করোনা-সংগ্রাম: পরিসংখ্যানের বাস্তবতা

সুজন ভট্টাচার্য

 




লেখক প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, কবি

 

 

 

উট একটি পশুর নাম, যা আবার মরুভূমির জাহাজ বলেই পরিচিত। মরুভূমির বুকে ঘুরে বেড়াতে এই উট নামক প্রাণীটিই মানুষের সবথেকে বড় ভরসা। উটের একটা পবিত্র স্বভাব আছে। মরুভূমিতে বালিঝড় উঠলেই উট নাকি চোখ বন্ধ করে ফেলে। হয়তো এভাবেই সে বাইরের আক্রমণকে নস্যাৎ করতে চায়। উটকে মানুষ পোষ মানিয়েছে সম্ভবত হাজার সাতেক বছর আগে। আর পোষ-মানামানির পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষও উটের কিছু স্বভাব রপ্ত করে ফেলেছে। যখন-তখন চোখ বন্ধ রাখার অভ্যাস তার মধ্যে অন্যতম।

প্রায়শই আমরা দেখি, অসুস্থ হলেও লোকে ডাক্তারের কাছে চট করে যেতে চায় না। সহজ যুক্তি, একগাদা টেস্ট দেবে; খরচা অনেক। হ্যাঁ। খরচের বালাই বড় বালাই। যার খসাতে হয়, সেই একমাত্র বোঝে। আর বিশেষ করে যার দৈনন্দিন দানাপানির সংবাদই ঠিকমত হয় না, সে আবার সেই সাহস দেখাবে কোত্থেকে? অতএব যুক্তি নেই, এমনটা বলা যাবে না। আবার বাধ্য হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেও নানা অছিলায় টেস্ট এড়িয়ে যাবার, কিংবা তার রিপোর্ট না আনতে যাবার কাহিনিও শোনা যায় অনেক। খরচ করে টেস্ট যদি করেই ফেলা হল, তাহলে রিপোর্ট আনতে অনীহা কেন? তখন তো আর পয়সা লাগছে না।

এর একমাত্র কারণ হল ভয়। রিপোর্টে যদি কোনও দুরারোগ্য ব্যাধির কথা বলা থাকে, তাহলে ঘাড়ের উপর চাপ আসবে চিকিৎসার। তার আর্থিক দায় যেমন আছে, তেমনি আছে মানসিক ধাক্কার প্রশ্ন। দুটোই সামলাতে পারে, এমন মানুষ এই পোড়া দেশে হাত-গুনতি। আর রিপোর্ট যদি না-ই থাকে, তাহলে ভয়ও নেই, ভাবনাও নেই। যদি কিছু হয়, তখন দেখা যাবে। না জানার একটা সুবিধা আছে। আশঙ্কা থাকে না। জেনে ফেললেই মুশকিল। দায়টা তখন চেপে বসে ঘাড়ে। কিছু একটা হয়েছে জেনে তো আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। সব থেকে ভালো, হাত-পা গুটিয়ে রাখা। আশাও নেই, আশঙ্কা-ও নেই।

ব্যক্তিগত জীবনের এমন অনেক কাহিনির আমরা সাক্ষী। কিন্তু সামাজিক জীবনে এমনটা ঘটে কি? তাহলে আসুন সাম্প্রতিক করোনা নামক আতঙ্কের বিষয়ে একটু খোঁজখবর নিই। এ কথা আমরা সবাই জানি, গত বছর চিনের উহান প্রদেশে অকস্মাৎ রোগটার সন্ধান পাওয়া গেল। তারপর সেখান থেকে ছড়িয়ে গেল ইউরোপ-আমেরিকায়। চিনে করোনার দাপট নাকি এখন থেমেছে। কিন্তু লাট হয়ে যাচ্ছে আমেরিকা, স্পেন, ইতালি, বৃটেন, ফ্রান্স, ইরান। গতকাল পর্যন্ত শুধু আমেরিকাতেই মারা গেছেন ৪৭,৬৮৪। স্পেন, ইতালি আর ফ্রান্স, তিনটি দেশেই মৃতের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। বৃটেনও খুব পিছিয়ে নেই সেই তালিকায়। এখনও পর্যন্ত ১৮ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন সেখানে।

