তারান্তিনো, সিজন দুই — সাত

প্রিয়ক মিত্র

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

কলকাতা শহরের বুকে একটা খুন হয়ে গেছে কাল। ভয়াবহ খুন। রহস্যজনক খুন। সাদা চোখে দেখে খুন বলে মনে হয় না হয়তো। কারণ, কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই, বিষপ্রয়োগ নেই‌, এমনকী একটা সূচও ফোটানো হয়নি গোটা শরীরে।

তাহলে খুন হল কীভাবে?

লালবাজারের অলিন্দ দিয়ে ব্যস্তসমস্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে শাজাহান ইলিয়াস।

চোখেমুখে দুশ্চিন্তা এবং তৎপরতা।

তরুণ, টগবগে এই পুলিশ অফিসার স্বদেশিদের খতম তালিকায় আছে। তাকে স্বদেশিদের ত্রাস বলে বটে তালপাতার সেপাইরা, কিন্তু স্বদেশিদের কাছে শাজাহান শুধুই শিকার। শাজাহানের মাথা গরম। পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে পারে না সে। স্বদেশিদের পাকড়াও করার আগেই সে খালাস হয়ে যেতে পারে। সেসব বুঝেই বোধহয় সাহেব বড়কর্তা উডপেক তাকে স্বদেশিদের পিছু নেওয়ার কাজ থেকে বিরত করছেন।

অবিশ্যি আসল কারণটা আলাদা! বড়কর্তার নইলে এত দরদ নেই শাজাহানের প্রতি।

গোয়েন্দা বিভাগে শাজাহানের নিয়োগ আসলে শাজাহানের শাস্তি। তার মতো দুঁদে অফিসারকে তো আর বসিয়ে দেওয়া যায় না! বা হাবিলদারিও করানো যায় না তাকে দিয়ে।

গত মাসের ঘটনা। হঠাৎ খবর এল, কলকাতার উত্তর প্রান্তে একটি বাড়িতে স্বদেশিরা ডাকাতি করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। বাড়িটা ঠনঠনিয়ার কাছে।

সকাল সকাল শাজাহানের ঘুম ভাঙল দরজার ঠকঠকানিতে।

ভবানীপুরের এই বাড়িতে শাজাহানের থাকার ব্যবস্থা করেছে পুলিশ বিভাগ। এলাহি ব্যবস্থা। হুকুম তামিল করার জন্য, সেবাশুশ্রূষার জন্য সবসময় খাস খানসামারা বহাল।

তার পরিবার নেই। জামশেদপুরে এক দূরসম্পর্কের চাচার বাড়িতে সে মানুষ। চাচা সপরিবারে থাকতেন এক বিলাসবহুল মহলে। খানদানি পরিবার। কিন্তু অনাথ শাজাহান বহুদিন পর্যন্ত অপাঙক্তেয় ছিল সেখানে। তার পড়াশোনা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা ছিল না। চাচি থেকে শুরু করে বাড়ির অন্যান্যরা তাকে দেখলেই মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠত। চাচা দেখলেন, এভাবে তো হয় না। তাঁর তো একটা দায়িত্ব থেকে যায়। শাজাহানের দায়িত্ব তিনি তুলে দিলেন ডেভিস সাহেবের হাতে। ডেভিস ছিলেন স্থানীয় পুলিশকর্তা। শাজাহানকে তিনিই বড় করলেন। তাকে দেখেই পুলিশ হওয়ার ইচ্ছে জেগেছিল শাজাহানের।

কলকাতায় প্রথমে শাজাহানের থাকার ব্যবস্থা ছিল পুলিশের মেসে। কিন্তু সেখানে টিকতে পারেনি শাজাহান। তাকে শুনতে হয়েছে তার গায়ে ‘ট্যানারির গন্ধ’, সে ‘গরুখেকো’ বলে সকলে অশুচি হচ্ছে— আরও কত কী!

