কপিলা বাৎস্যায়ন: ভারতীয় সংস্কৃতির চতুষ্কোণ এবং বৃত্ত

রাজশ্রী মুখোপাধ্যায়

 


লেখক শিল্প-ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক ও গবেষক

 

 

 

 

সেটা ২০০২ সালের গোড়ার দিকের কথা। গবেষণার কাজে দিল্লি গিয়েছি। উঠেছি আইআইসি, অর্থাৎ ‘ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার’-এর অতিথিশালায়। দিনদুয়েক সেখানে কাটানোর পর, একদিন প্রাতরাশের সময় সেখানকার এক কর্মচারী এসে বললেন, “ম্যাডাম আপকো বুলা রহি হ্যায়।” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,“কৌন ম্যাডাম?” এবার ভদ্রলোকের অবাক হওয়ার পালা। কপালে হাত ঠেকিয়ে, অত্যন্ত বিস্ময়-সহকারে হিন্দিতে যা বললেন তার মানে দাঁড়ায়— সেকি! আপনি শিল্পকলা নিয়ে গবেষণা করছেন, আর ম্যাডাম কে তা জানেন না?! সেদিনই জানলাম, শ্রীমতী কপিলা বাৎস্যায়ন রাজধানী দিল্লি এবং দেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক আঙ্গিনায় ‘ম্যাডাম’ নামে পরিচিত। বাকিদের নামের সঙ্গে ম্যাডাম বলা হয়— অমুক ম্যাডাম, তমুক ম্যাডাম। কিন্তু শুধু ম্যাডাম মানে তিনি। একমাত্র তিনিই। ভারতীয় সংস্কৃতিজগতের অবিসংবাদী সম্রাজ্ঞী, সংস্কৃতির ক্ষমতা-অলিন্দের শীর্ষবিন্দু।

যে ভাবে সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীদের নিয়ে যাওয়া হয় সর্বোচ্চ ক্ষমতার কাছে, আমিও গুটিগুটি পায়ে গেলাম তাঁর অফিসে। গিয়ে দেখি, তসরের শাড়ি পরা, শুভ্রকেশ এক বর্ষীয়ান মহিলা। প্রায় দিদিমা-সুলভ হাসি হেসে বসতে বললেন। তারপর শুরু হল আলাপচারিতা। বললেন, “শুনলাম কলকাতা থেকে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে এসেছে, তাই কৌতূহল হল।” খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন, কোথায় পড়াশোনা করেছি, গবেষণার বিষয় কী।  এশিয়াটিক সোসাইটি-র ফেলো শুনে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। এশিয়াটিক সোসাইটি, শান্তিনিকেতন— নানা দিক ছুঁয়ে কথা এগোল। পরামর্শ দিলেন, কীভাবে গবেষণার কাজকে প্রসারিত করতে পারি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আইজিএনসিএ-তে (ইন্দিরা গান্ধি সেন্টার ফর আর্টস) গেছি কিনা, সেখানকার লাইব্রেরি ব্যবহার করেছি কিনা, জানতে চাইলেন। প্রায় আধঘন্টা কথাবার্তা আর এক কাপ চায়ের পর কপিলাজি জানালেন, এবার তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। মিটিং আছে। বললেন, “শুধু কলকাতায় রিসার্চ করলে হবে না। দিল্লি এসো। আইজিএনসিএ-তে কাজ করো। তোমাদের মতো উদ্যমী নবীনাদের সেখানে দরকার।”

আইজিএনসিএ-র রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে আনন্দ কুমারস্বামীর জীবনীকার রজার লিপসির সঙ্গে