তুলনায় ভারতের অবস্থা নিঃসন্দেহে অনেক ভালো। জানুয়ারির ৩০ তারিখ প্রথম করোনা আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গেল দেশে। আর ২২ এপ্রিল পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছেন মাত্র ৬৮০ জন। আমেরিকা বা ইউরোপের তুলনায় তো কিছুই নয়। এখনও মোট আক্রান্তের হিসাবে বিশ্বে ভারতের স্থান ১৭তম। আর মৃত্যুর হিসাবে ১৮তম। বাস্তবে অনেকেই তো বলছেন, ভারতের করোনা ভাইরাসটি ইউরোপ বা আমেরিকার ভাইরাসের তুলনায় দুর্বল। কেউ কেউ আবার ভারতীয়দের গড় ইমিউনিটি অনেক বেশি বলে দাবী করছেন। সেই জন্যই নাকি করোনাজনিত মৃত্যু হার ভারতে অনেক কম। তাহলে একবার ২২ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের আক্রান্ত ও মৃত্যুর চেহারাটা দেখে নেওয়া যাক।

দেশ আক্রান্ত মৃত্যু মৃত্যুহার
আমেরিকা ৮,৪৯,০৯২ ৪৭,৮০৮ ৫.৬৩
স্পেন ২,১৩,০২৪ ২২,১৫৭ ১০.৪০
ইতালি ১,৮৭,৩২৭ ২৫,০৮৫ ১৩.৩৯
ফ্রান্স ১,৫৯,৮৭৭ ২১,৩৪০ ১৩.৩৫
জার্মানি ১,৫০,৭২৯ ৫,৩৫৪ ৩.৫৫
বৃটেন ১,৩৩,৪৯৫ ১৮,৭৩৮ ১৪.০৪
ইরান ৮৫,৯৯৬ ৫,৪৮১ ৬.৩৭
ব্রাজিল ৪৬,১৮২ ২,৯৩৪ ৬.৩৫
ভারত ২১,৭৯৭ ৬৮৬ ৩.১৫
ইজরায়েল ১৪,৫৯২ ১৯১ ১.৩১
পাকিস্তান ১০,৫১৩ ২২৮ ২.১৭
বাংলাদেশ ৪,১৮৬ ১২৭ ৩.০৩

সারণী – ১

উপরের সারণীটি আক্রান্তের সংখ্যার হিসাবে বড় থেকে ছোট হিসাবে সাজানো হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যার হিসাবে ভারত রয়েছে নবম স্থানে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেলে মৃত্যুর সংখ্যাও স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। সেক্ষেত্রে বৃটেন ও ইরানের সাপেক্ষে জার্মানি একমাত্র ব্যতিক্রম। দুটি দেশের থেকে জার্মানির মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুর ঘটনা কম। আবার পাকিস্তান ও বাংলাদেশের তুলনায় ইজরায়েলও একইভাবে ব্যতিক্রম। তবে ব্যতিক্রম কখনও সাধারণ প্রবণতাকে নাকচ করে না। সেই হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যায় ভারতের নবম স্থানে থাকাটা আশ্চর্যের নয়।

কিন্তু আক্রান্তের সাপেক্ষে মৃত্যুহার বিষয়টা একটু জটিল। উপরের সারণী থেকেই দেখা যাচ্ছে মৃত্যুহার সবথেকে বেশি ইতালিতে যদিও মোট আক্রান্তের হিসাবে ইতালি আছে তৃতীয় স্থানে। যদি মৃত্যুহারের অধঃক্রম অনুসারে সাজানো যায়, তাহলে সেই তালিকাটা হবে এইরকম –

দেশ মৃত্যুহার
বৃটেন ১৪.০৪
ইতালি ১৩.৩৯
ফ্রান্স ১৩.৩৫
স্পেন ১০.৪০
ইরান ৬.৩৭
ব্রাজিল ৬.৩৫
আমেরিকা ৫.৬৩
জার্মানি ৩.৫৫
ভারত ৩.১৫
বাংলাদেশ ৩.০৩
পাকিস্তান ২.১৭
ইজরায়েল ১.৩১

সারণী

দেখাই যাচ্ছে, দুটি সারণীতে কোনও দেশেরই অবস্থান এক নয়। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে মৃত্যুহারও একইভাবে বাড়বে, এমন সরল সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। কিন্তু মৃত্যুহারের এই পার্থক্য কেন হচ্ছে? নানারকম কারণ থাকতেই পারে। ভাইরাসের বিভিন্ন টাইপের প্রসঙ্গটাও সত্যি হতে পারে। যেমন পারে বহু-আলোচিত বিভিন্ন দেশের মানুষের ইমিউনিটির তারতম্যের প্রসঙ্গ। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বারবার কতগুলো রোগ থাকলেই অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে বলছেন। এইসব রোগ থাকলে নাকি করোনায় আক্রান্ত হবার এবং পরিস্থিতি জটিল হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এদের মধ্যে বার্ধক্য-কে সবার আগে রাখা হয়েছে। সর্বত্রই শোনা যাচ্ছে, ইতালিতে নাকি গড় বয়েস সবথেকে বেশি। তাই যদি হবে, তাহলে ইতালিকে টপকে বৃটেন মৃত্যুহারে এগিয়ে গেল কেন?

