লিঙ্গবৈচিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে কৃষক আন্দোলন: একমুখিনতা থেকে বহুত্ববাদের পথে

সংহিতা বরুয়া

 



অসমনিবাসী গবেষক ড. সংহিতা বরুয়ার এই লেখাটি গত ৫ ফেব্রুয়ারি ‘দি লিফলেট’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাংলায় ভাষান্তর করেছেন সত্যব্রত ঘোষ।

 

 

 

 

দিল্লির সীমান্তগুলিতে কয়েক মাস ধরে কৃষকদের বিক্ষোভ চলছে। যত দিন যাচ্ছে, খবরগুলি যত আমাদের সামনে আসছে, আমরা দেখছি, আন্দোলন ততই তীব্র হচ্ছে, কৃষকদের সামগ্রিক চেতনাও হচ্ছে ততই দৃঢ়। এই বিক্ষোভ আন্দোলন প্রথম থেকেই বহুমাত্রিক চরিত্রের। বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংগঠিত ক্ষেত্র এবং ইউনিয়নের কৃষকরা মিলিত হয়েছেন, প্রস্তুত হয়েছেন হিংস্র দমনপীড়নের মোকাবিলা করার জন্য।

কৃষকদের ওপর বৃহত্তর সমাজ এমনটাও আশা করছে যে, এই উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং বিভিন্ন প্ররোচনার মধ্যে কৃষকরা কৌশলী হবেন, তাঁদের স্থৈর্য বজায় রাখবেন। কারণ আন্দোলনের প্রমুখ কণ্ঠগুলিকে লাগাতার রুদ্ধ করবার, আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট কৃষকনেতাদের নীতি ও চরিত্রহনন করবার চেষ্টা হয়ে চলেছে। তাঁদের আন্দোলনের যে উদ্দেশ্য তার প্রতি মানুষের অবিশ্বাস ও অসম্মানের মনোভাব তৈরি করারও বহু চেষ্টা হয়েছে এবং হয়ে চলেছে।

একই সঙ্গে বিবেকসম্পন্ন সাংবাদিকতারও পতন ঘটেছে ধারাবাহিকভাবে। ফলে ঘটনাক্রমের মনগড়া ছবি ছড়ানো হচ্ছে সর্বত্র, অবশ্যই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে।

ব্যারিকেড বানিয়ে, উর্দিধারীদের মোতায়েন করে, নাগরিক সুবিধাদি বন্ধ করে, জাতীয় সুরক্ষার নামে দেশের রাজধানীর সীমানাগুলিকে আটকে দিয়ে বিষাক্ত পিতৃতান্ত্রিকতার প্রদর্শনও চলছে পূর্ণমাত্রায়। কৃষকসমাজ— যাঁরা এই ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং রূপান্তর চাইছেন— তাঁদের মনে একটা ভীতি সঞ্চার করতেই রাষ্ট্রের এই আয়োজন।

শান্তি, স্বাধীনতা, সহাবস্থান, সম্মান এবং আশা জাগিয়ে রাখবার জন্যে গত আট দশকে বহু বিদ্রোহ প্রত্যক্ষ করেছে ভারতবর্ষ। খোদ রাজধানী দিল্লিও তার মধ্যে অনেক ঘটনার সাক্ষী।

সেই ধারাবাহিকতাতেই কৃষকদের এই প্রতিবাদ নিজেদের অস্তিত্বরক্ষা এবং উপজীবিকার জন্যে সংগ্রামের এক গৌরবময় প্রতীক হয়ে উঠেছে।

