“লেনিনকে মানুষ চিনুক তাঁর নিজের লেখাপত্রের মধ্যে দিয়ে, অন্য কারও চোখ দিয়ে নয়”— কথোপকথনে তারিক আলি

রাজা নইম

 

এ বছর ২৮শে জানুয়ারির এক শীতল বৃষ্টিস্নাত বিকেলে গিয়ে পৌঁছলাম সেই বাড়িটিতে, যে বাড়িটিতে এসে উঠেছেন প্রখ্যাত লেখক এবং রাজনৈতিক কর্মী তারিক আলি। শুনলাম, বাড়িটি তাঁর বোনের। তাঁর এই দফায় পাকিস্তানে আগমন ন্যাশনাল কলেজ অফ আর্টসে লাহোর বিয়েনালে ২০২০-র অন্যতম মুখ্য বক্তা হিসেবে। সেই বক্তব্যে তিনি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েই আলোচনা করেছিলেন। আমি গেছিলাম তাঁর সঙ্গে লেনিনকে নিয়ে কথা বলতে, কারণ লেনিনই তাঁর সাম্প্রতিকতম কাজের বিষয়। অবশ্যই তার সঙ্গে আসবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন মহীরুহদের কথা, আসবে সাহিত্য, বা তাঁর আগামী কাজ নিয়ে আলোচনা। সেই বিস্তৃত কথোপকথনই রইল নিচে।

রাজা নইমের সঙ্গে তারিক আলি

বলা হয় চ্যারিটি ঘর থেকেই শুরু করতে হয়। তা আমরাও সেই বিকেলটা থেকেই শুরু করি। যে বিকেলে আপনি আপনার বাবা— একজন জঙ্গি কমিউনিস্ট, একজন দৃঢ়চেতা সাংবাদিক এবং একজন মহান লড়াকু মহিলার স্বামী— মাজহার আলি খানকে হারালেন। সেই দিনের স্মৃতিটা কেমন?

লন্ডনে ছিলাম। মা ফোন করে খবরটা দিলেন। বিধ্বস্ত লাগছিল, স্বাভাবিকভাবেই। পরদিন সকালে লাহোর পৌঁছলাম। ততক্ষণে বাবাকে সমাধিস্থ করা হয়ে গেছে। প্রচুর লোক আসছিল সান্ত্বনা দিতে। প্রচুর স্মৃতি…। পাকিস্তানের বাল্যকালের স্মৃতি। বাবা যে সংবাদপত্রটি সম্পাদনা করতেন, সেটির বাল্যকালের স্মৃতি। এটা কিন্তু একটা বিরাট ট্র্যাজেডি। প্রোগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেডের প্রকাশিত সেই যে সংবাদপত্রগুলি, সেসব কব্জা করল কিনা একটি সামরিক সরকার। লায়েল-ও-নাহার সম্পাদনা করতেন সিবতে হাসান। দি পাকিস্তান টাইমস সম্পাদনা করতেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, এবং তার পরে বাবা। ইমরোজ-এর সম্পাদক ছিলেন চিরাগ হাসান হাসরাত, পরে আহমদ নাদিম কাশমি। একটা জিনিস এঁরা তখন বলতে কুণ্ঠিত হতেন, কিন্তু এখন আমরা সেটা নিয়েই গর্ববোধ করি। এঁরা সবাই ছিলেন হয় প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিস্ট, নয়তো কমিউনিজমের ঘনিষ্ঠ অনুগামী। পাকিস্তানের একটা গোটা প্রজন্মকে এঁরা শিক্ষিত করেছিলেন। সংবাদপত্রগুলি দৃঢ়তার সঙ্গে একটি মৌলিক লাইন মেনে চলত— সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় এতটুকুও আপস নয়।

ট্র্যাজেডিটা এল ১৯৫৮ সালে, যখন প্রথম মার্শাল আইন বলবৎ হয়েছে। আমেরিকা প্রচণ্ডভাবে চাইছিল যেন কাগজটা বন্ধ হয়ে যায়। কাগজের বিরুদ্ধে একটা সাজানো মামলা দায়ের করা হল। আমার এখনও ওই দিনটা স্পষ্ট মনে পড়ে। ওরা এল মাজহার আলি খানের কাছে, জানাল এখন থেকে কাগজটাকে ওদের অধিকারে নেওয়া হচ্ছে। তিনি জানালেন, তাঁর নামটা যেন কাগজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই বলে পদত্যাগ করলেন। টাইম ম্যাগাজিন পাকিস্তান টাইমস-কে এশিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট সম্পাদিত কাগজ আখ্যা দিয়েছিল। এই জবরদখল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর একটা নারকীয় আঘাত। ডন এবং নওয়া-ই-ওয়ক্ত বিষাক্ত সম্পাদকীয় লিখেছিল এই জবরদখলকে সমর্থন জানিয়ে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই ঘটনা একটা যুগের অবসান ঘটিয়েছিল।

