কৃষি আইন ও কৃষক আন্দোলন

প্রণব কান্তি বসু

 



প্রাক্তন অধ্যাপক, নিবন্ধকার, রাজনৈতিক ভাষ্যকার

 

 

 

 

২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে মোদিসাহেব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিজেপি ক্ষমতায় এলে কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করে প্রতিটি নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা জমা করা হবে। পরে অবশ্য শাহ-বাবু ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন যে এটা নেহাতই কথার লব্জ কারণ এমন টাকা হস্তান্তরের আইনি ধারা নেই। এবার জনমানসে কৃষক আন্দোলনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করার জন্য ভারত সরকার একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে যাতে তারা বলছে যে মোদি সরকার ২০২২-এর মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করতে বদ্ধপরিকর। অবশ্যই এটাও একটা কথার লব্জ। বস্তুত, হালে প্রবর্তিত কৃষি আইনগুলির থেকে স্পষ্ট যে বর্তমান সরকারের উদ্দেশ্য কৃষিকে বৃহৎ পুঁজির অবাধ বিচরণভূমিতে পরিণত করা।

প্রথমে দেখা যাক সরকারের প্রচারপত্রের দাবিগুলির যাথার্থ্যটা। বলা হয়েছে যে এই তিনটি নতুন কৃষি আইনের মাধ্যমে ‘ক্রেতাদের সঙ্গে লেনদেনে কৃষকদের আইনি সুরক্ষার কাঠামো দৃঢ় করা হয়েছে যাতে তাদের পণ্য বিক্রি থেকে আয় সুনিশ্চিত হয়।’ বস্তুত, চুক্তিচাষ এবং পণ্য বিক্রি সংক্রান্ত দুটি আইনেই সাব-কালেকটার, ডেপুটি-কালেকটার এবং ডিসট্রিক্ট কালেকটারকে দেওয়ানি আদালতের বিচারকের মান্যটা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, চুক্তিচাষ এবং কৃষিপণ্য বিক্রি সংক্রান্ত কোনও বিবাদ হলে তা মীমাংসা করার অধিকার আদালতের থাকবে না, থাকবে সরকারি আধিকারিকের হাতে। আমলাতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ ও রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্য গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করে। এই আইনগুলি বিচারব্যবস্থার সাধারণ চরিত্র সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বিবাদ ফয়সালা করার দায়িত্ব আমলাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যে কোনও সংঘাতে দুর্বল পক্ষই সাধারণত সুবিচার পায় না। এ ক্ষেত্রে রিলায়েন্স জাতীয় বড় কৃষিপণ্যের ব্যবসায়ীদের তুলনায় কৃষক বিক্রেতারা অবশ্যই দুর্বল।  বিচারের সুযোগ থেকে তাদেরই বঞ্চিত করা হল।

এই প্রচারপত্রে আরও বলা হয়েছে যে ‘এই সংশোধনীগুলি বহু দশক ধরে স্টেকহোল্ডার বা স্বার্থসম্পৃক্ত সকলের সঙ্গে আলোচনা করে, একাধিক কমিটির মতামত নিয়ে, সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলির ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে।’ বাস্তবটা হল যে এই আইন অনুমোদনের আগে তা লোকসভার সিলেক্ট কমিটি-তেও বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়নি। প্রথমে, লোকসভা অধিবেশনের আগেই এই আইনগুলি অর্ডিন্যান্স হিসাবে জারি করা হয়। পরে তা কোনও আলোচনা ছাড়াই শাসক দলের সংখ্যাধিক্যের সুযোগে লোকসভায় অনুমোদন করানো হয়। এই প্রসঙ্গে এই তথ্যটা উল্লেখ করা জরুরি যে বিজেপি, সাধারণভাবে, লোকসভায় আলোচনাবিমুখ। চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ লোকসভায়, যথাক্রমে, ৭১ শতাংশ এবং ৬০ শতাংশ বিল সিলেক্ট কমিটি-র মতামতের জন্য পাঠানো হয়। ষোড়শ লোকসভায় মাত্র ২৫ শতাংশ বিল পাঠানো হয় এবং বর্তমান লোকসভায় এখন পর্যন্ত মাত্র ১৭টি বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।

