বিদ্যাসাগর : ব্যক্তিস্বরূপের অনন্যতা

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

 


লেখক প্রাচীন ভারতীয় বস্তুবাদী দর্শন বিশেষত চার্বাক/লোকায়ত দর্শন বিশেষজ্ঞ। বিশিষ্ট তাত্ত্বিক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

 

 

বিদ্যাসাগরকে নিয়ে যতজন যতকিছু লিখেছেন, বিশেষ করে যাঁরা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন— সেগুলির নিশ্চয়ই কমবেশি মূল্য আছে। কিন্তু একটি ব্যাপার নজরে না পড়ে যায় না। সেটি এই: বিদ্যাসাগরের দয়া মায়া দান দাক্ষিণ্য ইত্যাদি সে সব লেখায় যতটা বড়, আর কিছু ততটা নয়। শিবনাথ শাস্ত্রীর (১৮৪৭-১৯১৯) বিদ্যাসাগর স্মারক বক্তৃতা (১৩০৫ ব.) সেদিক থেকে একটু আলাদাই। সেখানে প্রধান হয়ে ওঠে বিদ্যাসাগরের মনন-এর দিক। যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ থেকে একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে শিবনাথ শাস্ত্রী বলেন:

মনন শব্দের অর্থ মনের ক্রিয়া বা ব্যাপার। লুতাতন্তুর ন্যায় অথবা ক্ষৌমকীটের ক্ষৌমকোষের ন্যায় মন সর্ব্বদাই কিছু বুনিতেছে; আপনার অন্তর্নিহিত জ্ঞান-সামগ্রী সকলের সাহায্যে সর্ব্বদাই নব নব আদর্শ রচনা করিতেছে; মনের এই যে অবিশ্রান্ত গঠন কার্য্য ইহার নাম মনন। (১৯৯১, পৃঃ ১৭)

মাকড়সার জাল বোনা আর গুটিপোকার কাজের সঙ্গে মনের অবিরাম গড়ে-চলার এই তুলনা খুবই সার্থক। শিবনাথ বলেন, “মানুষের যেন দুইটা জীবন আছে, এক দেহরাজ্যে, আর এক এই মননরাজ্যে।” বিদ্যাসাগরের সমস্ত কাজই ছিল এই মননরাজ্যে। আর দশজন মানুষের মতো বিদ্যাসাগরেরও মনে সর্বদাই একটা ‘অতৃপ্তি’ ছিল। যেমন অতৃপ্তি সব মানুষের থাকে: যা পাই তার চেয়ে আরও বেশি চাই। অন্য দশজনের মধ্যে এই অতৃপ্তি ছাইঢাকা আগুনের মতো লুকিয়ে থাকে; উশকে দিলে তবে সেটি দেখা দেয়। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মতো ‘সমাজসংস্কারকদের হৃদয়ে সেটি ঘনীভূত আকারে প্রকাশ পায়; এই অতৃপ্তি নর-প্রেমের সহিত মিলিত হইয়া তাহাদিগকে ঘোর দুঃখে নিমগ্ন করে।’

এছাড়া আরও একটি বিষয়ে অন্য দশজনের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতো মানুষদের তফাত থাকে: “আমাদের অতৃপ্তি অনেক সময়ে দরিদ্রের মনোরথের [ইচ্ছার] ন্যায় হৃদয়ে উদয় হইয়াই লয় প্রাপ্ত হয়; কিন্তু নির্ম্মলচিত্ত মহামনা ব্যক্তিদিগের অন্তরে তাহা স্থায়ী ফল প্রসব করে। তাঁহারা এই অতৃপ্তি লইয়া বসিয়া থাকেন না; মননশক্তির বলে ভবিষ্যতের ছবি গড়িতে থাকেন।” এই ছবি, মননদৃষ্টিতে যা দেখা, সেই vision-ই তাঁদের কাছে সত্য। বর্তমানের হীনতা তাঁরা বেমালুম ভুলে যান।

চক্ষু যেমন আকাশে বিস্তৃত পদার্থকে দর্শন করে তাঁহারাও ইহাকে [তাঁদের কল্পিত সেই ভবিষ্যতের ছবিকে] সেইরূপ উজ্জ্বলভাবে দর্শন করিয়া থাকেন। ইহা তাঁহাদের ধ্যান জ্ঞানে প্রবেশ করে ও হৃদয়কে জাগ্রত করে; তাঁহাদের চিত্তকে সিক্ত ও আপ্লুত করে; তাঁহাদের কল্পনাকে উত্তেজিত করে ও হৃদয়কে জাগ্রত করে।