আবার জার্মানির মানুষদের গড় ইমিউনিটি কি আশপাশের অন্যান্য দেশগুলোর থেকে অনেকটা বেশি? তাহলে তো জার্মানির সাধারণ মৃত্যুহার-ও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কম হওয়া উচিত। সেটা কি সত্যি? কেউ তো এতদিন সেই কথা বলেননি। সম্ভবত উত্তরটা এত সরল নয়। ইমিউনিটি-র কারণে আক্রান্ত হলে সামলে নেবার ক্ষমতা আসে। ফলে সংক্রমণ হলেও রোগলক্ষণ হয় প্রকাশ পায় না অথবা সামান্য প্রকাশ পেয়েই আবার ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু যারা আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়ে গেলেন, তাদের তো আর ফেলে রাখা হয় না। সংক্রমণের কোন পর্যায়ে তারা চিহ্নিত হচ্ছেন এবং তাদের কীভাবে চিকিৎসা করা হচ্ছে, এই দুটো বিষয়ই আসলে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এখনও পর্যন্ত সেই বিষয়ে কোনও তুলনামূলক আলোচনা কোনও জার্নালেই করা হয়নি, কিন্তু সাধারণ বোধবুদ্ধিতেই বিষয়টা বোঝা যায়।

করোনা আক্রান্ত হয়ে সবাই যে মারা যাচ্ছেন, এমনটা নয়। সর্বোচ্চ হার বৃটেনে ১৪.০৪%। বিশ্বজুড়ে গড় হার ১১.১৭%। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ২২ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে যে কমবেশি ১,৮৫,০০০ হাজার মানুষ মারা গেছেন, সেখানে মৃত্যুর সংখ্যায় প্রথম ১০টি দেশের অবদান ১,৫৭,৮২২। এদের মধ্যে আছে আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, বৃটেন, তুরস্ক, ইরান, চিন ও বেলজিয়াম। এই ১০টি দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২২ এপ্রিলে ছিল ২০ লক্ষের খুব কাছাকাছি। তার মানে অবশিষ্ট বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ৬ লক্ষের কিছু বেশি আর মৃত্যুর সংখ্যা মোটামুটি ২৮,০০০। এক্ষেত্রে মৃত্যুহার ৪.৬৭%। এইসব দেশের মধ্যে যেমন ইজরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া বা রাশিয়ার মতো কার্যকরী স্বাস্থ্য পরিকাঠামোসম্পন্ন দেশগুলো আছে, তেমনি আছে নাম-কা-ওয়াস্তে ব্যবস্থাসম্পন্ন দেশগুলো। তাহলে হিসাবটা এমন হচ্ছে কেন? তাহলে কি জলবায়ু, অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভাইরাস, কিংবা জনগণের গড় ইমিউনিটি-র মতো অপ্রমাণিত বিষয়গুলোই সত্যি হয়ে দাঁড়াচ্ছে? সম্ভবত নয়। কারণ যে দেশগুলো সব থেকে বেশি আক্রান্ত, সংক্রমণ নিয়ে তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার ধরনটা হুবহু এক। এরা কেউই সংক্রমণ নিয়ে প্রাথমিকভাবে কোনও হেলদোল দেখায়নি। মাত্রা ছাড়িয়ে যাবার পরেই টনক নড়েছে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, অসুখের ধরনটা নতুন নয়। তবে ভাইরাসটা নতুন। করোনা সংক্রমণে শেষ পর্যন্ত ফুসফুস আক্রান্ত হয় এবং শ্বাসরোধের ঘটনা ঘটে। ২০০২ সালের Severe Acute Respiratory Syndrome (SARS) কিংবা ২০১২ সালের Middle East Respiratory Syndrome (MERS)-এর ক্ষেত্রেও একই লক্ষণ দেখা যেত। দুই ক্ষেত্রেই করোনা ভাইরাসের জন্যই সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। তবে সেই ভাইরাসের সঙ্গে বর্তমান প্যানডেমিকের ভাইরাসের পার্থক্য আছে। SARS রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৮০৯৮ জন, আর MERS রোগে ২৫১৯ জন। কিন্তু মারা গিয়েছিলেন যথাক্রমে ৭৭৪ এবং ৮৬৬ জন মানুষ। অর্থাৎ মৃত্যুহার ছিল যথাক্রমে ৯.৫৬% ও ৩৪.৩৮%। সেই হিসাবে করোনা অনেক বেশি সংক্রামক। আবার সাধারণভাবে তাতে মৃত্যুর ঘটনাও অনেক বেশি। কিন্তু এমন রোগলক্ষণের সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম না, সেটা কিন্তু বলা যাবে না। কেবল ভাইরাসটা আলাদা, যদিও তাদের গোত্র একই।

করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণের একদম শুরুর পর্যায়েই যদি শনাক্ত করা যায়, তাহলে রোগের প্রকোপ মৃদু বা মাঝারি পর্যায়ের বাইরে যায় না। অনেকের ক্ষেত্রে তো রোগলক্ষণেরই প্রকাশ হয় না। আবার যদি রোগের প্রকোপ খুব তীব্র, এমন অবস্থায় শনাক্ত হয়, তাহলে জটিলতা বাড়ে, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু অবধারিত হয়ে ওঠে। তার মানে করোনা সংক্রমণকে সামলানো এবং মৃত্যুহারকে খুব কম রাখতে হলে সমস্ত আক্রান্তকে চিহ্নিত করতে হবে এবং সংক্রমণ ঘটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। সেক্ষেত্রে ব্যাপকহারে ডিটেকশনই এক ও একমাত্র পথ। ইতিমধ্যেই যেখানে যেখানে সংক্রমণ ঘটেছে, সেখানে তো বটেই, অন্যান্য অঞ্চলেও দ্রুত ও ব্যাপক পরীক্ষাই করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতার একমাত্র শর্ত। যত আগে একজন আক্রান্ত শনাক্ত হবেন, তত বেশি উজ্জ্বল হবে তার সুস্থ হবার সম্ভাবনা। আবার তার দ্বারা অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার রাস্তাটাও বন্ধ হবে।

একটা দেশের সমস্ত মানুষ মাসের পর মাস দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকবেন, সেটা কোনও কাজের কথা নয়। কারণ ১০০ শতাংশ লকডাউন কখনওই সম্ভব নয়। চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বেরোতেই হবে। তাদের আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসতেই হবে। আবার অন্য মানুষদেরও পরিষেবা দিতে হবে। এদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। আবার একইভাবে এদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাবার আশঙ্কাটাও বেশি। তাহলে কি তারা ঘরে বসে থাকবেন? সেক্ষেত্রে তো চিকিৎসা ব্যাপারটাই মুলতুবি করে দিতে হবে। তার মানে লকডাউন করে সংক্রমণের হার অবশ্যই কমানো যাবে, কিন্তু কখনওই শূন্য করে দেওয়া যাবে না। আবার ভাইরাস তো কোনও উল্কা নয় যে একটা সময়ের পরে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাবে। ভাইরাস থেকেই যাবে পৃথিবীর জল-হাওয়া-মাটিতে। ফলে আবার যেই মানুষ রাস্তায় বেরোবেন, অমনি সংক্রমণ হু হু করে ছড়াতে শুরু করবে। তার মানে কেবল লকডাউন করে সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা যাবে না। তাই তার সঙ্গেই চাই দ্রুত ও ব্যাপক ডিটেকশন। আর এখানেই আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে।

যে দেশগুলো নিয়ে আমরা তুলনামূলক আলোচনা করছি, তাদের পরীক্ষা ও প্রতি এক লক্ষ মানুষের ক্ষেত্রে পরীক্ষার গড় হারটা এবারে দেখা যাক।

