নির্জন স্বাক্ষর

নির্জন স্বাক্ষর -- কৌশিক মজুমদার

কৌশিক মজুমদার

 

“তাহলে তো সব রহস্যই আপনি সমাধান করেছিলেন?”

“প্রায় সব। একটা বাদে। সেই নাট্যপরিচালক খুন। ওই একটিই অসম্ভব খুন দেখেছি লাইফে। অনেক ভেবেছি, রাতের পর রাত। খুনের কিনারা করতে পারিনি। আমার চাকরি জীবনের একমাত্র কালো দাগ। অমন হাই প্রোফাইল খুন সলভ করতে না পারার জন্য আমাকে দার্জিলিং বদলি করে দেওয়া হয়, জানো?

“আমি খুব অল্প শুনেছি কেসটার ব্যাপারে। আপনি যদি একটু খুলে বলেন…”

 

এক রবিবার সকালে কথা হচ্ছিল সুকল্যাণ মিত্রের সঙ্গে তুর্বসুর। তুর্বসু রায় পেশায় প্রাইভেট ডিটেকটিভ। সবে কাজ শুরু করেছে। ওঁর ঠাকুরদার বাবা তারিণীচরণ ছিলেন কলকাতার প্রথম বাঙালি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। রে প্রাইভেট আই অ্যান্ড কোং নামে ক্লাইভ স্ট্রিটে অফিস খুলেছিলেন তিনি। এত বছর বাদে তুর্বসু সেই অফিসটাই সারিয়ে টারিয়ে গোয়েন্দাগিরি করে। সুকল্যাণ মিত্র পুলিশের আইজি পদে ছিলেন। চন্দননগরে একটা খুনের ব্যাপারে বাজেভাবে ফেঁসে গেছিল তুর্বসু। সুকল্যাণ না থাকলে তুর্বসু মারাও যেতে পারত। সেই থেকেই দুজনের আলাপ। কিছুদিন হল সুকল্যাণ রিটায়ার করেছেন। তুর্বসু সুযোগ পেলেই তাঁর কাছে চলে আসে। উনি বিপত্নীক। ছেলে বিদেশে। ছেলের বয়সি তুর্বসুকে বেশ স্নেহের চোখেই দেখেন। নিজের চাকরি জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলেন।

 

“আসলে কেসটার কথা যত ভাবি, তত কেমন একটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। অনেকবার অনেকভাবে ভেবেছি। কিন্তু এ যেন ম্যাজিক! তোমরা যাকে লকড রুম মিস্ট্রি বল, ঠিক তাই। এখনও ভাবলে তাজ্জব লাগে…”

“আপনি শুরু থেকে বলুন…”

“খুনের মামলা তো, ও কোনওদিন তামাদি হয় না। তাই কিছু নাম ঠিকানা একটু গোপন রেখে বলছি। কিছু মনে কোরো না।”

“সে ঠিক আছে। আপনি বলুন…”

“নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি হবে। আমি তখন লালবাজারে পোস্টিং। কদিন ধরেই খবর পেয়েছিলাম, কলকাতায় নাটক দেখাতে আসছেন বিখ্যাত নাট্যকার রঘুনাথ শর্মা। তখন তাঁর মত সেলিব্রিটি পরিচালক আর দুটো নেই। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার সদস্য, সারা বছর এদেশ ওদেশ লেকচার দিয়ে বেড়ান, তাঁর এক একটা নাটক নিয়ে পত্রপত্রিকায় গোটা পাতা জুড়ে রিভিউ ছাপা হয়, সে এক হইহই ব্যাপার আর কি! রঘু শর্মা তাঁর নতুন নাটক “তিতুমীর” নিয়ে আসছেন কলকাতায়। কলকাতার নানা মঞ্চে পনেরোদিন ধরে নাটকটা হবে। তারপর তিনি দমদম থেকেই রওনা দেবেন শিকাগোতে, কী এক লেকচার দিতে। যেহেতু সরকার থেকে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাই আমরা সবাই সতর্ক ছিলাম, তাঁদের কোনও অসুবিধা না হয়। গোটা দলকে রাখা হয়েছিল কলকাতার তখনকার সেরা হোটেলে। অ্যাকাদেমিতে প্রথম অভিনয় হল। ভিড় উপচে পড়েছিল। পরেরদিন সকালবেলায় নটা নাগাদ অফিসে ঢুকতে যাব, এমন সময় খবরটা পেলাম। রঘুনাথ শর্মা হোটেলে খুন হয়েছেন।”

“সেদিন সকালেই?”