এর দশ বছর পর একটা প্রবল বিক্ষোভের ঢেউ দেশ উথালপাথাল করে দেয় এবং সেই সামরিক একনায়কতন্ত্রের পতন হয়। এসবই মনে পড়ছিল। সেই প্রজন্মের লোকজন এসেছিলেন অনেকে। তাঁরা এইসব পুরনো গল্প করছিলেন।

বাবা খুব নীতিনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন এবং যাবতীয় নির্বুদ্ধিতা হাসিমুখে সহ্য করে যাওয়া তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। প্রোগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেড সরকার কব্জা করার পর তিনি যে সেখান থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, সেজন্য আমি গর্ববোধ করি। এরপর তিনি সারাজীবনের জন্য ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে গেলেন। যথেষ্ট সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন, মৃত্যুর সময়েও শরীরে মনে রীতিমতো চাঙ্গা ছিলেন। প্রোগ্রেসিভের ঘটনার পরে ভিউপয়েন্ট বলে একটি পত্রিকা চালু করেছিলেন, ডন-এ কলামও লিখেছিলেন। তবে সেগুলি কখনওই সেই প্রোগ্রেসিভের কাজের তুল্য হয়নি।

২০১৭তে আপনার বাবার জন্মশতবার্ষিকী গেল। কিন্তু আমরা দেখলাম আমাদের কোনও সাহিত্য উৎসবেই তিনি স্মরিত হলেন না। আপনি স্মৃতি নিয়ে অনেক কথাই বলেন। তো তাঁর জীবন এবং উত্তরাধিকারের প্রতি এই যে বিস্মৃতি এ নিয়ে আপনার মত শুনতে চাইব।

বাবা একদমই প্রচার ভালোবাসতেন না। যখন পাকিস্তান টাইমস সম্পাদনা করতেন তাঁর কড়া নির্দেশ ছিল তাঁর বা আমার মা-র কাজকর্ম যেন একদমই কভার করা না হয়। যেকোনওরকম মাখামাখি বা আত্মপ্রচার ঘৃণা করতেন। কখনওই তাঁকে একজন অফিসিয়াল লোক বলা যাবে না। শতবর্ষে বামপন্থীদের কিছু ছোট ছোট গ্রুপই খালি তাঁকে স্মরণ করেছে। আমি বলতে চাইছি, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ তিনি শুধুমাত্র একজন চমৎকার সাংবাদিক ছিলেন, আর কিছু নয়।

আপনার সাম্প্রতিকতম কাজের বিষয় লেনিন। আচ্ছা, সেই প্রসঙ্গে বলুন, আপনার বাবা তাঁকে কীভাবে দেখতেন? এবং আপনার কি মনে হয় আপনি আপনার বইতে লেনিনের যে ছবিটি এঁকেছেন তিনি তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন?

এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আসলে তাঁর প্রজন্মের কমিউনিস্টরা, অর্থাৎ ১৯৩০-এর দশকের, মস্কোর প্রতি প্রচণ্ড অনুগত ছিলেন। তাঁদের চোখে লেনিন একজন ধর্মনিরপেক্ষ সন্তবিশেষ যিনি কোনওদিন কোনও ভুল করেননি। প্রায় ভগবান আর কি! লেনিনের পরবর্তীতে স্তালিন এবং ক্রুশ্চেভের জমানায় সোভিয়েত সরকারিভাবে লেনিনের যে চিত্রটি বিশ্বে প্রচার করত তাঁরা তা সর্বতোভাবে গ্রহণ করতেন। তাঁদের যে লেনিনকে চেনানো হয়েছিল তিনি কোনও মানুষ নন। তিনি চিন্তা করেন না… তাঁর ভুল হয় না… তিনি সেই ভুলগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলিকে শোধরানোর চেষ্টাও করেন না। লেনিনের ‘সংগৃহীত রচনাবলি’র মধ্যে গোঁড়ামির কোনও চিহ্ন নেই কিন্তু। তিনি মার্কসবাদকে বিকশিত করেছিলেন, পরিশুদ্ধ করেছিলেন। স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার পর জীবনের শেষ দিনগুলিতে লেনিন যে নিবন্ধগুলি লেখা শুরু করেছিলেন, তাতে তাঁর কিছু সহকর্মী এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁরা প্রাভদার একটা ফেক ইস্যু বের করে তাঁকে দেখাবেন ভেবেছিলেন। তাঁদের ভয় পাছে তাঁর এইসব চিন্তাভাবনা বেশি গভীর অব্দি পৌঁছে যায়! ঘটনাচক্রে সেটা হয়নি শেষ পর্যন্ত, পলিটব্যুরো ভেটো দিয়ে ঠেকায়। এরকম কাজ খুব কম নেতাই করেছেন। রুশ নৈরাষ্ট্রবাদ, মার্কসবাদ এবং ইওরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা— এই তিনটি জিনিস মিলে লেনিনকে লেনিন বানিয়েছিল। জারতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার জন্য তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। লেনিন ছাড়া কোনও অক্টোবর বিপ্লব সম্ভবপর ছিল না। আমার লেনিনকে নিয়ে বই লেখার উদ্দেশ্য, মানুষ যাতে তাঁর প্রকৃত রচনাগুলি অধ্যয়ন করার একটা প্রেরণা পায়।