এমন একটি সময়ে এই আন্দোলন চলছে যখন দেশের সবখানে মানুষকে ছলে-বলে-কৌশলে ঋণ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে, যদিও মৌখিক বুলি শুনছি যে তাঁদের আত্মনির্ভর করা হচ্ছে। তাঁদেরকে যে কাজগুলি দেওয়া হচ্ছে তাতে না আছে কোনও সামাজিক নিরাপত্তা, না আছে নির্ভরযোগ্যতা। মানুষের নাম করে একটার পর একটা প্যাকেজের ঘোষণা করা হচ্ছে, কিন্তু তাতে শুধু দেশের বিত্তবান শ্রেণিরাই আশ্বস্ত হচ্ছেন।

এবার সেই মহিলা কৃষকদের কথা ভেবে দেখুন। যাঁদের জমি নেই, ট্র্যাক্টর নেই, কোনও পুরুষের সহায়তা নেই—সেইসব মহিলা কৃষকেরা জীবিকা অর্জনের জন্যে জৈবচাষ কেমনভাবে করবেন? এই বিবিধ লিঙ্গের কৃষকদের জমি, মূলধন, পরিচিতির প্রমাণপত্র, গবাদি পশু, জল, বিদ্যুৎব্যবস্থা, ট্রাক্টর, এমনকি কলের লাঙল— কিচ্ছুটি নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অস্তিত্বরক্ষা, সুবিচার, সাম্য এবং সহমর্মিতা আদায়ের জন্যে এই লড়াইয়ে তাঁদের ভূমিকা নগণ্য হয়ে পড়ছে।

কৃষক সমাজ সমস্বত্ব নয়। দেশ জুড়ে তাঁরা নানান শ্রেণিতে বিভক্ত। তাঁদের মধ্যে অনেকে দেশের কৃষি-নির্ভর অর্থনীতিতে অবদান রাখেন বলে গর্ববোধ করেন। অনেকে জমির মালিক, কোনও কৃষিপদ্ধতির উদ্ভাবক অথবা বিজ্ঞানসম্মত কৃষিকার্যে নিযুক্ত এবং উৎপাদক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু এমন বহু কৃষক আছেন যারা নিজেদের কৃষি-সংক্রান্ত পরিচয় সম্পর্কে আদৌ অবগত নন। জ্ঞানের বৈচিত্র, জীবসম্পদের বৈচিত্র এবং দেশের জৈব এবং কৃষিসম্পদের বৈচিত্র রক্ষায় এবং সেইসঙ্গে দেশের খাদ্য এবং পুষ্টির সুরক্ষায় তাঁরা যে অমূল্য অবদান রেখে চলেছেন, সে সম্পর্কেও তাঁরা অবগত নন।

মহিলা এবং অন্যলিঙ্গের কৃষকরা তাঁদের কৃষিক্ষেত্রগুলিতে এবং তার চারপাশের মাটি এবং জীবন্ত উদ্ভিজ্জের সম্ভার তৈরির পর সেগুলিকে টিকিয়ে রাখেন, পুনর্জীবন দেন এবং পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু তাঁদের ওপর কৃষিক্ষেত্রে বহাল থাকা পিতৃতন্ত্রের চাপ যথেষ্ট। যেমন ধরা যাক, একটি কৃষক পরিবার ভাগ্যজোরে একটা ট্র্যাক্টর জোগাড় করতে পারল— সেটি ব্যবহারের সুবিধা অনিবার্যভাবেই পাবেন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা, মহিলা এবং অপুরুষ সদস্যরা নন।

মেয়েদের কাজগুলি অবধি ঘরেতেই আবদ্ধ থাকে। তাঁদের জীবন-বৃত্ত অনুযায়ী সেগুলি শুধু বদলে যায়। এই প্রেক্ষাপটেই ভারতের গ্রামাঞ্চলের ছোট ছোট কৃষিক্ষেত্রগুলিকে দেখতে হবে। দলিত, আদিবাসী, পরনির্ভর, বংশপারম্পরিক, তত্ত্বাবধায়ক, বিবিধ লিঙ্গের কৃষকরা তাঁদের প্রাকৃতিক গেরস্থালির নিয়ম মেনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তা সে বাড়ির বাগানে, শরিকি জমিতে, ঝুম চাষের জমিতে, যৌথ বন খামারেই হোক অথবা খাদ্য, জ্বালানি, ভেষজ, ফল এবং বীজ প্রক্রিয়াকরণ ফার্মেই হোক। এই পরিশ্রমের ফলে তাঁদের অর্থনৈতিক উন্নতি কিন্তু দেখা যায় না, কোনওরকমে বেঁচে থাকাটাই হয় কেবল।

