চতুর্থ পাঠ : অথ গোলাপ বিনোদ কথা

পূর্ণা চৌধুরী

 

গোলাপ বনাম সুকুমারী

“রঙ্গভূমি ভালবাসি

হৃদে সাধ রাশি রাশি

আশার নেশায় করি

জীবন যাপন।।

-–গিরীশ চন্দ্র ঘোষ।

সুকুমারী  দত্তর  অপূর্ব সতী  কোনও কালজয়ী নাটক নয়। হরমণি নাম্নী এক বেশ্যা  তার লেখাপড়া জানা মেয়ের জন্যে জাল ফেললে। তাতে ধরা পড়ল চন্দ্রকেতু ঘোষ নামক এক জমিদার তনয়। হরমণির মেয়ে নলিনী যখন সেই কচি বাবুটির প্রেমে ভীষণ পড়লে, তখন হরমণি লোভে পড়ে তাকে তরুবাবু নামক এক মক্কেলের কাছেই বেঁচে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং কৃতকার্য হয় না। নলিনী চন্দ্রকেতুর সঙ্গে কাশীধাম যায় এবং গন্ধে গন্ধে চন্দ্রকেতুর পিতৃদেব তথায় পৌঁছিয়ে ছেলেকে বলপূর্বক কলকাতা আনয়ন করেন। নলিনী আত্মঘাতী হয়… ইত্যাদি। পাঠক, এই নাটকটি দেখছি একটি বিশেষ কারণে। যদি বলি কুসুমকুমারী এই নাটকে তাঁর নিজের সত্তাকে দুই টুকরো করে মা মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন, তাহলে কি আপনারা বিভ্রান্ত হবেন? সূত্র হল সেই হাড়ি চাঁচা আর সেতার বাদন। নলিনী যে ভাষায় কথা বলে সে হল নাটকের ভাষা, তাতে শব্দের ঝংকার আছে, আবেগের ঘনঘটা আছে, যা নেই তা হল বাস্তবের ছোঁয়া। শুনলে মনে হয় যেন একটি নাটুকে মেয়েমানুষ ঘুরে ঘুরে রাধা সতীর অভিনয় করছে। হরমণি যে ভাষায় কথা কয়, সে হল কথ্য ভাষা; সে ভাষায় পালিশ কিছু নেই, কিন্তু সে ভাষা যে অভিজ্ঞতার ভাষা তা বোঝাটা শক্ত  কিছু না।

পাঠক,  মা মেয়ের এই কথোপকথনটি শুনুন–

নলিনী: তুমি আমার সতীত্ব নাশের জন্য নানাপ্রকার চেষ্টা কচ্ছ। তুমি তোমার নিজের সতীত্ব নষ্ট করেছ বলে কি আমাকেও সেই পথগামিনী করতে চাও?

হর: আ মর বেটি! বেটি আমার কি সতীরে!– সতীপনা দেখছেন– আরে বেটি! সতীত্ব নিয়ে করবি কি?– সতীত্ব নিয়ে কি ধুয়ে খাবি?– না সতীত্বে পেট ভরবে? সেই জোগাড় কর, তারপর তখন আর চেষ্টা দেখিস। বেটির অরগণ নেই ছাড়গুন আছে।

আরও একটি মজার ব্যাপার দেখলাম। ভাষা যে দুই জিভে কথা কইছে সে সুকুমারী দত্ত ভালোই জানেন, কারণ, হরমণি শুধু যে মেয়ের সতীপনাকে গাল পাড়ছে তা নয়। মেয়ের নাটুকে ভাষাকেও ভ্যাঙ্গাচ্ছে–

মেয়ে মায়ের কাছে চন্দ্রকেতুর প্রতি তার প্রেমের গভীরতা নিয়ে কাব্যপ্রবণ আক্ষেপ আর হরমণির প্রতিক্রিয়া—

নলিনী: সেইদিন তাঁকে প্রাণনাথ বলে হৃদয়রাজ্যের রাজা করেছি— সেই অবধি তাঁর অধিনী বলে তাঁর চরণ সেবা করেছি। মা! আর অধিক কি বলব, সেই অবধি তাঁকে হর্তা কর্তা বিধাতা, আশ্রয় অবলম্বন বলে তাঁরই আশ্রিত হয়েছি।

