“বিজেপির বঙ্গবিজয়ের অর্থ হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে আরেকধাপ এগোনো”

পার্থ চট্টোপাধ্যায় 

 

প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিক দীপাঞ্জন সিনহার নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলির ঐতিহাসিক তাৎপর্য আলোচনা করেছেন। কী কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং বর্তমান বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জয় হলে তা আগামী দিনে আমাদের সমাজ জীবনে কী কী প্রভার ফেলতে পারে, অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় তাও বিশদে আলোচনা করেছেন এখানে।

সাক্ষাৎকারটি বিশিষ্ট সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতার ইউটিউব চ্যানেল PGT Online-এ গত ১২ এপ্রিল প্রকাশিত হয়। তাঁর অনুমতিক্রমে এটি বাংলায় অনুবাদ করে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এ ছাপা হল। শেষে মূল সাক্ষাৎকারটি দেওয়া থাকল।

 

কিছুদিন আগেও বলা হত বিজেপির রাজনীতি এই বাংলায় ও বাঙালিদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। আজ বলা হচ্ছে বিজেপির রাজনীতি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। আপনার মতামত কী?

বিজেপি আদিতে যা ছিল অর্থাৎ জনসংঘ, সেই জনসংঘ দলটা ১৯৫১ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রতিষ্ঠা করেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি তার আগে হিন্দু মহাসভায় ছিলেন। একটা ঘটনা অনেকেই ভুলে যায় যে ১৯৪৮ সালে গান্ধিজির হত্যার পর একটা অবস্থা হয় যখন হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে একটা তীব্র জনমত তৈরি হয়েছিল। কারণ গান্ধিহত্যার সঙ্গে এঁদের অনেকেরই যোগাযোগ ছিল। সেই অবস্থায় আরএসএস বেশ কিছুদিনের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

ঠিক সেই সময়, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি কিন্তু নেহেরুর ক্যাবিনেটের একজন মন্ত্রী, যদিও তিনি হিন্দু মহাসভা থেকে জিতেছিলেন। কারণ ওই সময় অনেক দলের নেতাদের নিয়ে ক্যাবিনেট তৈরি হয়েছিল। উনি দিল্লিতে নেহেরুর ক্যাবিনেটের সদস্য ছিলেন। তখনও হিন্দু মহাসভা সরাসরি দেশের সংবিধানকে সমর্থন করবে এরকম কোনও অবস্থান নেয়নি। আরএসএস তো একেবারে সোজাসুজি ভারতবর্ষের সংবিধানের বিরোধী ছিল। তারা সেই সময় ওই সংবিধান মানতেই চায়নি। শ্যামাপ্রসাদ সেইসময় হিন্দু মহাসভার অবস্থান খানিকটা নরম করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। তখন উনি আলাদা করে স্বতন্ত্র দল, জনসংঘ স্থাপন করেন। কিন্তু জনসংঘের প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন যারা দেখাশুনো করত, তারা প্রায় সবাই আরএসএস-এর লোক। শ্যামাপ্রসাদ অবশ্য তার অল্প কিছুদিন পরেই ১৯৫৩ সালে মারা যান। তারপর থেকে জনসংঘ, আরএসএস, অথবা পরবর্তীকালে বিজেপি, যার কথাই বলি না কেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তাদের জায়গা প্রায় ছিল না বললেই চলে। অবশ্য স্বাধীনতার আগে হিন্দু মহাসভার একাধিক নেতা ছিলেন, তাঁরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ নেতা, তাঁরা বাংলার মানুষ ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরে হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ বা পরবর্তীকালে ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গে কোনও জায়গাই ছিল না। আরএসএসের সামান্য কিছু শাখা তখন থেকেই থেকে গেছিল, সেগুলো ছিল। কিন্তু তার কোনও ব্যাপক জনসমর্থন কোনও অবস্থাতেই ছিল না।

বাংলায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি এত দুর্বল হল কী করে?

এর দুটো কারণ। প্রথম কারণ হচ্ছে পার্টিশন। পার্টিশনের আগে বাংলায় হিন্দু মহাসভার প্রভার ছিল, যার একটা বড় কারণ সেই সময়কার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। ১৯৩০-এর শেষ দিক থেকে স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত প্রায় আট-দশ বছর, বাংলার রাজনীতি পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ছিল। একদিকে মুসলিম লিগের নেতৃত্বে একটা মুসলিম সংগঠন যারা পাকিস্তানের দাবি করছে, অন্যদিকে হিন্দু মহাসভা। কংগ্রেসের অবস্থানটা ছিল এই দুইয়ের মাঝামাঝি। কারণ সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মুসলিমদের একটা বড় অংশের সমর্থন ছিল কংগ্রেসের প্রতি, যেটা তারা ছাড়তে চায়নি। ফলে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, সেটার প্রায় পুরোটার নেতৃত্ব দিয়েছিল হিন্দু মহাসভা। এই কারণে স্বাধীনতার আগে হিন্দু মহাসভার যথেষ্ট প্রভাব ছিল।

