প্রস্তাবিত নয়া শ্রম কোড: কর্পোরেটদের নির্লজ্জ পদসেবার অঙ্গীকার

রায়া দেবনাথ

 

কেমন দেখুন শীত এসে গেছে। শেষের মুখে একটা আস্ত বছর! কেমন দেখুন এই বছরটাও আমরা কেমন ধর্মীয় বিবাদে কাটিয়ে দিলাম! মন্দির ওহি তো হচ্ছেই! ভেঙে পড়া, ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির দেশে আর কী চাই! ক্যাব এলে এনআরসি হয়ে কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা যতই ভয়ানক হোক না কেন, আমাদের তো তিন হাজার কোটির মূর্তি আর উত্তরপ্রদেশ আছে! ধর্ষণ আটকাতে যতই গড়িমসি থাকুক না কেন ধর্ষণের পর এনকাউন্টারের উদ্দীপনাময় জীবন আছে! ১০০ টাকার পেয়াজ, যত্রতত্র লিঞ্চিং যতই থাকুক ন’টার প্রাইমটাইমে অর্ণব গোস্বামী আর সর্বপরি প্রতিবেশী হয়ে পাকিস্তান আছে! আর কী চাই বলুন তো!

চাই আসলে খুব সাধারণ কিছুই। মাথার উপর ছাদ, পেটে ভাত, শিক্ষা, চিকিৎসা, আর স্বাধীনভাবে শান্তিতে বেঁচে থাকা। গত ৪৫ বছরের ইতিহাসে সর্বাধিক বেকারত্ব আর চাকরি যাওয়ার বর্তমানে বাস করছি আমরা। আপনি যতই ঘুম থেকে উঠেই টিভি খুলে এলিয়নদের সঙ্গে বেদের কানেকশনের গূঢ় রহস্যে মজে থাকুন না কেন, বাস্তব হচ্ছে খাঁড়াটা কিন্তু আপনার ঘাড়ের কাছেও পৌঁছে গেছে। কোপ মারাটা সময়ের অপেক্ষামাত্র! এই ধর্মের টনিক খেয়ে একটা বালাকোট, একটা এনকাউন্টার আর অনেকটা হিন্দু-মুসলিমে আমরা যখন মগ্ন তখন সংসদে কেমন চুপিচুপি পাশ হয়ে যাচ্ছে মানুষ মারা একের পর এক বিল। ট্রান্সজেন্ডার বিল, স্বাস্থ্য বিল তো আগেই ছুট পেয়েছে, ভয়ঙ্করতমটিও নিশ্চুপে কিন্তু দ্রুত বেগে পাকাপাকি সিলমোহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে!

এ দেশে ৪৪টি শ্রম আইনের বিলোপ ঘটিয়ে চারটি শ্রমকোডের আসা এখন সময়ের অপেক্ষা! এই চারটি কোডে শ্রমজীবী মানুষের সমস্ত আইনি অধিকার কেটেকুটে সর্বতোভাবে মালিকরাজ তৈরির কেন্দ্রীয় সরকারি পরিকল্পনা মোটামুটি পাকা। এই ৪৪টি শ্রম আইনেই কি দেশের শ্রমিকরা চরম সুখে ছিলেন? উত্তর হল, না। কিন্তু এই আইনগুলি যথেষ্ট না হলেও আইনিভাবে একটা পর্যায় অবধি শ্রমিকদের অধিকার অবশ্যই নিশ্চিত করেছিল। এই আইন প্রণয়নও তো একদিনে হয়নি! এই দেশের শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ের ফলস্বরূপই পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জিত হতে হতে গেছে এই আইনগুলি। এবার এই কষ্টার্জিত অধিকারটুকুও কেড়ে নিতে চাইছে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন সরকার।

৪৪টি শ্রম আইনের জায়গায় যে চারটি কোড নিয়ে আসা হচ্ছে সেগুলি কী কী?

