যে যেখানে লড়ে যায়….

শতাব্দী দাশ

 


লেখক শিক্ষক, গদ্যকার, সমাজকর্মী

 

 

 

পশ্চিম পোল্যান্ডের পোজনান ক্যাথিড্রাল। রবিবারের পুণ্য প্রার্থনা-লগ্ন। চার্চের আপাত প্রশান্তিতে দাঁড়িয়ে ঠাহর করা মুশকিল, শহর জুড়ে জ্বলছে আগুন। হঠাৎ… সেই গির্জাতেও আগুন ঢুকে আসছে। ঢুকে আসছেন প্রতিবাদীরা। মূলত তাঁরা নারী। তাঁদের পরনে লাল জোব্বা, মাথায় সাদা আবরণী। পোশাক দেখলে মনে পড়ে যাবে অ্যাটউডের সেই ডিস্টোপিয়া-টির কথা, ‘দ্য হ্যান্ডমেডস টেইল’; সেই অন্ধকার কল্পজগতের মেয়েদের কথা মনে পড়ে যাবে। প্রসঙ্গত, হ্যাশট্যাগ #piekłokobiet হল সমাজমাধ্যমে এই আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদের অন্যতম ভাষা, যার অর্থ ‘নারীর জন্য নরক’।

পোল্যান্ডকে নরক তথা ডিস্টোপিয়া হয়ে ওঠা থেকে রক্ষা করতেই যেন চার্চে ঢুকে নির্ভীক প্রতিবাদীরা বলছেন, ‘গর্ভপাতের অধিকার চাই ক্যাথলিকের জন্যও’, বলছেন ‘অনেক হয়েছে, আর নয়।’ তাঁরা পোশাকে, প্লাকার্ডে, পোস্টারে ধারণ করছেন লাল এক বজ্র। তা প্রতিরোধের চিহ্ন।

পোল্যান্ডের গর্ভপাত আইন কঠোর ছিলই আগে থেকেই। তদুপরি ২২শে অক্টোবর, ২০২০ সালে আদালতের রায় অনুসারে ভ্রূণে বিকৃতিজনিত কারণে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হল সে দেশে৷ আগে তিনটি কারণে বৈধভাবে গর্ভপাত করা যেত পোল্যান্ডে। ১) যদি মায়ের জীবনহানির সম্ভাবনা থাকে, ২).যদি ধর্ষণ বা অজাচার ঘটে থাকে এবং ৩) যদি ভ্রূণে কোনও বিকৃতি থাকে। এই তৃতীয় কারণটি বাতিল হল ২২ তারিখের রায়ে। অথচ কার্যক্ষেত্রে, পোল্যান্ডে সরকারি হিসেবে বাৎসরিক যে সংখ্যায় গর্ভপাত হয়, তার মধ্যে আবার ৯৮ শতাংশ গর্ভপাতই ঘটত ওই তৃতীয় কারণে। সুতরাং ওই তৃতীয় কারণটিকে অবৈধ ঘোষণা করা মানে প্রায় গর্ভপাতেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা, এমনটাই মনে করছেন অনেকে।

নতুন আইনটি কার্যকরী হওয়ার আগেই, অনেক হাসপাতাল ভয়ে ওই তৃতীয় ধরনের গর্ভপাত বন্ধ করে দিয়েছে। পূর্বনির্ধারিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল হচ্ছে৷

নারীবাদী কর্মীরা বলছেন, ভ্রূণকে আইনের ভাষায় ‘গর্ভস্থ শিশু’  বলা হচ্ছে, অথচ নারীকে মতামতহীন অণ্ড-স্ফুটন যন্ত্র ধরে নেওয়া হচ্ছে! তাঁরা বলছেন, পোলিশ সংবিধান কি নারীকে স্বাস্থ্যের অধিকার, ব্যক্তিগত জীবনের অধিকার, ও সমতার অধিকার দেয় না?