বিমর্ষ হয়ে পড়ার ছেলে শাজাহান নয়। জন্মের পর থেকে অবহেলাই দেখে এসেছিল সে। কিন্তু ডেভিস তাকে শিখিয়েছেন, নিজেকে ভয়াল করে তুলতে, ওজনদার করে তুলতে। যাতে তাচ্ছিল্য করার সাহসও কেউ না পায়। বড় জোর এড়িয়ে যেতে পারে, তাতে কিছু যায় আসে না‌।

ওই মেসের এক বাসিন্দাকে একদিন দেওয়ালে গাঁথা গজাল থেকে টানা আটটি ঘণ্টা টাঙিয়ে রেখেছিল শাজাহান। তার হাতে ধরা ছিল একটি শঙ্করমাছের বেত। কী জানি সে কী বলেছিল শাজাহানকে!

ভয়ে আর কেউ ঘাঁটাত না শাজাহানকে বিশেষ।

এই ঘটনার পর সকলে মিলে তদ্বির করতে শুরু করল শাজাহানকে মেসে থাকতে না দেওয়ার জন্য। কিন্তু শাজাহান ততদিনে দাপুটে দারোগা। তাকে মেস থেকে তাড়াব বললেই তাড়ানো যায় না কি?

অবশেষে নিজর ব্যবস্থা নিজেই করল শাজাহান। আলিপুর বোমা মামলার পর থেকেই টেগার্টের আদেশে গুপ্তসমিতির পান্ডাদের শিকার করতে আদাজল খেয়ে নেমেছিল পুলিশ বিভাগ। শাজাহান একটি গুপ্তচক্রের পান্ডাকে হাতেনাতে ধরল, পুলিশ বহুদিন ধরে যাকে নজরে রেখেছিল, কিন্তু কিছুতেই বাগে আনতে পারছিল না।

খুশি হয়ে তাকে ভবানীপুরের এই বাসভবন দিয়ে দিলেন উডপেক সাহেব। এক বাবুর্চি তার এলাহি খানাপিনার ব্যবস্থা করত। এক শাফি তার গেলাসে পেয়ালা থেকে মদ ঢালত। একজন সকালে ঘুম ভাঙাত। একজন জুতো পর্যন্ত পরিয়ে দিত। সকলেই মোটামুটি বিশ্বস্ত।

সেদিন সকালে কেউ তার ঘুম ভাঙায়নি।

দরজায় দমাদ্দম আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে উঠে বিস্রস্ত অবস্থায় ড্রেসিং গাউন কোনও মতে গায়ে চাপা দিয়ে বেরিয়ে এল সে। আসার পথে চাকর বেয়ারাদের নাম করে হাঁক দিল, গাল পাড়ল। কেউ সাড়া দিল না। দরজায় পৌঁছে কিছু একটাতে হোঁচট খেতে খেতে বেঁচে গেল সে। আরও চিড়বিড় করে উঠল মাথা।

অবশেষে সে নিজেই খুলল সদর দরজা।

ভোররাত অবধি মদ খেয়েছে সে। মাথা টনটন করছে। চোখে এখনও মাকড়সার জালের মতো ঘুম লেপ্টে। এই অবস্থায় দরজা খুলে সে সামনে দেখে উডপেক সাহেব দাঁড়িয়ে।

একা উডপেক অবশ্য নন, বাকি হাবিলদারদের মুখ থেকেও একটা বিস্ময় এবং আতঙ্ক মেশানো স্বর বেরিয়ে এল শাজাহানকে দেখে।

‘ঘুম থেকে উঠে আয়না দেখোনি?’

