শীতলকুচির নরহত্যা এবং উত্তরবঙ্গের ভোট— এক সন্ধিক্ষণ?

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

 


প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য-কর্মী

 

 

 

এবারের নির্বাচন অন্য সমস্ত পূর্ববর্তী নির্বাচনের থেকে পৃথক একাধিক কারণে। এর মধ্যে কিছু কারণ বিশেষত উত্তরবঙ্গের জন্য সত্যি, অন্যগুলো সার্বিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের জন্য।

সেদিনের কথা ভাবি। প্রায় কোনও প্ররোচনা ছাড়া চারজন ভোটদানকারীকে সরাসরি বুকে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলেছে বলে অভিযোগ ভোট সুরক্ষিত করার কাজে নিযুক্ত আধাসামরিক বাহিনির জওয়ানদের বিরুদ্ধে— এমনটা সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে। যদিও আজকের (১৪.০৪.২১) একটি ভিডিও অন্যরকম কথাও বলছে। বিভিন্ন মেধাজীবী মানুষ, সাধারণ আত্মপরিচয়হীন জনতা এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রশ্ন তুলছে— আগাম সতর্কতা না দিয়ে, কোমরের নীচে গুলি না চালিয়ে কেন সরাসরি শরীর লক্ষ্য করে গুলি চালানো হল? কে দেবে উত্তর? তবে সাধারণ অনুমান শক্তি বলে এর কিছুটা হলেও ভোটে প্রভাব পড়বে।

নির্বাচন কমিশন ক্লিন চিট দিয়েছে। বাহুবলী জননেতাদের কেউ জানিয়েছেন “দুষ্টুমি করলে আরও শীতলকুচি হবে,” কেউ বলেছেন “চারজন কেন আটজনকে মারা যেত,” আবার কেউ বলছেন যে এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক। এখানে এবারের নির্বাচন নিয়ে তিনটি বিষয় উঠে আসে— (১) এর আগে নির্বাচন প্রক্রিয়ার এরকম সামরিকীকরণ বাংলার মানুষ দেখেনি, (২) নির্বাচনী প্রচারের ভাষায় এবং অভিব্যক্তিতে এরকম তীব্র লুম্পেনীকরণ আমরা কখনও চাক্ষুষ করিনি, এবং (৩) হিংস্রতার বার্তা, শিল্পীদের রগড়ে দেওয়ার মতো বার্তা লাগামছাড়াভাবে লাগাতার চালিয়ে গিয়ে আমাদের গা-সহা হওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে।

একইসঙ্গে, ক্রমক্ষীয়মান হয়ে পড়ছে আমাদের নাগরিক পরিসর। উত্তরপ্রদেশের মতো কয়েকটি রাজ্যে সম্ভবত এর অস্তিত্বই নেই। আর সবচেয়ে প্রাণবন্ত যে পরিসরটি পশ্চিমবঙ্গে ছিল রবীন্দ্রনাথ থেকে শঙ্খ ঘোষ, আইপিটিএ থেকে এপিডিআর অবধি, এবং একে অতিক্রম করে যে নাগরিক পরিসর জন্ম নিয়েছিল তা মরে যাচ্ছে। পার্টি ভাষ্যের বাইরে মানুষ নিজের কথা বলবে কোথায়? এ এক গভীর অশনি সঙ্কেত।

বাঙালির আত্মপরিচয় নিয়ে শ্লাঘা করার মতো বিপুল উপাদান ইতিহাস আমাদের ডালি ভরে দিয়েছে। ডালাভরা এই উপাচারের একজন অমর্ত্য সেন। তিনি যে একজন “জমি চোর” একথা আমরা আগে জানতাম না। জেনে নিলাম। কোনও শক্তিশালী প্রতিবাদ ছাড়াই— অবশ্য সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়, চিঠিপত্রের কলাম এবং ভার্চুয়াল মিডিয়া ছাড়া— মেনেও নিলাম। বা বলা ভালো আমরা সইয়ে নিলাম। বিষয়টি নিঃসারে জনমানসে গ্রাহ্যতা পেল।

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ “গুরুবর” হলেন। আমরা খিল্লি করলাম। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় চুটিয়ে খিস্তি-কিসসার বন্যা বইয়ে দিলাম। কিন্তু আমাদের (আমিও এর বাইরে নই) আত্মপরিচয়ে রক্তক্ষরণ হল না, চাবুকের দাগও দেখা গেল না। বরঞ্চ পায়ে হাত দিয়ে প্রণামে হাত উঠে হাঁটুতে আটকে গেল। আমাদের আত্মপরিচয় কি পুনর্নিমিত হচ্ছে আমাদের অজান্তে? সামাজিক মানসিকতা বা সোশ্যাল সাইকি কি রূপান্তরিত হচ্ছে ভিন্ন পরিচয়ে?