নারীকে অসুস্থ শিশু জন্ম দিতে বাধ্য করা, এমনকি যে কোনও শিশুই জন্ম দিতে বাধ্য করা তার নিজ শরীরের উপর অধিকারের পরিপন্থী। ‘নো ইউটেরাস, নো ওপিনিয়ন’ ছিল দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদের স্লোগান।

দ্বিতীয় তরঙ্গ বলত, যেহেতু নারীই দশ মাস শিশুকে গর্ভে ধারণ করেন এবং তারপর সন্তান-প্রতিপালনের দায়িত্বও সামাজিকভাবে মূলত মায়ের উপরেই ন্যস্ত হয়, তাই কখন তিনি মা হবেন, কোন পরিস্থিতিতে মা হবেন না, আদৌ মা হতে চান কিনা— তা স্থির করার অধিকার একমাত্র তাঁরই থাকা উচিত।

অতটা কট্টরপন্থী না হলেও, পোল্যান্ডের আন্দোলন বলছে, নারী ও তার পুরুষ সঙ্গীটির বড়জোর অধিকার থাকুক ভ্রূণের জন্মদান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কারণ অসুস্থ শিশুর প্রতিপালনের ভার ভবিষ্যতে নিতে হবে তাদেরই।

কেন এই অতিমারির সময়েই পোল্যান্ডের চরম দক্ষিণপন্থী সরকারটি আদালতকে এমন আইন প্রণয়ন করতে দিল? তারা কি ভেবেছিল জমায়েতে বাধা থাকায় মারীর সময়ে এ নিয়ে কোনও প্রতিবাদ হবে না? পোল্যান্ডবাসী তাদের ভুল প্রমাণ করেছে।

********

ধর্মীয় বিধি চাপিয়ে গর্ভপাতকে নিষিদ্ধ দেগে দেওয়ার প্রবণতা যে আসে নারীকে সন্তানধারণের যন্ত্র মাত্র ভাবার সামাজিক বদভ্যাস থেকে, তা বলাই বাহুল্য। পিতৃতন্ত্রের এমনই প্রভাব যে নারী নিজেও তাঁর মা হওয়ার ক্ষমতা নিয়ে গৌরব করে। কিন্তু অন্যদিকে অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্খিত সন্তান তো এসেই যায়। এসে যেত অতীতেও। তখন লুকিয়ে হাতুড়ে পদ্ধতিতে গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে প্রাণ দিতেন অনেকে। অথবা জন্ম দিতে বাধ্য হলেও সেই শিশুকে পরিত্যাগ করতে হতেন কুন্তীর মতো। কোনও নারীবাদী যদি ‘মহাভারত’-এ শান্তনু-জায়া গঙ্গার সাতবার সন্তান-বিসর্জনের ঘটনাকে তথা অষ্টমবার শান্তনু বাধা দিতে এলে গঙ্গা কর্তৃক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘটনাকে বিনির্মাণ করেন, তাহলে তিনি ‘মাতৃত্ব আবশ্যিক নয়, বরং একটি চয়েস’— এই মতের সপক্ষে উপাদান সংগ্রহ করতে পারবেন হয়ত মহাকাব্য থেকেই ৷ (অষ্টবসুর কাহিনি ভুলে যাওয়া হচ্ছে না, কিন্তু পুরাণের ‘বিনির্মাণ’ তো হয়েই থাকে আধুনিক কালে।)

যাইহোক,  ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, পর্তুগালের মতো ঔপনিবেশিক দেশগুলি তাদের গর্ভপাত-বিরোধী আইন চালু করেছিল নিজেদের উপনিবেশগুলিতেও৷

সর্বপ্রথম গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন সংস্কার করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯২০ সালে৷ এ’ঘটনা সম্ভব হয়েছিল, কারণ সোভিয়েত দেশ তখন সমাজতন্ত্র। বিংশ শতকের শেষ দিকে প্রায় ৯৮ শতাংশ রাষ্ট্রেই গর্ভপাত নানা শর্তসাপেক্ষে আইনি হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু একশো বছরের লড়াই-এর পর ‘কন্ট্রাসেপটিভ’-এর ব্যবহার যেমন আজ সমগ্র বিশ্বেই স্বীকৃত, তেমনটা গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ঘটতে এখনও বাকি আছে। এখনও বেশ কিছু দেশে গর্ভপাতের অধিকার আদায়ের লড়াই চলছে। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশে কুড়ি সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাতে কোনও অনুমতিও লাগে না৷ একুশ সপ্তাহ থেকে মাকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয় গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে (ভারতের গর্ভপাত আইন, ১৯৭১, অনুযায়ী)। ক্যাথলিক দেশ আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাত নিয়ে গোঁড়ামির শিকার হয়ে ২০১২ সালে মারা গেছিলেন ভারতীয় দন্ত-চিকিৎসক সবিতা হলপ্পানভর, তা নিশ্চয় আমরা ভুলিনি। সেদেশে অনেক টানাপোড়েনের পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে গর্ভপাত বিষয়ক নতুন বিল পাশ হয়। আন্দোলন এখনও চলছে।