প্রায় আর্তনাদের সুরে শাজাহানকে প্রশ্ন করলেন উডপেক।

শাজাহান যেন খানিক বিস্ময়ে হতবাক হয়েই কপালে হাত দিল, কারণ সামনের সকলের চোখ তার কপালে এসে ঠেকেছে।

অবাক আতঙ্কে শাজাহান দেখল তার হাতে উঠে এসেছে রক্ত।

বাংলা লেখা উডপেক এখন একটু একটু পড়তে পারেন, শাজাহানের কপালে টাটকা রক্ত দিয়ে খুদে অক্ষরে যা লেখা, তা বুঝতে পারছেন উডপেক।

লেখা আছে, ‘মরার জন্য তৈরি হও।’

হঠাৎ কী মনে হতেই বিভ্রান্ত শাজাহানকে ঠেলে উডপেক ঢুকে পড়লেন তার বাড়ির ভেতরে। সঙ্গী হল হাবিলদাররাও।

ঘুমচোখে এখনও আধামত্ত শাজাহান যা দেখতে পায়নি, তা এবার দেখতে পেলেন উডপেক ও বাকিরা।

বাড়িময় চাপচাপ রক্ত‌। তার মধ্যে শাজাহানের চারজন বেয়ারা ও একজন পাহারাদারের লাশ ইতস্তত পড়ে। পাহারাদারের লাশ পড়ে দরজার ঠিক সামনে।

পিছু পিছু এসে দাঁড়িয়েছে শাজাহান নিজেও। পাহারাদারের লাশ দেখে সে বুঝল দরজার সামনে সে কীসে হোঁচট খেয়েছিল।

এবং কথা বলার চোঙাসমেত টেলিফোনটা ভেঙে ছত্রখান।

উডপেক বুঝলেন, কেন সকাল থেকে শাজাহানকে টেলিফোনে পাওয়া যায়নি।

শাজাহানের মাথা গনগন করছে। সে তার বালিশের তলায় রাখে সার্ভিস পিস্তলটা। সেটা নিতে সে ছুটল ঘরে। প্রয়োজনে এই অবস্থাতেই সে খুঁজতে বেরবে যে, কার এত বড় স্পর্ধা, যে তার ঘরে ঢুকে এই কাণ্ড ঘটাতে পারে। ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তাকে টেরটিও না পাইয়ে তার কপালে হুমকি লিখে যেতে পারে।

শাজাহান তার শোয়ার ঘরে ঢুকে বালিশটা তুলতেই আঁতকে উঠল।

‘পিস্তল নেই?’

শোয়ার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন উডপেক। তার গলা গম্ভীর, থমথমে।

খাটের উপর ধপ করে বসে পড়ল শাজাহান।

কোনও মতে, প্রায়-অস্ফুট স্বরে সে বলল, ‘কার এত বড় সাহস!’

‘বোধহয় ঠনঠনের ডাকাতদের।’

ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে শাজাহানের খাস লোক, হাবিলদার বলরামও।

‘মানে?’

রাগে, বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে গেল শাজাহানের।

ব্যাপারটা স্পষ্ট করলেন উডপেক।

যে গুপ্তসমিতির পান্ডাকে ধরেছে শাজাহান, সম্ভবত তাদের লোকজন ঝামাপুকুর এলাকায় একটি বাড়িতে ডাকাতির চেষ্টা করেছে কাল রাতে। পারেনি। সঙ্গে শাজাহানের বাড়ির এই ঘটনা স্পষ্ট করে দিচ্ছে, শাজাহানকে তারা সরাসরি বার্তা দিচ্ছে। একবার ঝামাপুকুর গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করতে পারলে বোঝা যাবে।

শাজাহানের মাথার ঠিক রইল না। সে ঠিক করল, সে যাবেই ঝামাপুকুরে।

বারণ করেছিলেন উডপেক। একবার। তার কেন জানি না মনে হচ্ছিল, এই শাজাহান ধূর্ত, বুদ্ধিমান শাজাহান নয়। এই শাজাহানের মাথায় আগুন জ্বলছে। সে অনর্থ ঘটাতে পারে। এতে আখেরে ক্ষতিই হবে।