“হ্যাঁ, আর সেই কেসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে! কী কুক্ষণে যে কেসটা হাতে নিয়েছিলাম!”

“যাই হোক, তারপর?”

“রাস্তায় যেতে যেতে কেস ফাইলে চোখ বোলালাম। পনেরো মিনিট আগে লালবাজারে হোটেল থেকে ফোন করে জানানো হয়েছে। যিনি জানিয়েছেন তাঁর নাম সুধীর বসু। মজার ব্যাপার শুধু নামই না, তিনি নিজের পেশাও জানিয়েছেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ, এই অনেকটা তোমার মত। কিন্তু তিনি ওখানে কী করছিলেন? ভাবতে ভাবতে হোটেল পৌঁছে দেখি সবার মুখে কেমন ভয় ভয় ভাব। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম রিসেপশনটা কোথায়? কোনওক্রমে আঙুল দিয়ে দেখাল। রিসেপশনে একটা সুন্দরী মেয়ে বসে ছিল। কিন্তু চোখেমুখে আতঙ্ক। আমাকে দেখে একটু যেন আশ্বস্ত হল। আমি কিছু বলার আগেই সোজা সামনে দেখিয়ে দিল। আর তখনই আমি দেখতে পেলাম।“

“কী দেখলেন?”

“হোটেলে গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাউঞ্জে তিনটে লিফট আছে। দুটো বন্ধ। আর একটা হাঁ করে খোলা। যেটা খোলা সেটায় কিছু একটা মাটিতে পড়ে আছে। প্রথমে ভাবলাম সাদা পুঁটুলি জাতীয় কিছু। পরে দেখলাম একটা মানুষ। উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তাঁর পিঠ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। দুই হাত দুইদিকে ছড়ানো। অসহায়ভাবে লিফটের মধ্যে খুন হয়ে পড়ে আছেন বিশ্ববরেণ্য পরিচালক রঘুনাথ শর্মা। সামনে গিয়ে দেখলাম ডান হাতের কাঁধের কাছেও রক্তের দাগ। কিন্তু যে অস্ত্র দিয়ে তাঁকে খুন করা হয়েছে সেটার কোনও চিহ্ন নেই। আজ অব্দি পাওয়া যায়নি।”

“জেরা করে কী জানা গেল?”

“যা জানা গেল, তাতেই তো মাথা ঘুরে গেল হে! রঘুনাথ শর্মা বেশিরভাগ সময় বিদেশে থাকতেন। দেশে থাকলেও দিল্লির আনন্দ বিহারের বাড়িতে। কিন্তু ওঁর স্ত্রী মধুরা বাঙালি। তিনি আবার ভালো অভিনেত্রীও বটে। রঘুর সব নাটকে লিড রোলে থাকেন। মধুরা ইদানীং বাংলা ছবিতে ট্রাই নিচ্ছিলেন। সেটা মন্দ না। মধুরার তখন বয়স অল্প, দেখতে শুনতে ভাল…”

“কিন্তু যা জানি রঘুনাথ শর্মা তো প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সি ছিলেন…”

“ঠিকই জানো। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা! বুড়ো বয়সে নিজের ছাত্রীকে বিয়ে করেছিলেন। যাই হোক, যেটা বলছিলাম, কলকাতায় আসার পর গোটা নাটকের দলকে সরকার থেকে কলকাতার সেরা ফাইভ স্টার হোটেলে রাখা হল। খুনের দিন রঘুনাথ বেশ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েন। এই সাতটা নাগাদ। মধুরাও তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। তাঁকেও তিনি জাগিয়ে দেন। বলেন আটটায় তাঁকে একবার তৈরি হয়ে নিচে যেতে হবে। মধুরা জিজ্ঞেসা করেন,  কী এমন দরকার, যার জন্য দশটায় ওঠা মানুষ সাতটায় উঠে পড়ল। রঘু নাকি জবাব দেন, একজন নিচে দেখা করতে আসবে। কে সে প্রশ্ন করাতে অদ্ভুত জবাব দেন। বলেন এ হল সেই লোক যার কাছে সেই উত্তরটা আছে যেটা রঘু অনেকদিন হল খুঁজছেন…”

“এর মানে কী?”