হর: আহা! বেটি আমার ভিক্ষা চেয়ে প্রাণটা শীতল কল্লে রে! বেটি আমার কবিতা আওড়াতে লাগলেন (বিকৃত স্বরে) হত্তা কত্তা বিধাতা করেছি-– কটাক্ষপাত করেছি— মুণ্ডুপাত করেছি, বেটি আমার রাজরাজেশ্বরী হয়েছেন। (চতুর্থ অঙ্ক, প্রথম গর্ভাঙ্ক)

Verisimilitude, authenticity ইত্যাদি বড় বড় তত্ত্ব আমরা ব্যবহার করতে চাইনে, তবে হরমণির মধ্যে গোলাপের গল্প আর তার মাহেশের জীবনটি যেন কেউ তুলে বসিয়ে দিল নাটকের পাতায়। আর নলিনীর প্রেমাবেগে একটি রংচং মাখা কথা বলা পুতুল বৈ আর কিছু পাওয়া গেল না।  যে চরিত্র কলের পুতুলের মতো সাজানো গোজানো ভাষায় কথা বলে, সে থেটারে বসে একপ্রকার সহ্য করা যায়, কিন্তু জীবনে সে মানানসই হয় না। ঐটিই হল “জীবন ত্যাজিয়া ঝাঁপিয়ে জীবনে”র মূল ধরতাই। যে জীবন ঘেন্নার, সে জীবন ত্যাগ করলাম, কিন্তু যে সাজানো গোজানো জীবনে ঢোকার লোভ হল, তাতে ঠিক প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল না, সে রংচং-এ মাটির কাঠামো হয়ে রইল এবং ভেঙেও গেল। নলিনী সুকুমারী কিনা বলতে পারব না, কিন্তু নলিনীর ভাবভঙ্গি, কথার ধরণে কোথায় যেন এক aspiring মিসেস সুকুমারী দত্তকে দেখতে পেলাম। নাটকের কভার পৃষ্ঠায় যে ট্র্যাজেডি কথাটি তিন তিনবার লেখা হয়েছে, তার আসল ব্যঞ্জনা নাটক ছাপিয়ে সংলাপ ছাপিয়ে, এক বেশ্যার ‘ভদ্রমহিলা’ হয়ে ওঠার মর্মান্তিক চেষ্টার রূপক বর্ণনা অর্থাৎ কিনা allegory হয়ে পড়েছে বলে বোধ হল। সে ঠিক না ভুল তা পাঠকরা বিচার করবেন।

বিনোদিনী উবাচ…

যাহারা বিনোদিনীর ন্যায় অভাগিনী, কুৎসিত পন্থা ভিন্ন যাহাদের জীবনোপায় নাই, মধুর বাক্যে যাহাদিগকে ব্যাভিচারীরা প্রলোভিত করিতেছে, তাহারাও মনে মনে আশান্বিত হইবে যে, যদি বিনোদিনীর মতো কায়মনে রঙ্গালয়কেশ্রয় করি, তাহা হইলে এই ঘৃণিত জন্ম জনসমাজের কার্যে অতিবাহিত করিতে পারিব যাহারাঅভিনেত্রী তাহারা বুঝিবেকিরূপ মনোনিবেশের সহিত  নিজ ভূমিকার প্রতি যত্ন করিলে জনসমাজে প্রশংসাভাজন হইতে পারে
–শ্রী গিরিশচন্দ্র ঘোষ

 

বিনোদিনী দাসী, যাঁরে তাবৎ বাঙালি ‘নটি বিনোদিনী’ বলে থাকেন, আমার কথা  আর আমার অভিনেত্রী জীবনের  দৌলতে তিনি বাংলা সাহিত্যে একেবারে জাজ্বল্য হয়ে আছেন। যদি খুব ভুল না করি, তাহলে ইনিই এখনও পর্যন্ত একমাত্র মন্দ স্ত্রীলোক যাঁর জীবনী ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। এই যে ইনি বাঙালির সংস্কৃতিতে ফাইভ স্টার পেলেন, সে যে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দৌলতে সে বোঝা কঠিন নয়। মহাপুরুষের আশীর্বাদধন্যা হলে বেশ্যা জাতে না উঠে যায় কোথায়। আমাদের বাসি খবরে প্রয়োজন নেই। কথার মধ্যেও যেমন কথা থাকে, সে রূপকই হোক বা আভাসই হোক, তা আমরা খুব জানি। তাই মন দিয়ে লেখাটি পড়ি। ভারী সুন্দর করে তিনি তাঁর রামকৃষ্ণ দর্শনের কথা বললেন–