আশি বছর আগে এই আজকের দিনেই লেনিনের একজন মহান মুসলিম কমরেড মিরসাইদ সুলতান গালিয়েভকে প্রতিক্রিয়াশীল অভিযোগে মস্কোতে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয়। আপনার কী মনে হয়, মুসলিম দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রকে জনপ্রিয় করার যে প্রচেষ্টা গালিয়েভ চালিয়েছিলেন লেনিন তাকে কী চোখে দেখতেন? অকালমৃত্যু সত্ত্বেও ইতিহাস কি তাঁর প্রতি এইটুকু করুণা করতে পারে না?

সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে লেনিনের শেষ সংগ্রামটা ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সুরক্ষিত করার সংগ্রাম। তিনি তাঁর জর্জিয়ান সহকর্মীদের আচার আচরণে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং এই নিয়ে মাঝেমধ্যেই তাঁদের ওপর মেজাজ হারাতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রজাতন্ত্রের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। ব্যাপারটা এত দূর গেছিল যে একবার তিনি এমনও বলেছিলেন “আলজেরিয়াতে ফরাসি উপনিবেশবাদের চেয়ে সোভিয়েত তুর্কেস্তানকে আলাদা তোমরা কেন মনে করো?” পুরো ঠিকঠাকভাবে না হলেও এই প্রজাতন্ত্রগুলি আধুনিক হয়েছিল; প্রতিটি নারী পুরুষ শিক্ষিত হয়েছিলেন; মহিলা সহ সমাজের সবচেয়ে নিচুতলার মানুষদের ওপরের স্তরে উঠে আসার একটা প্রক্রিয়া চলেছিল। ওইসব অঞ্চলের অধ্যাপকদের সঙ্গে বিভিন্ন কনফারেন্সে আমার প্রায়ই দেখা হত। তাঁরা ইসলামের চমৎকার এবং প্রগতিশীল সব ব্যাখ্যা দিতেন। এর কারণ তাঁরা সোভিয়েত ইউনিয়নে শিক্ষিত হয়েছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁদের মুক্তি দিয়েছিল। এটা কিন্তু পৃথিবীর অন্য সমস্ত দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

লেনিন নারীদের সাম্যে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এবং মহিলারা কেবল গৃহকর্মেই আবদ্ধ রয়েছে জানলে খুবই ক্রুদ্ধ হতেন। আমরা যদি রাশিয়ায় সোভিয়েত-পরবর্তী নেতৃত্বের বা চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের সংবিধান দেখি তবে মনে হবে যেন নারীদের কোনও অস্তিত্বই নেই। আসলে আমাদের আগের প্রজন্মের কমিউনিস্টরা লেনিনকে দেখেছেন স্তালিনবাদী চোখ দিয়ে; আর স্তালিন-বিরোধীরা লেনিনকে দেখেছেন নৈরাষ্ট্রবাদী বা ট্রটস্কিবাদী চোখ দিয়ে। আমি পাঠককে লেনিনকে তাঁর নিজের লেখাপত্রের মধ্যে দিয়ে ঠিক তাঁর নিজের মতো করেই দেখাতে চেয়েছিলাম।

এটা বেশ চমকপ্রদ যে লেনিনকে নিয়ে বইটির চূড়ান্ত পর্যায়ে আপনি দেখিয়েছেন লেনিন কীভাবে আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে একসময় তাঁর চিন্তাভাবনাগুলি তাদের আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় ধর্মীয় বুলি-সর্বস্বতায় পরিণত হবে। এটা আমরা এমনকি তাঁর মহান পূর্বসূরি মার্কসের ক্ষেত্রেও দেখেছি। জীবনের শেষ লগ্নে এসে চরম ক্ষোভের সঙ্গে মার্কস বলেছিলেন, “আমি মার্কসবাদী নই!” আচ্ছা আপনার কি মনে হয় না এই যে ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’ কথাটাই সেই বুলি-সর্বস্বতার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ? এখন তো আবার অনেকে এর সঙ্গে মাওবাদ, হোজাবাদ ইত্যাদিও যোগ করে দিচ্ছে…