“প্রথমে আমিও বুঝিনি। পরে বুঝেছিলাম। বলছি ধীরেসুস্থে। শুনে যাও। এই জায়গাটা খুব ইম্পরট্যান্ট। ঠিক আটটায় সাদা ফুলহাতা জামা আর সাদা প্যান্ট পরে রঘুনাথ ঘর থেকে বেশ তাড়াহুড়ো করেই বেরোলেন। তাঁদের ঘর ছয়তলায়। লিফটের কাছে গিয়েই তাঁর মনে পড়ল তিনি তাড়াহুড়োতে হাতঘড়ি ঘরে ফেলে এসেছেন। দরজার সামনে গিয়ে তিনি স্ত্রীকে ডাকলেন। স্ত্রী ঘড়ি নিয়ে বেরিয়ে এসে তাঁকে লিফট অবধি এগিয়ে দিলেন। রঘুনাথ লিফটে ঢুকেই সোজা নিচে নামার বোতামটা টিপলেন, যাতে লিফট মাঝে আর কোথাও দাঁড়াবে না। এমনকি সওয়ারি চাইলেও না। তখন বাজে ঠিক আটটা তিন।”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান। দুটো প্রশ্ন। এক, সময়টা এত নির্ভুল জানা গেল কীভাবে? আর দুই, এটা তো মধুরার ভার্সান। মিথ্যেও তো হতে পারে!”

“দুটোর জবাবই দিচ্ছি। রঘুকে মধুরা ঘড়ি দেবার সময় রঘু জিজ্ঞেস করেন, দেখো তো ঘড়ি চলছে কিনা, তখনই মধুরা সময়টা দেখেন। রঘু চাবি দেওয়া টিসট হাতঘড়ি ব্যবহার করতেন, আর মাঝেমাঝেই চাবি দিতে ভুলে যেতেন, তাই প্রশ্নটা অস্বাভাবিক না। আর দ্বিতীয়টার সাক্ষী আছে। হোটেলের এক সাফাইকর্মী লিফটের ভিতর সাফ করছিল। সে বেরোতেই রঘু ঢুকে সোজা গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম টেপেন…”

“কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন রঘুনাথ?”

“হ্যাঁ, এটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভের সঙ্গে। যিনি নিজে হোটেল থেকে পুলিশে ফোন করেন।”

“সুধীর বসু?”

“হ্যাঁ, সেই সুধীর বসু। মাস ছয়েক আগে রঘুনাথ নাকি একবার কাউকে না জানিয়ে কলকাতায় আসেন। তখনই তিনি সুধীরবাবুকে অ্যাপয়েন্ট করেন মধুরাকে ফলো করার জন্য। তাঁর ধারণা ছিল মধুরা তাঁরই দলের লিড অ্যাক্টর প্রিয়াংশু সিনহার সঙ্গে তুমুল প্রেম চালাচ্ছেন। দুজনেই বাঙালি। প্রিয়াংশুও টলিঊডে চেষ্টা চালাচ্ছে, তাই সন্দেহ অমূলক নয়। আর মধুরাও একেবারে সতী টাইপের মেয়ে না। পুরুষ দেখলেই ওঁর ছোঁকছোঁক বাড়ত…”

“সুধীর বসু সেই তদন্ত চালান?”

“হ্যাঁ, কিন্তু তদন্তের ফল রঘুকে জানাতে পারেননি। জানানোর কথা ছিল সেদিন। সাক্ষাতে। আগেরদিন বিকেলে দল নিয়ে নাটকে যাবার আগে হোটেলের ফোন থেকে রঘু মিনিট দুয়েক সুধীরবাবুর সঙ্গে কথা বলেন। সুধীরবাবু পুলিশকে জানিয়েছেন সেই ফোনে রঘুনাথ ঠিক আটটায় সুধীরবাবুকে গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে বলেন। এক মিনিট আগেও না। এক মিনিট পরেও না। শুধু তাই না, এটাও বলেন এর অন্যথা করলে সুধীরবাবু একটা পয়সাও পাবেন না!”