“যখন তিনি অসুস্থ হইয়া শ্যামপুকুরের বাটিতে বাস বাস করিতেছিলেন, আমি শ্রীচরণ দর্শন করিতে যাই তখন সেই রোগক্লান্ত প্রসন্নবদনে আমায় বললেন : “আয় মা বোস”, আহা কি স্নেহপূর্ণ ভাব! এ নরকের কীটকে যেন ক্ষমার জন্য সতত আগুয়ান! কতদিন তাঁহার প্রধান শিষ্য নরেন্দ্রনাথের (পরে যিনি বিবেকানন্দ স্বামী বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন) “সত্যম শিবম” মঙ্গলগীতি মধুর কণ্ঠে থিয়েটারে বসিয়া শ্রবণ করিয়াছি। আমার থিয়েটার কার্যকরী দেহকে এই জন্য ধন্য মনে করিয়াছি।”

কিন্তু ওই অংশে আর একটি কথা উঁকি দিচ্ছে। আমি সেটির ’পরেই মনোস্থাপন করলাম। তিনি বলছেন, “নরেন্দ্রনাথের “সত্যম শিবম” মঙ্গলগীতি মধুর কণ্ঠে থিয়েটারে বসিয়া শ্রবণ করিয়াছি।” এইখানে একটু খটকা লাগল… নরেন দত্তর গান থেটারে, এ কিরকম! তারপর ঝটকা লাগল। ওই গানটি তাঁর মনের ভেতর রয়ে গেছিল, সেই গান তিনি মনে মনে শুনতেন। পাঠক, এইবার গিরিশবাবু আর বিনোদিনীর কথাগুলো আবার বিবেচনা করুন– “কুৎসিত পন্থা” “ঘৃণিত জন্ম” আর  “থিয়েটার কার্যকরী দেহ”। এই হল নাটুকে বেশ্যার ত্র্যহস্পর্শ। এই স্পর্শদোষ থেকে বাঁচার মন্ত্র হল ওই সত্যম শিবম জপমন্ত্র। ওই একরকম বেঁচে থাকার উপায়। পাঠক, বেশ্যার মন আর দেহ কি আলাদা? নিশ্চই তাই। থিয়েটার কার্যকরী দেহ রইল বাবুদের আর দর্শকের জিম্মা; মন শুনে গেল সত্যম শিবম। সেই মন্ত্র ধরে রাখার উপায়টি বাতলে দিলেন গিরিশবাবু–

“আমার অন্য কথা ভালো লাগিত না। গিরিশবাবু মহাশয় যে সকল বিলাতের বড় বড় অভিনেতা বা অভিনেত্রীর গল্প করিতেন, যে সকল বই পড়িয়া শুনাইতেন, আমার তাহাই ভালো লাগিত। মিসেস সিডনিস যখন থিয়েটারের কার্য ত্যাগ করিয়া দশ বৎসর বিবাহিতা অবস্থায় অতিবাহিত করিবার পর পুনরায় যখন রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন, তখন তাঁহার অভিনয়ে কোনও সমালোচক কোনও স্থানে কিরূপ দোষ ধরিয়াছিল, কোনও অংশে তাঁহার উৎকর্ষ বা ত্রুটি ইত্যাদি পুস্তক হইতে পড়িয়া বুঝাইয়া দিতেন। […] বঙ্কিমবাবুর “দুর্গেশনন্দিনী” কোন পুস্তকের ছায়াবলম্বনে লিখিত, “রজনী” কোন পুস্তকের ভাব সংগ্রহে রচিত, এইরকম কত বলিব। গিরিশবাবু মহাশয়ের ও অন্যান্য স্নেহশীল বন্ধুগণের যত্নে ইংরাজি, গ্রীক, ফ্রেঞ্চ, জার্মানি প্রভৃতি বড় বড় অথরের কত গল্প যে আমি শুনিয়াছি তাহা বলিতে পারি না। শুধু শুনিতাম না, তাহা হইতে ভাব সংগ্রহ করিয়া সতত সেই সকল চিন্তা করিতাম।”