মার্কস নিশ্চিতভাবেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদে বিশ্বাস করতেন। আপনি কখনওই শুধু রাজারাজড়াদের শাসনের গল্প শুনিয়ে কোনও দেশ বা কোনও সমাজের ইতিহাস লিখতে পারেন না। আমাদের অবশ্যই দেশগুলির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শক্তিগুলিকে বুঝতে হবে। এই শক্তিগুলি দ্বারাই দেশগুলির শাসকশ্রেণি নির্ধারিত হয়ে এসেছে। মার্কস এবং এঙ্গেলস যখন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে লিখলেন, “সারা বিশ্বের এতদিনকার সমস্ত ইতিহাসই হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস”, তখনই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সূচিমুখটি নির্দিষ্ট হয়ে গেল।

অর্থনৈতিক দমন এবং নিপীড়ন ছাড়াও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অনেক দিক রয়েছে। কেউ কেউ সঙ্কোচনবাদী হয়ে গেছেন। মার্কস, এঙ্গেলস এবং লেনিন অবশ্যই তাঁদের দলে নন। নিজের কথার বিকৃতি এবং অপব্যবহার দেখে লেনিন ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, যদি ওরা নিজেদের লেনিনবাদী দাবি করে তবে আমি বলব আমি লেনিনবাদী নই। আসলে রাজনৈতিক তত্ত্ব একটি সতত প্রবহমান ধারা। তাকে কখনওই সর্বকালের জন্য অনড় অটল বলে বেঁধে ফেলা যায় না। জাতীয় এবং বিশ্ব পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও পরিবর্তন করতে হয়। পরবর্তীকালে আসা অনেকগুলি গ্রুপ এই সত্যটাই কখনও বুঝল না।

লেনিনকে পুরনো দিনের অন্যান্য বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে আপনি কীভাবে তুলনা করবেন? আমরা বরং হাইতির বিপ্লব থেকে শুরু করি— তুস্যাঁ লুভার্তিউর; আর তারপরে ধীরে ধীরে আসি রোবস্পিয়ার, মাও, হো চি মিন, ফিদেল কাস্ত্রো এবং খোমেইনিতে…

মূলগতভাবে বলা যায় পরিস্থিতি এবং ইতিহাসের চালিকাশক্তিই সমস্ত পুরনো দিনের বিপ্লবী নেতাদের তৈরি করেছিল। সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেনিনই একমাত্র নেতা যিনি বিপ্লবকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বলেছিলেন বিপ্লবটা কী, এবং তিনি যে পার্টি তৈরি করছেন সেই বিপ্লবে তার ভূমিকা কী হবে। লেনিন তাঁর বিপ্লবকে আগেই সুসজ্জিত করে নিয়েছিলেন। এই কথাটি আপনি অন্য নেতাদের সম্পর্কে বলতে পারবেন না। তুস্যাঁ একজন মহান নেতা ছিলেন। একদম উপায়ান্তর না থাকা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করে গেছেন। একই কথা ফ্রান্সে জ্যাকবিনদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অক্টোবর বিপ্লবের পৃথিবীকে দেখা এবং বোঝার এবং একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের চরিত্রকে অনুধাবন করার অনন্যসাধারণ ক্ষমতা ছিল। সেই কারণেই উপনিবেশবাদের অবসানে এটি একটি নির্ধারক ভূমিকা নিয়েছিল। রুশ বিপ্লবের জন্যই চিন থেকে কিউবা ভিয়েতনাম সমস্ত বিপ্লবের নেতৃত্বে চলে এসেছিল কমিউনিস্টরা। কেরলের কমিউনিস্ট কে দামোদরন একবার ভারতীয় কমিউনিস্টদের একটি প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে হো চি মিনকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আমাদের পার্টির আয়তন ইন্দোচিনের কমিউনিস্ট পার্টির আয়তনের সমান হওয়া সত্ত্বেও আমরা ভারতে বিপ্লব সফল করতে পারছি না কেন, যেখানে আপনি বিপ্লবে সাফল্যের সঙ্গে নেতৃত্ব দিলেন?” এর জবাবে হো চি মিন যা বলেছিলেন সেটা আমার বরাবরের খুব পছন্দের— “ভারতে আপনাদের গান্ধি আছে। এখানে আমিই হো চি মিন এবং গান্ধি। ভারতে বুর্জোয়ারা চালাকি করে বরাবর আপনাদের দাবিয়ে রেখেছে। এখানে শুরু থেকেই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে কমিউনিস্টরা।”

চিন এবং ভিয়েতনামের দুই নেতাই জাপানি এবং ফরাসি দখলদারির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সম্মান অর্জন করেছিলেন। দুজনেই তাঁদের মতাদর্শগত সাফল্যের জন্য রুশ বিপ্লবের কাছে ঋণী। চিন বিপ্লব রুশ বিপ্লবের চেয়েও শক্তিশালী ছিল। কারণ এটি নির্মাণে কুড়ি বছর লেগেছিল। রুশ বিপ্লব অনেক সংক্ষিপ্ত এবং তীক্ষ্ণ বিপ্লব। সেখানে মাওয়ের ফৌজ গোটা দেশ চষে বেড়িয়েছে। কৃষকদের সঙ্গে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্কও রাশিয়ার তুলনায় ভিন্নতর ছিল। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি কৃষকদের নেতৃত্ব অর্জন করতে পেরেছিল। রাশিয়াতে কিন্তু কৃষকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই বৈরীভাবাপন্ন ছিল।

যে বুলি-সর্বস্বতার কথা আমরা বলছিলাম, এইসব নেতাদের সে সম্পর্কে কীরকম অবস্থান ছিল?

