মণিপুরে হিংসা এবং যৌন-নির্যাতন— দায়ী কারা?

তানিয়া লস্কর

 


মেইতেই জাতীয়তাবাদ এবং তাদের হোয়াইটওয়াশকারী মণিপুরি শিক্ষাবিদ তথা সমাজকর্মীদের কাছে কৈফিয়ত দাবি করতে না পারলে আমরাও কৌম-জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া জুগিয়ে যাব। বিজেপি নিজেদের নির্বাচনী ইস্তাহারে 'জাতীয় অখণ্ডতা' রক্ষা ইত্যাদি বলে যে অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে তথা সারা দেশ জুড়ে অপরায়নের যে রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে তার বিহিতের একটি ব্যবস্থা এখন থেকেই ভাবতে হবে

 

 

গত ১৯ জুলাই জাতিবাদী হিংসা-কবলিত মণিপুরের একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। ভিডিওটিতে একদল উন্মত্ত মেইতেই পুরুষ মিছিল করে দুজন কুকি মহিলাকে বিবস্ত্র অবস্থায় গ্রামের ভিতর দিয়ে প্যারেড করাচ্ছেন। পরবর্তীতে জানা গেছে তাঁদের মধ্যে একজনকে গণধর্ষণও করা হয়েছে। ঘটনাটি সামনে আসার পর স্বাভাবিকভাবেই দলমতনির্বিশেষে সকল সাধারণ মানুষই সামাজিক মাধ্যমে এর কঠোর নিন্দা করেছেন। বলিউডের অভিনেতা অভিনেত্রীরা ট্যুইট করে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষমেশ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও হিংসা শুরু হওয়ার প্রায় দু মাস পর এ-নিয়ে প্রথমবারের মতো মুখ খুলতে হয়েছে। তবে এ ঘটনার আরেকটি দিক হল আরেকবার প্রামাণিত হয়েছে যে কেন্দ্রীয় ধারার রাজনীতি এবং মিডিয়ার নজরে পড়ার জন্য উত্তরপূর্বের নারীদের এমন কোনও চূড়ান্ত হেনস্থার মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। যাই হোক, জনরোষের চাপে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহের সরকারকে প্রায় বাধ্য হয়েই মুখ্য অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে হয়েছে এবং কড়া শাস্তির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু দিল্লির হিন্দি চ্যানলগুলোতে ঘটনার বিবৃতি দিতে গিয়ে বীরেন সিংহ বলেছেন যে সমগ্র মণিপুরে এরকম প্রায় ১০০টি এজাহার অমীমাংসিত অবস্থায় আছে। এরপরেও প্রাথমিক আবেগের বহিঃপ্রকাশের পর এ-বিষয় নিয়ে আর তেমন আলোচনা হচ্ছে না। অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রোলসর্বস্ব সংস্কৃতিতে এটাই স্বাভাবিক। এমনকি সামগ্রিক জাতিহিংসার বিষয়টি নিয়ে যেসব কথাবার্তা চলছে সেগুলোও খুবই অপরিণত বলে মনে হচ্ছে। সামরিক বাহিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সন্ত্রাসবাদীদের পাহারা দিচ্ছে এমন ফটো প্রকাশ্যে আসার পরও কেন্দ্রীয় বাহিনি মোতায়েনকে হিংসার একমাত্র সমাধান হিসেবে তুলে ধরা সেটাই প্রমাণ করে। সুতরাং বিষয়টির যথাযথ সমাধান চাইলে প্রথমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজনীতি এবং সমাজকে বুঝতে হবে। এখানকার নানা রাজ্যে মাঝেমাঝেই এমন জাতিবাদী দাঙ্গার আগুন যে জ্বলে ওঠে তার মূল কারণ নিহিত আছে, কেন্দ্রে বসে থাকা জাতীয় দলগুলোর প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতায় এখানকার সংখ্যাগুরু জাতি-জনজাতিসমূহের মধ্যে গড়ে ওঠা জাতিবাদী বুর্জোয়া আবেগের মধ্যে। এ-বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা না হলে হিংসার দীর্ঘকালীন নিষ্পত্তি সম্ভব বলে মনে হয় না।