বিতর্ক তিনটি আইন নিয়ে। ‘কৃষিপণ্যের ব্যবসাবাণিজ্য (সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ)’ আইন; ‘কৃষকের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) এবং দাম সুনিশ্চিত ও কৃষিকাজ’ সংক্রান্ত আইন; ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সংক্রান্ত সংশোধনী’ আইন। প্রথম আইনটির ফলে এখন যে কোনও ব্যক্তি বা কোম্পানি কৃষকের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে কৃষিপণ্য কেনার চুক্তি করতে পারে। ফসল ওঠার আগেই তার দাম, মান এবং অন্যান্য আইনি বিষয় সম্বন্ধে চুক্তি হতে পারে। সরকারের প্রচার অনুসারে দ্বিতীয় বিলটির মুখ্য উদ্দেশ্য মাণ্ডি প্রথার গুরুত্ব কমানো। এখন আর মাণ্ডির বাইরে কৃষিপণ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে কোনও বাধা থাকল না। কৃষকের থেকে কৃষি বিপণন কোম্পানিগুলিরও সরাসরি পণ্য কেনার সুব্যবস্থা হল। সরকারের দাবী এতে কৃষকের লাভ হবে কারণ ক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে। অঞ্চলের কৃষি মাণ্ডির একচেটিয়া আধিপত্য কমবে এবং মাণ্ডিতে কেনাবেচার ওপর লাগু রাজ্যের কর থেকেও কৃষক মুক্ত হবে। তৃতীয় আইন (অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন)-এর মাধ্যমে খাদ্যশস্য, ডাল, তেলবীজ, আলু, পেঁয়াজ জাতীয় পণ্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হল। তালিকা বর্জিত করার ফলে এই পণ্যগুলি মজুতের কোনও আইনি সীমা আর থাকল না, এর দামের বা এর বণ্টনের ওপর, সাধারণভাবে, সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণক্ষমতা থাকল না। সরকার দাবী করছে যে এর ফলে হিমঘর বা কৃষিপণ্য বিপণনের সহায়ক অন্যান্য পরিকাঠামো প্রস্তুতকারী ক্ষেত্র ব্যক্তিগত পুঁজি বেশি মাত্রায় আকর্ষণ করবে কারণ কৃষিপণ্য-বাজারে সরকারের অতর্কিতে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা আর রইল না।

এই আইনগুলির বিরুদ্ধে কৃষকেরা নজিরবিহীন প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের আশঙ্কার নানা কারণ আছে। এদের মূল বক্তব্য এদেরই একটি স্লোগানে স্পষ্ট: “সারকার কি অসলি মজবুরি/আদানি, আম্বানি, জামাখোরি”। কৃষিপণ্যের ব্যবসাবাণিজ্য (সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ) আইন বলবত হওয়ার ফলে মাণ্ডিব্যবস্থা অবলুপ্ত হবে বলে কৃষকরা আশঙ্কা করছে। মাণ্ডিগুলি থাকলেও তার বাইরে কেনাবেচার ওপর কোনও কর লাগু হবে না বলে ব্যবসাদারদের কাছেও মাণ্ডিব্যবস্থার থেকে মাণ্ডির বাইরে কেনাই আকর্ষণীয় হবে। এর ফলে সরকারি নিয়ন্ত্রণের রক্ষাকবচ থেকে তারা বঞ্চিত হবে। বিশেষ করে কৃষকরা সরকারি সংরক্ষণ মূল্য থেকে বঞ্চিত হবে বলে আশঙ্কা। তারা আরও ভয় পাচ্ছে যে ধীরে মাণ্ডিব্যবস্থার বিলুপ্তির দিকেই সরকার এগোচ্ছে।

এটা ঘটনা যে মাণ্ডির মাধ্যমে এখনও কৃষিপণ্যের অর্ধেকের মত মাত্র বিক্রি হয়। এর কারণ মূলত সীমিত সংখ্যার মাণ্ডি। কিন্তু মাণ্ডিগুলি থাকার ফলেই কৃষকেরা সংরক্ষিত দামের সাহায্য নিতে পারে। মাণ্ডিব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায় যে এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল বাজারে কৃষক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ১৯৬০-৭০-এর দশকে প্রায় সমস্ত রাজ্যে কৃষিপণ্য বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ আইন বলবত করা হয়। এই আইন অনুসারে কৃষিপণ্যের প্রাথমিক বিক্রয় শুধু মণ্ডিতে হতে পারে। এই মাণ্ডিগুলি কৃষিপণ্য উৎপাদন সমবায় নিয়ন্ত্রণ করে। রাজ্য বিশেষে এই আইনের কিছু তারতম্য আছে কিন্তু মূলত এই সমবায়গুলি কৃষক, ব্যবসায়ী, কৃষিপণ্যের গুদাম মালিক এবং সরকারি আমলাদের নিয়ে গঠিত হয়। ব্যবস্থার কিছু দোষত্রুটি অবশই আছে। অনেকেই অভিযোগ করে যে প্রভাবশালী ব্যবসাদাররা মাণ্ডিগুলি নিয়ন্ত্রণ করে তার ফলে চাষিরা তাদের ফসলের ন্যায্য দাম পায় না। মাণ্ডিব্যবস্থার সংশোধন করা নিঃসন্দেহে প্রয়োজন; কিন্তু তা বর্জন করে সরকার যা করল তা বস্তুত আদানি, আম্বানি আর মজুতদারদের সুবিধা করে দিল।

