ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং: ভারতীয় সমাজের এক কলঙ্ক

ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং: ভারতীয় সমাজের এক কলঙ্ক -- ধ্রুব পাচৌরি

ধ্রুব পাচৌরি

 

ধ্রুব আইআইএম-আমেদাবাদের ছাত্র। তিনি এবং তাঁর আরও দুই সহপাঠী আশিস এবং রুদ্রিলের বেজওয়াড়া উইলসনের সঙ্গে আলাপচারিতা বর্তমান নিবন্ধটির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

যদি কোনও কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব না হয়, তবে তাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হয়। ভারতের জাতপাত ব্যবস্থাকে সেরকম ধ্বংস করার প্রয়োজন।
–বেজওয়াড়া উইলসন

ইউটিউব স্ক্রল করতে করতে একবার সামদিশ ভাটিয়ার মুম্বইয়ের ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারদের উপর একটি তথ্যচিত্র (লেখার নিচে দেওয়া হল) দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম। তখনই, বেশ কিছু প্রশ্ন আমায় সামনে চলে এসেছিল। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং ঠিক কী এবং ভারতে এটি এখনও কেন চলে আসছে? আমরা কি সামাজিকভাবেই একদল মানুষকে মরে যাওয়ার জন্য গ্যাস চেম্বারে পাঠাতে চাইছি? কেন বিশেষ কিছু জাতির মানুষকেই এভাবে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে?

ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং এবং স্ক্যাভেঞ্জার বিষয়টা একটু বোঝা যাক। Employment of Manual Scavengers and Construction of Dry Latrines (Prohibition) Act 1993 অনুযায়ী, ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং সেটাই যেখানে মানুষ নিজেই মানব-বর্জ্য পরিষ্কার করার কাজ করে। যাঁরা এই কাজ করেন, তাঁদের বলা হয় ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার।

একটি বিশ্বস্ত সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতীয় রেলে বর্তমানে সাফাই কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন পয়ঃপ্রণালীর ভেতরে ঢুকে পরিষ্কার করা ৭.৭ লক্ষ মানুষ এবং ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং করা ৩৬০০০ জন। বছরে গড়ে ১৭০০ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার পয়ঃপ্রণালীতে জমে থাকা বিষাক্ত গ্যাসে মারা যান। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর পেশা বেঁচে থাকার পক্ষেই এক বড়সড় চ্যালেঞ্জ। এই পেশায় নিযুক্ত মানুষের গড় আয়ু স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা কমে ৪০-৪৫-এ এসে যায় এই পেশার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন রোগের জন্য। এবং আশ্চর্যের কথা, ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারদের ৯৮ শতাংশই দলিত ও মহিলা।

 

বেজওয়াড়া উইলসন ও সাফাই কর্মচারী আন্দোলন

 

ভারতের বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কে খোঁজখবর করতে গিয়ে, আমার এবং আমার বন্ধুদের ২০১৬-র ম্যাগসেসে জয়ী এবং সাফাই কর্মচারী আন্দোলনের জাতীয় আহ্বায়ক শ্রী বেজওয়াড়া উইলসনের সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়। শ্রী উইলসন জাতি-বৈষম্য ও ম্যানুয়েল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম হোতা। তিনি ‘সাফাই কর্মচারী আন্দোলন’ বা সংক্ষেপে এসকেএ নামক এক জাতীয় আন্দোলনের মাধ্যমে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর বিরুদ্ধে সমস্ত কণ্ঠকে এক করেছেন। এই সংগঠন আইনগত ও সামাজিক প্রেক্ষিতে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এসকেএ-র করা একটি পেটিশনের পরিপ্রেক্ষিতেই মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৩ সালের আইন মোতাবেক ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং বন্ধ করতে আদেশ দিয়েছেন। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এসকেএ কাজ করছে। দেশের ৪৩৯টি জেলায় ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ৬৩০০-রও বেশি স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে এসকেএ-র।

আমাদের কথাবার্তার মধ্যেই আমরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে এসেছিল। শ্রী বেজওয়াড়ার সঙ্গে সেই কথোপকথনে সেই বিষয়গুলি সম্পর্কে যে উপলব্ধি তৈরি হয়েছিল, সেগুলিই এবার বলব।

 

এই নারকীয় প্রথা চিরতরে বন্ধ করতে আইনই কি যথেষ্ট?

