হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, কর্পোরেট স্বার্থ ও শিক্ষানীতি ২০২০

আকাশ ভট্টাচার্য

 


লেখক সম্প্রতি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি শেষ করে বর্তমানে বেঙ্গালুরুর একটি কলেজে ইতিহাস ও শিক্ষাশাস্ত্রের অধ্যাপক

 

 

 

 

আরএসএস ও শিক্ষা 

কয়েক সপ্তাহ আগে, কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট জাতীয় শিক্ষানীতি অনুমোদন করার সঙ্গে সঙ্গে, এক বিস্তারিত আলোচনা শুরু হয় এই নীতিকে নিয়ে। করোনাভাইরাসের জন্য বেশ কিছুদিন হল স্কুলকলেজ বন্ধ, এবং এই সুযোগে সরকারের সাহায্যে নানা প্রযুক্তি সংস্থা শিক্ষাকে পাকাপাকিভাবে প্রযুক্তির জালে আবদ্ধ করার চেষ্টা করছে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের ঘরে ইন্টারনেট নেই, এটা বলাই বাহুল্য। এমতাবস্থায় ব্যাপকহারে অনলাইন শিক্ষার অর্থ হল শিক্ষাক্ষেত্রে তথা সমাজে অসাম্যের বৃদ্ধি। বিষয়টি নিয়ে জনসাধারণ ও বুদ্ধিজীবী মহল বেশ কিছুদিন ধরেই রীতিমতো চঞ্চল হয়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে এসে পড়ল নয়া শিক্ষানীতি। অনেক শিক্ষাবিদরাই বললেন, গণহারে অনলাইন শিক্ষার প্রয়াস যে নীতিকাঠামোর প্রতিফলন, তারই আরেক অভিব্যক্তি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০। অর্থাৎ, শিক্ষার মাধ্যমে মাত্রাবিভক্ত অসাম্যের (graded inequality) উৎপাদন ও শিক্ষাক্ষেত্রে বড় পুঁজির নিয়ন্ত্রণবৃদ্ধির আরেক নাম জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০।

শাসনপ্রণালীর স্তরে কর্পোরেট আধিপত্যের প্রক্রিয়া শুরু করে কংগ্রেস এবং একে শক্তিশালী করে ভারতীয় জনতা পার্টি। তবে দুই দলের মধ্যে একটা ফারাক থেকেই যায়। বর্তমান সরকার হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধারক এবং শিক্ষার মাধ্যমে হিন্দুত্বের আদর্শগত নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ অনিল সদগোপাল, যিনি প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে শিক্ষা আন্দোলনে কর্মরত, এই নীতির মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন হিন্দুত্ব ও কর্পোরেট স্বার্থের এক আজব মিশ্রণ (cocktail)। তিনি এও বলেছেন যে এর পরিকাঠামো কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে দলিত, বামপন্থী ও নারীবাদী আন্দোলনের সাফল্যগুলিকে নাকার করতে চলেছে। সামাজিক ন্যায়ের দাবিকে দুর্বল করে এই নীতি, লিখেছেন শিক্ষক আন্দোলনের বহু কর্মী। এই সব ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে বোধহয় বই লিখতে হবে একখানা। আমি আপাতত হিন্দুত্ব/কর্পোরেট মিশ্রণের বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করব। কাজটা কঠিন, কারণ এই দুই শিবিরই নিজেদের ক্রিয়াকর্মে গোপনীয়তা বজায় রাখে। পর্যবেক্ষণ এবং কিছু গবেষণার মাধ্যমে যেটুকু বুঝতে পেরেছি তা বলার চেষ্টা করব।

প্রথমে আসবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, অর্থাৎ আরএসএস-এর কথা। কীভাবে এই নীতি শিক্ষাকে তাদের কবলে ঠেলে দিচ্ছে, তা নিয়ে থাকবে কিছু আলোচনা। তারপর কথা হবে কর্পোরেটদের স্বার্থ নিয়ে। কেন তারা আরএসএস-চালিত এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করছে, তা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