আপনি আগে খোমেইনির কথা বলছিলেন। ইরানীয় বিপ্লব কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের। এটি বিপ্লবের মধ্যেই একটি প্রতিবিপ্লব। ক্ষমতা দখলের পর বিপ্লবীরা ইরানিয়ান তুদে পার্টি এবং ফিঁদায়েদের ধ্বংস করে দেয়। এই বিপ্লব একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং বামপন্থীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত। মর্মান্তিক বিষয় হল, বামপন্থীদের প্রতি এদের নির্মমতা চরম পর্যায়ে গেছিল। সংস্কৃতি এবং রাজনীতি, দুই দিক থেকেই ইরানীয় ইন্টেলিজেনশিয়া সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে প্রগতিশীল। অন্তত আরব দুনিয়ার মধ্যে তো বটেই। শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়াকেই এই ব্যাপারে কিছুটা তুলনা করা যেতে পারে।

ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের বিপ্লব ছিল বুর্জোয়া বিপ্লব। রুশ বিপ্লবই একমাত্র বিপ্লব যা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই হতে চেয়েছিল। নিকারাগুয়ার বিপ্লব ছিল কিউবার বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বিপ্লব। সারা বিশ্বের ক্ষেত্রে রুশ বিপ্লবের যে ভূমিকা, লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে কিউবার বিপ্লবের ভূমিকাটাও সেরকম। অনেক ভালো লোক সান্দিনিস্তাদের ত্যাগ করেছিলেন। এটা মানতেই হবে বিপ্লবগুলির অনেক ট্র্যাজেডিও ছিল।

লেনিন বুলি-সর্বস্বতার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী তাঁর শরীরকে যেন মমি করে রাখা না হয় এই বলে পলিটব্যুরোর কাছে আর্জিও জানিয়েছিলেন। ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’-এ “নেতারা কেমন করে বিগ্রহে পরিণত হতে পারেন” সে নিয়ে লেনিন সম্পূর্ণ একটি প্যাসেজ লিখেছিলেন। মাওকে বিগ্রহে পরিণত করা হয়েছে, হো-কেও, আর লেনিন তো সম্পূর্ণ একজন বাইজান্টাইন দেবতায় পরিণত। দেশবাসীর কাছে যদি সমর্থনের অভাব ঘটে তখনই এগুলি করতে দেখা যায়— সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। জীবনের শেষদিকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় মাও ব্যক্তিপূজাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁর কিছু সংগ্রাম ছিল ‘নয়া অর্থনৈতিক নীতি’র পক্ষে, যে নীতি পুঁজিবাদকে অনেক ছাড় দিয়েছিল। মাও বুঝেছিলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে, এবং এও বুঝেছিলেন যে স্বেচ্ছাসেবী ভঙ্গিতে কাজ হয় না।

আপনি আপনার বইয়ের ব্লার্বে বার্ট্রান্ড রাসেলের একটি ইন্টারেস্টিং উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, যেখানে তিনি লেনিনকে ক্রমওয়েলের সঙ্গে তুলনা করেছেন…

আমি আসলে পাঠকদের দেখাতে চেয়েছিলাম চার্চিল এবং রাসেল দুজনের কেউই লেনিনের গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারেননি। কিন্তু এটা অত কিছু বড় ব্যাপার নয়।

লেনিনকে উপমাহাদেশের সাহিত্য— আমি বলছি উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবি, বাংলা ইত্যাদি ভাষার সাহিত্যের কথা— কীভাবে মনে রেখেছে? যদি আদৌ রেখে থাকে আর কি…

১৯৩০ এবং ৪০-এর দশকে লেনিনকে নিয়ে প্রচুর লেখাপত্র হয়েছে, তাঁর বইগুলি প্রায় সমস্ত প্রধান ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইকবাল একটি কবিতা লিখেছিলেন— ভগবান লেনিনকে কথা বলার জন্য ডেকেছেন, লেনিন স্বর্গে গেছেন এবং ভগবানকে বোঝাচ্ছেন মর্ত্যের মানুষ কীরকম সমস্যায় দিন গুজরান করছেন। ভগবান লেনিনের কথা শুনে খুবই প্রভাবিত হলেন এবং তাঁর ফেরেশতাদের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। এই কবিতাটা একদম আমার মনে গাঁথা আছে। খুবই বিপ্লবী কবিতা একটি। সম্ভবত উর্দু সাহিত্যে লেনিনকে নিয়ে এটিই সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা। ইকবাল কিন্তু কমিউনিস্ট ছিলেন না, বরং একজন আধুনিকতাবাদী মুসলিম কবি ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয় না এই কবিতাটি এখন আর এখানে স্কুলে পড়ানো হয় বলে…

একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং একজন লেখক হিসেবে আপনার পরিক্রমার কথা যদি ভাবি, তাহলে এই যে বিষয়বস্তু হিসেবে আপনি ট্রটস্কিকে না বেছে লেনিনকে বেছে নিলেন, সেটা কিন্তু আমাকে কিছুটা আশ্চর্য করেছে। আপনার আগের বহু কাজেই আমরা আপনাকে ট্রটস্কির বুদ্ধিবৃত্তি এবং উত্তরাধিকারের প্রতি সপ্রশংস হতে দেখেছি। তা এবার কি ট্রটস্কিকে নিয়ে কোনও কাজের পরিকল্পনা রয়েছে?

না, প্রশ্নটা ঠিক প্রশংসার নয়, প্রশ্নটা একটা বৌদ্ধিক সাহচর্যের। ট্রটস্কি একজন মহান বিপ্লবী নেতা, চিন্তক, রণকুশলী এবং একজন অসাধারণ নিবন্ধকার ও লেখক। লেনিন-পরবর্তী যুগ সম্পর্কে তাঁর সমালোচনামূলক লেখাগুলি থেকে অনেক কিছু শেখা যায়, আমি আগে বলেওছি সেটা। কিন্তু আমি লেনিনকে বেছেছি এই কারণে, ট্রটস্কি-স্তালিন বিতর্কের ক্ষেত্রে আনুগত্য সবসময়েই হয় স্তালিন নয় ট্রটস্কির প্রতি থেকে যায়। তাতে যেটা হয়, লেনিন প্রায়শই ঝাপসা হয়ে যান। আরও একটা ব্যাপার, আমি আগে লেনিনকে নিয়ে কখনওই কিছু লিখিনি। আর না, ট্রটস্কিকে নিয়ে আর কোনও কাজের পরিকল্পনা নেই।

এই বছর লেনিনের জন্ম-সার্ধ্বশতবর্ষ। লাহোর বিয়েনালেতে মুখ্য বক্তা হিসেবে আপনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংগ্রামরত তরুণদের কথা বলছিলেন। তা এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে আপনি তাঁদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য লেনিনের কোন লেখা বা কোন উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে চাইবেন?

আমি তরুণদের কোনও উপদেশই দেব না। আমি চাইব তরুণরা নিজেরাই লেনিনকে আবিষ্কার করুক। কী করতে হবে সেটা বলে দেওয়া উদ্বুদ্ধ করার কোনও ভালো পন্থা বলে আমার মনে হয় না। তারাই ঠিক করুক, তাদের সেইসব মানুষগুলিকে আর দরকার আছে কিনা। লেনিন পরবর্তী যুগে বিশ্ব-কমিউনিজমের একটা বড় সমস্যা হল, এই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কমিউনিজমকে একটা ধর্মের আসনে বসানো শুরু হয়। কমিউনিজমের নিজস্ব ভগবান হল, সন্ত হল, শহিদও হল। এমনিতেই ভারত এবং পাকিস্তানে গুরুভজা সংস্কৃতির একটা সুদীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। তোমাকে খালি শেখানো হবে, কিন্তু তুমি কোনও প্রশ্ন করতে পারবে না। নেতা এবং নেতা যা শেখাচ্ছে তার ওপর প্রশ্নহীন আনুগত্য রাখতে হবে। এই পদ্ধতি সবসময়েই উলটো ফল দেয়।

এবছর ফ্রেডরিক এঙ্গেলসেরও দ্বিশতবর্ষ। আচ্ছা, মার্কসাবাদী চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে এঙ্গেলসের অবদান আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? একই সঙ্গে জানতে চাইব এই একবিংশ শতাব্দীতে একজন রাজনৈতিক কর্মী বা একজন বুদ্ধিজীবী এঙ্গেলসের থেকে কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন?