শিবনাথ আরও একটি বিশেষ লক্ষণের কথা বলেছেন। সেটি ধর্ম ও সমাজসংস্কারকদের স্বধর্ম। ‘নিজ মননগঠিত আদর্শে অনুরাগ।’ নাম না করে তিনি গ্রীক পুরাকাহিনীর ভাস্কর, পিগম্যালিয়ন-এর দৃষ্টান্ত দেন। তিনি এমন একটি নারী মূর্তি পাথরে খোদাই করেছিলেন যে নিজেই সেটির প্রেমে পড়ে যান। দেবতারা তাই দয়া করে সেই মূর্তিটিকে প্রাণবন্ত করে তাঁকে উপহার দেন। শিবনাথ বলেন: “মানুষ আপনার মনন-শক্তির দ্বারা যে ছবি বা যে আদর্শ সমুৎপন্ন করে, তাহাতে এমন আসক্ত হয় যে জীবনকে জীবন জ্ঞান করে না।” দৃষ্টান্ত হিসেবে শিবনাথ বেছে নিয়েছেন ফরাসি-বিদ্রোহ (১৭৮৯)-র অধিনায়কদের। সাম্য-র প্রতি লক্ষ্য রেখে তাঁরা যেন ‘ক্ষিপ্ত’ হয়ে উঠেছিলেন। তার বদলে যদি অসাম্য তাঁদের লক্ষ্য হতো তাহলে কি তাঁরা এমন খেপে উঠতে পারতেন? মহৎ আদর্শের প্রেরণাই এই মননশীল ব্যক্তিদের ‘বাতুল’ করে তোলে। “বর্ত্তমান সময়ে [১৮৯৮] ইউরোপ ও আমেরিকার সভ্য দেশ সকলে ভূমিকম্পের ন্যায় যে ঘন ঘন সমাজকম্প হইতেছে, এবং ধনী দরিদ্র, রাজা প্রজাতে যে ঘোর বিদ্রোহ চলিতেছে, সেখানেও মানুষের দৃষ্টি সত্য, ন্যায়, প্রেম প্রভৃতির প্রতিষ্ঠার দিকে নিবদ্ধ রহিয়াছে।”

তাহলে শিবনাথ যে তিনটি গুণের কথা বললেন— বর্তমানে অতৃপ্তি, ভবিষ্যৎ রচনা ও নিজ আদর্শে আসক্তি— এই তিনটির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক কী? শিবনাথ মনে করেন: এই তিনটি বিষয় ‘যাহা মানব-প্রকৃতির গভীর রহস্য এবং যাহা মানব-প্রকৃতির মুখপাত্র স্বরূপ প্রত্যেক মহাজনে’র মধ্যে দেখা যায় সেটি বিদ্যাসাগরের মধ্যে ‘পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল।’ অর্থাৎ ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারকদের সম্পর্কে তিনটি সাধারণ লক্ষণের কথা বলে শিবনাথ বিশেষ করে বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গে এসেছেন। এখানে কোথাও বিদ্যাসাগরের ‘রোদন-প্রবণতা’— যখন তখন চোখের জল ফেলা— আসল কথা নয়। বিদ্যাসাগরের স্বভাব প্রসঙ্গে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯) এই রোদন-প্রবণতার কথা বলেছেন; স্বভাবতই বাল্মীকি রামায়ণ ও ভবভূতি-র উত্তররামচরিত নাটকের রামের সঙ্গে তাঁর মিলও দেখিয়েছেন (১৯৯১, পৃঃ ৯১)। একে তিনি বলেছেন: “তাঁহার চরিত্রের একটা বিশেষ লক্ষণ: এইখানেই বিদ্যাসাগরের অসাধারণত্ব। এইখানেই তাঁহার প্রাচ্যত্ব।” শিবনাথ কিন্তু এই দিকটির ওপর তত জোর দেন নি। তিনি বরং মনে করেন: “[বিদ্যাসাগর] হৃদয়ে যে ছবি দেখিতেন ও অন্তরের অন্তরে যাহা চাহিতেন, তাহার সহিত তুলনাতে বর্তমানকে তাঁহার এতই হীন বোধ হইত, যে, বর্তমানের বিষয় কথা উপস্থিত হইলে তিনি সহিষ্ণুতা হারাইতেন।” এর একটি দৃষ্টান্তও দিয়েছেন তিনি:

তাঁহার জীবনের শেষ ভাগে যখন আর তাঁহার পূর্বের ন্যায় খাটিবার শক্তি ছিল না, তখন এই অতৃপ্তি ভূগর্ভশায়ী প্রদীপ্ত অনলের ন্যায় তাঁহার অন্তরে বাস করিতেছিল; প্রসঙ্গ উপস্থিত হইলেই ঐ অনল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ন্যায় জ্বালা রাশি প্রকাশ করিত। তাঁহার কোমল ও পরদুঃখকাতর হৃদয়ে বর্তমান সমাজের অসারতা কৃত্রিমতা ও অসাধুতা এতই আঘাত করিত যে, বৃশ্চিক দর্শনের ন্যায় তাঁহাকে যাতনাতে অস্থির করিয়া তুলিত।