কিন্তু দেশভাগ হয়ে যাওয়ার পর বাংলার রাজনীতি অনেকটাই বদলে যায়। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আর কোনও তাৎপর্য রইল না। কারণ, পশ্চিমবাংলায় মুসলিম রাজনীতির আলাদা করে কোনও সংগঠনই রইল না। মুসলিম নেতৃত্ব যারা ছিল প্রায় সকলেই পাকিস্তানে চলে যায়। তেমনি কলকাতা বা পশ্চিমবাংলাতেও যাঁরা মুসলিম রাজনীতির নেতৃত্বে ছিলেন তাঁরা সকলে পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলেন। পশ্চিমবঙ্গে যেসব মুসলিম রয়ে গেলেন তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই কৃষক— যেমন মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া জেলার কৃষক— যাঁরা এখনও রয়েছেন। মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজ যারা সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারা প্রায় সকলেই পাকিস্তানে চলে যায়। তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার ইস্যুটা আর অত জোরদার থাকেনি। তার বদলে এসে গেল অন্য একটি রাজনীতি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের যে আন্দোলন, যাকে আমরা রিফিউজি আন্দোলন বলে জানি, তা ধীরে ধীরে একটি জায়গা করে নিল। দক্ষিণ কলকাতা থেকে উত্তর কলকাতার শহরতলি অবধি জবরদখল জমির ওপরে রিফিউজি কলোনি গড়ে উঠেছিল। তাদের পুনর্বাসন হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা ছিল। উদ্বাস্তুরা অবশ্য পুনর্বাসন চায়নি। তারা বলেছিল যে তারা এদেশে এসে যে যেখানে কলোনি গড়েছে সেখানেই তাদের স্বত্ব স্বীকার করতে হবে। তখন এই দাবিতে প্রচণ্ড আন্দোলন হয়েছিল। রিফিউজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল প্রধানত বামপন্থী নেতারা। ষাটের দশকে যারা খাদ্য আন্দোলন করেছিল, পরবর্তীকালে সিপিআইএমের মধ্যে পার্টির যে অংশটা যায়, তাদের মধ্যে একটা বিরাট বড় অংশই এই রিফিউজি আন্দোলন থেকে উঠে আসা। ফলে কলকাতা কেন্দ্রিক যে রাজনীতি, মধ্যবিত্ত বাঙালির যে রাজনীতি— তাতে সাম্প্রদায়িকতা আর থাকে না। সেই আন্দোলনের নানারকম অর্থনৈতিক দাবি, তারপর ষাটের দশকের শেষ থেকে যখন নকশাল আন্দোলনের ঢেউ উঠল, তখন থেকে কৃষকের দাবি— এগুলোই ক্রমশ বাংলার রাজনীতিতে প্রধান জায়গা নিতে শুরু করে। সেকারণেই পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের একটা ভিত্তি তৈরি হল। বামপন্থীদের মধ্যেও নানা ভাগ হল, সিপিআই ও সিপিআইএম, পরবর্তীকালে নকশালের আলাদা মতবাদ, সংগঠন ও আন্দোলন হয়েছে। অতএব পশ্চিমবাংলায় ধীরে ধীরে বামপন্থী রাজনীতিই অনেক বেশি করে প্রাধান্য পায়।

পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা বলতে গেলে মনে পড়ে, আমরা তখন ছোট ছিলাম, এখানে পঞ্চাশের দশকে দু-একটা দাঙ্গা হয়েছিল। তারপর অর্থাৎ যে সময়ে আমরা বড় হয়ে উঠেছি, পশ্চিমবঙ্গে বড় দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। এটাই পশ্চিমবঙ্গে আমার দেখা শেষ বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেটা আমার মনে আছে এই কারণে যে সে বছর আমার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেওয়ার কথা, ওই দাঙ্গার জন্য পরীক্ষা পিছিয়ে যায়৷ তখন যেটা হত, পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা হলে, পূর্ব পাকিস্তানেও দাঙ্গা হত একই কারণে। সেই ৬৪-র দাঙ্গাই শেষ দাঙ্গা। তার পরে আর পশ্চিমবঙ্গে কোনও বড়মাপের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কখনও আর হয়নি।