এই কৃষকরাই বীজ উৎপাদন করেন, সেই বীজের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পুনরুৎপাদন করে খাদ্যশৃঙ্খলটিকে বজায় রাখেন। মাটির নিচে থেকে বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত সর্বত্রই নিজেদের উপস্থিতিকে এইভাবে টের পাওয়ান তাঁরা। এইভাবেই তাঁরা স্বাস্থ্য, পুষ্টিসাধন এবং পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে যে মিথোজীবী সম্পর্ক বর্তমান, তার প্রতিটি উপাদানেই এঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

আমাদের সৌভাগ্য যে কৃষিক্ষেত্রে এই ধরনের কাজকর্মগুলিকে মুনাফামুখী করে তোলার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগের অভাব রয়েছে। এর ফলে কৃষিকাজ সম্পর্কে জ্ঞান বা বিভিন্ন কলাকৌশল সংরক্ষণ করা যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, যন্ত্রচালিত বিশাল ব্যয়বহুল কৃষি-উৎপাদন, যা একান্তভাবেই বাজারের কথা মাথায় রেখে চালিত হয়, তার চাইতে এই জ্ঞান অনেক বেশি সংহত ও টেকসই।

কৃষিকাজ কেবল মনুষ্যকেন্দ্রিক নয়, প্রকৃতিকেন্দ্রিকও বটে। মানুষের লাগাতার অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশের ফলে প্রকৃতির যা যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য তাই কৃষিকাজকে অবশ্যই নতুন নতুন পরিকল্পনা করতে হবে, নিজের পুনর্নবীকরণ করতে হবে।

কৃষি আইনগুলির প্রভাবে স্বনির্ভর মহিলা এবং বিবিধ লিঙ্গের কৃষকদের আজ হয়তো বিশেষ কিছু যায় আসে না। কারণ এনারা প্রকৃত অর্থে স্বরাজকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া বীজ, সার, পশুখাদ্য, জীববৈচিত্রের বিষয়ে পরিবেশগত জ্ঞান এবং ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যসুরক্ষা এবং পরিবারসুরক্ষার উপাদানগুলি তাঁদের কাছে আছে। কিন্তু তাঁদের সেই স্বনির্ভরতার স্বপ্ন শীঘ্রই ভেঙে যাবে। যখন রপ্তানি-ভিত্তিক লাভজনক ফসল চাষের একটা একমুখী সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া হবে।

রপ্তানির জন্যে ফসল উৎপাদন এবং কৃষি থেকে বেশি বেশি নগদ মুনাফার এই অসুস্থ তল্লাশির কারণে যেসব মহিলা এবং অন্য-লিঙ্গের মানুষরা দেশীয় পদ্ধতিতে জৈব চাষ করে বিষমুক্ত ফসল ফলান, তাঁদের সংখ্যার দ্রুত সংকোচন ঘটছে।