কিন্তু শাজাহানের জেদ দেখে আর বারণ করলেন না উডপেক।

সেখানে পৌঁছে যা জানতে পারল শাজাহান, তাতে তার মাথা গেল আরও গরম হয়ে।

একশো বছর আগেও এই এলাকা ছিল জঙ্গল। তারও একশো বছর আগে তো এই এলাকা কলকাতাও ছিল না। ছিল সুতানুটি গ্রাম। সেই গ্রাম ঘিরে থাকা এই জঙ্গলে সিদ্ধেশ্বরী কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এক তান্ত্রিক। তারও একশো বছর পর শঙ্কর ঘোষ নামে এক ব্যবসায়ী তৈরি করলেন এই মন্দির। তখনও জঙ্গল। সেই জঙ্গলে মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ ভেসে যেত, ঠনঠন ঠনঠন। সেই থেকেই নাম ঠনঠনিয়া। এই মন্দিরে গান গেয়ে গিয়েছেন নাকি স্বয়ং গদাধর চট্টোপাধ্যায়, অর্থাৎ, দক্ষিণেশ্বরের রামকেষ্ট ঠাকুর। এই মন্দিরের কল্যাণেই আশপাশের এলাকা, অর্থাৎ ঝামাপুকুর এলাকা সমৃদ্ধ হয়েছে। বর্ধমান থেকে এসে এখানেই বাড়ি করেছিলেন সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তার ছেলে ভবেশ প্রথমে শাক্ত, পরে বেম্ম, তারপর বিয়ে-থা করে গুচ্ছের সন্তানের জন্ম দিয়ে আবার বেম্ম হয়েছিলেন। তারপর লম্পট বড় ছেলে দীনেশকে শায়েস্তা করতে তার বিয়ে দিলেন। সেই পুত্রবধূর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েই শেষমেশ বাড়িছাড়া হল সেই বড় ছেলে, এবং অবশেষে বিবাগী হলেন ভবেশ। বড় ছেলে তারপর ফিরল বাড়িতে।

এসবই পুরনো গালগল্প। আসল গল্প অন্যত্র।

ব্যারিস্টার দীনেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং লক্ষ্মীদেবীর মেয়ে লতা। তাকে পড়াতে আসত হিন্দু কলেজের এক ছোঁড়া। কাল রাতে সে লতাকে নিয়ে ভেগেছে।

অন্যদিকে যে বাড়িতে ডাকাতি, সেই বাড়িতে আরেক কেচ্ছা!

সে কেচ্ছা অবশ্য পাড়ায় গুঞ্জনে ভাসছে।

ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে রায়বাড়িতে। জমিদারদের বাড়ি। জমিদার কালীনাথ রায় গত হয়েছেন। এখন গৃহকর্তা তাঁর ছেলে কাশীনাথ রায়। তাঁর তিন ছেলে-মেয়ের ছোটটির নাম তিনি রেখেছিলেন তাঁর স্বর্গত ঠাকুরদা রমাকান্ত রায়ের নামে।

সেই মেয়েকে নিয়ে পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে গেছে।

এই বাড়ির খাস চাকর বৃদ্ধ লোকেশের ছেলে খগেন নাকি পালানোর তাল করেছিল রমাকে নিয়ে। সঙ্গে নিয়ে যেত এ-বাড়ির পারিবারিক অভিজ্ঞান।

এর শাস্তি দেওয়ার জন্য খগেনকে জেল খাটানোর কথা ভেবেছিলেন কাশীনাথ। হাতেপায়ে ধরেছিল লোকেশ। সে বলেছিল, ‘আপনি ওকে চাবুকপেটা করুন। ব্রিটিশ দারোগার হাতে তুলে দেবেন না।’

