বস্তারের ইমলি আন্দোলন, ১৯৯৭

বস্তারের ইমলি আন্দোলন, ১৯৯৭ -- আমন রাঠি, আশুতোষ রুংতা, দর্পণ জৈন

আমন রাঠি, আশুতোষ রুংতা, দর্পণ জৈন

 



ছাত্র, আইআইএম-আমেদাবাদ

 

 

 

ছত্তিশগড়ের বেলিয়াপাল গ্রামে সকাল হচ্ছে। ভোর চারটে। শিবকুমারী— বছর চল্লিশ বয়স, আদিবাসী— জঙ্গলে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। ৫-৬ কিলোমিটার গহীনে ঢুকতে হবে। হাতে ঝুড়ি। তাতে নেওয়া হবে যাকে পরিভাষায় বলে মাইনর ফরেস্ট প্রোডাক্টস (এমএফপি)। কাছাকাছি এলাকাগুলিতে সাধারণত শালবীজ আর তেঁতুল পাওয়া যায়। আরও কয়েকজন আদিবাসী মহিলা বন্ধুদের সঙ্গে যাবেন, আর মাথায় করে সেসব নিয়ে আসবেন শিবকুমারী। প্রতিদিনই মোটামুটি ১০ কেজি জিনিস নিয়ে আসেন তিনি। এই ওজনটা মাথায় নিয়ে অনেকটা পথ হাঁটা তার অভ্যাস আছে।

সাতটা আটটার মধ্যে শিবকুমারী বাড়ি ফিরবেন জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে। স্বামী ছেলেমেয়েদের খাবার দেবেন। ঘরের কিছু কাজকর্ম শেষ করে ওইসব জিনিসপত্র কিছু সাফাই করবেন হয়তো— যেমন, তেঁতুল থেকে শক্ত খোসা বা ফাইবার ইত্যাদি ছাড়ানো। সেগুলি এখন বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত। এবার তিনি আবার এই প্রাথমিকভাবে প্রস্তুত করা এমএফপিগুলিকে মাথায় করে বয়ে অন্তত ১০ কিলোমিটার দূরে সবচেয়ে কাছের কোনও বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাবেন। দুপুর গড়িয়ে গেছে, জগদলপুর জেলার বাইরের ব্যবসায়ীরা এই মহিলাদের কাছ থেকে ‘ব্যক্তিগতভাবে’ জিনিসপত্র কিনে নেওয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তাঁদের ছোট ট্রাকে বস্তা এবং হাতে-মাপার দাঁড়িপাল্লা থাকে। ব্যবসায়ীর লোক শিবকুমারীর মাথা থেকে জিনিস দাঁড়িপাল্লায় তুলবে। শিবকুমারীর পরিশ্রম এবং জিনিসগুলির গুণাগুণ নিয়ে তাঁদের মধ্যে কিছু হালকা কথাবার্তা হবে। তারপর শিবকুমারী টাকাপয়সা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেবে। কোনও কোনও দিন ওরকম কিছু এমএফপির বিনিময়ে শিবকুমারী কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন নুন, চিনি ইত্যাদি নিয়ে নেন। এসব ক্ষেত্রে দাম-টাম নিয়ে কোনও কথাই হয় না। এই ধরনের বিকল্প বিনিময় প্রথা কিন্তু কম নয়। নুন, চিনি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি প্রত্যন্ত গ্রামে দুর্লভ বলা যেতে পারে এবং এইসমস্ত ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই আদিবাসীরা সেসব পেয়ে থাকেন।

