ঘাটের কথা

সৌগত ভট্টাচার্য

 

নদীর জলের বুকে একটা ঘড়ির কাঁটা রাখা থাকে। বয়ে যাওয়া জলের মধ্যে সময়ের শব্দ পাওয়া যায়। রাতে সারনাথের জ্বলে ওঠা আগুন নিভে গেলে সেই সবটা তাপ সংগ্রহ করে সূর্য ওঠে বরুণ নদীর ওই পারে অসি নদীর ঘাটে। প্রাচীন বৃদ্ধ পুরোহিত সেই আগুনের নাম দেন জবাকুসুম। বারাণসী নগরী জেগে ওঠে। ভোর থেকে সন্ধ্যারতির প্রদীপ জ্বালার সময় পর্যন্ত কাশী নগরীর ছায়া পড়ে গঙ্গার জলে, ছায়া পড়ে বৌদ্ধ শ্রমণের, জলছায়া পড়ে বুনট বেনারসি কালকার। তেমন কিছু টুকরো ছবি নিয়ে “বারো-আওয়ারি” ঘাটের কথা।

 

লেবু চা

অসি ঘাটের রং আস্তে আস্তে কমলা হয়। ‘সুভ-ই-বেনারস’ এর সঙ্গীতের সঙ্গে মিশে যায় লেবু চা বিক্রি করা কিশোর ছেলেটির গলা। বাসি মুখে কোন গলা বেশি সুরেলা বলা মুশকিল! পাশেই বাঁশি বিক্রেতা বাজিয়ে যাচ্ছে নতুন হিন্দি গানের সুর। রাত-সওয়ারী নৌকাদের তখনও ঘুম ভাঙেনি। প্রাচীন আগুনের ছটা এসে পড়ছে অসি ঘাটের শান বাঁধানো মেঝেতে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। ঠিক যেমন কপিলাবস্তু থেকে পায়রার দল খুদ খেতে উড়ে আসে রোজ গঙ্গার পারে। গঙ্গার হাওয়া নাকে ফুসফুসে নেয় স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে আসা মানুষের দল। জলের ভেতরে ঘড়ির কাঁটার শব্দ আর ফুসফুসে টিকটিক এক হয়ে যায়। গঙ্গা জলে ভোরের সূর্য পড়লে জলের রং লেবু চায়ের মত লাগে।

 

গল্প

সে সব অনেকদিন আগের কথা, পাথরের কথা নদীর কথা আগুনেরও। একটা মানচিত্রের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের গল্প। বৈদিক মন্ত্রের শেষে শ্রমণের ঘন্টা যেমন করে মিশে যায় গাঙ্গেয় উপত্যকায় গান হয়ে সেই গল্প। আদিম প্রস্তরখণ্ডের ওপর দিয়ে বয়ে চলা হাওয়ার গল্প। বেনারসের কলজের ভেতরে রাখা প্রেমের গল্প লেখা হয় তুলোট কাগজে। দূরের নৌকারা হয়ত ললিতা ঘাটে এসে নোঙর ফেলে। শ্রুতি থেকে বিনয় পিটকের দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয় জাতক! কেউ তুলসীদাস পাঠ করে অসীম জলধারার দিকে চোখ মেলে। বারাণসীর গল্প শ্রুতি হয়ে ওঠে ভৈরবীর মত। ছোট ছোট ঢেউ হয়ে ধাক্কা খায় ঘাটের গায়ে। গল্পরা ভেঙে ভেঙে কিংবদন্তি রচিত হয় উপমহাদেশের অলিগলিতে।

 

পাশাপাশি

নদীর জলে সময়ের মত শব্দ ভেসে যায় বর্ণমালা হয়ে। আকবর বাদশার বেনারসি-দিনলিপির খোঁজ গঙ্গা রাখে না। তিলক ও ফেজটুপি জায়গা বদল করলেও গঙ্গাজল নির্বিকার। সংস্কৃত পালি আরবি উপনদী হয়ে গঙ্গায় মিশে যায়। তবু কালো ছায়া পরে, রাতের মত অন্ধকার দেখায় মাঝেমাঝে। তারপর একই ঘাটের জলে গঙ্গাস্নান ও অজু করে মানুষের দল, যাদের পরিচয় পত্রে শুধু ধর্ম লেখা থাকে। মণিকর্ণিকা ঘাটে পাশাপাশি দেখা মেলে তাঁদের সঙ্গে। বুঝতে অসুবিধা হয় না পড়শির অন্তিম যাত্রায় আরেক স্বজন এসেছে পাশে থাকার জন্য। ঠিক যেমন ইতিহাস কাল ধরে বিশ্বনাথ মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জ্ঞানবাপী মসজিদ।