কপিলাজির সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা পরের বছরেই, খাস কলকাতায়। ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর। ভারতীয় শিল্প-ইতিহাস কংগ্রেস-এর অধিবেশনে কেডি বাজপেয়ী স্মারক বক্তৃতা দিতে এসেছেন। বিষয় ছিল তাঁর প্রিয় ‘গীতগোবিন্দ – সাহিত্য থেকে শিল্পকলায় রূপান্তর’। শ্রোতাদের একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন তাঁর বাগ্মিতায়, ওজস্বিতায়। প্রতিপাদ্য বিষয় উপস্থাপন করতে গিয়ে এমন কিছু ভাবনা ছুড়ে দিলেন, যেগুলি আলাদাভাবে প্রতিসরণ করলে এক-একটি বই হয়ে দাঁড়াবে! সেবার অবশ্য অত লোকের ভিড়ে কথা হয়নি। কিন্তু একঝলক দেখে পরিচিতার হাসি হেসেছিলেন। আমার পক্ষে সেটুকুই ছিল যথেষ্টর চেয়েও বেশি।

তৃতীয় এবং শেষবার দেখা তার ১০ বছর পরে, ২০১৩ সালে। আইজিএনসিএ-র ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আনন্দ কুমারস্বামীকে নিয়ে গোলটেবিলে বৈঠক। এশিয়াটিক সোসাইটি-র প্রতিনিধি হিসেবে আমি গিয়েছি। দেখেই বলে উঠলেন, “তোমার মুখটা খুব চেনা লাগছে। কোথায় যেন আগে দেখেছি…” আমি হেসে মনে করিয়ে দিলাম সেই প্রথম সাক্ষাতের কথা। “ঠিক ঠিক”, বলে পিঠে স্নেহের হাত রাখলেন। বদমেজাজি বলে দুর্নাম শুনেছি লোকমুখে, কিন্তু আমার সেই মেজাজ দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনওটাই হয়নি। বরং তাঁকে তাঁর নিজস্ব রূপে দেখলাম সেবার। আশির কোঠায় বয়েস তখন, কিন্তু তবু অনলস উদ্যোক্তা! সেই “ম্যাডাম,  ম্যাডাম” গুঞ্জন চারদিকে। বসে বসে শ্যেনদৃষ্টিতে সবকিছুর তত্ত্বাবধান করছেন। পান থেকে যেন চুন না খসে। সবাই তটস্থ! আবার আলোচনার সময় অতিথি-বক্তাদের আভিজাত্যপূর্ণ আমন্ত্রণ, নিজের বক্তব্য রাখার সময় সেই প্রখর যুক্তিবিন্যাস! তাঁর মৃত্যুর মোটে সাত বছর আগে! ভাবলেও বিস্ময় জাগে— কী প্রবল প্রাণশক্তি!

দূরদর্শনের প্রাক্তন ডিজি বিজয়লক্ষ্মী ছাবড়া এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পারুল পান্ড্য ধরের সঙ্গে

১৯২৮-এ পঞ্জাবি আর্যসমাজি পরিবারে তাঁর জন্ম। তারপর বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতনে ভারতীয় নৃত্যকলা ও সংস্কৃতির নিবিড় পাঠগ্রহণ। পরবর্তীকালে কত্থকের তালিম নেন অছ্ছন মহারাজের কাছে, মণিপুরি শেখেন গুরু অমোবি সিংয়ের কাছে, এবং ভরতনাট্যম কলাক্ষেত্র শৈলীর এসপি ললিতা আর মীনাক্ষী সুন্দরম পিল্লাইয়ের কাছে। যেমন নাচের ক্ষেত্রে, তেমন বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেও দিক্‌পালদের পেয়েছিলেন গুরু হিসাবে। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ ও শিল্পকলাবিশেষজ্ঞ বাসুদেব শরণ আগরওয়ালের কাছে। বিষয় ছিল, ‘সাহিত্য ও শিল্পকলায় ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য’। সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত এই বই, এক ক্রান্তদর্শী গবেষণা। বৌদ্ধিক পর্যবেক্ষণ ও শৈল্পিক অনুভবের মিলিত ফসল। মন্দিরগাত্রে খোদিত নৃত্যভাস্কর্য নিয়ে সেটিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ গবেষণা, যা পরবর্তীকালে ভারতীয় নৃত্য-আঙ্গিক, নৃত্য-দর্শন এবং নৃত্যশৈলীর ক্রমবিকাশ নিয়ে চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। এই বইটি একইসঙ্গে দৃশ্যকলা ও নৃত্যকলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে এক অমূল্য সংযোজন।