বস্তুত, গর্ভপাত যদি ওষুধের মাধ্যমে সম্ভব না হয়, যদি সার্জারির মাধ্যমেও তা ঘটাতে হয়, তাহলেও তা অন্যতম নিরাপদ একটি সার্জারি, যদি তা সঠিক পদ্ধতিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের হাতে ঘটে। কিন্তু WHO-র তথ্য অনুসারে, প্রতি ছটি মাতৃ-মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে একটি ঘটে হাতুড়ে পদ্ধতিতে গোপন গর্ভপাতের ফলে। তাই ‘Right to Safe, Legal Abortion’ বিশ্বজুড়ে আন্দোলনের স্লোগান হয়ে উঠেছে। পোল্যান্ডেও সরকারি নথি অনুসারে বাৎসরিক প্রায় ২০০০টি গর্ভপাত মামলার নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু নারীবাদীরা দাবি করছেন, বিদেশে গিয়ে বা দেশেই অবৈধ হাতুড়ে পদ্ধতিতে লুকিয়ে বাৎসরিক প্রায় দু লাখ পোলিশ নারী গর্ভপাত ঘটান। তাই আইন করে গর্ভপাত রোখা যাবে না। বাড়বে শুধু সেই সব নারীর জীবনের ঝুঁকি, যাদের হাতে নেই অর্থ ও সঠিক তথ্য।

********

আশ্চর্য ব্যাপার হল, পোল্যান্ডের ৩ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের মধ্যে যদিও ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ ক্যাথলিক, তবুও বিবিসির সমীক্ষা অনু্যায়ী সিংহভাগ মানুষ এই নতুন আইন সমর্থন করছেন না। নারীবাদীদের মতে, প্রতি চারজন পোল্যান্ডবাসীর তিনজন এই আইনের বিরুদ্ধে। বরং ৬০ শতাংশ পোলিশ গর্ভপাত আইনকে আগের চেয়েও শিথিল করার পক্ষে। ‘এত মানুষের মতামতের কোনও মূল্য নেই? সংসদের নিম্নকক্ষে আলোচিত না হয়েই কোনও আইন কীভাবে কিছু দক্ষিণপন্থী ও শাসকগোষ্ঠীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত বিচারকের দ্বারা আরোপিত হতে পারে?’, প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।

গত বছর শাসকদলের সাংসদরাই পোল্যান্ডের ১৯৯৩ সালের গর্ভপাত আইনের সংশোধনী চেয়ে আদালতে মামলা করেন। আর আদালতেও বেশিরভাগ বিচারকই শাসকদল মনোনীত। তাদের থেকে এ রায় অপ্রত্যাশিত ছিল না। ২০১৬ সালেও গর্ভপাত আইন তুলে দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতায় পথে নেমেছিলেন, ধর্মঘট করেছিলেন নারীরা। নতুন আইন কার্যকর হলে গর্ভপাতের জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হবে নারীর। জেল হবে ডাক্তারেরও। ক্যাথলিক চার্চ আবার এক্ষেত্রে উল্টো সুর গেয়ে বলছে, যদিও তারা গর্ভপাতের ঘোর বিরোধী, কিন্তু নারীর কারাবাসের পক্ষে তারা কখনওই নয়।