শিক্ষার মাধ্যমে আদর্শগত আধিপত্য স্থাপনের প্রচেষ্টা আরএসএস বহু দশক ধরেই করে চলেছে। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ, আবার একই সঙ্গে এই ব্যবস্থাকে ক্ষয় করা, এই হল এদের কার্যপ্রণালী। সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী শিক্ষাকে পরিচালনা করা এদের বিষয়সূচিতে কোনওদিনই স্থান পায়নি। এর আগে যখনই সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা সরকারে অংশগ্রহণ করেছে বা সরকার চালিয়েছে, পাঠক্রমকে হিন্দুত্ববাদী ভাবনায় পরিপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০-র জনতা সরকারই হোক, কিংবা ১৯৯৬ থেকে ২০০৪-এর ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্ত্বে রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক জোটের সরকারই হোক। মোদিরাজত্বের পূর্বে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তনই ছিল এদের সরকারগুলির শিক্ষাক্ষেত্রে প্রধান কর্মপন্থা। এর উদ্দেশ্য, ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত আর্য প্রব্রজন তত্ত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলিকে (যা হিন্দু রাষ্ট্র, অখণ্ড ভারত এবং হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান গোছের তত্ত্বকে ঐতিহাসিকভাবে ভ্রান্ত প্রমাণ করে) অস্বীকার করা, ভারতের মুসলমান ঐতিহ্যের ব্যাপারে মিথ্যাপ্রচার, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে শক্তিশালী করা, স্বৈরাচারবাদকে মহিমান্বিত করা, আমাদের সমাজের জাতিভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক ও শ্রেণিভিত্তিক গভীর অসাম্যগুলিকে অস্বীকার করা এবং সাধারণভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোবৃত্তিকে উৎসাহ দেওয়া।

গত দুই দশকে আরএসএস-এর কার্যপদ্ধতি কিছুটা পালটেছে। তাদের নিজেদের চালানো স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এগুলির দ্বারা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে একভাবে ঘিরে ফেলার অভিসন্ধি দেখা যাচ্ছে এদের কাজের মধ্যে। এক বিশ্বস্ত গবেষণা অনুযায়ী এই মুহূর্তে এরা চালায় প্রায় ১২,৩৬৩ স্কুল, ১২,০০১ একল বিদ্যালয় (একক শিক্ষকের অধীনে চলা স্কুল) এবং হাজার হাজার সংস্কার কেন্দ্র। এগুলি চলে অবশ্য বেনামে। আরএসএস নয়, অখিল ভারতীয় শিক্ষা সংস্থান, বিদ্যা ভারতী ও অন্যান্য আরএসএস-যুক্ত সংগঠন রয়েছে এগুলির দায়িত্বে। ইদানিং কালে আরএসএস আরও কিছু বেসরকারি সংস্থা স্থাপন করেছে, যারা সঙ্ঘের হয়ে সরকারের কাছে ওকালতি করে। নয়া শিক্ষানীতি তৈরি করার সময় সরকার কিছু উপদেশক সমিতি গঠন করে এবং শিক্ষার “ভারতীয়করণ”-এর অনবদ্য পরিকল্পনা প্রস্তুতির দায়িত্ব দেওয়া হয় এদের। এসব সমিতিতে আরএসএসের সমর্থিত সংগঠনগুলির লোকই ছিল বেশি।

 

হিন্দুত্ব ও জাতীয় শিক্ষানীতি

শিক্ষানীতিতে যে ধরনের ভাবনা ও মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, তাতে এই “ভারতীয়করণের” পরিকল্পনা বেশ পরিষ্কার। হিন্দুত্বের মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা মূল্যবোধ কেবল প্রাধান্য পেয়েছে তাই নয়, সেগুলিকে সাংবিধানিক মূল্যবোধের সঙ্গে একই পংক্তিতে রাখা হয়েছে। শিক্ষণীয় বোধগুলির মূলসূত্র হিসেবে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের কথা বলা হয়েছে অথচ ইসলামের কোনও উল্লেখ করা হয়নি। আবার অন্যদিকে মূল্যবোধের কথা জোর দিয়ে বলা হলেও, তার সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক নাগরিক অধিকারগুলির কথা কিন্তু কোথাও নেই। তাহলে ঠিক কী শেখানো হতে চলছে বাচ্চাদের? “মৌলিক নৈতিক বিচার, সাবেকি ভারতীয় মূল্যবোধ, সকল মৌলিক মানবিক ও সাংবিধানিক মূল্যবোধ,” যার একটি তালিকা ৪.২৮ পর্বে দেওয়া হয়েছে:

সেবা, অহিংসা, স্বচ্ছতা, সত্য, নিষ্কাম কর্ম, শান্তি, ত্যাগ, সহিষ্ণুতা, বৈচিত্র, বিবিধতা, ন্যায়নিষ্ঠ ব্যবহার, লৈঙ্গিক সংবেদনশীলতা, জ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান, পরিপ্রেক্ষিত নির্বিশেষে সকলের প্রতি সম্মান, পরিবেশের প্রতি সম্মান, উপকারিতা, ভদ্রতা, ধৈর্য, ক্ষমাশীলতা, সহানুভূতি, করুণা, দেশভক্তি, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, সততা, দায়িত্ববোধ, ন্যায়, স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ।

সমাজবাদ, ধর্মনিরেপেক্ষতা, মৌলিক অধিকার, এগুলি কোথায়? ত্যাগের সঙ্গে কি ব্যক্তিস্বাধীনতা সবসময় খাপ খায়? সাংবিধানিক অধিকারের জায়গা থেকে দেখলে কিন্তু মূল্যের তালিকায় আগে আসে স্বাধীনতা, সে বাকস্বাধীনতাই হোক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কে স্বাধীনতা। কিন্তু তালিকা থেকে অধিকারের সূচি বাদ দিলে ত্যাগের অর্থ ঠিক কী হয়ে দাঁড়ায় ? আরএসএস-এর মুখপত্রগুলিতে স্ত্রীত্যাগ ও স্ত্রীস্বাধীনতার তুলনামূলক মূল্যায়ন মন দিয়ে পড়লেই এই প্রশ্নের উত্তর মেলে। এবং উত্তরগুলি বেশ অস্বস্তিকর। নয়া শিক্ষানীতি এও বলছে যে বাচ্চাদের অল্প বয়স থেকে “কী করা উচিৎ” মার্কা প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন, এবং আরেকটু বড় হলে “প্রতারণা, হিংসা, চৌর্যবৃত্তি, দূষণ, সহিষ্ণুতা, সমতা, সহানুভূতি” ইত্যাদির ব্যাপারে শেখানো উচিৎ, যাতে নৈতিকতা তাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠতে পারে ও যাতে তারা যে কোনও মূল্যের ব্যাপারে নানা দৃষ্টিভঙ্গি চর্চার  মাধ্যমে এক বিশেষ অবস্থানের দিকে এগোতে পারে। তা সে তো খুব ভালো কথা। কিন্তু অধিকারগুলিকে বাদ নিয়ে নীতিচর্চা সাংবিধানিক মতে খুব একটা নৈতিক কি?

এই ধরনের উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে রাজ্যস্তরে ইতিমধ্যে পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের চেষ্টা কিন্তু বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে। রাজস্থানে ২০১৬ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার নতুন পাঠ্যপুস্তক চালু করে। এখানে বিজ্ঞানের বইতে পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যসমৃদ্ধ পৌরাণিক গাথা। সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানের বইগুলিতে জাতি/লিঙ্গ বৈষম্যের কথা ঢেকে রেখে সমাজ ও পরিবারের স্বার্থে ত্যাগের কথা বলা আছে, বিশেষ করে মহিলাদের। এখানে সেনাবাহিনীর প্রতি সম্মানকে দেশভক্তির নাম দেওয়া হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমকে বিকৃত করা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসকে মান্যতা দেওয়ার স্বার্থে। নয়া নীতি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে বিপুল ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে, যার ফলে সর্বভারতীয় স্তরে পাঠক্রমে এই ধরনের পরিবর্তন আসন্ন বলেই মনে হয়।

সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত নানা সংস্থা অন্যভাবেও শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে পারে। এই নীতি সরকারি-বেসরকারি সহযোগ বাড়ানোর কথা বলেছে। এই সহযোগের রূপরেখা ঠিক কীরকম? বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে স্কুল চালানো থেকে শুরু করে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পরীক্ষা নেওয়া, স্কুল ও কলেজ পরিসরে নিরাপত্তাব্যবস্থা, এরকম অনেক কিছুই বেসরকারি সংস্থার হাতে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ অনেক সময় স্কুল বা কলেজ নামে সরকারি হলেও বহু বেসরকারি সংগঠন সেগুলিতে স্থান পাচ্ছে। এখন ভবিষ্যতে কী কী ধরনের বেসরকারি সংস্থান এই কাজগুলি পাবে, তাদের নির্বাচন কীভাবে হবে, সে ব্যাপারে কিছু বলা নেই নয়া নীতিতে। অর্থাৎ সঙ্ঘচালিত সংগঠন বা ঐ ধারার অন্যান্য সংস্থা এই কাজগুলি পেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এখানে বলে রাখা ভালো যে এই সরকারি-বেসরকারি সহযোগের গল্পটা কিন্তু বেশ মজার। আপাতদৃষ্টিতে সরকারি ব্যবস্থাকে পোক্ত করাই হল এর উদ্দেশ্য। আসলে কিন্তু এর মাধ্যমে সরকারি কাঠামোকে ভেতর থেকে ফাঁপা করে দেওয়ার কাজ দীর্ঘদিন ধরে চলছে।

এই বিষয়ে আলোচনা শেষ করার আগে এর সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে একটু কথা বলা যাক। সঙ্ঘ দ্বারা শিক্ষক প্রশিক্ষণে হস্তক্ষেপের অর্থ হল শিক্ষাপদ্ধতিতে বিকার। সঙ্ঘের কাছে তা হবে পাঠ্যপুস্তক ও পাঠক্রমে হেরফেরের পরিপূরক। এদের পরীক্ষার ক্ষেত্রে মধ্যবর্ত্তিতার সুযোগ দেওয়ার মানে প্রশ্নের ধরনের বিষয়ে এদের বক্তব্য মেনে নেওয়া। আর আজকের সময়ে, যখন উৎপাদিত ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক হিংসা দ্রুত ছড়াচ্ছে, আরএসএস-চালিত নিরাপত্তা সংস্থা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিসরে কী হেন ঝামেলা বাঁধাতে পারে তা বলাই বাহুল্য।

 

কর্পোরেট স্বার্থ ও হিন্দুত্বের সঙ্গে সমঝোতা

এই শিক্ষানীতি রচনার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে কিছু বড় পুঁজিপতি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ঠিক কী এদের স্বার্থ? কেনই বা এরা শাসকদলের কর্মসূচিকে সমর্থন করতে আগ্রহী? এখানে বলে রাখা দরকার যে এই পুঁজিপতিদের মধ্যে সবাই যে হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী তা নয়। অথচ দেখা যাচ্ছে যে আপাতদৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিপতিরাও সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন এই নীতি রচনার কাজে। এহেন মনিকাঞ্চন সংযোগ অবশ্য কেবলমাত্র শিক্ষাক্ষেত্রে দেখা যায় তা নয়। সামগ্রিকভাবেই নীতি নির্দেশনা ও রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী শক্তির সঙ্গে কর্পোরেটদের অশুভ মিলন চোখে পড়ে। কেন এই মিলন?

ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিপতিরা অবশ্যই ক্ষমতাসীন দলের রোষের মুখে পড়ার ভয়ে রয়েছেন। কিন্তু তা দিয়েও এর সবটা বোঝা সম্ভব নয়।

