সাতটি কবিতা
একা
আমি ভালবেসে কাউকে, বজ্রের মতো ঘোষণা করলাম
অতল বিচ্ছেদ আমি মাতালাম আকাশ ফাটিয়ে
ব্যথা লাগলে চিক্কুর
অল্প ওমে সিংহগর্জন
এভাবে আমি
তোমার মুখের ছবি স্বর্গ থেকে টাঙিয়ে ফেললাম
অনন্ত বিচ্ছেদ আমি সবচে উজ্জ্বল রঙে ছোপালাম
আমার বাঁচামরা, দেশ কাল
স্থবিরতা, অতিঅস্থিরতা
সব আমি বাজালাম গগনবিদারী
এভাবে এভাবে আমি
সমস্ত আধো স্বর, না-বলা কথা
জীবন উজিয়ে আসা এক ফালি আশ্চর্য আলো
এক ভিড়ে দুটি চোখ নিছক তাকাল
সব হারালাম, সব ভুলে
পাড়ি জমালাম আত্মময় শব্দ আর অনর্থের কূলে
লেখা
আমি চাই আমার লেখা প্রেমের কথা বলুক
বলুক ফাগুনের কথা
আগুনের মতো জ্বলুক
তুমুল অন্যায্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াক পিঠ টান করে
আর যা মৃদু
বিধুর বাতাসে যা যা ভাসে
সেইসব রং রস সুরে
স্নান করে উঠুক সে
চোট-খাওয়া দেহে মনে হোক উপশম
হৃদয়ে ছড়িয়ে দিক নিরক্ষীয় ওম
আমি চাই
আমি এইসব চাই
কিন্তু আমি শেখাইনি লেখাকে হাঁটতে
শেখাইনি ভাঙতে, গড়তেও
পিষে ফেলবার পা, ঝটকায় ছিটকে দেবে, সে লেখা কোথায়?
অসামান্য অপ্রাপ্তি আর অকিঞ্চিত প্রাপ্তি নিয়ে
বানাবে অরূপ খেলাঘর,
সে লেখা কোথায়?
আমি লিখি না
আমি বাজাই: লিখব
আমি লিখি না
আমি সাজাই: লিখেছি
আয়ু সরে সরে যায়
আত্ম
কতটা জীবন আমি লেখায় বর্তাব
কত লেখা দিয়ে আমি গড়ব জীবন
লেখা কি জীবন নয়?
জীবন কি লেখার অধিক?
কতটা ভিখারি আমি, কতখানি আত্মসচেতন
অসীমে আরম্ভ হয়ে ধীরে অজানার দিকে যাব
সমস্ত ভুলের ব্যথা ভুলে গিয়ে ক্রমে ঠিক ঠিক
যেসব ছোটতে বাঁচি
ঘর পথ পাড়া প্রতিবেশ
যে অনন্তে অধিকারী নয় এই অণু-পরমাণু
সব স্বতশ্চল আর সবটুকু স্থাণু
মিলেমিশে বেঁধে তুলবে আমাকে জীবন
জীবনে লেখার ডাক
লেখায় জীবন খুঁজে পাব
অনধিকার
যে রোদে আমি পুড়িনি
আমি লিখিনি তার কথা
শরীর-মনে পাইনি যেই জলের মধুরতা
যে ঝড়ে এক হয়নি ঘরবার
কী হক তার ছবিটি আঁকবার?
যেই আগুনে হইনি জ্বলে খাক
যে ধ্বংসের নই অংশভাক
কীভাবে আমি লিখব তার কথা?