“ওঁর অদ্ভুত লাগেনি? এরকম নির্দেশ?”

“অবশ্যই লেগেছিল। কিন্তু উনি ছাপোষা গোয়েন্দা। খদ্দেরও খুব বেশি নেই, টাকার দরকার। উনিও কথা না বাড়িয়ে মেনে নেন। ওদিন হোটেলের সামনে সাতটা পঞ্চাশ নাগাদ পৌছে গেছিলেন। দশ মিনিট অপেক্ষা করে ঠিক আটটায় লাউঞ্জে এসে বসেন। আর বসার মিনিট চারেকের মধ্যে লিফট নেমে আসে। সঙ্গে রঘুর মৃতদেহ।“

“আটটা তিনে রঘু ছয়তলায় লিফটে চাপেন। আটটা চারে লিফট নিচে নেমে আসে। এতক্ষণ লাগল ছয়তলা থেকে নামতে?”

“খুব ভালো প্রশ্ন করেছ। আসলে রঘু শুরু থেকেই দাবি করেছিল তাঁদের নাটকের মালপত্র ইত্যাদি নেওয়ার জন্য আর তাঁর দলের লোকদের ওঠা নামার জন্য একটা লিফট ছেড়ে দিতে হবে। তাতে অন্য কেউ গেলে হবে না। যেহেতু সেলিব্রিটি মানুষ, হোটেল মেনে নেয়। তবে তাঁদের মালপত্র বা গুডস লিফটের একটা বেশ আস্তে নামে। সেটাই রঘুর দলকে দিয়েছিল ওঁরা। আমি নিজে চড়ে দেখেছি। পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড লাগে।”

“মানে হাতে রইল পনেরো সেকেন্ড।”

“তাও রইল কি না সন্দেহ। কারণ রঘুর ঘড়ি আর সুধীরবাবুর ঘড়িতে পনেরো সেকেন্ডের তফাত হতেই পারে। সবচেয়ে বড় কথা লিফটে ঢুকে রঘু সোজা নিচে যাবার বোতাম টিপেছিল। ও নিজে চাইলেও নিচে নামার আগে লিফট থামাতে পারত না। লিফটের ভিতরে কেউ ছিল না, সেটা মধুরা, সেই সাফাইকর্মী আর সুধীরবাবু সবাই বলেছেন।”

“অন্য ফ্লোরের কেউ বাইরে থেকে বোতাম টিপে থামাতে…”

“প্রশ্নই ওঠে না, ওভাবে করা যায় না, ডাইরেক্ট বোতামে।”

“আচ্ছা যদি কেউ আগে থেকেই লিফটের ওপরে উঠে বসে থাকে? লিফট চলা শুরু হতেই নেমে এল। খুন করল। তারপর আবার উপরে চড়ে বসল। তাহলে তো যে কেউ ভাববে লিফট খালি…”

“তুর্বসু, এটা আমার মাথায় আসেনি ভেবেছ? আমি প্রথমেই সেটা ভেবেছিলাম। কিন্তু সে গুড়ে বালি। লিফটের কামরার ওপরে একটা জালি লাগানো আছে বটে, কিন্তু সেটা শত চেষ্টাতেও ওপর থেকে খোলা যাবে না। খুলতে হলে ভিতর থেকে খুলতে হবে। আমি তাও চেক করেছি। স্ক্রুতে জং পড়ে গেছে। বহু বছর কেউ ওতে হাত দেয়নি।”

“রঘুর দেহে কোথায় কোথায় ক্ষত ছিল?”

“ডান হাতে দুটো ক্ষত। তবে ডিপ না। মেজরটা ছিল পিঠে। একটা ছুরি বা ভোজালি সোজা কেউ পিঠে গেঁথে দিয়েছিল। গোটা জামাকাপড় লণ্ডভণ্ড। যেন কারও সঙ্গে হাতাহাতি হয়েছে।”

“আর ছুরিটা?”

“সবার ঘর সার্চ করেও সেটা পাওয়া যায়নি।”

“সবার মানে?”

“মধুরা, প্রিয়াংশু আর নাটকের যারা সবাই সে সময় হোটেলেই ছিল, তাদের।”

“সবাই একই ফ্লোরে ছিল?”