এই গিরিশবাবু মহাশয়ের কারণেই বিনোদিনীর মুখের ভাষা নাটুকে পালা হয়ে পড়ল না। সেই সদাশয় ব্যক্তি বিনোদিনীর কার্যকরী দেহের থেকে মনটিকে টেনে বার করে নিলেন; ধুলো ঝাড়লেন, ঘষলেন, মাজলেন, তারপর সেই মন যখন কথা কইল, তখন সে থিয়েটার কার্যকরী দেহর ছায়া চকিতের ন্যায়ও ভাষায় ছাপ ফেলল না।

মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন বড় বিচিত্র। বিনোদিনী বলছেন–

“গিরিশবাবুর সঙ্গে আমার জোর জবরদস্তি মান অভিমান রাগ প্রায়ই চলত। তিনি আমায় অত্যধিক আদর দিতেন, প্রশ্রয় দিতেন। আমি তাই বড্ড বেড়ে উঠেছিলুম, মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে অন্যায় ব্যবহার করতুম, কিন্তু তার জন্য তিনি আমায় একটি দিনের জন্যও তিরস্কার করেননি, অনাদর অযত্ন তো করেনইনি। তবে আমি একটি দিনের জন্য এমন কোনও কাজ করিনি, জাতে তাঁর এতটুকু ক্ষতি হয়।”

বেড়ে ওঠার কারণ একটুখানি ছিল বৈকি। যে সময়ের কথা তিনি বলছেন তখন গিরিশবাবুর হাতে গড়া এই বেশ্যাটি Prima Dona of Bengali Theatre; Flower of Native Theatre. বাঙালি বাবুরা কোন ছার, সায়েবরাও তখন তাঁর কদর করছেন। বিনোদিনী  মনে কী ভেবেছিলেন কে জানে। নাটুকে মেয়েছেলে  যে আসলে নাটুকে বাবুদের সম্পত্তি, হাতের পুতুল, তা বুঝতে খানিক সময় লেগেছিল তাঁর। যে কথাটি তিনি তেমনভাবে পষ্টাপষ্টি বলে উঠতে পারলেন না তা হল তাঁর বিনিময়ে গিরিশবাবুর স্টার থিয়েটার লাভ।  আমার কথায়  শুধু লেখা হল–

“নানা কারণের প্রধান কারণ যে আমায় অনেক রূপে প্রলোভিত করিয়া কার্য উদ্ধার করিয়া লইয়া আমার সহিত যে সকল ছলনা করিয়াছিলেন তাহা আমার হৃদয়ে বড় লাগিয়াছিল। থিয়েটার বড় ভালোবাসিতাম তাই কার্য করিতাম। কিন্তু ছলনার আঘাত ভুলিতে পারি নাই। তাই অবসর বুঝিয়া অবসর লইলাম।”

১৮৮৭-র পয়লা জানুয়ারী তাঁর জীবনের শেষ অভিনয়। সেই স্টার থিয়েটারেই। নল দময়ন্তী-  দময়ন্তী, বেল্লিক বাজার–এর রঙ্গিনী। দুটিই গিরীশবাবুর লেখা। একই রাতে একটি চরিত্রে সতীর সতী, তস্য সতী, যারে কয়, sublime character; দময়ন্তী নলকে বলছেন–

প্রভু,  কি দিয়ে করিব দেব-পূজা?

দেহ, প্রাণ,–- কিছু আর নহে মোর;

দেবগণে সাক্ষী করি’ কহি—

সকলই হে দিয়েছি তোমায়,

জানি, নাথ, তুমি হে আমার

দানে তবে নাহি অধিকার।

ধর্মপত্নী আমি তব;

দেহ মোরে পতি-পূজা উপদেশ;

কহ, নাথ, স্বয়ম্বরে দিবে দেখা?

