রেজাউল করীম
সম্প্রতি সমাপ্ত UK India Summit-এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভারতবর্ষে স্বাস্থ্য-ব্যবসার আর্থিক মূল্য ১৬০ বিলিয়ন ডলার। এই ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ খুব লাভজনক, কারণ গড়পড়তা আর্থিক বৃদ্ধি প্রায় ১৫ শতাংশ। এই ব্যবসার প্রায় ২২ শতাংশ হল, ওষুধপত্র ও সাজসরঞ্জাম-এর দাম। এই রিপোর্টে উল্লেখ আছে যে, ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে ও সবচেয়ে বিপজ্জনক তথ্য হল স্বল্পমূল্যের ওষুধের চাহিদা ও জোগানের ঘাটতি৷
ভারতের জাতীয় ভেষজ নীতি বার বার বদল হয়েছে৷ প্রতিবার বদলের সময় কয়েকটি পৌনঃপুনিক ঘোষণা করা হয়৷ তা হল, সবার জন্য স্বল্পমূল্যের ওষুধের সংস্থান করা হবে। বস্তুত এই নীতির সুষ্ঠু রূপায়ণে একটি প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছিল ১৯৭৯ সালে, যখন ৩৩৪৭টি ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার আদেশনামা বার করা হয়৷ এই তালিকায় বাজারে ব্যবহৃত প্রায় ৯০ শতাংশ ওষুধকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ দুঃখের বিষয় মাত্র আট বছরের ব্যবধানে সরকারের সব সদিচ্ছার অবসান হয় ও তালিকার দৈর্ঘ্য ক্রমশ কমতে থাকে৷ ১৯৮৭ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৪ শতাংশে ও ১৯৯৪ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে৷ ১৯৯১ সালে মুক্ত অর্থনীতির ধাক্কায় ওষুধের বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে থাকে৷ এর ফলে একদিকে যেমন সরকার ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের নীতি থেকে সরে আসে, তেমনই বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ আরও সহজ করে তুলতে থাকেন। অবাধ বাণিজ্যের সিংহদুয়ার খোলার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ভেষজ নীতি ২০০২ সালে বড়রকম পরিবর্তন করা হল, যে সুপারিশগুলি হল—
- কেবলমাত্র যেসব বুনিয়াদি ওষুধে বংশানু (DNA), নিউক্লিক এসিড বা কোষ ও কলা ব্যবহৃত হয়, সেগুলি বাদে আর সব ওষুধের উৎপাদনের ক্ষেত্রে লাইসেন্স প্রথা বাতিল হয়।
- ১৯৯৯ সালেই তালিকাভুক্ত পাঁচটি ওষুধের উৎপাদনের জন্য যে সংরক্ষণ করা হয়েছিল তা বাতিল করা হল৷ বেসরকারি যে কোনও সংস্থা অতঃপর এর উৎপাদন করতে পারবে।
- ২০০০ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ করা হয় ৫১ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশ৷ বর্তমানে তা ১০০% করা হল।
- উৎপাদনে বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহার অবাধ করা হল।
- সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিযোগিতাও অবাধ করা হল। বেসরকারিকরণে উৎসাহ দেওয়া শুরু হল।
- রপ্তানিযোগ্য ওষুধের কাঁচামাল আমদানি নিঃশুল্ক করা হল।
- পেটেন্টের সময়সীমা ৫ বছর থেকে বেড়ে ১০ বছর করা হল।
(তথ্য : ‘দেশের জাতীয় ওষুধনীতি : কার স্বার্থে?’ — ডাঃ সিদ্ধার্থ গুপ্ত, ৯১ পাতা)
সরকারি ওষুধনীতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, ব্যবসার সহজসাধ্যতা বাড়াতে গিয়ে সীমাহীন মুনাফার সুযোগ করে দেওয়া৷ দেখা যাচ্ছে যে সরকার কোনও কোনও ক্ষেত্রে মুনাফা কমানোর জন্য ক্ষীণ প্রচেষ্টা করেছেন। যেমন জীবনদায়ী ওষুধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মুনাফার পরিমাণ বলা হয়েছে ৪০%। অত্যাবশকীয় ওষুধের ক্ষেত্রে এই হার ১০০%। এই দুটি তালিকার বাইরের অন্যান্য ওষুধের মুনাফার কোনও লেখাজোখা নেই।
ওষুধ নিয়ে এই যে ফাটকাবাজি তার বিষময় ফল ভোগ করতে শুরু করল দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ। নানারকম সমীক্ষক ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন এমন অর্থনীতিবিদরা নানা তথ্য দিয়ে প্রমাণ করলেন যে—
- রোগীর নিজের পকেট থেকে যে শতকরা ৬৮ টাকা ব্যয় হয় তার প্রায় ২/৩ অংশ চিকিৎসার ওষুধ ও সরঞ্জাম কিনতে।
- প্রতি বছর প্রায় ৭% রোগী চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে দরিদ্র হচ্ছেন।
আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশের উদাহরণ এক্ষেত্রে দেওয়া যায়। ওদেশের শতকরা ৯৭% ওষুধ ওদের দেশেই তৈরি হয়। বাংলাদেশের ওষুধনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল— ওষুধের গুণমান নির্ধারণ, মুনাফা নিয়ন্ত্রণ ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধের উৎপাদন বন্ধ করা। এর ফলে কয়েক হাজার অবৈজ্ঞানিক Formulation অবলুপ্ত হয়। কোনও কোনও ওষুধের দাম প্রায় ৫০০% কমে যায়। আমাদের দেশে হাজার হাজার অবৈজ্ঞানিক Formulation অবাধে কাউন্টার থেকে কিনতে পাওয়া যায়। কাশির সিরাপ, ব্যথার ওষুধের Combination, বা অদ্ভুত ডোজের Antibiotic ওষুধের Combination আমাদের দেশে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কোনও কোনও আশাব্যঞ্জক ঘটনা যে ঘটছে না এমন অবশ্য নয়। গত সপ্তাহে সরকার ৪২টি অ-তপশিলভুক্ত ক্যানসারের ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই প্রসঙ্গে Imatinib Mesylate বিতর্ক ও তৎপরবর্তী কোর্টে আইনগত লড়াইটি হয়তো মনে থাকতে পারে। পেটেন্ট আইনের ধাক্কার এই ওষুধটির জন্য রোগীর ব্যয় ছিল মাসিক প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে তার Generic ওষুধের জন্য মাসিক খরচ মাত্র ৮০০০ টাকা। বাংলাদেশেও জাফরুল্লা চৌধুরী বলেছিলেন যে ৬ ডলারের ওষুধ আগে বাংলাদেশে ৪৯ ডলারে বিক্রি করা হত।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় (জুন ২০১৩) যে সরকার নিজেই প্রতিষ্ঠানগুলিতে Generic ওষুধ সরবরাহ করবে। এই ন্যায্য মূল্যের দোকানে ওষুধের মূল দামের ৩০-৭০% বোনাস দেওয়া হয়। এই দোকানগুলিতে ১৪২টি ওষুধ, ইমপ্ল্যান্ট ও অন্যান্য উপকরণ পাওয়া যাবে বলে সরকার জানায়। এই ব্যবস্থারও নানারকম ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। তাছাড়া অনেক রোগী ও চিকিৎসক এইসব ওষুধের গুণমান নিয়েও যথেষ্ট সন্দিহান।
ওষুধের উচ্চমূল্য কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশের সম্পদের আসল মালিকানা থেকে গেছে মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির হাতে। দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি ও রাজনীতি তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করেন। কল-কারখানা-শিল্পের মালিকানাও তাঁদের হাতে। একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকারি খরচের পরিমাণ হয় কমেছে না হয় তা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বরাদ্দ মোট উৎপাদনের মোট ১ শতাংশ। সেই একই সময়ে প্রায় ২ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে বৃহৎ শিল্পপতিদের ঋণ মকুব করতে। দেশে হাসপাতালে যে নতুন শয্যা তৈরি হয়েছে তার শতকরা প্রায় ৭০ শতাংশই হল বেসরকারি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাজেটে ১২৩১.৫০ কোটি টাকা বিনামূল্যে ওষুধে ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচের জন্য বরাদ্দ করেছে। এই বরাদ্দের পরিমাণ হল মাথাপিছু প্রায় ১৪০ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু সমস্যা হল, এই অর্থ সদ্ব্যবহারে সুষ্ঠু নীতির অভাব। সরকার একদিকে যেমন হাসপাতালগুলিতে জীবনদায়ী ওষুধ ব্যবহার করতে পারছে না, অন্যদিকে আবার ৭ লক্ষ টাকা ব্যয় করে cochlear implant সরবরাহ করছে। বহুমূল্য pacemaker, stent ইত্যাদির জন্য খরচ হচ্ছে অথচ মহিলাদের anaemia বা malnutrition বন্ধ করার কোনও আন্তরিক প্রচেষ্টা নেই।
স্বাস্থ্য এখন একটি স্বীকৃত মানবাধিকার। সরকারের উচিত স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। সর্বজনীন ও বিনামূল্যে চিকিৎসার পূর্ণ দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। সব আয়ের মানুষের জন্য একই ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এই ব্যবস্থা চালু হলে স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা অনেকাংশে কমে যাবে। তার সুফল ভোগ করবে গোটা দেশ। জাতীয়তাবাদের গর্বে স্ফীত বক্ষ নিয়ে তাই আমাদের নতুন যুদ্ধ শুরু করতে হবে। এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারলে অকাল মৃত্যু ও দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব হবে। এর জন্য স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৩ শতাংশ করতে হবে।