“না। টপ ফ্লোরে রঘু আর মধুরা, তার ঠিক নিচের ফ্লোরে প্রিয়াংশু আর সেকেন্ড ফ্লোরে বাকিরা সবাই।“

“প্রিয়াংশু আলাদা কেন?”

“ওভাবেই বুকিং হয়েছিল। এতে ওর কোনও হাত নেই।“

“ওর জবানবন্দি নিয়েছিলেন?”

“অবশ্যই। ও দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। আমরা গিয়ে ওর ঘুম ভাঙাই।”

“ওই তো মধুরার সঙ্গে প্রেম করত?”

“এখানে একটা প্যাঁচ আছে। সেটাই তোমাকে বলা হয়নি। সুধীরবাবু মধুরাকে আর প্রিয়াংশুকে ফলো করে নিশ্চিত হন ওঁদের মধ্যে প্রেম কেন, বন্ধুতা ছাড়া কিছুই নেই। বরং মধুরা অন্য একজনের প্রেমে হাবুডুবু। কলকাতায় সে এলে দুজনে এক হোটেলে কাটায়।”

“কে সে?”

“রঘুনাথের ম্যানেজার সুরজ প্রতাপ সিং, পাঞ্জাবি ছেলে।”

“বলেন কী? সাসপেক্ট তো তাহলে পরিষ্কার। সুরজকে জেরা করলেন?”

“নাহ!” মাথা নেড়ে বললেন সুকল্যাণ মিত্র।

“কেন?”

“কারণ সুরজ তখন কলকাতাতেই ছিল না। ইন ফ্যাক্ট দেশেই না। রঘুই ওঁকে শিকাগোতে পাঠিয়েছিলেন ওখানকার ব্যবস্থাপাতি দেখাশোনা করতে। রঘু গেলে ও চলে আসত।”

“মানে সুরজ তো সন্দেহের বাইরে চলে গেল, যদি না ও কাউকে দিয়ে করায়…”

“তুমি বুঝতে পারছ না তুর্বসু প্রশ্নটা কে না, প্রশ্নটা কীভাবে? চলন্ত লিফটে এক মিনিটের কম সময়ে আততায়ী ঢুকল কেমন করে, আর বেরিয়েই বা গেল কীভাবে? আর সেই রিভলভার? সেটাও কি করে রঘুর পকেটে এল?”

“কোন রিভলভার?”

“এ বাবা! এত কথা হল, আর ওটার কথা বলিনি! ওটা একটা পুরনো কোল্ট ০.৩২। এককালে নাকি রঘুরই ছিল। মধুরা বিয়ের শুরু শুরুতে দেখেছিল। তারপর মাস ছয়েক আগে কোনওভাবে ওটা হারিয়ে যায়। মৃত রঘুর পকেটে যখন ওটা পাওয়া যায় তখন কিন্তু একেবারে চকচক করছে। সাইলেন্সার লাগানো। সব কটা বুলেট ভরা।”

“ওটাই যে হারানো বন্দুক কী করে নিশ্চিত হলেন?”

“বাঁটে রঘুর নাম খোদাই করা ছিল। দলের অনেকেও চিনেছে ওটা।”

“হারানোর পর রঘুর এফআইআর করেননি?”

“নাহ। অন্তত সেরকম কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।”

“হুম। একটাই প্রশ্ন। নাটকের প্রপস, মানে যেখানে সব সাজসরঞ্জাম রাখে সেই রুমটা কোনতলায় ছিল? আর তার চাবি কার কাছে ছিল?”

“পাঁচতলায়। লিফটের উলটো দিকে প্রিয়াংশুর রুম, তাঁর পাশেরটাই প্রপ রুম। চাবি দুটো ছিল। একটা রঘুর কাছে, একটা প্রিয়াংশুর কাছে, যেহেতু ও ওই ফ্লোরেই ছিল।”

“বুঝলাম! আর একটা কথা, ওই দুটো রুমের পরে কি কোনও টার্ন বা বাঁক ছিল?”

“আশ্চর্য! তুমি জানলে কীভাবে? ওই দুটো ঘর বাকি লবি থেকে একেবারে আলাদা ছিল। লবির শেষে একটা বাঁক, তারপর ওই দুটো ঘর।”

“তার মানে লবিতে লোক চলাচল করলেও ওই দুটো ঘরকে দেখা যাবে না, ঠিক কিনা?”

