নারী চেতনা এবং মহাশ্বেতা দেবী

ঈশিতা ভাদুড়ী

ঈশিতা ভাদুড়ী

 



লেখক নেশায় কবি ও গদ্যকার। পেশায় বাস্তুকার।

 

 

‘নারী চেতনা’ শব্দটি যত কম অক্ষরের, বিষয়ের বিস্তার কিন্তু ততটাই বেশি। সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই নারীরা বঞ্চনার শিকার। সেই কারণেই অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ভাবে কাজ করে চলেছেন। কবি-লেখকরাও তাঁদের কলমের মাধ্যমে লড়াই করে চলেছেন, যে অঞ্চলে আলো পড়েনি সেইখানে বিশেষভাবে আলোকপাতের চেষ্টা করে চলেছেন। এই লড়াইয়ে মহাশ্বেতা দেবীর ভূমিকা অগ্রগণ্য বলা যেতে পারে।

তাঁর লেখক সত্তার পাশাপাশি তাঁর সমাজসেবামূলক কাজের কথা আমরা জানি। মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্পে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতন, ডোম, লোধা, শবর বিভিন্ন জনজাতির কথা। তিনি জীবনের অধিকাংশ সময়ই তাদের সঙ্গে অতিবাহিত করেছেন। তাদের পরিবেশ, পরিস্থিতি, যাপনচিত্র তাঁর কলমে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বাক্ষর রেখেছে। কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও পরোক্ষভাবে তাদের সংগ্রামে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি সমাজে চেতনার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছেন। বিশেষত আদিবাসী নারীচরিত্রেরা তাঁর কলমে অনন্য হয়ে উঠেছে, বুদ্ধিতে সাহসে প্রেমে ও প্রতিবাদে তারা একের পর এক নির্মিত হয়েছে মহাশ্বেতা দেবীর রচনায়। উপজাতিদের, বিশেষত নারীদের বঞ্চনা ও বিপন্নতার কথাই প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর ছোট গল্পগুলিতে।

শুধুমাত্র সাহিত্য নয়, সমাজতত্ত্বেরও নিদর্শন রয়েছে তাঁর সেই সব রচনায়। বিষয়-বৈচিত্র্যে, হৃদয়-অনুভবে এবং শিল্প-কুশলতায় সেই সব রচনা যুগসাহিত্য বা ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তিনি প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষের বেদনা উপলব্ধি করেছেন এবং সেই উপলব্ধ অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে সমাজে বার্তা দিয়েছেন। আদিবাসী জনজাতিদের সঙ্গে থেকে তাদের জন্যে সংগ্রাম করে তাদের স্ব-বিকাশে গাইডের ভূমিকা নিয়েছেন।

আগেই বলেছি মহাশ্বেতা দেবীর কলমে নারীচরিত্ররা বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। শুধুমাত্র নারীদের মানসিক বিশ্লেষণ নয়, তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থানও স্পষ্ট করেছেন তিনি। এই সব চরিত্র-নির্মাণে মহাশ্বেতা দেবী অদ্বিতীয়। আদিবাসী জনজাতির সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সমস্যা তাঁর প্রতিবাদী কলমে বারবার উঠে এসেছে। অনুভবের বিভিন্ন স্তরের নিবিড় বিস্তারও তাঁর প্রতিটি রচনার মধ্যে বিরাজমান।

পশ্চিম মেদিনীপুরের গোহালদেহী নামের ছোট গ্রামের মেয়ে চুনী কোটালের কথা আমরা জানি, লোধা সম্প্রদায়ের সেই নারী কীভাবে বারবার বঞ্চনার শিকার হয়েছিল। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ১৯৮৫ সালে তার সম্প্রদায়ের তিনিই প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। মেদিনীপুরের রানি শিরোমণি এসসি অ্যান্ড এসটি গার্লস হোস্টেলের হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে যখন নিযুক্ত হয়েছিলেন চুনী, সেখানেও তিনি হয়রানির শিকার হন। এরপর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হন তখনও ধারাবাহিকভাবে নিপীড়নের শিকার হন। সকল রকম মানদণ্ড পূরণ করা সত্ত্বেও তাঁকে প্রয়োজনীয় পাস গ্রেড দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। তাঁকে বলা হত শিক্ষাগ্রহণের কোনও অধিকার তাঁর নেই। সম-সম্প্রদায়েরই একজন মানুষকে ভালোবেসে তিনি বিবাহ করেন, কিন্তু তাঁরা একসঙ্গে থাকতে পারেননি পরিস্থিতির চাপে। শেষমেশ অপমানিত ও হতাশ চুনী ১৯৯২ সালে আত্মহত্যা করে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁকে নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী ‘ব্যাধখণ্ড’ লিখে সামাজিক বার্তা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই লেখক লিখলেন ‘রুদালী’, রাজস্থানের একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের নারীকে নিয়ে, অর্থের বিনিময়ে মৃতের বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটি করে যারা। এই ‘রুদালী’ গল্পের নায়িকা শনিচরী, কলেরায় স্বামীর মৃত্যুতে অসহায়, স্বামীর জন্যে তার কাঁদা হয়নি, শাশুড়ির মৃত্যুর পরেও সে কাঁদেনি। কিন্তু তাঁকে অর্থ রোজগারের জন্যে এবাড়ি-সেবাড়িতে গিয়ে মাথা চাপড়ে চাপড়ে কাঁদতে হয়েছে। কান্নার রকমফেরে মজুরি ধার্য হয় যে সমাজে সেখানে শনিচরীরা তার স্বামী বা প্রিয়জনের জন্যে কীভাবেই বা কাঁদবে!

লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে যেমন সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, পাশাপাশি একথাও ঠিক, তিনি তাঁর উপলব্ধ সমস্যার সমাধান করারও চেষ্টা করেছেন প্রতি মুহূর্তে। তাঁর সমাজসেবী সত্তা তাঁর সৃজনীশক্তিকে ক্ষুণ্ণ হতে দেয়নি কখনও। তাঁর ছোট গল্প ‘বাঁয়েন’-এ ভয়াবহ অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য চিত্র এঁকেছেন, যেখানে নায়িকা চণ্ডী জাতিতে ডোম। চণ্ডীর বাবা ভাগাড়ের কাজ করত, অর্থাৎ কারও মৃত্যু হলে তার জন্যে গর্ত খুঁড়ে দিত। চণ্ডী তার বাবার মৃত্যুর পর সেই কাজ আরম্ভ করে। শবদেহ সৎকারের সূত্র ধরেই ওই গ্রামেরই বাসিন্দা মলিন্দরের সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে হয়। তাদের পুত্র ভগীরথের কখনও মনে হয়নি চণ্ডী বাঁয়েন কখনও কারও মা হতে পারে, দূর থেকে দেখেছে মাথায় লাল কাপড়ের ধ্বজা, উদভ্রান্তের মত ধানক্ষেতের আল ধরে চৈত্রের দুপুরে কাঠি দিয়ে টিন বাজাতে বাজাতে পুকুরের দিকে যাচ্ছে, পেছনে একটা কুকুর। ডোমদের মধ্যে একটি প্রচলিত সংস্কার ছিল, বাঁয়েন যদি কোনও ছোট ছেলে বা পুরুষকে দেখে, তখনই তাদের শরীর থেকে রক্ত শুষে নিতে পারে। অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার চণ্ডীকে স্বামী সংসার সন্তান থেকে সরে যেতে হয়, এমনকী নিজের স্বামী সন্তানের পরিচয় দেওয়াও নিষেধ ছিল। পুত্র ভগীরথ জানতেও পারে না তার মাতৃপরিচয়। সেই পরিচয় যখন উদ্ঘাটিত হয়, ভগীরথের হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সেই চণ্ডী বাঁয়েন যখন নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে গ্রামের মানুষজনকে রক্ষা করে, তখন সেই সমাজই তাকে, সেই বিসর্জিত চণ্ডীকে তার আসল পরিচয় ফিরিয়ে দেয়। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের কাছে চণ্ডী তখন তাদেরই একজন হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়। ভগীরথ বলে, “মা ঈশ্বরচণ্ডী গঙ্গাদাসী…”। এখানে নারীর প্রতি অন্ধ কুসংস্কারে জীর্ণ সমাজের অত্যাচার ও তার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিয়েই লেখকের সমাজ-সচেতন মন প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে।

মহাশ্বেতা দেবীর বিভিন্ন গল্পের বিভিন্ন নারীচরিত্র স্বাতন্ত্র্যের ছাপ রেখেছে। নারীদের প্রতি সমাজের অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ মুখরিত হয়েছে তাঁর ‘শিকার’ গল্পের নায়িকা মেরীর কণ্ঠে। মুক্তমনা, কর্মদক্ষ, প্রেমে ব্যাকুল মেরীর নারীত্বের স্বরূপ প্রকাশ পায় মহাশ্বেতা দেবীর অসাধারণ লেখনীতে। তোহরি বাজারে মেরীর ভক্তবৃন্দের অভাব নেই। সে স্টেশনে নামে রানির মতন। পুরুষদের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে খায়, বাজারিয়াদের পয়সায় চা খায়, কিন্তু কাউকে আমল দেয় না। লেখক লিখেছেন—