১৯৪৭ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। ওই সময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে যখন প্রথম দেশভাগের প্রস্তাব গৃহীত হল, তখন নীতি হিসেবে স্থির হয়েছিল যে সমস্ত প্রদেশগুলো মুসলিম মেজরিটি, সেই প্রদেশগুলো পাকিস্তানে যাবে আর বাকি যেগুলো হিন্দু মেজরিটি প্রদেশ, সেগুলো ভারতবর্ষে। এই নীতি অনুযায়ী পাঞ্জাব এবং বাংলা এই দুটো প্রদেশেরই পাকিস্তানে যাওয়ার কথা। মার্চ মাসে প্রথম পাঞ্জাবে বিশেষ করে শিখদের পক্ষ থেকে দাবি করা হল যে তারা পাকিস্তানে যেতে চায় না, সুতরাং পাঞ্জাব প্রদেশটাই পার্টিশন করা হোক। অর্থাৎ জেলা অনুযায়ী, যে সমস্ত জেলাগুলোতে মুসলিম মেজরিট সেগুলো পাকিস্তানে যাক, আর যেগুলোতে হিন্দু শিখ মেজরিটি, সেগুলো ভারতবর্ষে আসুক। একবার যখন পাঞ্জাব প্রদেশে পার্টিশনের প্রশ্নটা উঠল, তখন বাংলাতে কী হবে এই দাবিটা হিন্দু মহাসভার হয়ে প্রথম শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি তুললেন। উনি বললেন, বাংলা প্রদেশটাও তাহলে পার্টিশন করতে হবে। অর্থাৎ বাংলার হিন্দুরা পাকিস্তানে যেতে চায় না, সুতরাং বাংলা প্রদেশটাও ভাগ করা হোক। এই সময় এইটা যাতে না হয় সেজন্য একটা চেষ্টা করা হয়েছিল শরৎচন্দ্র বোস এবং সুরাবর্দি এই দুজনের পক্ষ থেকে। তখন তাঁরা যুক্তবাংলা বা ইউনাইটেড বেঙ্গল বলে একটা প্রস্তাব এনেছিলেন। ওঁরা বলেছিলেন যে বাংলা প্রদেশ ইন্ডিয়াতেও যাবে না, পাকিস্তানেও যাবে না, স্বতন্ত্র একটা দেশ হবে ইউনাইটেড বেঙ্গল। তাই নিয়ে খানিকটা আন্দোলন হয় কিন্তু সেটা বেশি দূর যায়নি। এর বিরুদ্ধে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি যে প্রশ্নটা তুললেন তা হল, সেরকমও যদি হয়, তারপর কোনও একটা সময় ইউনাইটেড বেঙ্গলে যদি আবার দাবি ওঠে যে যেহেতু এখানে মুসলিম মেজরিটি, ফলে আমরা পাকিস্তানে যাব, তখন তো আর এই ব্যবস্থাটা থাকবে না। তখন কী করা হবে? সুতরাং এখনই পার্টিশন করা হোক। একবার এই দাবিটা ওঠার পরে সেসময় এটা নিয়ে বাংলার অ্যাসেম্বলিতে ভোটাভুটি হয়। তাতে যারা হিন্দু মেম্বার, যেমন কংগ্রেসের সদস্যরা, বা একজন বা দুজন কমিউনিস্ট মেম্বার ছিলেন, তাঁরাও, অধিকাংশ শিডিউল কাস্ট মেম্বার— তাঁরা সবাই বললেন যে না, বাংলাকেও পার্টিশন করতে হবে।

অতএব, বাংলা পার্টিশন করার যে প্রস্তাবটা তাতে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।  গোড়ার দিকেও প্রায় ওঁর একার দাবিতে প্রস্তাবটা অনেক দূর অবধি যায় এবং শেষ অবধি হিন্দুরা সবাই প্রস্তাবটা মেনে নেয়। সেকারণে ওইসময় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির একটা ভূমিকা ছিল। কিন্তু তারপরে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গাটা শেষ হয়ে যায়। আগে যেরকম মুসলিম লিগের একটা সংগঠন ছিল, যারা মুসলিম দাবি নিয়ে আলাদা করে রাজনীতি করত, সেই মুসলিমের লিগেরও আর কোনও কনস্টিটুয়েন্সি রইল না। স্বতন্ত্রভাবে কোনও মুসলিম সংগঠন, মুসলিম দল অবশিষ্টই রইল না। তার ফলে, সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিটা আর পশ্চিমবঙ্গে ছিল না।

এখন যে কথাটা উঠেছে, যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি পশ্চিমবাংলার জনক, সেটা এই অর্থে, যে উনিই প্রথম জোরালোভাবে এই দাবিটা করেন যে বাংলা প্রদেশকে ভাগ করতে হবে।

এত বছর পরে বাংলায় আবার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ফিরে এসেছে। এটা হল কী করে?