শিবকুমারীর টাকার দরকার প্রচণ্ড, এবং ব্যবসায়ীরা সেটা জানে। ফলে তারা তাঁকে এবং তাঁর মতো অন্যান্য আদিবাসী মহিলাদের জিনিসগুলো যতটা সম্ভব কম দামে নিয়ে নেয়। হয় বলে বাজারদর কম, নয় জিনিসপত্র ভালো নয়, এমন অজুহাত দিয়ে। শিবকুমারীর অন্য ব্যবসায়ীদের কাছেও যাওয়ার উপায় নেই। কারণ তিনি এই ব্যবসায়ীদের কাছেই বহুদিন থেকে জিনিসপত্র বিক্রি করছেন এবং এর থেকে ধারকর্জ্জও করে রেখেছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই ব্যবসায়ীরা একটা কার্টেল বানিয়েছে। তার নিয়ম অনুযায়ী কোনও ব্যবসায়ী ইচ্ছে করলেই জিনিসের দাম বাড়াতে পারবে না। ফলে শিবকুমারীদের ওই বেঁধে দেওয়া স্বল্পমূল্যেই জিনিস বিক্রি করতে হবে। শিবকুমারী কিন্তু বোঝেও না যে তাঁকে কম দাম দিয়ে ঠকানো হচ্ছে। ওজন মাপার প্রক্রিয়াটিও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানেও স্বাভাবিকভাবেই স্বচ্ছতার কোনও বালাই নেই।

প্রায় এক শতক ধরে এই একপেশে ব্যবসা প্রতিদিন অসংখ্যবার হয়ে চলেছে। হিসাব মতো এই ধরনের এমএফপি-র মূল্য হয় বছরে দু লক্ষ কোটি টাকা। আদিবাসী ভারতবর্ষে মোটামুটি এইরকম প্রায় পাঁচ কোটি শিবকুমারী আছেন, যারা নিজেরা পরিশ্রম দিয়ে এগুলি সংগ্রহ করেন এবং তারপর অনেক কম দামে এমন বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হন যে বাজার পুরোপুরি মধ্যস্বত্বভোগীরা নিয়ন্ত্রণ করে। এইধরনের এমএফপি শিবকুমারীদের বাড়ির উঠোন থেকে তাদের যাত্রা শুরু করে এবং শেষ করে হেলথকেয়ার, বিউট কেয়ার ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়ে। যদিও, এই শিবকুমারীরা, যারা এইসব দ্রব্যের প্রকৃত মালিক, তাঁদের বাজারের অন্তিম মূল্যের ১০ শতাংশেরও কম পেয়েই খুশি থাকতে হয়।

Panchayets (Extensions to Scheduled Areas) Act 1996 বা পেসা অনুযায়ী, অরণ্যে বসবাসকারী মানুষের অরণ্যজাত দ্রব্যের উপর অধিকার সবচেয়ে বেশি। যদিও, এই আইন এমএফপি-র কোনও সংজ্ঞা দেয়নি এবং কিছু প্রায়োগিক ভুলভ্রান্তিও থেকে গেছে। চিরাচরিতভাবে অরণ্য গাছ, ফল, ফুল, মূল ইত্যাদির সমাহার যা জীবন ও জীবিকার জন্য যথেষ্টই। কিন্তু সমস্যার গভীরে ঢুকতে গিয়ে দেখা গেছে অরণ্যের অধিকার সম্বন্ধে উপলব্ধিতে ধোঁয়াশা থাকার ফলে এই অরণ্যবাসীরা বাধ্য হয়ে কৃষি শ্রমিক জাতীয় বিকল্প পেশা বেছে নিচ্ছেন। এছাড়াও, অরণ্যের অতি-ব্যবহার আটকাতে ফরেস্ট অফিসিয়ালদের বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞাও ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা ঘটনা যে, ভারতে অরণ্য সেখানেই টিকে আছে যেসব এলাকা খুব বেশি আদিবাসী অধ্যুষিত। কিন্তু এই আদিবাসীরাই কোনও না কোনওভাবে অত্যাচারিত হতেই থাকেন। এইজন্যেই এখন খুব প্রয়োজন আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া যাতে তাঁদের জীবিকা ও আয়ের ধারাবাহিক জোগান সচল থাকে, আর পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে তাঁরা রক্ষা পান।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমানেসমানে কথা বলা এবং সমঝোতা করার মতো আদিবাসীদের সমষ্টিগত তৎপরতার অভাব। একারণেই, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে জোট গড়ে এবং ন্যায্য মূল্যের বাজার তৈরি করে পরিবারের একমাত্র আয় করা এই শিবকুমারীদের মতো মানুষের জীবনে স্বচ্ছলতা আনা যেতে পারে।