পরবর্তীটিতে এক মেথরানী, যে অশ্লীল নাচ গানে স্টেজ মাতায়। রঙ্গিনী গাইছে–

মায় বাপ জিসিকে রোয়ে,

জরু ছোড়ে কে কসবি ঘরমে শোয়ে,

হাম ওস্কে দেওয়ে; গঙ্গা কিরা ময় সাচি কহি॥

যো না মানে দেওতা ভি না মানে পীর,

বে পয়জারসে যিসিকে না নোয়ে শির,

সরাব মে রহে যো মস্তাগীর,— যো

ছোড়া হ্যায় জাত,

ডেম (damn) ডেম বলে ছোড়হে লাথ,

উসিকে দেনে ময় খাড়া রহি॥

 

 

দময়ন্তীর ভোল পাল্টে রঙ্গিনীর নাচটি নাচতে নাচতে ফ্লাওয়ার অফ নেটিভ থিয়েটার কি ভাবছিলেন কে জানে। এ নাটকও গিরিশবাবুর লেখা কিনা। এবং প্রহসন। আগের কিস্তিতে গোলাপের প্রসঙ্গে বলেছিলাম কোথায় জীবনের শুরু কোথায় নাটকের শেষ কে জানে… এখনও সেই একই কথা বললাম। নল দময়ন্তীতে বিনোদিনী দময়ন্তী, নল নাট্যকার গিরিশবাবু স্বয়ং। তার আগে ১৮৮৩ সালেও এই স্টার থিয়েটারেই গিরিশবাবুর সঙ্গে তাঁরই লেখা দক্ষ যজ্ঞ । সে নাটকেও বিনোদিনী সতী, গিরিশবাবু মহাদেব। সেটিই স্টার থিয়েটরে তাঁর প্রথম অভিনয়।

বিনোদিনীর জীবনে গুর্মুখ রায়কে বাদ দিয়েও, পাঁচ পাঁচটি বাবু। রাধারমণবাবু, ছোটবাবু, গিরিশবাবু। গিরিশবাবু ঈশ্বর। তিনি কাদার তাল আর পাঁকের ময়লা তুলে প্রতিমা তৈয়ের করলেন। তারপর সে প্রতিমা সোনার দরে বেচলেন। আর এক বাবু রীতিমতো তলোয়ার নাচানো ‘সম্ভ্রান্ত যুবক বাবু’। তিনি নিজে বিয়ে শাদি করে থিতু হয়ে, বিনোদিনীর নতুন বাবুর খবর পেয়ে তলোয়ার বাগিয়ে তাঁর একদা বাঁধা মেয়েমানুষকে কাটতে গেলেন। আর একজন ‘রাঙা’ বাবু তাঁকে ছায়া দিলেন ১৮৮৭ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত। একটি মেয়েও হয়েছিল তাঁদের। মেয়েটির নাম ছিল শকুন্তলা। ১৯০২-এ সে মারা যায়। ১৯১২তে মারা যান দুই বাবু : গিরিশ বাবু আর ‘রাঙা’ বাবু। তলোয়ার বাবুটি আগেই গিয়েছিলেন। বিনোদিনী সম্পর্কে পড়তে গিয়ে দেখলাম এই ‘রাঙা’বাবুটিকে কেউ বলেছেন ‘স্বামী’, কেউ বলেছেন ‘বেনেফ্যাক্টর’। ‘স্বামী’ কথাটি কিন্তু বিনোদিনী একবারও উচ্চারণ করলেন না, কারণ মিথ্যা বলা তাঁর ধাতে ছিল না। গিরিশবাবুর লেখা ভূমিকা তিনি প্রথম সংস্করণে ছাপাননি কারণ,”তাহাতে অনেক সত্য ঘটনার উল্লেখ ছিল না”। সুতরাং তাঁর একটি ‘প্রাণের দেবতা’ (রাঙা বাবু) থাকলেও, তাঁর ‘মাথা মুণ্ড’ জীবনীতে তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন যে তিনি বেশ্যাই ছিলেন, এবং বেশ্যার ব্যবহারই পেয়ে গেছেন, যতই সতী আর দময়ন্তী সাজুন না কেন–