চাবুকপেটা করে খগেনকে মেরেই ফেলত কাশীনাথ।

বাদ সাধল নায়েব বিশ্বনাথের ছেলে গৌরমোহন। সে দরজা বন্ধ করে কাশীনাথকে কী বলল কে জানে! কাশীনাথ যখন ঘর থেকে বেরল, তখন তার চোখের দৃষ্টি পালটে গেছে। ঘরের বাইরে বসে থাকা লোকেশ আর খগেনের চোখে আকুতি দেখে তার চোখ নেমে এল। সে কোনও কথা না বলে চলে গেল নিজের ঘরে।

চিলেকোঠায় বন্ধ অবস্থায় এ খবর পেয়ে রমার কোনও অনুভূতি হয়নি। সে শুধু ভাবছিল লতার কথা। লতা পালিয়ে গেল মৃন্ময়দাদাকে নিয়ে। সে পারল না‌ খগেনদার সঙ্গে পালাতে।

এই গোটা ঘটনাটা লক্ষ করে সন্দেহ হয়েছিল কাশীনাথের ভাই রাধাকান্তর। সে চেপে ধরেছিল গৌরমোহনকে।

গৌরমোহন তার কাছে কিছু লুকোয়নি। বলেছিল, যা সে শুনেছিল তার বাবা বিশ্বনাথের থেকে।

ওই আংটি আদতেও তাদের পারিবারিক অভিজ্ঞান নয়। ওই আংটি আসলে লোকেশ-খগেনদেরই।

বিশ্বনাথের ছেলেকে অবিশ্বাস করার কারণ নেই। কিন্তু সত্যিটা জেনে কাশীনাথের মতিগতি গেল পালটে। সে জীবনেও যাকে চাকর বলে ভাবেনি, সেই লোকেশ বা খগেনকে সে আর সহ্য করতে পারল না।

তবে সে কাউকে কিছু বলেনি। রাধাকান্ত একজনকেই বলেছিল। অনেক পরে। কাশীনাথের নাতি আদিনাথকে।

যাক সেসব কথা, শাজাহানের এতখানি জানার কথাই নয়। সে শুধু কেচ্ছাটুকুই জানল।

রায়বাড়িতে তাহলে ডাকাত পড়েইনি। খগেন রমাকে নিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে।

আর পাশের বাড়িতেও একই ঘটনা। এই বাড়ির মেয়ে রমা আর পাশের বাড়ির মেয়ে লতা তার মানে একসঙ্গেই পালানোর ফন্দি করেছিল। তাহলে তো রমাকে জেরা করলেই হয়!

এসবের পেছনে নাকি স্বদেশিরা আছে! কে যে এসব মাথায় ঢুকিয়েছে সাহেবের!

শাজাহানের এসবে সময় নষ্ট করলে চলবে না। তাকে জানতে হবে কে তার বাড়িতে ঢুকে এত বড় ঘটনা ঘটাল।

শাজাহান এই তদন্তে আর সময় দিল না। আর তার দু দিনের মধ্যেই জানা গেল, যাকে গ্রেফতার করেছিল শাজাহান, সেই স্বদেশিদের পান্ডা সূর্য দত্ত পালিয়েছে জেল থেকে। শাজাহান যখন তার খোচড় লাগিয়ে তার ওপর হামলার চক্রীদের খুঁজছে, ততক্ষণে তারা পালিয়েছে জেল ভেঙে তাদের পান্ডাকে সঙ্গে নিয়ে।

এর পরের খবরটা শাজাহানের জন্য আরও বিধ্বংসী।

পুলিশ বিভাগ খবর পেয়েছে, মুখুজ্জেবাড়ির মেয়ে লতা যার সঙ্গে পালিয়েছে, সেই মৃন্ময় এই দলের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আরও জরুরি যা, তা হল লতার নিজেরও যাতায়াত ছিল সূর্য দত্তর বাড়িতে।

আর রমা নাকি এসবের কিছুই জানত না‌‌।

রায়বাড়িতে ডাকাতি করার চেষ্টা তার মানে স্বদেশিরাই করেছিল। সেদিন শাজাহানের মন এতই অন্যদিকে পড়েছিল, যে সে ভাল করে ডাকাতির বিবরণই শোনেনি। শুনলে বুঝত, নিজেদের বাড়িতে জলছাদ দিয়ে খগেন আর রমা ঢুকত না। পালাবার চেষ্টা করার বদলে, তারা গৌরমোহনকে অজ্ঞান করে সে ঘর খানাতল্লাশ করত না। আর গৌরমোহনকে অজ্ঞান করার আগে জিজ্ঞেসও করত না, খগেন কোথায়!