প্রসঙ্গত, আরেকটি বিষয়কে আমরা গুরুত্ব দেব। আজ (১৪.০৪.২০২১) টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রের একটি খবরের শিরোনাম “BJP stunt to implicate Sitalkuchi falls flat.” ঘটনাটি কী? টেলিগ্রাফের খবর থেকে হুবহু দেখা যাক— “The saffron ecosystem’s desperation to defend Saturday’s killings in Sitalkuchi has led its members to tweet a picture and a video clip of purported mob violence in the constituency, which were quickly exposed as fraudulent and hurriedly deleted in the face of a social media backlash. The photo was from Jharkhand and the video a two-year-old one from Manipur, Trinamul has said and independent fact-checkers confirmed.” এই ভুয়ো খবর, মিথ্যে সংবাদ, সজোরে অর্ধসত্যকে বারংবার প্রচার করা, জীবনের চেয়ে মানুষের চেয়ে দেশের চেয়ে বড় করে বেছে নেওয়া নেতার ভাবমূর্তির ফানুস তৈরি হয়েছে এতদিন— নিঃসাড়ে জনসমাজের শেকড় পর্যন্ত চারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন সংগঠন দিয়ে, এবং সোচ্চারে আইটি সেল এবং মিডিয়া প্রচারের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে রবীশ কুমার তাঁর The Free Voice গ্রন্থে একটি মনোযোগ দেওয়ার মতো পর্যবেক্ষণ রেখেছেন— ““In recent times a new trend has emerged among citizens … When a voter merges in the leader, he is no longer the people, or even a voter. He is merely the dust swept up by a windstorm.”

ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে কীভাবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইন্সটাগ্রামের মতো মাধ্যম ২০১৪ আর ২০১৯-এর নির্বাচনের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা ধরা আছে সিরিল স্যাম এবং পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার লেখা The Real Face of Facebook in India: How Social Media have become a Propaganda Weapon and Disseminator of Disinformation and Falsehood (২০১৯) গ্রন্থে। লেখকেরা মন্তব্য করছেন— “Facebook provided Narendra Modi and the apparatus of the BJP apparatus even before the 2014 elections; the close ties it had with key people in the BJP-NaMo team; and about a revolving door between this team and that of Facebook.” এরপরে পরতে পরতে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে মিথ্যাচার, গুজব, মাথা ঝিম-ধরানো প্রবঞ্চনার।

বায়োলজির দিক থেকে এটা বলার কথা যে, যতবেশি মানুষ উপরিস্তরের নিউরনের কাজের মধ্যে আটকে থাকবে ততবেশি গুজব এবং মিথ্যের বাতাবরণ ফনফনিয়ে বেড়ে উঠবে। নিঊরনের পাশে শুয়ে থাকা গ্লায়াল কোষের কাজ যত কম হবে তত মানুষের গভীরে গিয়ে ভাবার ইচ্ছে এবং ক্ষমতা কমবে। স্মৃতির গভীর থেকে উঠে আসা চিন্তার বিস্তার কমে যাবে। এতে লাভ? রাষ্ট্র এক মানুষ-পিণ্ড তৈরি করতে পারবে যারা প্রশ্ন করতে ভুলে যায়। শুধু দৌড়ে চলে নির্মিত মিথ্যা, অর্ধসত্য বা গুজবের পেছনে— একে নিজের মধ্যে আত্মীকরণও করে নেয়। এবং নিপুণতার সঙ্গে এই কাজটিই যদি সেকেন্ড-মিনিট-ঘন্টা-দিন-বছর ধরে ছেদহীনভাবে করে যাওয়া যায় তাহলে জনমানসে গুজব গেলানোর সঙ্গে ভোটের ঈপ্সিত ফলাফলের একটি সমানুপাতিক সম্পর্ক তৈরি করা যায়— কি আমেরিকায়, কি অন্যত্র।

ঠিক এ ঘটনাগুলোই ঘটছে উত্তরবঙ্গ জুড়ে। এক হাওয়া তৈরি হয়েছে এখানকার প্রকৃত অধিবাসী রাজবংশী, পালিয়া, দেশিয়া এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে। তৃণমূল সরকারের এতদিনের দুর্নীতি, মিথ্যাচার, দম্ভের এক বিকল্প হিসেবে বিজেপি তথা মোদিকে দেখছে এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ। বামেরা ক্রমাগত শক্তিহীন হয়ে গোষ্ঠীর রাজনীতি করেছে— আমজনতা সঙ্গে নেই। এমনকি লকডাউন পরবর্তী সময়ে নিরলসভাবে স্থানান্তরী শ্রমিক এবং দরিদ্র মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য যে “শ্রমজীবী ক্যান্টিন” চালানো হয়েছে তার সুফল মূলত শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ। একসময়ের শক্ত ঘাঁটি উত্তর দিনাজপুর এবং জলপাইগুড়িতে কংগ্রেসের সংগঠন হীনবল। তবে সম্মিলিত জোট হয়তো ভোটের সমীকরণ ভিন্ন খাতে বওয়াতে পারে।