পতিপ্রেম সাধ আমাদের আছে, কিন্তু কোথায় পাইব? কে আমাদের হৃদয়ের পরিবর্তে হৃদয় দান করিবে? লালসায় আসিয়া প্রেমকথা কহিয়া মনোমুগ্ধ করিবার অভাব নাই, কিন্তু কে হৃদয় দিয়া পরীক্ষা করিতে চান যে আমাদের হৃদয় আছে? আমরা প্রথমে প্রতারণা করিয়াছি, কি প্রতারিত হইয়া প্রতারণা শিখিয়াছি, কেহ কি অনুসন্ধান করিয়াছেন? […] অনেক প্রদেশে জল জমিয়ে পাষাণ হয়। আমাদের তাহাই […] যাহা হউক, এখন ও কথা থাকুক।

গৌরবে বহুবচনের এমন সার্থক প্রয়োগ খুব কম দেখেছি।

১৯১২-র ৯ই ফেব্রুয়ারি গিরিশচন্দ্রের প্রয়াণ। কলকাতার টাউন হলে সর্বশ্রী সারদাচরণ মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা বর্ধমানের রাজা বিজয়চাঁদ মহতাবের সভাপতিত্বে যে বিরাট শোকসভার ডাক দিলেন সেখানে নাট্যাচার্যের প্রতি সম্মান আর শুদ্ধতার অজুহাতে অভিনেত্রীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল (একথা আগেও বলেছি) প্রতিবাদে স্টার থিয়েটারের “সুধাকন্ঠী” সুশীলাবালার (১৮৮৪-১৯১৫) নেতৃত্বে অভিনেত্রীরা গিরিশচন্দ্রের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের অধিকার দাবি করেছিলেন। দাবি মঞ্জুর হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৮ই সেপ্টেম্বর অভিনেত্রীদের তরফে একটি শোকসভা হয় স্টার রঙ্গমঞ্চে। সুশীলাবালার জিজ্ঞাস্য ছিল— ‘নারীকে বেশ্যা বানায় যাঁরা তাঁরা বেশ্যাকে ঘৃণা করে কোন মুখে?’ শোকসভায় সুশীলাবালা বলেছিলেন, ‘…পতিতা আমরা, সমাজ বর্জিতা বটে— কিন্তু আমরা মানুষ। …প্রিয়জন বিরহে যদি ক্রন্দনের অধিকার থাকে,… বুকফাটা হাহাকারে যদি দোষ না থাকে তবে আমাদের শোক দূষণীয় হইবে কেন?’

এই প্রশ্নটির সদুত্তর কোনও Reformist অবলাবান্ধব দিতে পারেননি বলেই জানি। নাট্য ইতিহাসের রেজিস্টারি তাই বলে।

 

পরিশিষ্ট

বিনোদিনীর পর ‘নাট্যসম্রাজ্ঞী’ তারাসুন্দরী, ‘নটকুলমণি’ কুসুমকুমারী, ‘সুধাকন্ঠী’ সুশীলাবালা, ‘সংগীতনিপুণা’ নরীসুন্দরী, সারদামণির স্নেহ ধন্যা নীরদাসুন্দরী… এমন আরও কত পাপিষ্ঠার কথা  অ-বলা  রয়ে গেল। তাঁদের সম্ভবত কোনও গিরিশবাবু জোটেনি… তাঁরা তাই চকিতের ন্যায় মিলিয়ে গেলেন… কতগুলো পোকায় কাটা আবছা ছবি শুধু রয়ে গেল, আর কোনও কোনও সুভাগিনীর ক্ষেত্রে, গুটি কতক নেহাতই কাঁচা, অপটু কবিতা।

গবেষকরা সে সকল আবেগমথিত কবিতা পড়িয়া এবং ছবি দেখিয়া যৎপরোনাস্তি উল্লসিত হইলেন এবং archival material বিবেচনা করিয়া তাহা লইয়া সংকলন বাহির করার প্রয়াস পাইলেন। অধম আমরা সেই জ্ঞানবৃক্ষের ফল লইয়া কোলাহল করিতে থাকিলাম।

 

Featured Image: Kalighat Pat Babu Bibi Google
বিনোদিনী :  https://alchetron.com/Binodini-Dasi-1207453-W

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...