জঙ্গলের সঙ্গে আদিবাসীদের মিথোজীবীতার সম্পর্ক। দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য তাঁদের দিনে একবার জঙ্গলে যেতেই হয়। শহরের জীবনযাত্রার সঙ্গে এই জীবন মিলবে না। এবার এই তাঁদের সঙ্গে প্রচণ্ড অসাম্যযুক্ত একটা বাজারের যে সম্পর্ক সেটাই রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ দাবি করে। জঙ্গল হল প্রকৃতির সম্পদ। যেসব জনজাতি এই জঙ্গলের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকেন তাঁরা এর প্রকৃত মূল্য বোঝেন, এবং একে রক্ষা করতে তথা সংরক্ষণ করতেও জানেন। তাঁরা লাগানো গাছ এবং প্রাকৃতিক অরণ্যের তফাত করতে জানেন। একদিকে বনজ সম্পদ থেকে তৈরি হওয়া জিনিসগুলো ভোগ করব, আর অন্যদিকে আদিবাসীরা জঙ্গল ধ্বংস করছে বলব— এ হল চূড়ান্ত মধ্যবিত্ত হিপোক্রিসি, যা আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্ন এলেই বেরিয়ে পড়ে।

প্রাকৃতিক অরণ্যগুলিতে সুস্থিত জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন সেইসব জাতির মানোন্নয়ন এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের ক্ষমতা বন্ধ করে এদের অরণ্যের অধিকারকে ফিরিয়ে দেওয়া। কাঠ ছাড়া অরণ্যের অন্যান্য দ্রব্য অর্থাৎ এমএফপি-গুলির ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গে বিকেন্দ্রীকরণ পদ্ধতিতে কোনও স্বচ্ছ সংস্থার মাধ্যমে কেনাবেচা সুনিশ্চিত করতে হবে, যাতে এঁদের যথেষ্ট আয় সম্ভব হয়। সঠিক রূপায়ণ হচ্ছে কিনা ঠিকমতো লক্ষ রাখতে হবে, পাশাপাশি অসাধু উপায়ে মূল্য বাড়ানো, ওজনে কারচুপি ইত্যাদি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

এবং ঠিক এটাই ১৯৯৭ সালে হয়েছিল। সে বছর এক দিন, বাস্তারের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর এবং ১৯৮৭-র এমপি ক্যাডার ব্যাচের আইএএস অফিসার শ্রী প্রবীর কৃষ্ণ বাজারের এইধরনের অসাধু অস্বাভাবিক কাজকর্ম দেখে ফেলেন। কোনও আদিবাসী মহিলা মহুয়ার মতো মূল্যবান সংগ্রহ হয়তো এক প্যাকেট নুনের বিনিময়ে দিয়ে দিচ্ছেন বা কেজি প্রতি পঞ্চাশ পয়সার মতো সামান্য মূল্যে বিক্রি করছেন, যেখানে বাজারদর তখন কেজি প্রতি পাঁচ টাকা। প্রবীর কৃষ্ণ ব্যবসায়ীদের এই অসততা মেনে নিতে পারেননি।