দুটো বিষয় সাম্প্রতিক কালে আবার নতুন করে মাথা চাড়া দিয়েছে। এক নম্বরটা হচ্ছে, দেশভাগ ও পুরোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি। এটা যারা মনে রেখেছে, তারা জানেন সেটা কত ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা। এখনকার ছেলেমেয়ে অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সেই স্মৃতিটাই নেই। ফলে সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপারটা যে কী, এটা তারা সঠিক জানে না। ভারতবর্ষে অন্য জায়গায় সাম্প্রদায়িকতার অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু তা অন্য জিনিস। পশ্চিমবাংলায় সেই অভিজ্ঞতাটা আর সেভাবে অবশিষ্ট নেই। ফলে এটার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর যে একটা খুব বড় রকমের প্রয়োজন আছে, এই প্রয়োজনটাই অনেকের কাছে খুব একটা জোরালোভাবে দেখা দেয় না।

দ্বিতীয় বিষয়টাই সম্প্রতি অনেক বেশি করে ঘটছে। বিজেপির যে প্রচারটা অনেক বেশি করে করছে তা হল পশ্চিমবাংলায় তথাকথিত বহিরাগত বা বাংলাদেশ থেকে মানুষের আসা। এই আসার ভিত্তিতে মানুষের মনে ভয়ভীতির সঞ্চার করা হচ্ছে যে মুসলিম জনসংখ্যা ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এটা সেনসাস ইত্যাদি দ্বারা দ্রুত বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু আসলে প্রচণ্ড গতিতে মুসলিমদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে। সুতরাং আরেকটা পার্টিশন হবে। অসম ও পশ্চিমবাংলা— এই দুটো জায়গাতেই এই প্রচারটা গত পনেরো-বিশ বছর ধরে খুব বেশি বেশি করে করা হচ্ছে। প্রথমে অসম, ও অসম থেকেই এই ‘বহিরাগত’ কথাটা বাংলায় এসেছে।

অসমের ঘটনাটা কিন্তু অনেকটা অন্যরকম। ময়মনসিংহ, রংপুর এইসব অঞ্চল থেকে অসমে গিয়ে ওখানকার জঙ্গল পরিষ্কার করে, নতুন করে চাষের জমি তৈরি করে, আবাদ করে ওখানে গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা— এই ঘটনা অনেকদিন ধরে, প্রায় একশো বছর ধরে ঘটে চলছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ষাটের দশকে অসমে ‘বঙ্গালখেদা’ বা বাঙালিকে তাড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলন তৈরি হয়। এটা খুব সত্যি কথা যে তখন কিন্তু অসমে বাঙালি মাইগ্রেশন দেশের অন্য রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি হত। অসমে যারা সাংস্কৃতিক তথা রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, তাদের কাছে একটা ভয়ের কারণ তৈরি হয়েছিল যে হয়তো অসমে অহমিয়াভাষীরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন। অতএব বাঙালিদের তাড়াও। এটাকে বেশ খানিকটা হিংস্র আন্দোলনই বলতে পারা যায়। ৬১-৬২-৬৩, এই সময়টায় ওখানে যথেষ্ট মারদাঙ্গা হয়েছিল।

এই আন্দোলন খানিকটা প্রশমিত হয় এই কারণে যে তখনকার কংগ্রেস নেতৃত্ব এইটাকে খুব বেশি বাড়তে দেয়নি। ‘বঙ্গালখেদা’-য় এই বাঙালি বিরোধী ব্যাপারটার সঙ্গে একটা মুসলিম বিরোধিতাও জুড়ে যাচ্ছিল। কারণ যেসব বাঙালি কৃষক, তাদের সমস্তটাই প্রায় মুসলিম। অসমের হিন্দু বাঙালি প্রধানত কাছাড় অঞ্চলের বাসিন্দা এবং তারা অনেকদিনের পুরনো। কিন্তু অপেক্ষাকৃত নতুন যে অংশের বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এলাকায় বাস করে, তাদের নব্বই শতাংশই মুসলিম। বঙ্গালখেদার মধ্যে বাঙালি ও মুসলিম— এই দুটো পরিচয় খানিকটা জুড়ে গেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ঘটনাটিকে একটা এথনিক মারামারি অর্থাৎ বাঙালি বনাম অহমিয়া— এটা না করে যেটা করা হল— বাঙালিদের বলা হল, এরা বিদেশি। অর্থাৎ অসম একটা সীমান্তবর্তী প্রদেশ, বর্ডার রাজ্য, এখানে বিদেশ থেকে লোক আসছে, অতএব সারা দেশের সিকিউরিটি এখানে বিপন্ন— এই যুক্তি থেকে পরবর্তীকালে আসু-র আন্দোলন (All Assam Students’ Union) গড়ে উঠল যা আরও পরে অসম গণপরিষদের আন্দোলন হয়ে দাঁড়াল। এই সবটাই কিন্তু বহিরাগত-বিরোধী বা বিদেশি-বিরোধী আন্দোলন। অর্থাৎ বিদেশি তাড়াও।