মেরী যখন এসে দাঁড়ায়, তখন সে যেমন ট্রেনটিকে দেখে, যাত্রীরাও চোখে পড়লে তাকে দেখে। বয়স আঠারো, দীর্ঘাঙ্গী, চ্যাপ্টা মুখ-নাক, রঙ তামাটে ফরসা। সাধারণত ছাপা শাড়ি পড়ে। দূর থেকে ওকে খুব মোহনীয় দেখায় কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায়, ওর চোখের ভাষায় খুব কঠিন প্রত্যাখান আছে।

এই মেরীকে তসিলদার ভোগ করতে চেয়েছিল, কিন্তু সে বুদ্ধিপ্রয়োগ করে তসিলদারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পায়। গল্পের প্রথমদিকে মনে হবে তসিলদার শিকারি এবং মেরী হল তার শিকার। কিন্তু গল্পের শেষে দেখা যায় তসিলদার শিকার। যথেষ্ট সচেতনভাবেই মেরী চরিত্রের মধ্যে দিয়ে লেখক ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রকাশ করেছেন।

মহাশ্বেতা দেবীর গল্প ‘ধৌলি’তে এক আদিবাসী নারীর সঙ্কটময় জীবনকাহিনি অন্য মাত্রা অর্জন করেছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, প্রেম ও বিশ্বাসঘাতকতার সকরুণ চিত্র স্পষ্ট সেখানে। ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন এলাকার ধৌলির স্বামীর মৃত্যুর পর তার ভাসুরের নজর এড়াতে সে চলে আসে তার মায়ের কাছে। সেখানে উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ মিশ্রিলালের প্রতি তার ভালোবাসা এবং গর্ভবতী হওয়া, তারপর মিশ্রিলালের মায়ের থেকে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে স্বীকৃতি না পেয়ে, সর্বোপরি মিশ্রিলালের থেকে প্রত্যাখাত হয়ে একসময় সে পতিতাবৃত্তি বেছে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই ধরনের পথ নারীকে অবলম্বন করানোর জন্যে যে মিশ্রিলালরা দায়ী থাকেন, সেকথা সমাজে কখনওই বিবেচিত হয় না। সেই বাস্তব ছবিই ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক তাঁর কলমে।

১৯৭০ সালের নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস ‘হাজার চুরাশির মা’ হল সুজাতা নাম্নী একটি মায়ের গল্প, যাঁর পুত্র ব্রতীকে তার আদর্শের জন্যে রাষ্ট্র পাশবিকভাবে হত্যা করেছিল। লাশকাটা ঘরে ব্রতীর নম্বর ছিল ১০৮৪, গল্পটি শুরু হয়েছে পুত্রের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন। তাঁর সঙ্গে ব্রতীর এক সহকর্মীর দেখা হয় এবং তিনি ব্রতীর বিপ্লবী মানসিকতার বিচার করতে চেষ্টা করেন। সমগ্র উপন্যাসে কঠোর মানসিকতার নারী হিসেবে চিহ্নিত সুজাতা যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গিয়েছেন।

মহাশ্বেতা দেবীর আরেকটি শক্তিশালী গল্প ‘দ্রৌপদী’তে সভ্য সমাজের আদিবাসীদের প্রতি শোষণ এবং সেই শোষণের প্রতি বিদ্রোহ প্রকাশ পেয়েছে। এই গল্পে দ্রৌপদী নামক আদিবাসী নারী-চরিত্রে উলঙ্গ ও সোচ্চার প্রতিবাদ তুলে ধরেছেন লেখক তাঁর শাণিত উচ্চারণে। চারদিকে চেয়ে দ্রৌপদী রক্তমাখা থুথু ফেলে বলে, ‘হেথা কেও পুরুষ নাই যে লাজ করবো কাপড় মোরে পরাতে দিব না। আর কি করবি?’ মহাশ্বেতা দেবী একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন— “শুধু একটা মেয়েকে উলঙ্গ করা যায়, লালসা চরিতার্থ করা যায়, কিন্তু সম্মান দেওয়া যায় না। অথচ এই গল্পের শেষে সমাজের মানুষ কিন্তু দ্রৌপদীকেই সম্মান করে। এই সম্মান দ্রৌপদী আদায় করে নিয়েছে। আমি চাই সমাজের দ্রৌপদীরা সবাই এইভাবেই জেগে উঠুক, কেড়ে নিক তাদের প্রাপ্য সম্মান।”

সামাজিক অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, সেই লক্ষ্যেই মহাশ্বেতা দেবী তাঁর কাজ করে গেছেন। তাঁর সৃষ্ট নারীরা যেমন শোষিত হয়েছে, ঠিক সেরকমই বুদ্ধিতে, সাহসে, সরব ও নীরব প্রতিবাদে স্বতন্ত্র হয়ে যাতে সমাজে বার্তা দিতে পারে, সেইদিকেই লেখকের দৃষ্টি ছিল। তাঁর গল্পের নারী চরিত্রদের মধ্যে সেই চেতনা লক্ষ্যণীয়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...