এমতাবস্থায়, শাস্তি বা মারির ভয় আন্দোলনকারীদের আটকাতে অপারগ। চলছে লাগাতার ধরপাকড়, গ্রেপ্তারি, মরিচ-স্প্রে। অথচ রাজধানী ওয়ারশ-সহ পোজনান, রোকলো, ক্রাকো শহরে বিক্ষোভ থামছে না। আমাদের দেশের মতো পোল্যান্ডেও আছে স্বঘোষিত দক্ষিণপন্থী দেশরক্ষকরা। কালো পোশাক পরিহিত এই দল, যার সদস্যদের মস্তক প্রায়শ মুণ্ডিত, তারা প্রতিবাদীদের যত্রতত্র মারধর করছে। তাদের আক্রমণে আহত দুই মহিলা সাংবাদিকও।

এদিকে হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। দিনে কুড়ি হাজার নতুন কেস নথিভুক্ত হচ্ছে পোল্যান্ডে। কিন্তু প্রতিবাদীরা পিছু হটতে নারাজ প্রধানমন্ত্রী মাতিউস মরাউইস্কির অনুরোধ সত্ত্বেও। আগেও এই সরকারের এলজিবিটিকিউ-বিরোধী পদক্ষেপ দেখেছে পোল্যান্ড। প্রধানমন্ত্রীকে আর তারা বিশ্বাস করতে চায় না।

রাষ্ট্রপতি আন্দ্রে দুদা যেন খানিক সন্ধির পথে হাঁটতে চাইছেন। বলছেন, ভ্রূণে মারণ বিকৃতি থাকলে নাহয় গর্ভপাত অনুমোদিত হবে এবং ডাক্তারি পরীক্ষাসাপেক্ষে সবচেয়ে সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে গর্ভপাতের অধিকার পাওয়া যাবে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা এতে খুশি নন। বামপন্থী সাংসদ জোয়ানা শিউরিং-উইলগাস একে একটি ফাঁদ হিসেবেই দেখছেন।

ওদিকে উপপ্রধানমন্ত্রী ও পার্টি প্রধান জারোস্ল কাচজানাস্কির মনোভাব অনমনীয়। তাঁদের লক্ষ্য প্রতিবাদীদের ‘অপরাধী’ ও প্রতিবাদকে বে-আইনি জমায়েত নাম দিয়ে আইনের সাহায্যে দমন করা। আন্দোলন সংগঠিত করা নারী সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে যে কোনও সময়।

কীভাবে পোল্যান্ডের এই জাতীয় সমস্যার নিষ্পত্তি ঘটবে, তা ভবিষ্যতই বলবে। কিন্তু পোলিশ ইতিহাস এই অভ্যুত্থান মনে রাখবে। ১৯৮৯ সালে তথাকথিত সমাজতন্ত্রী পার্টির পতনের পর থেকে পোল্যান্ড বহু বছর এমন দেশজোড়া অভ্যুত্থান দেখেনি। কমিউনিস্ট শাসন যখন কঠোর ও অত্যাচারী হয়ে উঠেছিল, তখন তারও পতনও ঘটেছে। তারপরে পোল্যান্ড ঝুঁকেছিল দক্ষিণপন্থা ও ক্যাথলিক ধর্মের দিকে। আবার এখন পোলিশ জনগণ মনে করছেন, কমিউনিস্ট-পরবর্তী যুগের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা তাঁরা হারাতে বসেছেন দক্ষিণপন্থী ‘ল অ্যান্ড জাস্টিস’ পার্টির অপশাসনে। তাই লড়াই আবারও সমাগত। পোল্যান্ডের মানুষ মনে করেন, এই নতুন গর্ভপাত সংশোধনী কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তা হল বর্তমান সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতায় এক নতুন সংযোজন। তাই শুধু নারীরাই যে পথে নেমেছেন, তা নয়। বরং প্রায় নব্বই থেকে একশো জায়গায়, প্রায় চারশোটি মিছিলে পথে নেমেছেন প্রায় পাঁচ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু। কিন্তু একথাও অনস্বীকার্য যে পোল্যান্ডের বর্তমান অভ্যুত্থান এক নারীবাদী আন্দোলনের মাধ্যমেই ঘনীভূত হল। তাই পোলিশ জাতির সঙ্গে এই পর্ব মনে রাখবে বিশ্বজোড়া নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাসও।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...