তত্ত্ব ও প্রয়োগের এই মেলবন্ধন চলেছে তাঁর সমগ্র জীবন ধরে। কপিলা ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই বহুমুখী প্রতিভা। কী না করেছেন জীবনে! স্বাধীনতারও আগে, ১৯৪৫-এ ফিরোজ শাহ কোটলা ময়দানে প্রথম নৃত্যউৎসবে কত্থক পরিবেশন করেছেন, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের উচ্চপদে প্রশাসকের দায়িত্ব সামলেছেন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা-কর্ণধার ছিলেন, আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন, বিরজু মহারাজ ও বালা সরস্বতীর মতো শিল্পীদের আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরেছেন, মায় রাজ্যসভার সদস্যও হয়েছেন। দীর্ঘদিনব্যাপী এই সুবৃহৎ ও বিচিত্রগামী কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১ সালে পদ্মবিভূষণ উপাধি লাভ করেন কপিলা।

এবার আসি তাঁর লেখা বইয়ের প্রসঙ্গে। কপিলার লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ ও বইয়ের মধ্যে যে দুটি প্রধান বিষয়ের অভিনিবেশ দেখতে পাই, তা হল গীতগোবিন্দ আর ভরতের নাট্যশাস্ত্র। তিনি মনে করতেন, ভারতীয় শিল্পতত্ত্ব ও সৌন্দর্যতত্ত্বের ভিত্তি হল এই দুই আকর গ্রন্থ। এ দুটির গভীর অধ্যয়ন প্রয়োজন। তাঁর কথায়, “দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর-পূর্ব মণিপুর— সব জায়গায় শিল্পীদের মধ্যে গীতগোবিন্দের চর্চা দেখেছি। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে ক্ষেত্রসমীক্ষার ফলস্বরূপ ছ বাক্স বোঝাই গবেষণার উপাদান নিয়ে দিল্লি ফিরেছি। যেখানেই গিয়েছি, দেখেছি, “ললিত লবঙ্গলতা” পদ সবাই জানেন। কিন্তু কী অপূর্ব বিভিন্নতায় ভরা তার আঞ্চলিক প্রকাশ! একইভাবে, নাট্যশাস্ত্রে আলোচিত ‘রস’ আর ‘ভাব’ হল সঙ্গীত-দৃশ্যকলা-নৃত্যকলা-নাট্যকলা ইত্যাদি সব কিছুরই ভিত্তি। তাই ভারতীয় সংস্কৃতির অন্তরাত্মাকে অনুধাবন করতে গেলে, এই দুই গ্রন্থের তন্নিষ্ঠ পাঠ আবশ্যিক।”

কপিলা বাৎস্যায়ন নানা ধরনের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রতীক ছিলেন। একদিকে বহির্বিশ্বে ভারতীয় সাংস্কৃতিক কূটনীতির প্রতিনিধিত্ব করতেন, অন্যদিকে সংস্কৃতির নানা আঞ্চলিক উপাদান, লেখক, বইপুথির খোঁজ রাখতেন। বিদেশি অধ্যাপক-গবেষকদের পাশাপাশি দেশীয় গবেষণার ব্যাপারেও ছিলেন সমান উৎসাহী— ওডিশার কেদারনাথ মহাপাত্র বা বাংলার শশীভূষণ দাশগুপ্তর কাজ সম্পর্কে গভীরভাবে অবহিত ছিলেন। দাশগুপ্ত মশাইয়ের “শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ”-এর কথা একবার উল্লেখ করেছিলেন কোনও একটি প্রসঙ্গে।