উত্তরপূর্ব ভারতের সমাজ-রাজনীতিতে ‘otherization’ বা ‘অপরায়ন’ একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য বা master narrative। প্রায় সবকটি রাজ্যের নামই একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর নামে নামাঙ্কিত। এবং সেই জনগোষ্ঠীর দল-সংগঠন সেই রাজ্যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশেষাধিকারের দাবি করে। এটা যে শুধু জাতীয় আবেগে উদ্বুদ্ধ দল-সংগঠনসমূহই করে এমন নয়, এমনকি আপতভাবে জাত-ধর্ম-নিরপেক্ষ সর্বভারতীয় দল-সংগঠন তথা বুদ্ধিজীবীবর্গকেও এখানে টিকে থাকতে নিজেদের কাঠামো অনুযায়ী এ-সমস্ত জাতিবাদী পরিভাষা বা narrative-কে আত্মস্থ করে নিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ অসমের অখিল গগৈ কিংবা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল AAP-এর কথা বলা যায়। অখিল গগৈ দিল্লি গিয়ে যতই ফ্যাসিবাদবিরোধী বড় বড় কথা বলুন না কেন তাঁর লেখা বই ‘বিদেশি সমস্যা’ পড়লে বোঝা যায় যে বঙ্গমূলীয় মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুদের অপরায়ন করতে তিনিও মোটেই দ্বিধাবোধ করেন না। আপ নেতা আতশি মার্লেনাকে গৌহাটি নগর নিগমের নির্বাচনের সময় বিজেপির বিরুদ্ধে দেশের নানা জায়গায় ‘বাংলাদেশি’ এবং ‘রোহিঙ্গা’দের রক্ষণাবেক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করতে দেখা গেছে। এখানে এটাও বলে রাখি যে সে নির্বাচনে প্রথমবার প্রার্থী দিয়ে আপ ২টি আসনে জয় লাভ করে। মানে হাতে হাতে ফল। সুতরাং বিজেপির মতো ধর্মীয় বিভেদের রাজনীতি করা দল ক্ষমতায় থাকলে এমন সুযোগের ব্যবহার নিজেদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আখের গুছোনোর জন্য তারা যে করবে, তাতে কোনও সন্দেহ থাকে না। এ পরম্পরাতেই ২০২২-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি নিজেদের নির্বাচনী ইস্তাহারে মণিপুরের National interigity বা জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। অবশ্য এই রক্ষকের স্থানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রয়োজন সৃষ্টি করার জন্যই বোধহয় গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি এবিভিপির মতো সংগঠনগুলোর মাধ্যমে ‘মেইতেই লিপুন’ ‘আরাম্বাই তেঙোল’ ইত্যাদি মেইতেই জাতীয়বাদী সংগঠনগুলোকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদত দিয়ে আসছে। যেটা ‘দি ওয়ার’ নামক ওয়েব চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে স্বীকার করেছেন মেইতেই লিপুনের নেতা প্রমথ সিংহ। এমনকি তাদেরকে বন্দুকের লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ট্রেনিং দেওয়ার সরকারি বরাতও দেওয়া আছে। এটা নতুন কিছু নয়। আশির দশকে ‘অসম আন্দোলন’-এর সময় বিজেপির ভাল ফ্যাসিস্ট শ্রীমান অটলবিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে আরএসএসও অসমের জাতীয়তাবাদীদেরকে এমন প্রছন্ন মদত দিয়েছে। এই তথ্য এজন্যও গুরুত্বপূর্ণ কারণ অসমিয়া এবং মেইতেই জাতীয়তাবাদ একে অন্যের দোসর। দুপক্ষই এক সময়ের ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী ভক্তি আন্দোলনের প্রভাবে বৈষ্ণব মতে প্রভাবিত হয়েছিল। কিন্তু হিন্দুত্ববাদের নীরব ক্রমবিকাশের ফলে আশির দশক থেকে আবার সংস্কৃতায়নের প্রভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদকে আত্মীকরণ করতে শুরু করেছে। এবং সেই চিন্তাধারার প্রভাবেই নিজেদের জায়গায় নিপীড়িত শ্রেণিকে অপরায়িত বা otherise করতে শুরু করে দুপক্ষ। অসমে যেমন নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং মিঞা মুসলমানরা এর বলি হয়েছেন, মণিপুরে তেমনি কুকিদের অপরায়িত করা হয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের জাতীয়তাবাদীদের স্ক্রিপটাও একই। দুপক্ষই তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ‘বহিরাগত’ ‘ড্রাগ মাফিয়া’ ইত্যাদি একইরকম মানক বা signifier ব্যবহার করে। অসমে ড্রাগ মাফিয়া অপবাদ দিয়ে ২০২২ সালে প্রায় ৩০ জন লোককে গুলি করা হয়েছে। বলাবাহুল্য যে তাদের বেশিরভাগই মিঞা মুসলমান। এবং এতে সর্বান্তকরণে মদত দেয় তাদের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। ১৯ তারিখের ঘটনার পর মেইতেই বুদ্ধিজীবী ভগত অইনাম, বিমল আকোইজামদের কথাবার্তা খেয়াল করলে সেটা স্পষ্টতই বোঝা যায়। এমনকি বিনালক্সমি নাইপ্রাম, লিসিপ্রিয়া কাংগোইজামদের মতো নারীবাদী আন্দোলনের মুখ্য নেতৃত্বকেও হোয়াইটওয়াশিং (whitewashing)-এ লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ধারার নারীবাদীদের কাছে বিষয়টি কিছুটা বিস্ময়কর হলেও ইরম শর্মিলার আফস্পাবিরোধী আন্দোলনকে যাঁরা কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁরা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন এই ফেনোমেনন। বর্তমান সময়ে মণিপুরের নারী আন্দোলন সেখানকার কৌম-পরিবারবাদী জাতীয়তাবাদের যে উর্ধ্বে উঠতে পারেনি তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন ইরম শর্মিলা। তাঁকে মণিপুরের মহিলারা আদর করে ডাকতেন ‘মাংগোবি’ বলে। সেইসব সাধারণ মহিলাদের সংগঠন মৈরাপাইবিরা যখন সেনাবাহিনির পথ অবরোধ করে জাতিবাদী নেতাদের রক্ষণাবেক্ষণ দেন, তখন আবার সেই কৌম-জাতীয়তাবাদের প্রভাবই পরিলক্ষিত হয়। ইরম শর্মিলাকে ততদিন যাবৎ সম্মান স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যতদিন পর্যন্ত তিনি জাতির খাতিরে নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছাকে দমিয়ে রেখে ব্রাহ্মণ্যবাদস্বীকৃত দেবীর স্থানে পর্যবসিত ছিলেন। যে মুহূর্তে তিনি ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্খার কথা প্রকাশ করে সেই ব্রাহ্মণ্যবাদী দেবীর ধারণাকে পরিত্যাগ করেছেন, তাঁকে বর্জন করেছে সমগ্র মণিপুর। বিধানসভা নির্বাচনে প্রত্যাশী হয়ে তিনি মাত্র ৯০টি ভোট পেয়েছিলেন। এমতাবস্থায় এটা আশ্চর্যকর কিছুই নয় যে মণিপুরি সামাজিক সংগঠন তথা বুদ্ধিজীবীমহল মেইতেই জাতীয়তাবাদকে প্রচ্ছন্ন বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে সরাসরি সহায়তা জোগাবেন।