কৃষকদের আশঙ্কা করছে ‘কৃষকের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) এবং দাম সুনিশ্চিত ও কৃষিকাজ সংক্রান্ত আইন’-এর মাধ্যমে সরকার চুক্তিচাষের ক্ষেত্র সম্প্রসারণের চেষ্টা করেছে। অর্থাৎ এক দিকে যেমন প্রথম আইনের সুযোগে কৃষিপণ্য বিপণন ক্ষেত্রের কর্পোরেটাইজেশনের সুযোগ করে দেওয়া হল, অন্যদিকে তেমন দ্বিতীয় আইনের সাহায্যে কৃষি-উৎপাদনের কর্পোরেটাইজেশনের সুব্যবস্থা করে দেওয়া হল। এর ফলে কিছু পুঁজি বিনিয়োগ কৃষি-উৎপাদন এবং বাণিজ্য ক্ষেত্রে ঘটবে না এমনটা নয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই ক্ষেত্রগুলি আদানি-আম্বানিদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। সরকার যা প্রচার করছে— প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি— তার ঠিক বিপরীতটাই ঘটবে। অবশ্য, এটাই সরকারের গূঢ় পরিকল্পনা। গৈরিকীকরণ আর সমস্ত ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষেত্র বৃহৎ মিত্রোঁ পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া এটাই বর্তমান সরকারের মূল নীতি। প্রশ্ন করতে পারেন এর ফলে যদি সাধারণের চাকরি হয় ক্ষতি কী। হালে সরকারের প্রণীত শ্রমবিধিগুলি যদি একটু দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে কোনও ক্ষেত্রে উন্নয়ন যদি বা ঘটে তার সম্পূর্ণ ফায়দাই যাতে পুঁজিপতির হাতে কুক্ষিগত হয় এবং শ্রমজীবী মানুষের থেকে সস্তা আরও শ্রম কীভাবে শুষে নেওয়া যায় তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকার সদা তৎপর।

এই আইনগুলি আমাদের সংবিধানের ফেডেরাল চরিত্রেরও বিরোধী। সংবিধান অনুসারে কৃষিক্ষেত্র রাজ্যের অধীনে। এ কারণেই মাণ্ডি সংক্রান্ত পুরনো আইনগুলি রাজ্যস্তরে প্রণীত হয়। কিন্তু বর্তমান আইনগুলি কৃষিক্ষেত্র সম্বন্ধীয় হলেও রাজ্যগুলির সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করেই কেন্দ্র লাগু করেছে। এখানে কেন্দ্র সরকার একটা চাতুরি করেছে। তারা দাবী করছে যে যেহেতু এই আইনগুলি বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তাই তা কেন্দ্রের ক্ষমতার আওতায় পরে। মনে রাখতে হবে যে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ একনায়কতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। বামপন্থী কিছু মানুষ কৃষকদের আন্দোলন সম্বন্ধে সন্দিহান কারণ তাদের মতে এটা পুঁজিবাদী কৃষক বা কুলাকদের আন্দোলন। যারা আন্দোলন করছে তাদের একটা বড় অংশ অবশ্যই অবস্থাপন্ন, কিন্তু যে বিপুল সংখ্যায় কৃষকরা আন্দোলনে সামিল হয়েছে তার থেকে এটা স্পষ্ট যে এরা কোনও মতেই বৃহৎ পুঁজির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। চার্লি চ্যাপলিন যখন ইউনাইটেড আর্টিস্ট গড়ে হলিউডের স্টুডিওগুলির ওপর একচেটিয়া পুঁজির নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তখন তা অবশ্যই প্রগতিশীল একটা পদক্ষেপ ছিল। আবার গোদি সংবাদপত্রগুলি দাবী করছে যে ইতিমধ্যেই কৃষকদের সঙ্গে বৈঠকে কেন্দ্র কৃষকদের তোলা আপত্তিগুলি সংশোধনী এনে সমাধান করবে বলে আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করছে না কারণ তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এরা বেমালুম ভুলে যাচ্ছে যে আন্দোলনকারী কৃষকদের একটা মূল বক্তব্য তাদের জীবিকা সম্বন্ধে কোনও আইন প্রণয়ন করতে হলে তা তাদের সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনা করেই হতে পারে। সুতরাং তাদের দাবী: বর্তমান আইন তিনটে খারিজ করে তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নতুন আইনের খসরা তৈরি করতে হবে। বিজেপি সরকার মূল সমস্যার থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাবার জন্য কংগ্রেস এবং অন্যান্য দলগুলি আগে কী করেছিল এই সব প্রশ্ন তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বস্তুত, কংগ্রেস যে সাধারণভাবে বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির হয়েই কাজ করে তা বলাই বাহুল্য; কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণের ওপর ভর করেই সমস্ত সংসদীয় পার্টিগুলির সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেই বিচারে এখন কংগ্রেসের পক্ষে আম্বানি, আদানিদের তাঁবেদারি করা মুস্কিল। এ কারণেই তারা বাম শক্তিদের সঙ্গে বিহারে মহাগঠবন্ধনে যেতে বাধ্য হয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...