শেষের দিকে লেখা বইগুলির পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কপিলার চিন্তাভাবনা ক্রমশ প্রাচীন শাস্ত্র ছেড়ে সমকালীন সমাজসংস্কৃতিকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। প্রশাসনের অভিজ্ঞতার ছায়া পড়েছে লেখায়। যেমন “প্লুরাল কালচার্‌স অ্যান্ড মনোলিথিক স্ট্রাকচারস”— বহুস্তর সংস্কৃতি এবং একমুখী প্রতিষ্ঠান। এখানে তিনি জীবনসায়াহ্নে নিজের কাজের অভিজ্ঞতাকে অণুবীক্ষণের তলায় ফেলে দেখার চেষ্টা করেছেন। ভারতবর্ষের মতো নানা ভাষা-সংস্কৃতির দেশ যখন রাষ্ট্রনীতির একদেশদর্শিতা ও একমাত্রিকতার মুখোমুখি হয়, তখন সমাজের হৃদয়পুরে যে জটিলতার খেলা চলে তার সুগভীর ও যুক্তিনিষ্ঠ উন্মোচন করেছেন এই বইয়ে। তাঁর শেষ বই সম্ভবত ২০১৮-তে প্রকাশিত “রোল অফ কালচার ইন ডেভেলপমেন্ট”। স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি সংস্কৃতি সঙ্গে উন্নয়নের সমীকরণ বুঝতে চেয়েছেন প্রথমজীবনের শাস্ত্রপাঠ, এবং পরবর্তীকালের ভ্রমণ, নানাবিধ বিনিময় ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার নির্যাসের আলোকে।

কপিলার মৃত্যুতে সবাই আন্তরিক শোক প্রকাশ করেছেন। সত্যি, তাঁর স্থান অপূরণীয়। কিন্তু তাঁর মৃত্যু আমার কাছে দুঃখের নয়, উদ্‌যাপনের। অমর কে কোথা কবে? বরং, তিনি এক পরিপূর্ণ জীবন যাপন করে, অসাধারণ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে গিয়েছেন। তীব্রভাবে বেঁচেছেন, প্রবলভাবে কাজ করেছেন আর আমাদের জন্য বিপুল উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছেন। কী সেই উত্তরাধিকার? তা কেবল তাঁর লেখা গ্রন্থসম্ভার, বক্তৃতার রেকর্ডিং বা তাঁর হাতে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলি নয়। তিনি রেখে গিয়েছেন এক সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের মানসিকতা— বিশ্লেষণী গ্রহণের মানসিকতা। সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, বহুস্তর ও বহুমাত্রিক গবেষণা, প্রাচীনকে নতুনের আলোকে পুনরাবিষ্কার, বিভিন্ন বিষয়ের আন্তর-সম্পর্কের খোঁজ, নতুন প্রেক্ষাপটের সন্ধান। তাঁর এই মৌলিক, স্বকীয়, সমন্বয়ী ভাবনার জন্য ইউনেস্কো, ইউএনডিপি-র মতো বিশ্ব সংস্থা তাঁকে তাঁদের উপদেষ্টার সম্মাননীয় পদ দিয়ে ধন্য হয়েছে।

“ভারতীয় শিল্পকলায় চতুষ্কোণ এবং বৃত্ত” গ্রন্থটি কপিলার অন্যতম সেরা কাজ, যেখানে তিনি নাট্য-স্থাপত্য-ভাস্কর্য-সঙ্গীতের আন্তর-সম্পর্কের অনুসন্ধান করেছেন তা-ই নয়— বৃত্ত ও চতুষ্কোণের মতো জ্যামিতিক চিহ্নর মাধ্যমে গণিতবিদ্যা ও শিল্পকলার সেতু খুঁজেছেন। ভারতীয় নৃত্যে পটিয়সী হয়েও পাশ্চাত্য নৃত্যকলার তালিম নিয়েছেন হুয়ানা ডি লাবান আর হানিয়া হোমের কাছে।

কপিলা, আমার কাছে তাই এক সাংস্কৃতিক সেতুর নাম। ভারতের বহুধাবিভক্ত সংস্কৃতির বিভিন্নতার ঐতিহ্যটি আজ যখন নানা সঙ্কটের মুখে, এই সময়ে কপিলার উত্তরাধিকার ও তাঁর ভাবনার ধারা বিশেষভাবে স্মরণ করা ও তাঁর ভাবনাকে অনুসরণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

 

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4418 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...