কাউকে দোষারোপ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু কারণগুলো যথাযথভাবে সনাক্ত না করলে সমাধানে পৌঁছনো সম্ভব নয়। সমন্বয় তো দূর অস্ত। নাহলে কেন্দ্রীয় সরকারকে দাঙ্গায় মদত দেওয়ার জন্য দোষারোপ করে আবার তাদের কাছেই কেন্দ্রীয় বাহিনি মোতায়েনের মতো বোকা-বোকা দাবি করতে থাকব আমরা। কাজের কাজ কিছুই হবে না। এসব দাবি করার আগে কবে বা কোথায় আর্মি সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঙ্গা রুখতে সক্ষম হয়েছে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেওয়া দরকার। আর দরকার সামগ্রিক আত্মমন্থন। মেইতেই জাতীয়তাবাদ এবং তাদের হোয়াইটওয়াশকারী মণিপুরি শিক্ষাবিদ তথা সমাজকর্মীদের কাছে কৈফিয়ত দাবি করতে না পারলে আমরাও কৌম-জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া জুগিয়ে যাব। বিজেপি নিজেদের নির্বাচনী ইস্তাহার ‘জাতীয় অখণ্ডতা’ রক্ষা ইত্যাদি বলে যে অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে তথা সারা দেশ জুড়ে অপরায়নের যে রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে তার বিহিতের একটি ব্যবস্থা এখন থেকেই ভাবতে হবে। আর মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ ছাড়াও তাঁর উল্লেখ করা ১০০টি এফআইআরের তদন্ত সহ এই দুমাস ধরে হওয়া যৌন হিংসার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি বিচারবিভাগীয় কমিটি গঠন করা তথা নির্যাতিত গোষ্ঠীগুলোর উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব সহ একটি শান্তিসমন্বয় সমিতি গঠন করাও প্রয়োজন। কুকিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি স্বতন্ত্র ফোরামও তৈরি করতে হবে। তাহলেই হয়তো সমন্বয়ের যাত্রা পুনরায় শুরু হতে পারে। নাহলে মণিপুরের আগুন ত্রিপুরা মেঘালয় ইত্যাদি পার্শ্ববর্তী রাজ্যে ছড়াতে সময় লাগবে না। এবং বলা বাহুল্য সেসব রাজ্যে বাঙালিরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।


*মতামত ব্যক্তিগত

Be the first to comment

আপনার মতামত...