তার মনে হয়েছিল এই এত বড় দুর্নীতি দেখে চুপ করে থাকাটা একটা অপরাধ. ট্রাইবাল অ্যাট্রোসিটিজ অ্যাক্ট-এর ১৪৪ ধারা অনুযায়ী এই সমস্ত কাজকর্ম বেআইনি, এবং এই এলাকার এই মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সেটাই লাগু করা হল। এই আইন অনুযায়ী নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণের দায়টা অভিযুক্তের ওপরেই বর্তায়। স্বভাবতই ব্যবসায়ীদের সংগঠন ক্ষেপে উঠল এবং কালেক্টরের ওপর একের পর এক মামলা চাপানো হতে থাকল। আমরা যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলি তখন তিনি মনে করে বলতে পেরেছিলেন এরকম মোট ৩৫টা মামলা চাপানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি একটু শক্ত ধাতের মানুষ ছিলেন। এই সমস্ত করে তাঁকে কাবু করা সম্ভব ছিল না। আদালতে আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে তিনি নিজেই নিজের হয়ে সওয়াল করা শুরু করলেন। তাঁর পক্ষে জনমত তৈরি হতে থাকল। তার সঙ্গেই তিনি পিএমও এবং রাজ্যের মন্ত্রীদের কাছে একের পর এক চিঠি লেখা শুরু করলেন। ব্যবসায়ীরা তাকে হেনস্থা করা শুরু করতেই তিনি আইনি সুরক্ষা এবং সহায়তা চেয়ে আবার ওপরমহলে চিঠি লিখলেন। একটা গোটা টিম কমিশন করা হয়, নিউ দিল্লির সিনিয়র অফিসারদের কাছে রিপোর্ট পাঠানো হয়, এবং শেষ পর্যন্ত এই বিষয়টা সত্যিকারের যেখানকার সেখানে আলোড়ন তৈরি হতে শুরু করে।

এই লড়াইয়ের ফলে প্রবীর কৃষ্ণ তখনকার বাজারে ৫০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন, যা আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য ধার্য করা হয়েছিল। তেঁতুলের ন্যূনতম মূল্য কেজি প্রতি পঞ্চাশ পয়সা থেকে বেড়ে ছ টাকায় উন্নীত হল। কেনাবেচার যে প্রক্রিয়া চলত তাকে বেআইনি ঘোষণা করা হল এবং দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হল। এই কাজের জন্য একটি সামগ্রিক পর্যবেক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি করা হল, যেখানে সমস্ত সরকারি কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে ওয়্যারলেস যন্ত্রপাতির মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করা হল এবং কোনও অন্যায় দেখলেই তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট করতে বলা হল। তৃণমূল স্তরে ২৪০০টি স্বনির্ভর দল তৈরি করা হল, যার মাধ্যমে আদিবাসীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ করতে পারবেন। এই স্বনির্ভর দলগুলি তৈরি হওয়ার ফলে অসাধু ব্যবসায়ীদের পক্ষে বিশেষ কিছু আদিবাসীকে চিহ্নিত করে তাঁদের উপর অন্যায় করার পথে বাধা তৈরি হল। হাটে বাজারে হওয়া প্রত্যেকটি লেনদেন পর্যবেক্ষণ করা হল এবং অডিটের জন্য নথিভুক্তও করা হল। আদিবাসীদের সঠিক মূল্য দিয়ে সৎ ব্যবসার লক্ষ্যে একজন মানুষের লড়াই শেষমেশ এক গণ-আন্দোলনে পরিণত হল।

কিন্তু ব্যবসায়ীরা অত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই এই ঘটনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রবীর কৃষ্ণ স্মৃতিচারণ করছিলেন সেদিনের কথা— যেদিন মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টার কোন্ডাগাঁও নামল এবং সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসীরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং তাঁদের ‘ইমলি আন্দোলন’ ও ‘ইমলি ম্যান’ সম্পর্কে সব শোনালেন। একজন আদিবাসী মহিলার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল। তিনি হাত দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন, ‘সাব, পহলে হাম ইতনা (খুব কম) কামাতে থে’ এবং ‘ইস সাল হাম ইতনা (খুব বেশি) কামায়েঁ’। সবাইকে বোঝানোর জন্য এই কথা কটাই যথেষ্ট ছিল। তারপর আস্তে আস্তে, মধ্যস্বত্বভোগীরা নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলতে শিখে নিল।