রাজীব গান্ধি আসার পর যে অসম চুক্তি হয়, সেই চুক্তিতে একটা রেজিস্ট্রার অফ সিটিজেনস তৈরি করার প্রস্তাব থাকে যা পরবর্তীকালে এনআরসি হয়েছে। সেই এনআরসি অসমের ক্ষেত্রে করতে অনেক সময় লেগে গেল। তো এই যে প্রক্রিয়াটা শুরু হল যে বিদেশি যারা তাদেরকে চিহ্নিত করো, এবং চিহ্নিত করে তাদেরকে দেশ থেকে সরিয়ে দাও অথবা রিটায়ারমেন্ট ক্যাম্পে বসিয়ে দাও। এদের ভোটাধিকার থাকবে না। এই যে দাবিটা এইটা অসম থেকে শুরু হল। বিশেষ করে, যে সময়টায় অযোধ্যায় রাম মন্দির আন্দোলন হচ্ছিল, ওই সময় থেকেই নির্বাচনী প্রচারে এই ইস্যুটা ছিল। ওই সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলিতে যেমন মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়ায় আরএসএস-বিজেপির প্রচারটা শুরু হয় যে এখানেও বিদেশিদের চিহ্নিত করে তাদেরকে তাড়াও। একেকটা সময় এই ইস্যুটা খানিকটা প্রচার পেয়েছে, আবার স্তিমিত হয়ে গেছে। কিন্তু গত দশ বছরে এই দাবিটা খুব বেশি করে উঠে এসেছে। স্বভাবতই এখন ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে বিজেপির সামনে চলে আসা, তাদের সরকার করা এসব দিয়ে এটিকে তারা গত তিন-চার বছরে খুব বেশি করে নিজেদের প্রচারের অংশ করে তুলেছে।

যদিও বিষিয়টিকে বিদেশি-চিহ্নিতকরণ বলা হচ্ছে, তবুও অন্তর্নিহিত অর্থে এটা মুসলিম-বিরোধিতাই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এই যে প্রচার, এখান থেকেই বাংলায় হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার একটা নতুন সূচনাই হল বলা যায়। মাঝে অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর রাজনীতিতে এই ঘটনা ছিল না। এটা নতুন করে হয়েছে এবং এর সঙ্গে অনেক রকম জিনিস জুড়ে গেছে। যেমন, মতুয়া আন্দোলনের দাবি। নমঃশূদ্ররা ৪৭ সাল থেকেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসতে শুরু করছে, ৭১ সালের পরে একটা বড় ধাক্কায় অনেকে এসেছে। তারপরেও কিছু কিছু করে নিশ্চয়ই আরও অনেকে এসেছেন।

নমঃশূদ্র জাতি তখন যেভাবে এসেছিল তা অন্যান্য উদ্বাস্তুদের মতোই। তাদের কারও কাছে সেভাবে কোনও কাগজপত্র ছিলই না। তারপর যাকে বলা হয় স্বাভাবিকভাবে ন্যাচারালাইজড হয়ে গিয়ে, তারা ভারতীয় হিসেবেই বাস করেছে। অন্য যেকোনও ভারতীয় যা যা প্রমাণপত্র দেখাতে পারে, সেগুলো আজ তাদের আছে— যেমন প্রথমে রেশন কার্ড হয়েছে, তারপর কিছুদিন পর ভোটার কার্ড হয়েছে, আজকাল তো প্যান কার্ড, আধার কার্ড সবই আছে। কিন্তু এখন নতুন করে এই প্রশ্নটা তোলা হচ্ছে যে এদের নাগরিকত্বের তো কোনও প্রমাণ নেই! নাগরিকত্বের প্রমাণ আলাদা করে কার কী থাকে?

এই যে নাগরিকত্বের প্রমাণ আমার একটা চাই— এই দাবিটার পেছনে আছে অসমের এনআরসির যুক্তি। অর্থাৎ তোমার দায়িত্ব প্রমাণ করা যে তুমি এদেশের নাগরিক। তোমার কী প্রমাণ আছে? আর প্রমাণ বলতে, তোমার নিজের জন্ম কোথায়। আবার তোমার নিজের জন্মেও কিছু এসে যাচ্ছে না, যদি তোমার অল্পবয়স হয়। আচ্ছা বেশ, তুমি না হয় জন্মেছ, কিন্তু তোমার বাবা-মায়ের পরিচয় কী? তারা কোথা থেকে এসেছিলেন? তারা কোথায় জন্মেছিলেন, তার প্রমাণ দাও। অসমে যেটা দেখা গেল, এই প্রমাণ তো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেওয়া প্রায় অসম্ভব। কার কী জন্মের প্রমাণ থাকে! কিন্তু এইটার ভিত্তিতে যাকে আমরা চাইব, তাকে আমরা নাগরিক বলে মেনে নেব। যাকে চাইব না, তাকে বলব তুমি তো কোনও প্রমাণ দেখাতে পারছ না, অতএব তুমি বিদেশি, তুমি এদেশের নাগরিক নও।