  1. ওয়েজেস (মজুরি সংক্রান্ত)
  2. সোশ্যাল সিকিউরিটি (সামাজিক সুরক্ষা)
  3. ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার (স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত)
  4. ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন (শিল্প-সম্পর্ক সংক্রান্ত)

এর মধ্যে চারটিই ক্যাবিনেট মিটিংয়ে গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে বসে আছে, প্রথম দু’টি আবার লোকসভাতেও পাস হয়ে গেছে।

নামগুলো গালভরা হলেও ভয়াবহতা এই কোডগুলোর আনাচকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে।

প্রথম অর্থাৎ মজুরি সংক্রান্ত কোডটিই কথাই ধরুন! এত দিন অবধি দেশের শ্রমিকদের মজুরি সুরক্ষিত ছিল মজুরি প্রদান আইন (১৯৩৬), ন্যূনতম মজুরি আইন (১৯৪৮), বোনাস সংক্রান্ত আইন (১৯৫৫), সম বেতন আইন (১৯৭৬) ইত্যাদি আইনের দ্বারা। নতুন কোডে এই সব কটি আইন কার্যত ভিত্তিহীন হয়ে যাচ্ছে। এই কোড অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ন্যূনতম মজুরি কমিয়ে করা হয়েছে দৈনিক ১৭৮ টাকা, অর্থাৎ মাসে মাত্র ৪৬২৮ টাকা! এই অগ্নিমূল্য বাজারে যে সরকার ভাবতে পেরেছে এই টাকায় একটা পরিবারের বেঁচে থাকা সম্ভব, সেই সরকারের দেশের মানুষের প্রতি দরদ কিন্তু সহজেই অনুমেয়। ২০১৮ সালে অনুপ সথপতির নেতৃত্বে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করেন কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ কুমার গঙ্গোয়ার। ২৭০০ কিলো ক্যালরি দৈনিক ন্যূনতম পুষ্টির মানদণ্ড ২৪০০ কিলো ক্যালরিতে নামিয়ে এনে সেই টিম মাসিক ন্যূনতম মজুরি ধার্য করে ৯৭৫০-১১৬২২ টাকা। ২০১৯ সালে কমিটি সেই রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে পেশও করে। ১১৬২২ টাকাতেও কীভাবে এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে সংসার চলে সেই নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আগেই কেন্দ্র সরকার এমনকী নিজের তৈরি করা কমিটির রিপোর্টও অগ্রাহ্য করে নয়া কোডে ন্যূনতম মজুরি আরও অনেকটা কমিয়ে ধার্য করেছে ৪,৬২৮ টাকা! কখন? যখন বাজারে এক কেজি পেয়াজের দাম ১০০ পেরিয়েছে! সংগঠিত, অসংগঠিত উভয় ক্ষেত্রেই এখন ন্যূনতম মজুরি হতে চলেছে এটাই। নয়া উদারবাদের যুগে বেসরকারিকরণের হাওয়ায় যখন স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মত মৌলিক অধিকারও দিন দিন সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন মাস মাইনের ন্যূনতম সীমা এই পর্যায়ে নামিয়ে আনার অর্থ পক্ষান্তরে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মত অধিকার থেকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বঞ্চিত করা। টাকা থাকলে খেতে পরতে শিক্ষা পেতে বেঁচে থাকতে পারবেন, টাকা না থাকলে এই সব কিছুর থেকেই আপনি আমি আমরা সবাই দূরে সরতে থাকব। আর নয়া মজুরি সংক্রান্ত লেবার কোডের দাক্ষিণ্যে সাধারণ মানুষের কাছে টাকা থাকার সম্ভাবনাও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে চলেছে। এর আগে কেন্দ্রীয় ন্যূনতম মজুরি স্থির হত নির্দিষ্ট স্ট্যাটুটারি মিনিমাম ওয়েজ বোর্ডের অফিসিয়াল মিটিংয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে। আমাদের শ্রমমন্ত্রী অবশ্য এই লফতে ন্যূনতম বেতন কাঠামো ঘোষণার সময় সেই সবের ধার ধারেননি! ২০১৬ সালের সপ্তম বেতন কমিশন অনুযায়ী যে ন্যূনতম মজুরি ধার্য করা হয়েছিল, বর্তমান কোডে তার এক চতুর্থাংশও থাকছে না। আগের মতই রাজ্যগুলি চাইলে নিজেদের ভিন্ন ন্যূনতম বেতন স্থির করতেই পারে। কিন্তু যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারই ন্যূনতম বেতনের সীমারেখা এমন লজ্জাজনক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে সেখানে রাজ্যগুলি যে ন্যূনতম বেতন কাঠামোর ক্ষেত্রে যুগান্তকারী কোনও সিদ্ধান্ত নেবে এ দেশে এমন ভাবনা যথার্থ অর্থে দুরাশাই! কোড অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ করতে হবে বেসিক ও ডিএর ভিত্তিতে এবং যা স্থির হবে দক্ষতা, শ্রমের প্রকার এবং কর্মস্থলের ভৌগোলিক চরিত্রের উপর নির্ভর করে! এবং এই সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার প্রশ্নহীনভাবে সরকারের হাতেই থাকবে! আরও গুরুত্বপূর্ণ, দেশে যে হারে বেসরকারিকরণ বাড়ছে, ছোট, বড়, মাঝারি সমস্ত পাবলিক সেক্টর চলে আসছে পুঁজিপতিদের দখলে, সেখানে মিনিমাম ওয়েজ যদি আইন মেনেই এত কমিয়ে দেওয়া হয়, পুঁজিপতিরা নিজেদের লাভের ঘড়া আরও বেশি পূর্ণ করার এমন ‘সূবর্ণ সুযোগে’র সদ্ব্যবহার করবে তা তো সহজেই অনুমেয়! মোদ্দা কথা এই কোড শ্রমজীবী মানুষের শ্রমকে পূর্ণমাত্রায় এক্সপ্লয়েট করে শিল্পপতিদের চির পৌষমাসের হদিশ দিতে বদ্ধপরিকর।