“একেবারে ঠিক…”

“যাক, এতক্ষণে ধোঁয়াশা কাটল।”

“তাই নাকি? কী বুঝলে বলো দেখি? বুঝলে খুনি কে?”

“বোধহয় বুঝতে পেরেছি।”

এবার সত্যি সত্যি চমকে উঠলেন রিটায়ার্ড আইজি সুকল্যাণ মিত্র। ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন,

“তাই নাকি? খুনি কে? নাকি কারা?”

“খুনি একজনই। রঘুনাথ শর্মা।”

ঘরে পিন পড়লেও বুঝি শব্দ শোনা যায়। খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন সুকল্যাণ “তুমি কি ফাজলামো মারছ নাকি হে? এত কথা শুনালাম তোমার ইয়ার্কির জন্য?”

তুর্বসু খুব বিনীতভাবে বলল, “মাপ করবেন। রেগে যাবেন না। এত বছর বাদে সেভাবে কিছু প্রমাণ করা মুশকিল। কিন্তু আপনি যাকে অসম্ভব খুন বলছেন, আমার কাছে তার ব্যাখ্যা আছে। রঘু তার হারানো বন্দুকের এফআইআর কেন করল না? সে বন্দুক তার পকেটে এল কীভাবে? চলন্ত লিফটে কীভাবে তাঁর দেহ পাওয়া গেল? কেনই বা সে সুধীরবাবুকে ঠিক আটটায় আসতে বলেছিল, আগেও না পরেও না, সব কিছুর। একমাত্র একটা গল্পেই এই সবকটা পাজল মিলে যায়। একেবারে খাপে খাপ, পঞ্চুর বাপ।”

“কীভাবে বলো শুনি?”

“অনেকদিন ধরেই মধুরা আর প্রিয়াংশুর বন্ধুতা দেখে রঘুর চোখ টাটাচ্ছিল। ওঁরাও হয়তো একটু বেশিই স্বাধীনভাবে মিশতেন, কারণ ওঁরা জানতেন ওঁরা কোনও পাপ করছেন না। মধুরার প্রেমের কিছু প্রমাণ হয়তো রঘু পেয়েছিলেন, কিন্তু উনি তো আগে থেকেই প্রিয়াংশুকে অপরাধী বানিয়ে বসে আছেন। সুরজের কথা তাঁর মাথাতেই এল না। একসময় তিনি ঠিক করলেন প্রিয়াংশু বাঁচার অধিকার হারিয়েছে। ওঁকে খুন করতে হবে। কীভাবে? গুলি করে। তাই প্রথমেই প্রচার করে দিলেন তাঁর বন্দুক খোয়া গেছে। কিন্তু তারজন্যে যে এফআইআর করতে হয়, সেটা করলেন না। তাহলে তো সব ধরা পড়ে যাবে! এবার তাঁর দরকার ছিল একজন সাক্ষী। যে তাঁর হয়ে পুলিশকে সাক্ষ্য দেবে। আর পুলিশও তার কথা বিশ্বাস করবে। তিনি সুধীরবাবুকে অ্যাপয়েন্ট করলেন। মনে রাখবেন রঘু আগেই নিশ্চিত ছিলেন মধুরা প্রিয়াংশুর সঙ্গেই প্রেম করছে। তাই এই তদন্ত নেহাত ধোঁকার টাঁটি ছাড়া কিছু না। আগেই উত্তর জেনে এক্সপেরিমেন্ট করার মত। শুধু বুঝতে পারেননি, এক্ষেত্রে ওঁর ভাবনাটা ভুল। যাই হোক, উনি খুনের প্লট সাজালেন। যাকে বলে পারফেক্ট মার্ডার। আর সেই জন্যেই ঠিক আটটার সময় সুধীরবাবুকে লাউঞ্জে আসতে বললেন। আগেও না। পরেও না।”

“বুঝলাম না, বুঝলাম না। এক মিনিটের কম সময়ে খুন করবেই বা কী করে? তাও চলন্ত লিফট থেকে? ও তো চাইলেও বেরোতে পারবে না?”