“আমার মনে আছে একদিন পরিদর্শনের কাজে একটা গ্রামে গেছি। সেখানকার আদিবাসীরা তো আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে ‘ইমলি ম্যান’ বলে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। সেদিনই আমার প্রথম উপলব্ধি হয়েছিল যে এটা একটা উদ্যোগ থেকে আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এই মানুষগুলিকে যে শেষমেশ কিছুটা হলেও সুবিচার দিতে পেরেছি এটাই আমার তৃপ্তি। আর সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝেছিলাম যে এই লড়াইটা আমি হারতেই পারতাম না। আমি তো শুধু নিজের জন্য বা নিজের জেদের জন্য লড়ছিলাম তা নয়। আমি লড়ছিলাম এই মানুষগুলির কয়েক প্রজন্মের জীবন এবং জীবিকার জন্য।”— প্রবীর কৃষ্ণ বলছিলেন।

তাঁর কাজে খুশি হয়ে মুখ্যমন্ত্রী একটি ১০০ কোটি টাকার তহবিল অনুমোদন করেন, যার লক্ষ্য ছিল মূল্য উপযোগের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্মূল করে ফেলা, আদিবাসীদের উপার্জন আরও বাড়ানো, এবং সমস্ত সদর্থক কাজগুলিকে সংহত করা। কৃষ্ণ একটি বড় এবং অনেকগুলি ছোট ছোট প্লান্ট তৈরি করেছিলেন যেখানে গ্রামবাসীরা তাদের এমএফপিগুলিকে প্রসেস করতে পারত। সরকার জিনিসগুলি মার্কেটিং ব্র্যান্ডিং এবং বিক্রির দায়িত্ব নিয়েছিল।

সবই ঠিকঠাক চলছিল। তারপরই একটা আঘাত এল বাইরে থেকে। ২০০০-এর ১ নভেম্বর মধ্যপ্রদেশ কেটে ভারতের ২৬তম রাজ্য হিসেবে ছত্তিশগড়ের জন্ম হয়। এর ফলে নতুন প্রশাসন আসে, এবং বেশিরভাগ সরকারের মতোই তারাও আগের সরকারের শুরু করা সমস্ত কাজেরই হয় গুরুত্ব কমিয়ে দেয় নয়তো বন্ধ করে দিতে চায়। সরকারের এই মানসিকতা, আর তার সঙ্গে আরও কিছু প্রশাসনিক বিষয় যুক্ত হয়ে কৃষ্ণর কাজে গুরুতর ক্ষতি হয়। ফান্ড আসা কমে যায়, তার স্বাধীনতা কমিয়ে দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত আরও অনেক কাজ করার মানসিকতাসম্পন্ন আমলার মতই তাকেও অনুগত না হওয়ার অপরাধে বদলি হয়ে যেতে হয়।