আসা যাক ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সংক্রান্ত কোডটিতে। পূর্বের শ্রম আইন অনুযায়ী মোট ১৩টি আইন ধার্য ছিল শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও কাজের পরিবেশ বিষয়ে। যা নয়া কোডের দৌলতে আপাতত বাতিলের খাতায়। ১৯৭০ সালের ঠিকা শ্রমিক বিলুপ্তি ও নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী কোনও স্থায়ী কাজ, অর্থাৎ যা নিয়মিত, তা ঠিকা প্রথায় করানো বেআইনি ছিল। স্থায়ী শ্রমিক তো বটেই ঠিকা শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও নিরাপত্তার যাবতীয় দায়িত্ব আইনত মালিকপক্ষেরই ছিল। নয়া কোডে এই উভয় অধিকার থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রমিকরা। অর্থাৎ, এবার থেকে যে কোনও প্রকারের কাজেই (স্থায়ী, অস্থায়ী) ইচ্ছামত ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ জায়েজ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রেও তাদের সুরক্ষার কোনও দায় থাকছে মালিকপক্ষের। এর সঙ্গেই ইতিমধ্যেই ‘ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট’ আইন নিয়ে এসে সরকারি বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই চুক্তিভিত্তিক কাজের নিয়ম চালু করে ফেলেছে। এই আইন অনুযায়ী প্রত্যেক এমপ্লয়ির সঙ্গে এমপ্লয়ারের কাজের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক চুক্তি হবে। তিন মাস, ছয় মাস যা খুশি হতে পারে এই সময়সীমা। নির্দিষ্ট সময়ের পর মালিকপক্ষ চাইলে সেই চুক্তি আর নাও বাড়াতে পারে! অর্থাৎ, পুরোটাই নির্ভর করবে এ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের মর্জির ওপর! ধরুন আপনার পোশাকের রং নাপসন্দ হল মালিকের, চুক্তি ফোরালেই ইচ্ছামত আপনার চাকরিটি ‘নট’ করে দিতে পারেন মালিক বা ঊর্ধ্বতন অফিসার বা কর্তৃপক্ষ! অর্থাৎ স্থায়ী শ্রমিকের ধারণাটাই আসতে আসতে বিলুপ্ত করে ফেলার সমস্ত দুরভিসন্ধি পাকা!

সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত কোডটি থেকে কার্যত বাদ গিয়েছে অস্থায়ী শ্রমিকদের জন্য ধার্য্য করা সমস্ত প্রকল্পগুলিই।