“এখানেই এই পারফেক্ট প্ল্যানের তুরুপের তাস। রঘু ঘর থেকে আটটা তিনে বেরিয়েছেন। এটা কীভাবে জানা গেল?”

“মধুরা বলেছে…”

“মধুরা কীভাবে জানল?”

“রঘুর ঘড়ি দেখে…”

“ঘড়ি দেখতে কে বলেছিল?”

“রঘু.. মানে…”

“একদমই তাই। রঘু যে আটটা তিনে লিফটে চাপলেন, সেটার সাক্ষী দরকার ছিল। আর তারজন্যেই তিনি ঘড়ি ঘরে ফেলে আসেন। এবার ধরুন ঘড়ির সময় যদি দশ মিনিট এগোনো থাকে? মানে রঘু রওনা হচ্ছেন সাতটা পঞ্চাশে, কিন্তু মধুরা ভাবছেন রঘু আটটা তিনে বেরোচ্ছেন। আগেরদিন শো ছিল, শুতে রাত হয়েছে। মধুরাও ঘুম চোখে আর সময় রিচেক করেননি, বা করলেও সেটা যে দরকারি কিছু ভাবেননি। দশ মিনিট কী আর এমন টাইম।

রঘু সোজা নিচের বোতাম টিপে সাতটা একান্নতে নিচে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার পাঁচ তলার বোতাম টিপে চলে গেলেন পাঁচ তলায়। এই ফাঁকে ঘড়ির টাইম ঠিক করে নিলেন। তিনি আগে থেকেই জানতেন এই লিফটে দলের কেউ ছাড়া অন্য লোক আসবে না। সেই জন্যেই শুরুতে একটা লিফট নিজেদের জন্যে করে নেন। একা প্রিয়াংশুর রুম পাঁচতলায় বুক করার পিছনে প্রিয়াংশুর হাত নেই ঠিক, কিন্তু রঘুর হাত ছিল। তিনি চাননি দলের কেউ তাঁকে দেখে ফেলুক। ঠিক সেই জন্যেই লিফটের ঠিক উলটো দিকে প্রিয়াংশুর রুম। যাতে লিফট থেকে বেরিয়ে লবিতে হাঁটতে না হয়। বন্দুকে সাইলেন্সার লাগানোতে এটাও পরিষ্কার যে নিঃশব্দে খুনটা সেরে ফেলতে চাইছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন প্রিয়াংশুর রুমে যাবেন। এক গুলিতে তাঁকে খুন করবেন। সত্যিকারের আটটা তিন নাগাদ লিফটে উঠে সোজা পাঁচ তলা থেকে নিচে নেমে আসবেন, লাউঞ্জে বসে থাকা সুধীরবাবু সাক্ষ্য দেবেন তিনি আটটা চারে নেমে এসেছেন। আপনি যেটা বললেন, আটটা তিনে লিফটে উঠে চাইলেও উনি কীভাবে খুন করে আটটা চারে নামতে পারেন? একেবারে ওয়াটার টাইট অ্যালিবাই। আর তারপরেও যদি বন্দুক ইত্যাদি থেকে ওঁর খোঁজ পড়ে, উনি তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে শিকাগোতে। কিন্তু মুশকিল একটা হল…”

“কী মুশকিল?” সুকল্যাণ মিত্রর মুখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে।

“একটা জিনিস হিসেবের মধ্যে আনেননি রঘু। তাঁর বয়স পঞ্চাশ, আর প্রিয়াংশু তাগড়াই তিরিশ না পেরনো ছোকরা। ফলে বন্দুক তুলে গুলি করার আগেই হাতাহাতি শুরু হল। খুব সম্ভব বন্দুক ছিটকে যায়। রঘু প্রিয়াংশুর ওপরে চেপে বসেন। প্রিয়াংশুর হাতের সামনে ছুরি জাতীয় কিছু ছিল। রঘুকে সরাতে সে তাঁর হাতে দুইবার আঘাত করে। শেষে আর না পেরে গোটা ছুরি ঢুকিয়ে দেয় রঘুর পিঠে। রঘু সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। এবার চেপে বসে ভয়। সে ছুরি তুলে নেয়। ভাবতে থাকে মৃতদেহ কোথায় ফেলবে। তাঁর তখন মাথা কাজ করছে না। এদিকে এসব করতে গিয়ে দশ মিনিট কেটে গেছে। সে কোনওমতে দেহটা নিয়ে ঘরের উলটোদিকে লিফটে চড়িয়ে দেয়। দিয়েই ডাইরেক্ট নিচের বোতাম টিপে দেয়। কাকতালীয়ভাবে তখন ঠিক আটটা তিনই বাজে। রঘু তাঁর প্ল্যান মতই নিচে নেমে যায়। ভুল বললাম, রঘু না, রঘুর মৃতদেহ…”

“তাহলে সেই ছুরি?”