কিন্তু গ্রাম্বাসীদের জীবনে কৃষ্ণর প্রভাব বা অবদান কোনওভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। এবং শেষমেশ তাঁর এই মডেলকে দেশব্যাপী চালু করার উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত সরকার ২০০৬ সালে ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট, ২০০৬ পাশ করে। এই আইনের বলে এমএফপি-গুলির ওপর গ্রামবাসীদের অধিকারকে মান্যতা দেওয়া হয়। এই আইন ১৯৯৬-এর পেসা আইনের চেয়ে অনেকটাই উন্নত কারণ, এতে বাঁশ, কোকুন, মধু, মোম, তেন্দুপাতা এবং অন্যান্য ভেষজ লতাগুল্মের মতো কাঠ-ব্যতীত অন্যান্য বনজ দ্রব্যগুলিকে অরণ্যবাসী মানুষের আয়ের উৎস বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এই স্বীকৃতির ফলে অরণ্য নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনে গণতান্ত্রিকীকরণের একটা চেষ্টা করা হয়েছিল বলা যায়। ভারতের জম্মু ও কাশ্মির ও উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলিকে বাদ দিয়ে মোট ৮৫.৬ মিলিয়ন একর বনাঞ্চলে কমিউনিটি ফরেস্ট রিসোর্স রাইটসকে মান্যতা দেওয়া হয়েছিল। এভাবে দেশের ১,৭০,‌০০০টি গ্রামে মোট ২০০ মিলিয়ন অরণ্যবাসীকে সম্মানের সঙ্গে কর্মসংস্থান করে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখিয়েছিল এই আইন। এখানে শুধুমাত্র আর্থিক দিক অর্থাৎ দারিদ্র দূরীকরণ ও কর্মসস্থানের সুযোগই তৈরি হয়নি, লিঙ্গ সমতা (সামাজিক দিক) ও অরণ্য সংরক্ষণের (পরিবেশগত দিক) সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। স্থানীয় মানুষদের কাজে লাগিয়ে, জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারকে সুনিশ্চিত করে এই আইন উগ্র বামপন্থীদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার রাস্তাও তৈরি করেছিল।

কিন্তু তাত্ত্বিক দিক থেকে ঠিক থাকলেও বাস্তবে সঠিক রূপায়ণের অভাবে পরিণতিতে একেবারেই সফল হয়নি এই আইন। ২০১৬ পর্যন্ত কমিউনিটি ফরেস্ট রিসোর্স রাইটসের মাত্র ৩ শতাংশই রূপায়িত হয়েছে। মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, কেরল ইত্যাদি কিছু রাজ্য ভালো কাজ করলেও অধিকাংশ রাজ্যের কাজই নিন্দনীয়। ছত্তিশগড়ের কথাই যদি ধরা যায়, তাহলে সেই রাজ্য ব্যক্তিগত অধিকার ও কমিউনিটি অধিকারকে মান্যতা দিলেও কমিউনিটি ফরেস্ট রাইটসকে মান্যতা দেয়নি। কমিউনিটি ফরেস্ট রাইটস গ্রামসভাকে গুরুত্ব দেয় এবং অরণ্য সংরক্ষণে এর ভূমিকাকে মান্যতা দেয় বলে এর তাৎপর্য যথেষ্টই। কেন্দ্রের আদিবাসী বিষয়ক দপ্তরের পক্ষ থেকে সংগঠন তৈরিতে ব্যর্থতা, ইচ্ছেশক্তির অভাব, এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং অপ্রতুল পর্যবেক্ষণের পরিণতিতে শেষমেশ এই আইন শুধুমাত্র কাগজেকলমেই থেকে গেল।

কিন্তু ২০১৭-র মাঝবরাবর সময়ে এক সদর্থক বদল এল, কারণ সেই প্রবীর কৃষ্ণ দেশের আদিবাসী উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম ট্রাইবাল কোঅপারেটিভ মার্কেটিং ডেভেলপমেন্ট ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া বা ট্রাইফেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিযুক্ত হলেন। এই সংস্থাটি দেশের আদিবাসীদের বিভিন্ন উৎপাদিত দ্রব্যের বাজার তৈরি এবং বণ্টনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রবীর কৃষ্ণ ঠিক সেটাই করতেন বস্তারে তাঁর ট্রান্সফারের আগে অবধি। সেই ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের তহবিল থেকে।