এই যে তফাত করা, এই ঘটনার ফলে অসমে যে কী এক সাংঘাতিক এক অবস্থা হয়েছে, তা তো আমাদের জানাই আছে। এই ঘটনাই আবার বাংলায় এনআরসি চালু করার মধ্যে দিয়ে ও নতুন সিএএ আইনের মাধ্যমে কার্যকর হবে। সিএএ আইনে পরিষ্কার বলা হচ্ছে, এইরকম যদি কেউ থাকে, যার সরাসরি নাগরিকত্বের কোনও প্রমাণ নেই, তিনি যদি মুসলিম না হন, তাহলে মেনে নেওহা হনে যে সে নাগরিক। এটাই হচ্ছে আইনটির মূল কথা। সে ধর্মে মুসলিম না হলে, তার ওইরকম কোনও প্রমাণপত্র না থাকলেও, সে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী নয়। কিন্তু তিনি যদি মুসলিম হন, তাহলে তাকে আলাদা করে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি কীভাবে, ভিসা নিয়ে বা পাসপোর্ট নিয়ে কখন এদেশে এসেছিলেন। এই তফাতটা আইনে করে রাখা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু জেলাতে, কিছু কিছু অঞ্চলে এই প্রচারটা এগিয়েছে। এই প্রচারের পেছনে যে সাম্প্রদায়িকতা তাকে আর সুপ্ত বলা যাবে না, এটা প্রকাশ্যেই সাম্প্রদায়িকতার প্রচার। সেই প্রচার যে এগিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এখানে একটা বিষয় আমি বলব যে ভোটের রাজনীতিতে শুধুমাত্র এই সাম্প্রদায়িক প্রচারের মাধ্যমেই যে বিজেপির মতো একটা দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, এটা বোধহয় তারা নিজেরাও মনে করে না। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে যে গুরুত্বটা অনেক বেশি দেওয়া হচ্ছে যে কেন্দ্রে ও রাজ্যে যদি একই দলের সরকার হয়, তাহলে সরকারি সুযোগ-সুবিধে, কেন্দ্রের সাহায্য ইত্যাদি অনেক সহজে পাওয়া যাবে। কেন্দ্রের সঙ্গে ঝগড়া করে এসব পাওয়া যায় না। এই প্রচারটাই এখন হয়তো বেশি করে করা হচ্ছে, যা সরাসরি ওই অর্থে সাম্প্রদায়িক প্রচার নয়। সাম্প্রদায়িকতা ছাড়াও অন্য কোনও একটা প্রচার তাকে আনতে হচ্ছে।

কিন্তু আমি আবার বলব যে পশ্চিমবাংলায় স্বাধীনতার পরবর্তীকালে অন্তত ষাটের দশকের পর থেকে যে সাম্প্রদায়িকতা প্রায় ছিলই না, সেখানে সাম্প্রদায়িকতার একটা ধারা নিশ্চয়ই এসেছে।

বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলেরা দাবি করেছে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাংলার সংস্কৃতির সাথে বেমানান, কিন্তু তারা মানুষকে এটা খুব একটা বোঝাতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। আপনার কী মত?