দেশ পরীক্ষা         পরীক্ষা/লক্ষ
আমেরিকা ৪৩,২৬,৬৪৮ ১,৩০৭
জার্মানি ২০,৭২,৬৬৯ ২,৪৭৩
ইতালি ১৫,১৩,২৫১ ২,৫০২
স্পেন ৯,৩০,২৩০ ১,৯৮৯
বৃটেন ৫,৫৯,৯৩৫ ৮২৪
ভারত ৫,০০,৫৪২ ৩৬
ফ্রান্স ৪,৬৩,৬৬২ ৭১০
ইরান ৩,৭৭,৩৯৬ ৪৪৯
ব্রাজিল ২,৯১,৯২২ ১৩৭
ইজরায়েল ২,৪০,৩০৩ ২৭৮
পাকিস্তান ১,২৪,৫৪৯ ৫৬
বাংলাদেশ ৩২,৬৩০ ২০

সারণী

দেখাই যাচ্ছে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত মোট পরীক্ষার হিসাবে ভারত আছে ছয় নম্বর স্থানে। পরীক্ষার সংখ্যা ৫ লক্ষ ছাড়িয়েছে। কিন্তু যখনই হিসাবটা জনসংখ্যার প্রতি এক লক্ষে কতজনের পরীক্ষা হয়েছে, এইভাবে দেখা হবে, তখনই ছবিটা হয়ে উঠবে চরম নিরাশাজনক। ভারতে সেই হার মাত্র ৩৬, এমনকি পাকিস্তানেরও নিচে। গোটা তালিকায় তিন অঙ্কের সংখ্যা ছুঁতে পারেনি, এমন তিনটি দেশই এই উপমহাদেশের। তার মধ্যে ভারতের স্থান একমাত্র বাংলাদেশের উপরেই আছে। তার মানে ভারতে আক্রান্তের যে সরকারি তথ্য, উপযুক্ত সংখ্যায় পরীক্ষা না হবার কারণেই সেই সংখ্যাটা বাস্তবকে সম্পূর্ণ প্রতিফলিত করতে পারে না। ব্যাপকহারে পরীক্ষা ছাড়া এই ক্ষেত্রে মোটামুটি সঠিক অবস্থাটা বোঝা সম্ভব নয়।

একটা অঙ্ক কষা যাক। ভারতে পরীক্ষা হয়েছে ৫,০০,৫৪২টি আর আক্রান্ত বলে চিহ্নিত হয়েছেন ২১,৭৯৭ জন। অর্থাৎ পরীক্ষিতদের ৪.৩৫ শতাংশ আক্রান্ত বলে চিহ্নিত হয়েছেন। ব্যাপকহারে পরীক্ষা করাতে অর্থের জোগান চাই। আক্রান্তদের চিকিৎসা ও অন্যান্য পরিকাঠামো চালু রাখার জন্যও অর্থ চাই। হাওয়ায় সেইসব আয়োজন হয় না। অর্থনীতির বিচারে ভারত ব্রাজিলের কাছাকাছি। ব্রাজিলে প্রতি লক্ষে পরীক্ষা হয়েছে ১৩৭ জনের। ভারত যদি অন্তত সেই হারটাও অর্জন করে, তাহলে ১৩৮ কোটির দেশে পরীক্ষা হবে ১৮,৯০,৬০০। আবার যদি ভারতের আক্রান্তের চলতি হার বজায় থাকবে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা হবে ৮২,২৪১। আর যদি জনসংখ্যার অন্তত ১%-এর পরীক্ষা করা হয়, তাহলে এই হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা হবে ৬ লক্ষের বেশি। আর জার্মানির ধারেকাছে যেতে হলে আক্রান্ত হবে ১২ লক্ষের বেশি। ২০,০০০-এর কিছু বেশি আক্রান্ত নিয়ে ভারত এখনই নাজেহাল। এই বিপুল পরিমাণ আক্রান্তের বোঝা নিয়ে তাহলে আমরা কী করব?

আশার কথা একটাই। যদি ব্যাপক হারে পরীক্ষা হয় এবং সংক্রমণ শুরুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আক্রান্তদের চিহ্নিত করা যায়, তাহলে তাদের প্রায় সকলেই এমনিতেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু যত দেরি হবে, তাদের অবস্থা ততটাই খারাপ হবে। আবার একই সঙ্গে লকডাউন চললেও তারা আশপাশে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেবেন। মাসের পর মাস লকডাউন চালানোর বিলাসিতা বিশ্বের কোনও দেশই দেখাতে পারবে না। আবার শুধু লকডাউন করেও কাজের কাজ কিছু হবে না। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র সমাধান পরীক্ষা, দ্রুত এবং ব্যাপক হারে। একমাত্র তাহলেই আমরা বর্তমান সমস্যা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারব।


প্রতিটি তথ্য worldmeters.info থেকে সংগৃহীত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4643 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...