এবং শিল্প-সম্পর্ক সংক্রান্ত কোড! এই কোডটি খানিক বিশেষ। এই কোডটিতে একদম স্পষ্টভাবেই কর্পোরেট তোষণের কথা বলা রয়েছে। ‘ট্রেড ইউনিয়ন’ আইন (১৯২৬), শিল্প বিরোধ আইন (১৯৪৭) সহ এক গুচ্ছ আইন এই কোডের দরুণ প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। এই কোড অনুযায়ী ৫০ জনের বেশি এবং ৩০০ জনের কম শ্রমিক বিশিষ্ট কোনও কোম্পানিতে লে-অফ, ক্লোজার বা ছাটাইয়ের ক্ষেত্রে সরকারি অনুমতির আর কোনও প্রয়োজনই থাকছে না। থাকছে না এই কর্মক্ষেত্রগুলিতে ছাঁটাই, ক্লোজার বা লে অফের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের কোনও আইনি অধিকারই! এর আগে ১০০ জন কর্মচারী সম্বলিত কোনও কোম্পানিতেও এই অনুমতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। ভারতে ৬৫-৭০% কর্মক্ষেত্রেই শ্রমিক সংখ্যা ৩০০-র কম। ৫০ জনের কম শ্রমিক বিশিষ্ট কোনও কোম্পানি এই কোডের বলে শ্রম সংক্রান্ত সমস্ত আইনেরই আওতাবিহীন হয়ে যাচ্ছে। রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর গোটা বিশ্বেই দৈনিক আট ঘণ্টার কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম ও আট ঘণ্টা বিনোদনের যে ঐতিহাসিক দাবী আদায় করেছিলেন শ্রমিকরা এই শ্রমকোড ধ্বংস করছে তাও। ন্যূনতম কাজের সময়সীমা ধার্য করা হচ্ছে ৯ ঘণ্টা! এইখানেই ইতি নয়! যদি মালিকপক্ষের শোষণের বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মঘট আন্দোলনের পথে শ্রমিকরা হাঁটতে চান, তাহলে অন্তত দু সপ্তাহ আগে নোটিস দিয়ে তা মালিকপক্ষকে জানাতে হবে। বর্তমান আইনে শুধুমাত্র অত্যাবশকীয় পরিষেবার ক্ষেত্রে এই নিয়ম রয়েছে। নয়া কোডে তা সার্বজনীন হল! ১৪ দিন আগে নোটিস না দিলে কী হবে? ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করা হবে! ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের সরকারি পেয়াদা এসে পাকড়াও করে নিয়ে যাবে! ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা ১ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা উভয়ই হতে পারে! এমনকি, কেউ যদি এই সময় শ্রমিকদের আন্দোলনে কোনওভাবে পাশে দাঁড়াতে চান, বা সাহায্য করতে চান, একই রকম শাস্তি ভোগ করতে হবে তাকেও! সেই সাহায্যের পরিমাণ যদি দুই টাকাও হয়, শাস্তির পরিমাণের হেরফের হবে না তাতে! অর্থাৎ শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের পথই শুধু এতে বন্ধ হবে না, শ্রমিক আন্দোলন যাতে কিছুতেই সামগ্রিক গণআন্দোলনে রূপান্তরিত না হতে পারে আইন করে সেই ব্যবস্থাই পাকা করতে চলেছে মোদি সরকার।

দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি নাকি চাঙ্গা হবে, দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, তরতর করে এগিয়ে যাবে নাকি দেশ! এই দোহাই দিয়ে একাধারে রেল, প্রতিরক্ষা, টেলিকম, বিমান, ব্যাঙ্কিং পরিসেবার মত গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক সেক্টরগুলো দ্রুত গতিতে পুঁজিপতিদের হাতে বেচে দিচ্ছে সরকার। বেচার তালিকায় আছে ২৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। অন্যদিকে, চলে আসছে এই লেবারকোড যার ওয়ান পয়েন্ট আজেন্ডা। মালিকদের স্বার্থরক্ষা।