এখন দুরকম ঘটনা এখানে খানিকটা মিলেমিশে গেছে। যদি ইতিহাসের দিকে দেখা যায়, তবে বাংলায় তো একসময় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক মতবাদ, ভাবনাচিন্তা যথেষ্ট ছিল। স্বাধীনতার আগে তো যথেষ্টই ছিল। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাও ছিল, মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাও ছিল। তবে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তা দেখা যায়নি। কিন্তু বাংলার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অন্য যে জিনিসটা আসছে তা হল যে রাজনৈতিক সংগঠন এই নতুন ধরনের প্রচার শুরু করেছে বাংলায় এর আগে তাদের প্রচার বা উপস্থিতি তেমন ছিল না, সেকারণে তাদের নেতৃস্থানীয় লোক সবাই পশ্চিমবাংলার বাইরে থেকে আসছে। পাশাপাশি এখানে বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে বা সামনে এসেছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মতবাদ বা দাবি যা উত্তরভারতে প্রচলিত আছে। যা উত্তরভারতে অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত, সেই ধারণাগুলি, সেই কথাগুলো, সেই স্লোগানগুলো এখন পশ্চিমবাংলায় এসেছে। এগুলোর কোনওটাই কিন্তু বাংলা নয়। সে জয় শ্রীরাম থেকে শুরু করে লাভ-জিহাদ বিরোধী কথা, বা গো-রক্ষা, এগুলো কোনওটাই কিন্তু বাংলার সংস্কৃতির অঙ্গ নয়। স্বামী বিবেকান্দ বলুন, বা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রই বলুন, এঁদের অনেক রকম কথাবার্তার মধ্যে খুঁজলে হয়ত হিন্দু রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। শুধু সাম্প্রতিককালে নয়, আগেও এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিবেকানন্দ বা বঙ্কিমচন্দ্রের আরও অনেক কথাবার্তার মধ্যে তাঁরা সামগ্রিকভাবে বাংলার যে সংস্কৃতি, তার অন্তর্গতই ছিলেন। এখানে আমি বামপন্থী বা কংগ্রেস ভেদ করছি না। আপনি বামপন্থীদের মধ্যেও বহু লোক পাবেন, যারা বঙ্কিমচন্দ্রের অনুরাগী। এমনকি বিবেকানন্দ সম্পর্কেও যথেষ্ট অনুরাগী এমন অনেকেই আছে। এখানে মনীষীদের কখনও কোনও বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাদা করে ভাবা হয়নি। কিন্তু এটা দাবি করার চেষ্টা হচ্ছে যে এঁদের কথা বাংলা আসলে ভুলে গিয়েছে, আমরাই এঁদেরকে নতুন করে বাংলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, এটাই তোমাদের আসল ঐতিহ্য। এইভাবে যে একটা হিন্দু জাতীয়তাবাদকে নিয়ে আসার চেষ্টা, এটাই আমি বলব যে তেমনভাবে সফল হচ্ছে না। যেটা সফল হচ্ছে তা হল উত্তরভারতীয় হিন্দু রাজনীতির চেহারা খানিকটা নিয়ে আসতে পারা। এবং তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক যেমন সাজপোশাক, গেরুয়া পোশাক পরে মিছিলে হাঁটা, এই বিষয়গুলো বাংলার রাজনীতিতে নতুন, আগে ছিল না। হিন্দু মহাসভাও কখনও গেরুয়া পোশাক পরে যেত না। এটা নতুন। এটা একেবারের সম্প্রতি উত্তরভারত থেকে এসেছে। যেমন ‘জয় শ্রীরাম’ও কোনও বাংলা স্লোগান নয়, হিন্দি স্লোগান।

এরকম অনেক কিছু বলতে পারা যায়, যেগুলো অনেক বেশি করে এসেছে এবং প্রচার পেয়েছে আধুনিক প্রচারমাধ্যমে, কিংবা সোশাল মিডিয়ায়। হিন্দি ভাষাকে অবলম্বন করে যে রাজনৈতিক প্রচার সেটা অনেক ছড়িয়েছে। এটা নতুন। কিন্তু বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বার করার চেষ্টা, আমার কাছে মনে হচ্ছে না যে এটা খুব বেশি সফল হয়েছে।

কিন্তু এতে বিজেপির উত্থান তো আটকানো যায়নি….

টোটাল সার্জটার মধ্যে অনেকগুলো জিনিস জুড়ে গেছে। এর মধ্যে কতটা হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের ফল, কতটা তৃণমূল সরকারের প্রতি নানা কারণে মানুষের ঊষ্মা ও অশ্রদ্ধা, অর্থাৎ তৃণমূল বিরোধিতার প্রকাশ? আর তৃতীয় হচ্ছে, বৃহত্তর ভারতবর্ষের যে চেহারা তার সঙ্গে পশ্চিমবাংলার যে তফাতটা করা হচ্ছে। অন্যান্য জায়গায় অনেক বেশি মানুষের হাতে পয়সা বেশি, সেসব শহরে গেলে দেখতে পাওয়া যায়, সেসব শহরের চেহারা অন্যরকম। আমাদের এখানে কেন সেরকম নয়! তাই সেখানকার যারা নেতা, তাদেরকে যদি আমরা এখানে নিয়ে আসি, তাহলেই আমাদের শহরগুলোর চেহারা ওদের শহরগুলোর মতো হয়ে যাবে… এইরকম গোছের একটা ধারণা। সত্যি কথা বলতে কী, আজ থেকে দশ বছর আগে আমাদের রাজ্যে বিজেপিকে তো এত প্রকাশ্যে দেখতে পাওয়া যেত না। কিন্তু আজকে যে তারা প্রধান বিরোধী দল, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অতএব এই যে জায়গাটায় তারা পৌঁছেছে, তা কিন্তু একাধিক কারণের যোগফল। এবং এর সবটাই যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের জন্য হয়েছে এ কথা আমার মনে হয় না।

বিজেপি ক্ষমতায় এলে আমরা কী ধরনের পরিবর্তন দেখতে পাব?