উত্তরবঙ্গের অন্য জেলাগুলিতেও এ হাওয়া রয়েছে। কিন্তু এখানে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বিপুল। এদের বেশিরভাগ অংশই এনআরসি এবং সিএএ-তে আক্রান্ত হবে না বলে মনে করছে। বরঞ্চ ভোটের আগে মিথ্যের ঝুরি শুনে মনে করছে এদের বৈধ নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে। ডিটেনশন সেন্টার নিয়েও আপাতত কোনও উদ্বেগ নেই।

যে প্রশ্নগুলো অন্য রাজনৈতিক দলগুলো রাখতে পারত গলার শির না ফুলিয়ে, মাঠ গরম করা বক্তৃতা না দিয়ে সেগুলো রাখেনি। প্রশ্ন করা যেত— ২০১৪ পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ, সঠিক কী কী পেয়েছে— মিথ্যে গিমিক ছাড়া? এক দুই তিন করে জানতে চাওয়া যেতে পারত। জানতে চাওয়া যেতে পারত— লকডাউন পরবর্তী সময়ে স্থানান্তরী শ্রমিক এবং দুর্বলতর জনতার জন্য সামাজিক সুরক্ষার কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? জানতে চাওয়া যেতে পারত— প্রাথমিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সঠিক কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? সামাজিক আয় বৃদ্ধির জন্য কী কী পদক্ষেপ এতদিন নেওয়া হল?

প্রশ্ন করা যেতে পারত— OXFAM-এর রিপোর্ট অনুযায়ী কোন জাদুমন্ত্রবলে, রাষ্ট্রের কী ধরনের মদতে, সরকারের কী কী পদক্ষেপে “COVID-19 Made Indian Billionaires 35% Richer As Lakhs Lost Jobs”? এ রিপোর্ট অনুযায়ী— “১০০ জন ধনীতম ভারতীয় যা আয় করে তা দিয়ে সবচেয়ে দরিদ্র ১৪ কোটি ভারতবাসীর রেশনের ব্যবস্থা করা যায়।” এ প্রশ্নগুলো ঠান্ডা নিরুত্তাপ গলায় করা হয়নি। ধর্মের গেণ্ডুয়া খেলায় সবপক্ষই ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

কিন্তু রুটি-রুজি-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বাসস্থান-সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া কোনও সেকুলারিজমই বাঁচতে পারে না। আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। কিন্তু শেষ হয়নি এখনও।

0

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ,সময়োপযোগী। তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ।

  2. এখানে স্পষ্টতই দুটো দিক। একদিকে আমাদের মতন, জয়ন্তদার মতন মানুষরা, যাঁরা স্থির করেছি শিরদাঁড়া ঝজু রেখে এই বিপন্ন সময়ে বুঝে নেব মানুষের অধিকার – শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, বেঁচে থাকার অঙ্গীকার। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ, বুলেট আর চোখ রাঙিয়ে হাঁদা পাবলিকের মাথায় পা দিয়ে আখের গুছোতে ব্যস্ত। এদের ডান-বাম দিকনির্ণয় করে আলাদা না করলেও চলবে। এরা লাশ চায়, তাই আসমুদ্রহিমাচল মর্মান্তিক মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে একজন হাহা করে হেসে বলতে পারে কতজন লোক তার নির্বাচনের সারশূন্য বক্তৃতা শুনতে এসেছে, এদের কতজন যে নিছক মরে যাবে তার ইয়ত্তা নেই।
    এই রৌরব থেকেও আমরা বেরোব। কিন্তু তার একটাই শর্ত, নিজে জেগে অন্যকে জাগানো। জয়ন্তদা কলম ধরে নিরলস ভাবে এই কাজটি করে চলেছেন, আগামীদিনের ভারতবর্ষ তাঁর কাছে ঝণী।
    আমি ভারতবর্ষে থাকিনা, আমি আপনাদের কেউ নই, তথাপি একজন বাঙালী হিসেবে দু একটা কথা বলতেই হয়। এই যে নিত্যদিন আপনাদের পেছনে একদল অপদার্থ স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতার দল গ্যাসের আলো জ্বালিয়ে আপনাদের মধ্যে বিভেদ এনে আখের গুছনোর ধান্দাবাজি করছে, যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে গোল্লায় পাঠিয়ে ফার্মাসিউটিকাল ব্যবসার রমরমা, পরিবেশ ধ্বংসের রাজনীতির দাওয়াই গেলানো হচ্ছে, এখনো সময় আছে এই মৌষলকাল থেকে উদ্ধার পাবার। রুখে দাঁড়ান।
    এত কালো মেখেছেন দু হাতে। এবার ঘুরে দাঁড়ানোই ভাল, এবং খেয়াল রাখবেন, রাস্তাই একমাত্র রাস্তা। আমাদের পাথেয় হোক জয়ন্তদা এবং আরো সমকালীন লেখকদের প্রতিবাদ!

আপনার মতামত...