ভারতে Employment of Manual Scavengers and Construction of Dry Latrines (Prohibition) Act 1993 মোতাবেক ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং নিষিদ্ধ। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই এই আইনের তোয়াক্কা করা হয় না। ২০০৩ সালে এসকেএ সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন ফাইল করে ১৯৯৩ সালের আইনটির আরও কড়া প্রয়োগ দাবি করে। পিটিশনে বলা হয়েছিল এই আইন ভঙ্গ করার প্রকৃত প্রস্তাবে সংবিধানের ১৭ নং (অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধকারী) এবং ২১ নং (মর্যাদা সহ বাঁচার অধিকার) ধারা লঙ্ঘনের সামিল হিসেবে গণ্য করা হোক। ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৩ সালের আইনটি লঙ্ঘন আসলে সংবিধান লঙ্ঘনের সমতুল— এই মর্মে রায় দেয়।

কিন্তু এইসব রায় এবং আইনের পরেও ভারতের বহু জায়গাতেই এই কাজ এখনও চলছে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণ যে সব কর্তাব্যক্তিদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইনকানুন প্রযুক্ত হয়, তাঁরাই জাতি-বৈষম্যের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছেন। এমনকী সুপ্রিম কোর্টের ২০১৪ সালে দেওয়া নির্দেশের পরেও কোনও সরকারি আধিকারিকের এখনও পর্যন্ত কর্তব্যে গাফিলতির দায়ে শাস্তি পেতে হয়নি, যদিও ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং কিন্তু অনেক জায়গাতেই বহাল আছে দিব্য। কিছু এফ আই আর দায়ের হয়েছে, কিন্তু কোনও এফআইআরই কাঠগড়ায় ওঠার জায়গায় পৌঁছতে পারেনি।

দ্বিতীয়ত, আইন এবং অধিকার সম্পর্কে নিপীড়িত মানুষের নিজেদের যথেষ্ট ধারণার অভাবও ভারতীয় সংবিধানের আইনগুলির পর্যাপ্ত প্রয়োগের আরেকটি বাধা।

 

জাতিভেদ প্রথা: ক্ষমতাশালীদের একটি সুবিধাজনক হাতিয়ার

ক্ষমতাশালী অংশকে আরও বেশিদিন ক্ষমতায় রাখতে, যেকোনও সমাজেরই বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা এক ব্যবস্থা রাখা দরকার, যাতে নিচের স্তরের মানুষদের যথেচ্ছ শোষণ করা যেতে পারে। ভারতে, সেটাই হল জাতিভেদ প্রথা, যার দ্বারা নিচুজাত নামে দাগিয়ে দেওয়া মানুষদের এইভাবে অত্যাচার করা হয়ে থাকে। জাতিবৈষম্যের ফলে উঁচুজাতের মানুষেরা বিশ্বাস করেন তাঁরা নিচুজাতের মানুষদের সেবা নেওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন। উঁচুজাতের মানুষেরা এই কুপ্রথাকে কাজে লাগিয়ে কম পারিশ্রমিকে কঠোর কাজ করিয়ে নেন। এইভাবেই, উঁচুজাতের মানুষদের কাছে জাতিভেদ প্রথা খুবই সুবিধের একটি অস্ত্র হয়ে উঠেছে।

 

নিপীড়িতদের কাছেই সমাধানের খোঁজ করা কি উচিত?

