দুত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছিলেন এই বলে যে, হিন্দুরা বহিরাগতদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারে। হিন্দুত্ববাদী সরকারের বিরোধিতা প্রথম প্রত্যক্ষ করে রোহিঙ্গারা, এবং এখন সিএএ এই সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনাকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলার চেষ্টা করছে।
অমিত শাহ দাবি করেছেন, এনআরসি এবং সিএএ-র মাধ্যমে তিনি এই দেশ থেকে প্রত্যেক অনধিকার প্রবেশকারীকে বহিষ্কার করবেন। আসল অনধিকার প্রবেশকারী কিন্তু আরএসএস-বিজেপিই। সংবিধানের অন্তর্গত মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস না রেখে, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ না নিয়ে, রাষ্ট্রগঠনের জন্য কোনও ত্যাগ স্বীকার না করে, (ভি ডি সাভারকর, একমাত্র হিন্দুত্ববাদী কর্মী যিনি জেলে গিয়েছিলেন, এবং ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে এসে তাদের কাছ থেকে পেনশন গ্রহণ করতেন), এ-দেশের এবং গণতন্ত্রের উপর কোনও বিশ্বাস ছাড়াই তারা অর্থশক্তির সহায়তায় পরিচালন ব্যবস্থাকে দখল করেছে। এ-দেশের বেশিরভাগ মানুষ তাদের আদর্শে বিশ্বাস করে না, তাও বিজেপি সরকার এমনভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যেন তা গোটা দেশের আদেশে নেওয়া হয়েছে। হিন্দুত্বের ধ্বংসাত্মক প্রকল্পটির সমাধি তখনই হবে যখন জনগণ আমাদের সমাবেশ ও সংসদ থেকে তার মশালবহনকারীদের বহিষ্কার করবে।
মূল স্তরের সবচেয়ে জনপ্রিয় অসমিয়া নেতা এবং কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির উপদেষ্টা, অখিল গগইকে অবৈধ কার্যক্রম প্রতিরোধ আইন, ২০১৪-এর অধীনে বন্দি করা হয়েছে এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হওয়ার মাধ্যমে ধর্ম, জাতি, জন্মস্থান, বাসস্থান ও ভাষার ভিত্তিতে বিভিন্ন দলের মধ্যে শত্রুতা প্রচারের সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করার অভিযোগ আনা হয়েছে। দৃশ্যমান উপস্থাপনা এবং কথ্য শব্দ ব্যবহার করে গোষ্ঠীগুলির মধ্যে, সামঞ্জস্যর প্রতি হানিকর কাজ করে রাষ্ট্রের সুরক্ষা এবং সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তোলার অভিযোগ রয়েছে। সমগ্র দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা এই বিবৃতিতে অখিল গগই-এর নাম ‘ভারত সরকার’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করলেও অভিযোগগুলি সত্যই থাকবে। সরকার আজ দেশের জন্য ত্রাসের কারণে পরিণত হয়েছে।