এ দৃষ্টির অপার সুদূরতা
ফিসফিসিয়ে জানাই সংহতি
মুখ লুকিয়ে মানাই প্রতিলোম
একার পক্ষ, একার অসম্মতি
একার ঘরে জ্বালিয়ে তোলা হোম
বোঝাপড়া
কোনওদিন ফেরাতে পারিনি কোনও ঢিল
শুধু,
মনে মনে প্যাঁচোপরি প্যাঁচ
শান্তি প্রেম ন্যায়সাম্য
তীব্র ক্যাঁচক্যাঁচ
হিংসুকে মোক্ষম থাবড়া
পণ্ডিতকে মুখের মতন,
সেয়ানার ঘাড় পাকড়ে: চোরা রে ধর্মের বাণী শোন
এইসব ভাবি আর
দুপা আগে তিনপা পিছনে
নথি পড়ে, পথে ঘুরে,
ডানা মুড়ে নিজস্ব উঠোনে
নেমে আসি,
হাতের পাতায় ঢাকি চোখ
দেবতা মানি না আর ভয়ে মরি:
হে দেবতা
স্পর্ধা দাও, জ্ঞানচক্ষু, বুঝসুঝ, কৌশল বর্ষাও
এই বেশুমার গড়িমসি
ভেঙে দাবড়ে বলো: তত্ত্বমসি
আমারো আপদ শান্তি হোক
চলে যাব
এ শহর, যার ধুলো গিলে মেখে এতদূর আসা
উপকণ্ঠ, গ্রামদেশ, আধো বা অচেনা
যাকে চেয়ে গেছি শুধু
যাকে ছাড়া দিন কাটছে না
লোভে কামে ঈর্ষায় প্রণয়ে
দীনতায় নিরুপায়ে অস্তিত্ব-সংশয়ে
যে ঘর স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে
যা রয়েছে নামমাত্র, যা কিছু অনন্ত রোমন্থনে
সংযোগ যাচ্ঞা করে যে ভূগোলে ফেরা জনেজনে
সব ছেড়ে সব ছেড়ে সব
উধাও দোকানে এক, চা চুমুকে জাগবে অনুভব
কে আমি? এ দেশে কালে, এ প্রকৃতি এই লোকালয়ে?
কার কাছে, কী অর্থে, পৌঁছতে চাই নিজেকেই ক্রমে ক্ষয়ে ক্ষয়ে?
রোজ ফিরে আসি ঘরে, সেই ঘর কার?
যে পথে ঝাঁপাই সেই পথ কি আমার?
অল্প শীতে কুয়াশায় আলো জ্বলবে না
এক প্রতারিত লোক, তারও চেয়ে বেশি প্রতারক
মিশে যাবে পথহীন পথে
একা একা একাকী না হতে
যে নেই, ব্রহ্মাণ্ড তাকে ছাড়া চলবে না
অধিকার
চেঁচানো বারণ হলে একটু কেশে নিলাম।
গলা ঝেড়ে ফের বললাম:
বন্ধুরা, উঁচু আওয়াজ হল ক্ষমতার দম্ভ;
আসুন আমরা নরম স্বরে প্রতিবাদ করি।
মাথার ওপর হাত তোলা বন্ধ– বলা হল তারপর।
বললাম: হাত-পা ছোঁড়া শুধুই অস্থিরতার অভিব্যক্তি,
আমাদের বিক্ষোভ হোক স্থিতু ও নিশ্চিত।
গান তো জলসায় গাইব, কিম্বা কোনো উন্মুক্ত আড্ডায়;
এখানে আমাদের লক্ষ্য প্রতিবাদ, শিল্পের আহ্লাদ নয়।
অতএব গান স্তব্ধ, বন্ধ আঁকালেখা,
পোস্টার গ্রাফিত্তি কোলাজ, সব একে একে;
ফিসফিস স্লোগান আর কবিতার লিপরিডিং চলল তারপর।
এক সময় আদেশ এল: এ চত্বরে কেন?
প্রতিবাদ— চ্যারিটিরই মতো— উঠুক পড়ুক ঘরে ঘরে;
মাথা চুলকানোর হাত আমাদের কিছুটা সময় দিল।
মন্থর নিশ্চিত গতিতে ফিরে চলেছিলাম;
এমন সময়, একটা হইহই তাড়া করে এল: তীব্র, আগ্রাসী;
ভয় পেতে নিষেধ ছিল না;
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করলাম;
আর দেখলাম,
ফিরে আসার, সরে আসার, ছেড়ে আসার, হেরে আসার,
পথ,
অন্তহীন।