হিন্দুত্ববাদী সরকার ও বড় পুঁজির মধ্যে রয়েছে এক জটিল ও গভীর দেওয়ানেওয়ার সম্পর্ক, যা কিনা বর্তমানে ক্ষমতার মানচিত্রকে অনেকাংশে নির্ধারণ করছে। এক দিকে বড় পুঁজির রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন ছাড়া আরএসএস ও ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষে এতটা ক্ষমতাসীন হওয়া কঠিন হত। আবার অন্যদিকে হিন্দুত্ব কেবল ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে শক্তিশালী করছে তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে বেকারত্ব, আর্থিক মন্দা, কর্মক্ষেত্রে শোষণ, নাগরিক অধিকার, সাধারণ বণ্টনব্যবস্থার দুরবস্থা ইত্যাদি ধর্মপিরপেক্ষ মুদ্দাগুলিকে রাজনীতি থেকে সরিয়েও নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়া কিন্তু বড় পুঁজিকে অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। কাজেই বর্তমানে এই দুই শিবির নিজ নিজ স্বার্থে একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খানিকটা এরকমই দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক আমরা দেখতে পাচ্ছি জাতীয় শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে। শিক্ষানীতি বর্তমানের শ্রেণিবিভাজিত সমাজ ও শোষণমূলক চাকরির পরিদৃশ্যকে মান্যতা দিচ্ছে এবং শিক্ষাকে এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। নতুন পাঠক্রম অনুযায়ী লেখাপড়ার পরিমাণ কমবে, স্কুল থেকেই বাচ্চাদের পেশামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং ছাত্রদের প্রথম চাকরির সঙ্গে দ্বিতীয় ও তৃতীয় চাকরির জন্য প্রস্তুত করা হবে। অর্থাৎ “ভারতীয়করণের” পাশাপাশি, কাঠামোগত বেকারত্ব এবং অস্থায়ী ও নিম্নমানের চাকরির সঙ্গে মানিয়ে চলার তালিম দেওয়া হবে অল্প বয়স থেকেই। পাশাপাশি, বর্তমান আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে রুখে দাঁড়ানোর আকাঙ্খা বা সম্ভাবনার বীজ উপড়ে ফেলা হবে ক্লাসরুম থেকে। আগেই বলা হয়েছে যে এই দস্তুরে মৌলিক অধিকারের কথা প্রায় নেই। ব্যবস্থায়িক স্থিতাবস্থার এই নমনীয়তাকে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ “ক্ষমতায়ন”-এর (empowerment)  আখ্যা দিচ্ছে (ভাগ ৪.৯)। আপনারাই বলুন, সস্তায় শ্রম বেচতে প্রস্তুত ও নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে অল্পশিক্ষিত শ্রমিকশ্রেণি কোন পুঁজিপতি না চায়? তিনি যতই ধর্মনিরপেক্ষ হন না কেন।

আবার এই পরিবর্তনগুলির প্রভাবে সমাজে মাত্রাবিভক্ত অসাম্যের পরিমাণবৃদ্ধি হিন্দুত্ববাদকে সাহায্য করবে। এই নীতি শিক্ষায় সামাজিক ন্যায়ার্জনের ক্ষেত্রে এক বড় ধাক্কা। বামপন্থী, দলিত এবং মহিলা আন্দোলন দ্বারা অর্জিত বহু জয়কে এক কলমের খোঁচায় নাকচ করে এই দস্তুর। ভাগ ৮.২তে দেওয়া “আর্থ সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠী”-র (Socio-Economically Disadvantaged Groups) সংজ্ঞা এখানে লক্ষণীয়। লিঙ্গকে কেবলমাত্র পরিচিতির (identity) আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, অর্থাৎ লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনার জটিলতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বর্ণব্যবস্থার জটিল বিন্যাসকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র তফসিলি জাতির অন্তর্ভুক্তির কথা রাখা হচ্ছে। “দলিত” ও “শ্রেণি” শব্দ দুটি, যার বিশ্লেষণার্থে উপযোগিতা ছাড়াও গভীর রাজনৈতিক নিহিতার্থ আছে, এখানে চোখে পড়ে না। সামগ্রিকভাবে ২০২০-র এই নতুন পরিকাঠামো উচ্চশ্রেণি ও উচ্চবর্ণের নব্য-একত্রীকরণ সম্ভবপর করে তুলবে, যা কিনা এক মনুবাদী ভারত নির্মাণের আদর্শ উপযোগ।

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4645 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...