এইটেই অনেক বেশি করে ভেবে দেখা প্রয়োজন। কারণ সরকারে আসার জন্য বা নির্বাচনে জেতার জন্য কৌশল হিসেবে একাধিক প্রচারের বিষয়কে তারা হাতিয়ার করছে, এটা তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। আমি যেটা বললাম, যে এখানে সবটাই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা নয়। তার বাইরেও অনেকগুলো জিনিস তারা ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। এবং যদি শেষ অবধি তাতে তারা সফল হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায়, এবং একবার সরকার গড়ার পর, তারপরে কী হতে পারে, এখানে কিন্তু অনেক রকম বিষয় ভাবার আছে। ভাবার আছে এই কারণে যে এটা মনে করার কোনও কারণ নেই, যে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি রাতারাতি একটা অন্য সরকার এলেই অন্যরকম হয়ে যাবে। লোকের হাতে প্রচুর পয়সা চলে আসবে, বিরাট সমৃদ্ধি হবে— এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। কারণ সেগুলো যদি হওয়ার থাকত তো অন্য কারণে অন্যভাবেও হত। নতুন সরকার এলেই হঠাৎ করে শিল্পপতিরা পশ্চিমবঙ্গে এসে নতুন নতুন কলকারখানা তৈরির জন্য টাকা ঢালবেন, এটা মনে করারও কোনও কারণ নেই। টাকা ঢেলে যদি তা থেকে মুনাফা করার সুযোগ থাকত, তবে তা তারা এমনিতেই করতেন। আর যে সুযোগ যদি না থাকে, তবে একটা-দুটো লোকদেখানোর জন্য হয়তো শিল্প হতে পারে, কিন্তু তাতে কখনও উন্নতি হতে পারে না। আর্থিক সমৃদ্ধির যদি কোনও সামাজিক ভিত্তি না থাকে বা নতুন করে তৈরি না হয়, তাহলে সেটা শুধুমাত্র একটা সরকার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে হতে পারে না। অর্থাৎ এসব ভাবার কোনও কারণ নেই।

কিন্তু যে পরিবর্তন হতে পারে, যে পরিবর্তন একটা সরকার গিয়ে অন্য সরকার নিয়ে আসতে পারে, সেগুলো অন্য কতগুলো সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য জগতে কিছু পরিবর্তন। এই পরিবর্তন শুধু বিজেপি নয়, সামগ্রিকভাবে হিন্দুত্ববাদী যে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো আছে, এটা তাদের অ্যাজেন্ডা বলা যেতে পারে। সাংস্কৃতিক অ্যাজেন্ডা। এবং সেখানে বাংলার জায়গাটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে। কারণ উত্তরভারতে এবং পশ্চিমভারতে, অর্থাৎ গুজরাট-মহারাষ্ট্র যদি ভাবা যায় এবং পুরো উত্তরভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চল, এইখানে তাদের যে সাংস্কৃতিক আধিপত্য এখন, সেই আধিপত্য এখনও বাংলায় নেই। দক্ষিণভারতে নেই। দক্ষিণভারতে চট করে সরকারে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম কারণ সেখানে রাজনৈতিকভাবে অন্য অনেকগুলো দল ইত্যাদি আছে, সেখানে এই ধরনের দক্ষিণপন্থী দলের শুধুমাত্র কর্নাটক ছাড়া তামিলনাড়ু, অন্ধ্র বা কেরলে সেই অর্থে সুযোগ খুব কম। অসম এবং বাংলা, এই দুটো জায়গায় বিজেপির সুযোগ এসেছে। অসমের তুলনায় বাংলা নিশ্চিতভাবে তাদের কাছে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলায় যদি হিন্দুত্ববাদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করা যায়, ঠিক যেমন আজ উত্তরপ্রদেশে সরকার বা সরকারি মুখপাত্রদের যে ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে, সেটা যদি বাংলায় আসে, তাহলে কিন্তু সাধারণভাবে ওরা যাকে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে, সেদিকে এটা তাদের কাছে খুব বড় রকমের এগিয়ে যাওয়া হবে। সুতরাং এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারা যায়, যারা বাংলার সংস্কৃতিতে বিজেপির বিপদের কথা বলছেন, এইদিক থেকে বিপদটা অনেক বেশি। সরকার একবার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে, সরকারি সবরকম ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে হিন্দুত্ববাদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বাংলায় প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা অবধারিত হবে। উত্তরভারতে যেমনটা হয়েছে। সেটাই হয়তো প্রধান কাজ দাঁড়িয়ে যাবে, কারণ আর্থিক দিক থেকে ভয়ঙ্কর রকমের বৈপ্লবিক কিছু পরিবর্তন হবে এই আশা করার কোনও মানে হয় না, কারণ তার কোনও ভিত্তি নেই।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...