শিবনাথ যেসব উপমা প্রয়োগ করেছেন সেগুলি বিশেষ করে খেয়াল করার মতো। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, বিছের কামড়— এগুলি নেহাত কথার কথা নয়। বিদ্যাসাগরকে বোঝার ক্ষমতা যাঁদের ছিল না— এখনই বা কজনের আছে?— তাঁরা মনে করতেন: মানবপ্রেমিক থেকে বিদ্যাসাগর মানববিদ্বেষী হয়ে গেছেন। আসলে কোন জ্বালা থেকে অমন ধিক্কার দিতেন সেটিই তাঁরা বোঝেন নি, যেমন বুঝেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। আট-ন বছর বয়স থেকে তিনি বিদ্যাসাগরকে দেখেছিলেন, বিনা ছেদে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত (১৮৯১)। ১৮৯৮-এ তিনি লেখেন: “সেই দিন হইতে আমি তাঁহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিতেছি, এমন সোজা পথে চলিবার মানুষ আমি অল্পই দেখিয়াছি। আমি তাঁহার অত্যুজ্জ্বল গুণাবলীর পার্শ্বে দুই একটা উৎকট দোষও দেখিয়াছি; কিন্তু সেই তেজঃপুঞ্জ চরিত্রের সোজা পথে চলা যখন স্মরণ করি, তখন আর কোনও দোষের কথা মনে থাকে না; বলি, হায়! হায়! এমন মানুষ আবার কতদিনে পাইব?”

বক্তৃতার শেষ দিকে শিবনাথ আবার একই প্রসঙ্গে ফিরে গেছেন:

এইজন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ভালোবাসিতাম যে, তাঁহাতে তাজা খাঁটি, ষোল আনা মানুষটি পাইতাম। তাঁহার সকল বৃত্তিই সতেজ ও উৎকট ছিল, ভালোবাসাটাও উৎকট, বিদ্বেষটাও উৎকট।

পরেও তিনি লিখেছেন:

তেমন তাজা মানুষ আর দেখিব না। তিনি তাঁর কোনো প্রবৃত্তিকেই যেন কখনও রোধ করেন নাই; সকলেই পূর্ণ মাত্রায় বাড়িয়াছিল। নিকটে গেলেই দোষে গুণে জড়িত আসল মানুষটি দেখিতাম। এইজন্যই তাঁহার চরিত্র চিন্তা করিতে ভালো লাগে।

 

আগেই বলেছি, বিদ্যাসাগর সম্পর্কে তাঁর পরিচিত ব্যক্তিরা যা লিখে গেছেন নিঃসন্দেহে সেগুলির মূল্য আছে। কিন্তু শিবনাথ শাস্ত্রীর বক্তৃতাটি সব দিক থেকেই অনবদ্য। বিদ্যাসাগরকে তিনি যেভাবে দেখেছেন আর কেউ কিন্তু তাঁকে এই মননের মূর্তি রূপে দেখেননি, দেখাননি। অনেকেই যেভাবে বিদ্যাসাগরকে শুধুই অসামান্য হৃদয়বান হিসেবে দেখাতে ব্যস্ত থাকেন, তাতে সন্দেহ হয়: বিদ্যাসাগরের স্বরূপকে আড়াল করাই যেন তাঁদের আসল উদ্দেশ্য। আর যাঁরা বিদ্যাসাগরকে হেয় করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন (এখনও তাঁদের উত্তরাধিকারীরা বহাল তবিয়তে আছেন) তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলতে প্রবৃত্তি হয় না।

 

শিবনাথ লিখেছেন: “[বিদ্যাসাগরের] যৌবনকালে কলকাতার কি ভয়ানক অবস্থা ছিল! আমরা বাল্যকালে এই কলিকাতা শহরকে যাহা দেখিয়াছি, তাহা এখন স্মরণ করিতেও হৃদয় কম্পিত হয়।” তার এত বছর পরে কলকাতা নিশ্চয়ই অনেক পাল্টেছে কিন্তু খুব বেশি পাল্টেছে কি?

সেই পাপপঙ্ক যদি বিদ্যাসাগরকে সেদিন স্পর্শ না করে থাকে, আজও আশা করি, নিন্দাপঙ্কও তা করবে না।

 

  • শিবনাথ শাস্ত্রী ও রামেন্দ্রসুন্দর রচনা দুটি বিমান বসু সম্পাদিত ‘প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর’, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতি, ১৯৯১-এর যথাক্রমে পৃঃ ১৭-৩০ এবং পৃঃ ৮৪-৯৫ থেকে উদ্ধৃত।
  • কৃতজ্ঞতা স্বীকার: শ্যামল চট্টোপাধ্যায়, পার্থসারথি মিত্র, সিদ্ধার্থ দত্ত।
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...