ডাকাতরা খগেনকে খুঁজছিল বলেই সকলে ভেবেছিল খগেন এর মধ্যে আছে। কিন্তু তদন্ত বলছে খগেন এর বিন্দুবিসর্গও জানত না‌।

তাহলে খগেনকে স্বদেশিরা খুঁজছিল কেন? কী চায় তারা খগেনের কাছে?

এসব উত্তর পাওয়ার আগেই উডপেক ডেকে পাঠালেন শাজাহানকে। তিনি বুঝেছিলেন, শাজাহান বিষয়টা ব্যক্তিগতভাবে নিচ্ছে। তাই তাকে দিলেন অন্য কেস।

সূর্য মিত্রর সঙ্গে আরও দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারাও পালিয়েছে জেল থেকে। কিন্তু জেল থেকে পালিয়েছে আরও এক দাগী আসামি। বেশ কয়েকটা খুনের মামলা আছে তার নামে। উডপেকের মতে সে ‘মোস্ট নটোরিয়াস জেলবার্ড হু ফ্লিউ অ্যাওয়ে।’

‘স্বদেশিদের থেকেও নটোরিয়াস?’ তাকে স্বদেশিদের মামলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বুঝে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়েই শাজাহান জিজ্ঞেস করেছিল।

উডপেক বললেন, হ্যাঁ‌।

এরপর আর কথা চলে না। গোয়েন্দাবিভাগের জাঁদরেল অফিসার গোবিন্দরাম দাস ছিলেন এই কেসের দায়িত্বে। তাঁর সঙ্গে এই কেসের তদন্ত শুরু করেছে শাজাহান।

গতকালের খুনটা নিয়ে তাই এত তৎপর শাজাহান।

একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে তার বাড়িতে ঢুকে খুন করা হয়েছে। আতরে অ্যালার্জি ছিল ভদ্রলোকের। আর তাকে খুন করা হয়েছে সম্ভবত কড়া আতরের গন্ধ শুঁকিয়ে। লোকটির মেডিক্যাল হিস্ট্রি না জানলে এমনভাবে খুন করা যেত না। যে গুটিকয় লোক এ বিষয়ে জানত, তার মধ্যে ছিল এই ব্যক্তির এককালীন ডাক্তার।

সেই ডাক্তার আর কেউ নয়, শাজাহানরা যাকে খুঁজছে, সেই ফেরার আসামি।

এই খুন কীভাবে হয়েছে, তা পুলিশের ডাক্তার বা ময়নাতদন্ত— এসবের মাধ্যমে জানা যেতেই পারত। কিন্তু যে রুমালে আতর মাখিয়ে শুঁকিয়ে, বা বলা যেতে পারে, নাকে চেপে ধরে খুন করা হয়েছে লোকটিকে, সেই রুমাল মৃতদেহের পাশেই ফেলে রাখা হয়েছে।

যেন পুলিশকে জানান দেওয়া, আমি আছি।

অলিন্দ পেরিয়ে গোবিন্দরাম দাসের ঘরে এসে ঢুকল শাজাহান।

গোবিন্দরাম তার দিকে তাকাতেই বুঝলেন, গোলমাল।

শাজাহান বলল, ‘এই খুনি প্রমথরঞ্জন রায় ছাড়া কেউ হতে পারে না, স্যর!’

 

(আবার আগামী সংখ্যায়)


তারান্তিনোর সব পর্বের জন্য দেখুন: তারান্তিনো — প্রিয়ক মিত্র

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...