এখনও পর্যন্ত তাঁর এই পদে থাকাকালীন ট্রাইফেডের লভ্যাংশ চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উপকৃত হয়েছেন আড়াই লাখ আদিবাসী হস্তশিল্পী। অন্যান্য পরিবর্তনও হয়েছে। আদিবাসী উন্নয়ন মন্ত্রক থেকে প্রায় ৫০টি এমএফপি-র জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ধার্য করা হয়েছে। বলা যেতে পারে প্রবীরবাবুর সেই ২০ বছর আগের কাজই এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ছাড়াও আদিবাসীরা যাতে তাঁদের সংগৃহীত জিনিসগুলি কিছুটা উন্নত করে আরও বেশি দাম পেতে পারেন ট্রাইফেডের পক্ষ থেকে তাঁদের সেই প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। যেমন, কাঁচা তেঁতুল বাজারে কেজি প্রতি ৩০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু ফাইবার ও বীজ বাদ দিলে তার দাম ১২০ টাকা প্রতি কেজি। আরও পাউডার, চাটনি, সস ইত্যাদি বানিয়ে নিতে পারলে তা ৪০০ টাকা প্রতি কিলোয় বিক্রি হতে পারে। এইধরনের প্রাথমিক মূল্য সংযোগের কাজগুলি গ্রামে বসেই করে ফেলা যায়। প্রবীরবাবু বলছিলেন, ‘আমরা প্রথমে আদিবাসীদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিয়ে সাহায্য করতে চাই, তারপর ভ্যালু অ্যাডিশন এবং শেষে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিতে চাই।’

প্রবীরবাবু এবং ট্রাইফেডের সর্বশেষ প্রোজেক্ট হল ‘বন ধন’ ট্রাইবাল স্টার্ট-আপ যোজনা। এতে গ্রামে গ্রামে গোষ্ঠী-পরিচালিত বন ধন বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমে আদিবাসীদের দল বানিয়ে তাঁদেরকে আঁন্ত্রেপ্রেনিওরে পরিণত করার চেষ্টা করা হবে। প্রতিটি কেন্দ্র ১৫টি আদিবাসী সেলফ হেল্প গ্রুপের সমন্বয়ে তৈরি, যার প্রতিটিতে আছেন ২০ জন করে আদিবাসী। ফলে প্রতিটি কেন্দ্র থেকে বেনিফিশিয়ারি ধরলে সংখ্যাটা মোট ৩০০-য় দাঁড়াচ্ছে। কেন্দ্র সরকার থেকে প্রতিটি কেন্দ্রকে ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে বলা হয়েছে। কেন্দ্রগুলি আদিবাসীদের যন্ত্রপাতি কেনার, ভ্যালু অ্যাডিশন করার এবং সামগ্রিক ম্যানেজমেন্টে প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে। এখন যখন অতিমারির জন্য প্রচুর আদিবাসী শহর থেকে কাজ খুইয়ে গ্রামে ফিরছেন, এই অবস্থায় এই যোজনা আদিবাসীদের কর্মসংস্থানের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য হিসেবে দেখা দিতে পারে। যাই হোক, তাত্ত্বিক দিক থেকে খুবই আশাব্যঞ্জক হলেও শেষমেশ বাস্তবে রূপায়ণের কতটা কী হয়, তা বোঝাটা সময়সাপেক্ষ। তবে, প্রবীর কৃষ্ণ নেতৃত্বে থাকলে, অনেক কিছুই আশা করা যেতে পারে।

ফেম ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন, এশিয়া পোস্ট এবং পিএসইউ ওয়াচ-এর ‘২০২০-র সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০ ভারতীয়’-র তালিকায় প্রবীর কৃষ্ণ যে থাকবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এবং তাঁর এই তালিকাভুক্ত হওয়া এবং ট্রাইফেডে এমডি হিসেবে তাঁর কাজকর্ম— এই দুইই পরস্পর সংযুক্ত। বনজ দ্রব্য কেনাবেচার প্রক্রিয়াটিকে সঠিকভাবে আদিবাসীদের পক্ষে নিয়ে আসতে তিনি যে সচেষ্ট হয়েছিলেন, আজ ট্রাইফেডে তাঁর সেই মানসিকতার প্রতিফলনই আমরা দেখতে পাচ্ছি।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...