 

চিরপ্রণম্য

এক জন্মে নির্বাণের জন্য যে আগুন প্রয়োজন, সে যেন অপেক্ষমান দিবারাত্রি, অহর্নিশ জ্বলন্ত। আটটি বুদ্ধ নির্দেশিত পথ দিয়ে নির্বাণ গঙ্গার তীরে এসেছিল কি না সে কথা বেনারসি হাওয়া জানে। কিন্তু মুক্তি! দূরদূরান্ত থেকে শবদেহ এসে জড়ো হয় অনির্বাণ অনলের আশায়। আগুনে সূর্য পড়লে আগুন অদৃশ্য হয়, নশ্বর দেহের মত। রোজ যেন কোনও সতীর কর্ণ-কুন্তল পড়ে মনিকর্ণিকা ঘাটে। সেখানে দিবারাত্রি জ্বলে থাকা আগুন যেন নির্বাণের পথ তৈরি করে রোজ রোজ। কিসের মুক্তি! যে মুক্তির দেওয়ার অপেক্ষায় মণিকর্ণিকা জেগে থাকে দিনরাত। পাপপুণ্য মিশে যায় ছাই হয়ে গঙ্গার জলে। যিশুর জন্মের ছয় শতক আগে ভারতভূমির এক ক্ষত্রিয় সন্তানের দেখানো মুক্তির পথ আজও অনির্বাণ গঙ্গার তীরে মণিকর্ণিকায়!

 

শ্মশান যাত্রী

শরীরের মৃত্য হলে আকাশছোঁয়া বৃক্ষরা শ্মশানযাত্রী হয়। ভস্ম ভেসে যায় কিনারার খোঁজে। দর দাম দালাল দিয়ে স্বর্গলাভের আশায় মৃতদেহের স্তুপ বাড়ে। মণিকর্ণিকা ঘাটে যাওয়ার সরু গলিপথ দিয়ে মানুষ তাঁর প্রিয়জনের শেষযাত্রাকে প্রশস্ত করতে চায়। যে ধর্মীয় বিশ্বাসের গল্প কথামুখ ইতিহাস হয়ে ওঠে। গাছেরা রাজা হরিশচন্দ্রর ডোম হয়ে যাওয়ার গল্প জানে না, শুধু মৃতদেহর সঙ্গে পুড়তে জানে। গঙ্গা-পারের মাটিতে নাভিমূল পুঁতে যায় স্বজনেরা। কল্পিত স্বর্গে রওনা করে বেনারাসের ঘাটে নাড়ির টান রেখে যায় অজান্তে। বিশ্বাসে গঙ্গার সঙ্গে মানুষের নাড়ির যোগস্থাপন হয়। তারপরও গাছের কোনও নাভিমূল থাকে না, গাছ পুড়লে ছাই হয়।

 

আলো

আর্যাবর্ত থেকে ভেসে আসা অশ্বমেধ ঘোড়ার মত স্তোত্র একদিন আটকে যায় এক ক্ষত্রিয়র সামনে। অনুষ্ঠান সর্বস্বতার উল্টোদিকে এক জল ভরা নদী বয়ে চলে আহবমান। ভারতভূমে জন্ম হয় দীন-ই-ইলাহী, বেনারস থেকে কয়েকশো ক্রোশ দূরে। বেনারসি শাড়ির মত বুনন হয় বিশ্বনাথ মন্দিরের গায়ের কারুকার্যে। সান্ধ্য ভাষার কবিতারা ঘাটে বসা পায়রাদের গান অনুবাদ করে। কালো ছায়া পড়ে নদী মানচিত্র জুড়ে বারবার। তারপর একদিন দ্বারভাঙা ঘাট থেকে একটা নদী দেখা যায়, নদীর ওই পারে সবুজ জঙ্গল দেখা যায়, জলের শব্দ শোনা যায়, ভোর হয়, রোজ ভারতবর্ষ জেগে ওঠে সকালবেলা।

 