এঙ্গেলস তাঁর নিজের যোগ্যতাতেই মহান। তাঁকে কখনওই মার্কসের জুনিয়র পার্টনার বলা যায় না। তাঁরা দুজনেই দুজনকে শিখিয়েছেন, দুজনেই দুজনের থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। তিনি এমন সব বিষয়ে লিখেছিলেন যেগুলি নিয়ে মার্কস কোনওদিনই লেখেননি। ‘…পরিবারের উৎপত্তি’তে আয়োজনপূর্বক এবং বলপূর্বক বিবাহকে তিনি পতিতাবৃত্তির একটি রূপ বলে বর্ণনা করেছিলেন। জার্মানির সশস্ত্র সংগ্রাম এবং কৃষক যুদ্ধেও তাঁর শক্তিশালী ভূমিকা ছিল। অসাধারণ সামরিক জ্ঞানের জন্য তাঁকে ‘দি জেনারেল’ নামে ডাকা হত। জনগণের বাস্তব প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারলেই মতবাদের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। যদি কোনও মতবাদ তা না পারে, তবে সেই মতবাদ মৃত। আমি এঙ্গেলসের ক্লাসিক জীবনীগুলি পড়েছি, আধুনিকগুলি আমার পছন্দ নয়। সেগুলি এঙ্গলসের শ্রেণি-প্রেক্ষাপট নিয়ে বড় বেশি চিন্তিত— যে তিনি একজন শিল্পপতি ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনযাপন এবং মানুষের কেমন করে বাঁচা উচিত সেই বিষয়ে এঙ্গেলস মার্কসের থেকে অনেক কম রক্ষণশীল। মার্কস নৈতিকতার দিক থেকে অনেক বেশি ভিক্টোরীয়, এঙ্গেলসের জীবন অনেক বেশি খোলামেলা এবং সৃজনশীল। তিনি বিবাহের পবিত্রতা তো দূরের কথা, বিবাহেই বিশ্বাস করতেন না।

লাহোর বিয়েনালেতে আপনার যে বক্তব্যের কথা বলছিলাম, তাতে আপনি এও বলেছিলেন যে প্যালেস্তাইন আন্তর্জাতিক অ্যাজেন্ডা থেকে মুছে যাবে। গামাল আবদেল নাসিরের একীভূত আরব প্রজাতন্ত্রের চিন্তাভাবনা যে বিস্মৃতির অতলে চলে গেছে সেটাও বলেছিলেন। এইরকম ঘটনায় স্মৃতি অনেক সময়েই প্রতিরোধের আকার নেয়। এই সেপ্টেম্বরে নাসিরের মৃত্যুর এবং একই সঙ্গে জর্ডনের সেই কুখ্যাত কালা সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ডের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের ওপর, বিশেষত ওই অঞ্চলের প্রগতিশীল শক্তিগুলির ওপর, এই দুই ঘটনার প্রভাব সম্পর্কে কিছু বলুন…

শুধু নাসিরের মৃত্যু নয়। ১৯৬৭-র আরব-ইজরায়েল যুদ্ধে পরাজয়ের পর থেকেই আরব জাতীয়তাবাদ ধ্বংস হয়ে যায়। আরব জাতীয়তাবাদের কাছে এটা একটা বিশাল পরাজয়। নাসির খুবই জনপ্রিয় ছিল, মানুষের সম্মান এবং ভালোবাসা অর্জন করেছিল, কিন্তু সে তার লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ। একটি একীভূত আরব দুনিয়ার পতনের সেই শুরু। এখন কী দেখছি আমরা? সংকীর্ণতা, বিভাজন, মার্কিন আগ্রাসনে একের পর এক দেশের ধ্বংস হয়ে যাওয়া, একটি বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে গড়ে ওঠা প্যালেস্তিনীয়দের আন্দোলনকে ইজরায়েলের শেষ করে দেওয়া…

আমার প্রয়াত বন্ধু এডওয়ার্ড সইদ সবসময় বলে এসেছে অসলো চুক্তি প্যালিস্তনীয় স্বার্থের প্রতি একটা চরম বিশ্বাসঘাতকতা। তার কথার সত্যতা আজ প্রমাণিত। দুই-দেশ সমাধান আজ সমুদ্রের গর্ভে। ইজরায়েলিরা কখনওই একটি প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে অনুমোদন করবে না। তারা নিজেরাই একটা এক-দেশ সমাধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে এবং সেই লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে।

ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর একটা বড় পরাজয়। জর্ডন প্যালেস্তিনীয়দের দমন করতে সহায়তা করেছিল। জেনারেল জিয়া-উল-হক জর্ডনের রাজতন্ত্রকে সহায়তা করে নিজের সামরিক খ্যাতি বাড়াচ্ছিলেন। তবে প্যালেস্তিনীয় মুক্তি সংগ্রামে এটা একটা বড় ধাক্কা হলেও তাঁরা সামলে উঠেছিলেন, এবং সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিলেন।