বেজওয়াড়া উইলসন যখন সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দায়ের করেছিলেন, তখন তাঁকে এবং তাঁর সহকর্মীদের কাছে বহুবার এই ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং বন্ধ করার জন্য সমাধানের রাস্তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু শ্রী বেজওয়াড়ার মতে কোনও ব্যক্তিবিশেষের চেয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষেই এই সমাধান বের করাটা বেশি সহজ। এই সমাধান খোঁজার দায়ভারটাও নিপীড়িত মানুষদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের এই মনোভাবের মধ্যে দিয়ে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর মতো একটি নারকীয় প্রথা বন্ধ করতে তার সদিচ্ছার অভাবেরই প্রকাশ ঘটে।

 

ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং নির্মূল করতে প্রযুক্তিকে কি কাজে লাগানো যেতে পারে?

মজার কথা, ভারত মঙ্গল গ্রহে পৌঁছে যেতে পারে, এক পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে, অথচ খুব কম বিজ্ঞানীই সমগ্র ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং প্রক্রিয়ার যান্ত্রিকীকরণের বিষয়ে কাজ করছেন। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর সমস্যার প্রযুক্তিগত সমাধানের দিকে খুব কমই দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে। এই সামাজিক অপরাধের থেকে আশু সমাধান হিসেবে প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করতে ভারতের অবিলম্বে বেশি করে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ শেষমেশ, মানুষই হল সভ্যতার মূলগত ভিত্তি।

 

তাহলে কি সরকার থেকে একমাত্র আশ্বাস বলতে আর্থিক পুনর্বাসনই পড়ে থাকল?

ভারত সরকার থেকে আর্থিক দিক দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করা হয়েছে। শ্রী বেজওয়াড়া বলছেন, আর্থিক সাহায্য ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য শেষতম পন্থা। তাঁর কথায়, এই পেশায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের অটো-রিকশা বা মোষ ইত্যাদি দিয়ে তৎক্ষণাৎ পাশে দাঁড়ানোর মতো সাহায্য সরকারের থেকে প্রয়োজন নেই। বরং, সরকারের এঁদের কাজের দিকটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা উচিত। তাঁদের নতুন দক্ষতা ও পারদর্শিতা খুঁজে বের করতে উদ্যোগী হওয়া উচিত। কারণ এঁরা ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং ছাড়া আর কোনও কাজই শেখেননি। প্রশিক্ষণপর্বে সরকারের উচিত এঁদের যথাযোগ্য আর্থিক সহযোগিতা করা। যখনই এঁরা বিকল্প পেশার জন্য পারদর্শিতা ও জ্ঞান অর্জন করবেন, তখনই সরকার তাঁদের সেইসমস্ত পেশায় নামার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ তৈরি করে দেবে।

 

অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি

ভারতে জাতিভেদ প্রথার শেকড়ে এতটাই গভীরে প্রোথিত যে তথাকথিত নিচুজাতের মানুষরা নিজেরাই বিশ্বাস করেন যে এই ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর কাজটা তাঁদেরই, এবং উঁচু জাতের লোকেরা তাঁদের চাইতে শ্রেষ্ঠতর। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং নির্মূল করতে গেলে নিপীড়িত মানুষদের বোঝাতে হবে যে অর্থাভাব বা অন্যান্য কাজে দক্ষতার অভাবের জন্য নয়, একমাত্র জাতিভেদ প্রথার জন্যই তাঁদের একাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাঁদের আরও স্পষ্ট ভাষায় বোঝাতে হবে যে, অন্যেরা যদি ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং না করে বেঁচে থাকতে পারেন, তাহলে তাঁরাও এইধরনের অসম্মানজনক কাজ না করেই টিকে থাকতে পারবেন।

এই মর্মেই এসকেএ নিপীড়িত মানুষদের বিষয়গুলি বোঝাতে নিরলস কাজ করে চলেছে। এসকেএ তাঁদের প্রতিবাদের পদ্ধতি শেখাচ্ছে, এবং এই মারণ চক্র থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা বাতলাচ্ছে। এই অবদমিত মানুষগুলি যদি একবার এই নারকীয় কাজ থেকে মুক্তি পেতে চান, তখন পৃথিবীর কোনও শক্তিই আর তাঁদের আটকাতে পারবে না।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...