প্রস্তর যুগ

পাথর যে গল্প জানে, মানুষ জানে না। পাথর খোদাই করে ইতিহাস লিখতে চাওয়া মানুষের দল ঘাটের গল্প শোনে কী! ঘাটে একা বসে থাকা মানুষের সঙ্গে পাথরের একধরনের সম্পর্ক তৈরি হয় বহুযুগ পর। নারদ ঘাটের টঙে বসে বই পড়ে অশীতিপর বৃদ্ধ, বইয়ের পাতা হাওয়ায় উড়ে গেলে নদীর দিকে তাকায় সে, নৌকার যাত্রীর দিকে না। রাজকীয় ঘটের মেঝেতে বসে একমনে পড়ে যায় সস্তায় কেনা তুলসীদাস। এই ঘাটের পাথর কয়েক জন্ম ধরে তুলসীদাস শুনে এসেছে। একজন মানুষ পাথরের ওপর বসে তুলসীদাস পড়তে পড়তে নিজেই পাথর হয়ে যায় একদিন। মানুষের দল এসে সেই পাথর খোদাই করে মানুষের গল্প বের করার জন্য।

 

ছত্রচ্ছায়া

ঘাটের ঘোলা জলে মানুষের আজন্ম বিশ্বাস মিশে থাকে। প্রাচীনতম নগরী তার দুই বাহু প্রশস্ত করে টেনে নেয় পাপপুণ্যের এক বুক জলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে তার ছত্রচ্ছায়ায়। ছাতার তলে বসে পাঠ করা মন্ত্র গঙ্গার ঘোলা জলের মতই ঘুরে যায় দশাশ্বমেধ রাজেন্দ্রপ্রাসাদ ঘাটের পিচ্ছিল সিঁড়ি দিয়ে। এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে স্কুল ইউনিফর্ম পরে কিশোরী ফুলবিক্রেতা ফুলের টুকরি নিয়ে অপেক্ষা করে গঙ্গায় পুণ্যি-স্নান সেরে ওঠা ধার্মিক কাস্টমারের জন্য। নদীতে ফুল বেলপাতার সঙ্গে টাকা ভেসে বেড়ায়। টাকার ছত্রচ্ছায়ায় না থাকা জলে দাঁড়িয়ে ফুল প্রদীপ কিশোরীর মাথায় ছাতা ধরবে কোন মার্গ!

 

আড়াল

মানুষ তো আড়ালই চেয়েছে প্রতিনিয়ত। আলো থেকে আড়াল কোলাহল থেকে আড়াল। জীবন থেকে আড়াল চাওয়ার জন্য মুক্তি খুঁজেছে। দশাশ্বমেধ ঘাটে কোলাহলে একজন মানুষ আড়াল করেছে নিজেকে, বাড়ি থেকে সরু ঘাটে যাওয়ার পথ পেরিয়ে এসেছে নদীর কাছে আড়াল খুঁজতে। যে নদীর জলে মানুষ ডুব দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় তারপর সব পাপ নদীর কাছে গচ্ছিত রেখে জলের আড়াল সরায়। পাপপুণ্যের হিসেব রাখার দায় জলের নেই। একদিন একলা মানুষ সব আড়াল সরিয়ে ঘাটের ওপারের সঙ্গে গল্প করে এই ঘাটে বসে… মাঝে শুধু একটা জলধারা বয়ে যাচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে।

 

সন্ধ্যা

সূর্য ডুবলে সব প্রদীপের বুক জ্বলে ওঠে। শুরু হয় গঙ্গা আরতি। দিনের সব আলো টুকরো টুকরো হয়ে জড়ো হয় গঙ্গার তীরে। চারিদিকে ঘন্টা মন্দ্রস্বরে মন্ত্র ধূপের গন্ধ মিলে অসি ঘাট থেকে দশাশ্বমেধ পর্যন্ত যেন পার্থিব সব গঙ্গার বুকে সমর্পণের পালা চলে সমারোহে। গঙ্গার বুকে ছায়া পড়ে আগুনের। নদীর জল আরতির শব্দ শুনলে রাত্রি হওয়া টের পায়। সারনাথের দিকে মুখ করে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালায় বারাণসী। বৈদিক মন্ত্র ভেসে যায় লুম্বিনী রাজগৃহের দিকে ইলাহাবাদের দিকে। বেনারস ঘাটের সন্ধ্যা আরতি শেষে প্রদীপ ভাসিয়ে দিলে সে প্রদীপ রাতের অন্ধকারে যে ঘাটে পার নেয় তার নাম ভারতবর্ষ।


*সমস্ত ছবি লেখকের তোলা

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...