প্রথম ইন্তিফাদা ইজরায়েলের রাজনৈতিক এবং সামরিক ব্যবস্থাকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ইয়াসের আরাফত অসলো চুক্তি মেনে নিল। ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের সেই নেতাদের সঙ্গে নেগোশিয়েশনে গেল যারা আদৌ ইন্তিফাদার নেতা ছিল না। বরং এরা আগে থেকেই দেশ ছেড়ে টিউনিশিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ইজরায়েলের মানসিকতা প্রচণ্ডভাবেই উপনিবেশবাদী এবং জাতিবিদ্বেষী। প্যালেস্তিনীয় নেতৃত্ব কানাগলিতে পড়ে গেল এবং চিন্তাভাবনা করাই বন্ধ করে দিল। নিজেদের হাতের সব তাস তারা ইজরায়েলের কোলে উপুড় করে দিল। প্যালেস্তাইনের জন্য এটা একটা বিপর্যয়। অসলো চুক্তির এক বছর পরেও অন্তত তারা বিশ্বের কাছে আবেদন জানাতে পারত এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারত। প্রতিদিন হত্যাকাণ্ড হয়ে চলেছে, আর সারা বিশ্ব বসে বসে দেখছে। প্যালেস্তিনীয়দের সঙ্গে ইজরায়েল এটাই করে চলেছে। এবং তারা এখন ভারতে মোদি সরকারকেও কাশ্মিরিদের বিরুদ্ধে এবং সে দেশের আরও যে সব সংখ্যালঘুরা দিল্লির দখলদারি মেনে নিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধেও একই রাস্তা নিতে পরামর্শ দিচ্ছে।

আজকে আমরা দেখছি আরব দুনিয়ার ঐক্য এবং প্যালেস্তাইনের মুক্তি— এই দুইই ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে। তা এইরকম একটা পরিস্থিতিতে ওই ঘটনাদুটি স্মরণ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয়?

ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। স্মৃতি মুছে ফেলা ঠিক না। অতীত ভুলে গেলে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করা যায় না। স্মৃতি এবং ইতিহাস— দুয়েরই গুরুত্ব আছে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই ইতিহাসবিকৃতি একটা বড় সমস্যা। মোদি যে ইরফান হাবিব এবং রোমিলা থাপারের ওপর আক্রমণ আনছে তার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এই আক্রমণ পরিকল্পিত এবং সংগঠিত। তাদের নিজস্ব ইতিহাসের বয়ান নির্লজ্জভাবে ভারতীয় রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু আমি খুশি এটা দেখে যে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধও হচ্ছে।

আচ্ছা, আমরা সাহিত্য নিয়ে বেশি কিছু কথা বলিনি, তা সেটা একটু শুধরে নেওয়া যাক। এই বছর মহান জাপানি লেখক য়ুকিও মিশিমার সেই অদ্ভুত আত্মহত্যার ঘটনার ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। তাঁর লেখার সঙ্গে আপনার বিজড়ন কেমন ছিল? এবং বিংশ শতকের রাজনীতি এবং সাহিত্যে তাঁকে আপনি কোন জায়গায় বসাবেন?

মিশিমা রক্ষণশীল হলেও চমৎকার ঔপন্যাসিক ছিলেন। সাহিত্যকে শুধুই নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা ঠিক নয়। এটা মানতে হবে যে অনেকে চরম দক্ষিণপন্থী এবং প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া সত্ত্বেও মহান সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। ফরাসি লেখক সেলিন বা নরওয়ের ক্‌নুট (Knut) হামসুনের কথা মনে পড়ছে। নিজেরা সাহিত্যে নোবেল জিতে বার্লিন পাড়ি দিয়েছিলেন সেই নোবেল হিটলারকে দেওয়ার জন্য।

বর্তমান নোবেল-লরিয়েট পেটার হান্টকে ক্ষমতাশালী সাহিত্য মাফিয়া গোষ্ঠীর মধ্যে পড়েন না। তিনি ঠিক প্রথাগত মানুষ নন। সেইজন্যই তাঁকে অপবাদ দেওয়া হয়। তিনি যথেষ্ট স্বাধীনচেতা এবং যেভাবে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা হচ্ছে তা পছন্দ করেন না। তিনি অতি-ডানও নন। আমি তাঁকে এবং তাঁর কাজ সম্পর্কে জানি।

শেষ প্রশ্ন, আপনার আগামী কাজ সম্পর্কে কিছু বলুন…

চার্চিলের রহস্য উন্মোচন করে একটা বই লিখছি, তাঁকে একটু পুনর্নির্মাণও করছি বলা যায়। চার্চিলের ভাবমূর্তি ব্রিটেন, আমেরিকা দু জায়গাতেই হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডেও… অনেক জায়গাতেই। বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ‘দি চার্চিল ফ্যাক্টর’ বলে একটা বেস্টসেলার বই লিখেছেন, যেটাকে কিন্তু বুদ্ধিহীন বই বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এর একটা উত্তর দেওয়া প্রয়োজন। আমার বইটির নাম হবে ‘চার্চিল: হিজ লাইফ অ্যান্ড ক্রাইমস’।


মূল সাক্ষাৎকারটি ইংরাজিতে দুই কিস্তিতে ‘ফ্রাইডে টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়। লিঙ্ক:

https://www.thefridaytimes.com/talking-lenin-with-tariq-ali-i/
https://www.thefridaytimes.com/talking-lenin-with-tariq-ali-ii/

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...