এই প্রেক্ষিতেই ভারতের বিভিন্ন ছোট ছোট এলাকার কৃষকরা আবহাওয়া পরিবর্তনের ঘাতসহ এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রসম্পন্ন কৃষি-বাস্তুতন্ত্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন। যেমন, নাগাল্যান্ডের এবং দাক্ষিণাত্য মালভূমির দলিত মহিলা কৃষকরা; ভারতের বিভিন্ন বনভূমি অঞ্চলের আদিবাসী কৃষকরা; উপকূল অঞ্চলের মৎস্যচাষিরা; পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের যাযাবর সম্প্রদায়ের কৃষকরা; উত্তর, দক্ষিণ এবং উত্তরপূর্ব ভারতের পার্বত্য কৃষকরা; মণিপুর, ত্রিপুরা ও অসমের নদী ও জলাভূমি এলাকার কৃষকরা; এবং মেঘালয়, পশ্চিমঘাট এবং মধ্য ভারতের সংরক্ষিত এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রহরীরা। বাস্তুতন্ত্রের নিয়মনীতিগুলিকে কৃষিকাজে প্রয়োগ করার পদ্ধতিকেই কৃষি-বাস্তুতন্ত্র বলে।

এই কৃষক সম্প্রদায়গুলির ধ্যানধারণা তৈরি হয়েছে সংহতিমূলক এবং পুনরুৎপাদনশীল অর্থনীতির ভিত্তিতে। যার থেকে সুস্বাস্থ্যের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সম্প্রদায়গত এবং পারিবারিক সুরক্ষা লাভ সম্ভব। এটি আবার একই সঙ্গে সম্পদ সুরক্ষার পরোক্ষ সুবিধাগুলিও তৈরি করে।

সিংঘু সীমান্তে প্রতিবাদরত সমস্ত মহিলা এবং বিশেষ লিঙ্গের কৃষকরা তাঁদের পরিবার, চাষের জমি, বনজঙ্গল এবং তাঁরা দেশকে যে খাদ্যশস্য সরবরাহ করে থাকেন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। এই কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ে এবং ক্যানসার-মুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি ভাবনায় এই তিনটি জিনিসের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছে— খাদ্য, পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সুরক্ষা।

একটি ভোগবাদ-সর্বস্ব নগদনির্ভর অর্থনীতিতে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল আত্মনির্ভর ও স্বাস্থ্যবান জনগণ। খাদ্য উৎপাদন ক্ষেত্রগুলির বাইরে বিভিন্ন দোকানগুলিকে বন্ধ করে দিতে চায় সেই অর্থনীতি। আর সেই ব্যবসাগুলিই চালাতে চায়, যেগুলি যান্ত্রিক পদ্ধতিতে অজৈব কৃষিকাজ দ্বারা পরিচালিত হবে।

ফলে কৃষকদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে হিংস্র প্রতিরোধ হচ্ছে, কৃষি আইনকে রক্ষা করবার জন্যে ব্যবহার হচ্ছে জলকামান। এই সরলরৈখিক নীতিসমূহ এবং পিতৃতান্ত্রিক সাংগঠনিক হিংসার প্রাধান্যই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলিতে প্রতিফলিত হচ্ছে।

বর্তমান অর্থনৈতিক মডেল এবং তার ফলে ঘটে চলা পরিবেশ ধ্বংস ও আবহাওয়া পরিবর্তনের শিকার হচ্ছেন মহিলা এবং বিবিধ লিঙ্গের কৃষকরা। অনুপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার, পদ্ধতিগুলি জানাবোঝার খামতি এবং এমন এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক গতিশীলতা যা কৃষকদের মধ্যে পিতৃতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেয়— এই কৃষকদের সেগুলিরও মোকাবিলা করে চলতে হচ্ছে।

এখন কৃষকেরা নিজেদের জন্যে একটি পরিসর তৈরি করতে চাইছেন। আর বিবিধ লিঙ্গের কৃষকেরা চাইছেন সেই পরিসরে নিজেদের পরিচিতি, বক্তব্য এবং বৈচিত্রগুলিকে স্থান দিতে। আমাদের মনে রাখতে হবে, তাঁরা জীবনদায়ী শক্তির প্রতিনিধি, জীবন-ধ্বংসকারী শক্তির নন। আর সাধারণ মানুষের সহজাত এই বহুত্বই এখন আশা এবং জীবনের শক্তিকে পুনরুদ্ধার করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...