“একটা বালির কণা লুকিয়ে রাখার সবচেয়ে ভাল জায়গা কোনটা জানেন? বালির স্তুপ। সেখানে অনেক বালির মধ্যে একটা বালি ধরা পরে না। তাই আমি প্রপস রুমটা কোথায় জানতে চাইলাম। রঘুকে মেরে ছুরিটা ধুয়ে মুছে প্রিয়াংশু প্রপস রুমে রেখে দেয়। মনে রাখবেন নাটকটা তিতুমীর, সেখানে ছুরি, তীর, ধারালো অস্ত্র প্রপস হিসেবে ব্যবহার হয়। তাই ওই রুমটা দেখলেও তাঁর মধ্যে আলাদা করে একটা ছুরি চোখে পড়বে না। কিন্তু আপনারা কি ওই রুমটা দেখেছিলেন?”

পাশাপাশি মাথা নাড়লেন সুকল্যাণ মিত্র। দেখেননি। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। চোখ ছলছল। “কী লজ্জা তুর্বসু, তোমায় কী করে বোঝাই? ডিপার্টমেন্টে আমার সব সুনাম এই একটা কেসে শেষ হয়ে গেছিল। আমার আড়ালে অনেকেই আমায় রঘু রঘু বলে ডাকত, জানো। তোমার সঙ্গে আগে কেন দেখা হল না বলো তো…” বলতে বলতে হঠাৎ কি যেন মনে হল তাঁর, “আচ্ছা তুর্বসু, মার্ডার কেস তো তামাদি হয় না। বলে কয়ে কেসটা রি ওপেন করাব?”

তুর্বসু মাথা নিচু করে বসেছিল, বলল “স্যার জয় বাবা ফেলুনাথ দেখেছেন? অম্বিকা ঘোষালের একটা কথা আছে, যার মনে চুরি, সেই তো চোর! এখানে তাই খুনি একজনই। রঘুনাথ শর্মা। আর সে তো তাঁর পাপের শাস্তি পেয়েইছে। আপনি নাম বলেননি, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি প্রিয়াংশু কে। সে এখন টলিউডের সেরা অভিনেতাদের একজন। মধুরাও সুরজকে বিয়ে করে সুখেই আছে। পেজ থ্রিতে ছবি টবি দেখি। কী দরকার স্যার নির্দোষ এতগুলো মানুষকে কষ্ট দেবার? রঘু চেয়েছিল প্রিয়াংশুর মৃত্যদূত হতে। বুঝতেই পারেনি মৃত্যু কোন ফাঁকে এসে ওঁর পিঠে নিজের নির্জন স্বাক্ষর রেখে গেছে।”


ক্লাসিক্যাল লকড রুম মিস্ট্রি যাকে বলে তাঁর জনক ছিলেন জন ডিকশন কার। লকড রুম মিস্ট্রি কতরকম হতে পারে তাঁর প্রতিটার সংজ্ঞা তিনি তাঁর বিখ্যাত থ্রি কফিনস বইতে দিয়েছেন। পৃথিবীর কোনও লেখকের সাধ্য হয়নি তাঁর বাইরে বেরনোর, আমি তো কোন ছাড়। কিন্তু বহুদিন বাংলায় কোনও ক্লাসিক লকড ডাউন মার্ডার দেখি না। তাই নিজেই লিখতে বসলাম, সেই ছোট্টবেলায় হলদে হয়ে আসা বইগুলোতে যে ধরনের গল্প পড়তাম, তাঁর আদলে….

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4877 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. ভালো লাগলো। সূর্যতামসীর টীজার হিসেবে খাসা । একসাথে দুটো genre নিয়ে ভালো খেলা হলো।

আপনার মতামত...