বেকারত্বের কালো গর্তের দিকে এগোচ্ছে দেশ

সুমনা রহমান চৌধুরী

 

এই মুহূর্তে আমার আপনার, মানে আমাদের যুবসমাজের সামনে প্রধান সমস্যা কী বলুন তো? বেকারত্ব। আমরা একটা বয়স অব্দি লেখাপড়া করেছি, এক-একটা ডিগ্রি নিয়ে রেখেছি, কিন্তু আমাদের হাতে কোনও চাকরি নেই। আমাদের মধ্যেই প্রচুর মানুষ আছেন যারা অনেক আর্থিক অসুবিধার মধ্যেও নিজের পড়াশুনোটা চালিয়ে গেছেন, শুধুমাত্র একটা ভালো চাকরির আশায়। স্বপ্ন দেখেছি, এখনও দেখছি, একটা চাকরি পেলেই মা-বাবার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেব। বিশেষত অনেক ছেলেরা আছে, চাকরি নেই বলে বিয়ে করতে পারছে না। চরম পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজব্যবস্থায় মেয়েপক্ষ বেকার ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে চান না।

ভারতবর্ষে এই মুহূর্তে শিক্ষিত বেকারের সমস্যা ভয়াবহ। সরকারি যে কোনও চাকরিতে আবেদনপত্র জমা পড়ছে কয়েক লাখ। শুধু এটাই নয়, নিম্নপদের চাকরির জন্যেও আবেদন করছে অনেক উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা। অনেক ছেলেমেয়েরা লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলেও, মৌখিক পরীক্ষায় রিজেক্ট হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র ঘুষের টাকা যোগাড় করতে না পারায়, অথবা তাদের কোনও ‘প্রপার চ্যানেল’ না থাকায়। যে কিছু সংখ্যক ছেলেমেয়ের টাকা আছে বা মন্ত্রী-বিধায়কদের সাথে চ্যানেল আছে তারাই চাকরি পাচ্ছে। বাদবাকিরা হতাশ হয়ে পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে ফেলছে চাকরির সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে।

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী জেন অ্যাডামস বলেছিলেন, “সব ধরনের সামাজিক দুর্দশার মধ্যে বেকারত্বের মতো প্রাণঘাতী অন্য কিছুই নয়।” ভারতবর্ষে এইমূহূর্তে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা মারাত্মক। সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্টারন্যাশন্যাল লেবার অর্গানাইজেশনের (ILO) রিপোর্ট অনুযায়ী গত বছরে ভারতে বেকার যুবকযুবতীর সংখ্যা ছিল ১৮.৬ মিলিয়ন যা ২০১৯-এ পৌঁছে ১৮.৯ মিলিয়নে বাড়তে পারে।

গত কয়েক বছরে দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র এক লাখ লোকের। গত বছর কেন্দ্রীয় সরকারের সাড়ে ২৪ হাজার শূন্যপদের জন্য আবেদন জমা পড়েছিল প্রায় দেড় কোটি। চলতি অর্থ-বছরে পদের সংখ্যা ২৫ হাজার বাড়লেও এর বিপরীতে আবেদন ছাড়িয়ে গেছে আড়াই কোটি। এক বছরের মধ্যেই একই সংখ্যক পদের জন্য প্রায় এক কোটি প্রার্থী বেড়ে যাওয়ায় এটা স্পষ্ট, বেসরকারি খাতেও যথেষ্ট চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (CMIE)-র দেওয়া তথ্য মতে জুলাই ২০১৭ থেকে এপ্রিল ২০১৮ সালের মধ্যে ভারতে বেকারত্ব দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। বেকারত্বের হার ৩.৩৯ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.২৩%। ৩১ মিলিয়ন শিক্ষিত বেকার বর্তমানে চাকরি খুঁজছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সি এস আই ই-র (CSIE) রিপোর্টে বলা হয়েছে চলতি বছরে দেশে বেকারত্বের হার এসে দাঁড়িয়েছে ৬.৯ শতাংশে। যা গত দু’বছরের থেকে সর্বোচ্চ। ২০১৭ সালে দেশে কর্মরত মানুষের সংখ্যা ছিল ৪০.৭ কোটি। বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯.৭ কোটি।

সিএসআইই-র (CSIE) রিপোর্টে বেকারত্বের আরও যে ভয়াবহ দিক উঠে এসেছে তা হল ডিমনিটাইজেশনের পরে দেশে কাজে শ্রমিক যোগদানের হার উল্ল্যেখযোগ্যভাবে কমেছে। লেবার পার্টিসিপেশন রেট বা শ্রমিক যোগদানের হার হল ১৬ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মোপযোগী মানুষের মধ্যে মোট কত শতাংশ মানুষ বর্তমানে কাজে নিযুক্ত রয়েছেন বা কাজের খোঁজে রয়েছেন। ডিমনিটাইজেশনের আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাস অব্দি দেশে শ্রমিক যোগদানের হার ছিল ৪৮ শতাংশ। মানে ডিমনিটাইজেশনের আগে ভারতে কর্মোপযোগী মানুষের মধ্যে প্রতি ১০০ জনের ৪৮ জন কাজ করতেন। কিন্তু ডিমনিটাইজেশনের পরে সেই হার নেমে এসেছে ৪২.৮ শতাংশে। দেখা যাচ্ছে মাত্র ২ বছরের মধ্যে কর্মোপযোগী মানুষের মধ্যে শতকরা ৬ জন ব্যক্তি কাজ হারিয়েছেন। আরও যে ভয়াবহ তথ্য এই রিপোর্টে উঠে এসেছে তা হল ২০১৭ সালে যেখানে দেশে ২ কোটি ১৬ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কাজে নিযুক্ত ছিলেন, সেখানে বর্তমানে ২ কোটি ৯৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক কাজের খোঁজে রয়েছেন।

আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত বেতন বৃদ্ধি হলেও দেশের ৮২ শতাংশ পুরুষ কর্মী এবং ৯২ শতাংশ মহিলা কর্মী এখনও মাসে ১০ হাজার টাকার কম বেতন পাচ্ছেন। সংগঠিত নির্মাণ ক্ষেত্রের অধীনে ৯০ শতাংশ শিল্পক্ষেত্রে ন্যাশনাল পে-কমিশন নির্ধারিত ন্যূনতম মাসিক বেতন দেওয়া হয় না।

ইন্টারন্যাশন্যাল সংস্থা ‘অক্সফাম’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী মোদি সরকারের আমলে দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ ভারতের মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে মাত্র ১ বছরে ভারতে ৭৩ শতাংশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ বড়লোকের হাতে। এই রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট যে ডিমনিটাইজেশনের ফলে কার্যত ধনিক শ্রেণির আয় বহুগুণ বেড়েছে। অন্যদিকে নিম্নশ্রেণির আয় আরও নিচে নেমেছে।

মোদি সরকার দেশের জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রতি বছরে দু’কোটি চাকরির সংস্থান করে দেবেন। অথচ প্রতিশ্রুতি দিয়েও গত কয়েকবছরে তার ১০০ ভাগের এক ভাগও (বছরে দুই লক্ষ) পূরণ হয়নি। বরং পূর্ববর্তী মনমোহন সরকারের আমলে দেশে বাৎসরিক কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান মোদির আমলের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি ছিল।

অথচ আমাদের যুবসমাজকে আমি কখনওই দেখি না নিজেদের রোজকার জীবনের এই চাওয়া-পাওয়া বা অধিকার দাবিগুলো নিয়ে সরব হতে! সরকারকে প্রশ্ন করতে! নিজেদের রোজকার জীবনের প্রয়োজনীয় দাবিগুলো ভুলে তারা ব্যস্ত গরু, ধর্ম, আর দেশপ্রেম-দেশদ্রোহিতা নিয়ে। মৌলবাদী শক্তিগুলো তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে ধর্ম আর জাতিবাদের বিষ। এই বিষ দেশ, সমাজকে বিষাক্ত করতে করতে যে একদিন তাদেরকেও গিলে খাবে এটা তারা বুঝতে পারে না।

তারা বুঝতে পারে না, এইভাবে ধর্ম, জাতি-বর্ণের নামে মিথ্যা প্রচার করে মৌলবাদী শক্তিগুলো একটা বেকার যুবককে ভুলিয়ে দিচ্ছে, সে বেকার। একজন শ্রমিককে ভুলিয়ে দিচ্ছে, সে একজন শ্রমিক। তার কাছে প্রধান করে তুলছে তার হিন্দুত্বের পরিচয়, তার মুসলমানত্বের পরিচয়। তাকে তার রুজি-রোজগারের চিন্তা ভুলিয়ে দিতে তার কানে কানে বলছে— ‘গরব সে কহো হাম হিন্দু হ্যায়’ অথবা ‘বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জেহাদ করো, পৃথিবীতে ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা করো।’

তারা বুঝতে পারে না, এই উগ্র মৌলবাদী শক্তিগুলো গরীব মানুষদের তাদের জীবন-জীবিকার প্রকৃত সমস্যাগুলো থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চায় ধর্ম, সম্প্রদায়ের দোহাই তুলে। গরীবী, বেকার সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, আর্থিক বৈষম্য, লিঙ্গসাম্যের অধিকার, সর্বোপরি মানুষ যাতে তার মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে কথা বলতে না পারে, তার জন্যে প্রতিনিয়ত খুব সুচারুভাবে তাদের মগজ ধোলাই করছে। মানুষকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে লড়িয়ে দিয়ে এই মৌলবাদী শক্তিগুলো নিজেরা ‘রামরাজ্যের’ হাওয়া খায়, ‘ইসলামিক শাসনের’ হাওয়া খায়।

তাই এবারে এই যুবসমাজকেই বুঝতে হবে, কোনটা আমাদের জন্য জরুরি? ভাবতে হবে ‘রামরাজ্যে’ বা ‘ইসলামিক শরিয়া আইনের দেশে’ আমরা একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলো পাব তো? চাকরি, আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঠিকঠাক হবে তো? সাম্য পাব তো? ভাবতে হবে, আর কতদিন আমরা আমাদের অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হব? এবং বুঝতে হবে, ধর্ম, রামরাজ্যে, ইসলামি রাষ্ট্রের ফোলানো প্যাকেটে আমাদের পেট ভরবে না। বিধর্মী, নিচুজাত এদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধটা নয়, যুদ্ধটা নিজের পেটের সাথে। যুদ্ধটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের যোগান দিতে পারে না, আর্থিক রোজগারের পথ দেখাতে পারে না।

তাই আরও অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগে আসুন আমরা ভাবনাচিন্তা করি, এবং একজোট হয়ে নিজেদের মৌলিক দাবিগুলো আদায়ের জন্যে লড়াই করি।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...