এইবার একটু পরপর ভাবুন।

যে হারে বেসরকারিকরণ চলছে তাতে এ দেশের শ্রমশক্তি উপার্জনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে   বেসরকারি সংস্থাগুলোর উপর। ন্যূনতম মজুরি যা হচ্ছে তাতে এক মাসে এই বাজারে একজনের পক্ষেও তা বেশ কম। চারজনের সংসার চালানো সেখানে এক কথায় অসম্ভব। থাকবে না কোনও স্থায়ী চাকরি। এখনই যেখানে বেকারত্বর হার ভয়াবহ, স্থায়ী চাকরি না থাকলে হাহাকারটা কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। মালিকপক্ষ যখন আইনি সহায়তাতেই যখনতখন ছাঁটাই করতেই পারবে, তখন তারা আর বেতন কাঠামো নিয়ে ভাববেই বা কেন? চাকরি নেই। পেটে খিদে আছে। বাঁচার জন্য মানুষ তখন ওই স্বল্প বেতনেই অত্যধিক শ্রমদানে বাধ্য হবে। প্রতিবাদ করলে চাকরি যাবে বিনা আয়াসেই। আর ওই একটা চাকরি পাওয়ার জন্য পিছনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবে লাখ লাখ ভুখা পেট! তাদের সন্তানসন্ততি! ফলে যতই অত্যাচার হোক, যতই অসুরক্ষিত কাজের পরিবেশ হোক টুঁ শব্দটি করা যাবে না! মালিকের মর্জিমত কাজ করো, না হলে মরো! আইনের পথ নেই, জোট বাঁধার পথ বন্ধ! সোজা বাংলায় কর্পোরেট মালিকদের দাস হয়ে বাঁচতে বাধ্য হবেন সাধারণ মানুষ!

যারা এখনও সরকারি সিস্টেমের বেহাল দশার উল্টোদিকে সিস্টেমের খোলনলচে বদলের পরিবর্তে বেসরকারিকরণের রাস্তাকে, ঢালাও বিনিয়োগের দোহাই দিয়ে এই লেবার কোডের অবতারণাকে স্বর্গরাজ্যে পোঁছে যাওয়ার সিংহদুয়ার বলে ভাবছেন, তারা সম্ভবত নিজেদের, নিজেদের পরিবার, এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের থেকেও আম্বানি-আদানিদের বেশি ভালোবাসেন। ‘কর্মসংস্কৃতি’, ‘মানসিকতা’ই যদি চিন্তার বিষয় হয় তাহলে বেসরকারিকরণ হলেই কোন জাদুবলে তার আমূল পরিবর্তন হবে তাও অবশ্য রহস্যই থেকে যাবে! পাশাপাশি শিল্পপতিদের ঋণ দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয় এলআইসি, মার খায় আমার আপনার টাকা, লাটে ওঠে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যঙ্ক, নিজের জমানো টাকা থেকেই বঞ্চিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বহু সাধারণ মানুষ। মোদি জমানায় যখন দেশের সার্বিক অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, হাঙ্গার ইন্ডেক্সে দেশের পতন যখন অব্যাহত, জিডিপির হাল বেহাল, সেই সময়ে মুকেশ আম্বানির সম্পদ বেড়েছে ১১৮%, গৌতম আদানির সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ ১২১%! ৩১ জন শিল্পপতি ঋণ শোধ না করে আপাতত বিদেশবাসী! রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ঘাড়ে ২১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ এই শিল্পপতিদেরই সৌজন্যে! এই শিল্পপতিরা হঠাৎ করে নিজেদের মুনাফা লোটার পথ ত্যাগ করে দেশের মানুষের উন্নতিকল্পে নিবেদিত প্রাণ হবেন, এমন ভাবনার পিছনে কোনও নির্দিষ্ট কারণ বা ডেটা এখনও অবধি পাওয়া যায়নি কিন্তু!

এই লেবার কোড সমর্থনের আগে ভেবে দেখবেন লেদ কারখানার শ্রমিকটির জীবন যেমন বিপন্ন হবে, এই একই আইনের কোপ থেকে বাঁচবে না আইটি সেক্টরের ব্লুকলারডরাও!

গোটা দেশের মানুষকে কার্যত কর্পোরেটের দাসে পরিণত করে, তাদের জীবিকা অনিশ্চিত করে, তাদের পেটে লাথি মেরে কোন দেশের উন্নতি হবে? দেশের মানুষই যদি মরে, কার ভোগে লাগবে এই অলীক ‘উন্নয়ন’? এই ‘আচ্ছেদিন?’

শিয়রে শমন এখন আমাদের প্রত্যেকেরই। যূথবদ্ধভাবে সেই শমন প্রতিহত করবেন নাকি তার কাছে আত্মসমর্পণ করে আধুনিক দাসপ্রথাকেই গ্রহণ করবেন, সেই চয়েস কিন্তু এখন আমি, আপনি, আমাদের, এই দেশের সাধারণ মানুষের হাতেই। ভেবে দেখুন দাসত্ব না স্বাধীনতা, একটি গণতান্ত্রিক সার্বভৌম দেশের বাসিন্দা হয়ে কোনটাকে বেছে নিতে চাইছেন?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...