স্বাধীনতা-উত্তর কালের বাংলা গান: বিবর্তনের ধারা ও পরম্পরা

স্বাধীনতা-উত্তর কালের বাংলা গান: বিবর্তনের ধারা ও পরম্পরা -- অনর্ঘ মুখোপাধ্যায়

অনর্ঘ মুখোপাধ্যায়

 


ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে মগ্ন, কথা ও সুরে সঙ্গীতস্রষ্টা, একটি বাংলা ব্যাণ্ড-এর ভোকালিস্ট, গীতিকার, সুরকার এবং পিয়ানিস্ট।

 

 

 

শুরুরও শুরু থাকে। তাই স্বাধীনতা পরবর্তী পর্বের বাংলা গান নিয়ে কিছু বলতে গেলে আমাদের একটু আগে থেকেই খোঁজখবর নিতে হবে। রাজা বাদশা জমিদারদের আমলে শিল্পীরা দরবারে বসে গান গাইতেন। কখনও শুধু গানের জন্যই গান। কখনও বাঈজিদের নাচের অনুষঙ্গে গান-বাজনা। মাইক, স্পিকার, মিক্সার, রেকর্ড— এসব ছিল না। ভরত, শার্ঙ্গদেব, হনুমন্ত, আমীর খসরু বা তানসেন বাদ দিয়ে সঙ্গীতশিল্পের জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং নন্দনতাত্ত্বিক চর্চা সেভাবে খুব কম পণ্ডিতরাই করেছেন। দীর্ঘদিন অবধি সঙ্গীতকে নিছক বিনোদনের কারবার হিসেবেই দেখা হত। দার্শনিক কাব্যসম্বলিত চর্যাগীতি অথবা সুফি-ভক্তির সহজিয়া দর্শনের গানকে দীর্ঘদিন অবধি মূলধারার সঙ্গীত বলে গণ্য করা হত না।

আধুনিক কালে গান বেঁচে আছে গানের বাজারে। সেই বাজার আবার প্রযুক্তিনির্ভর। প্রযুক্তির বিকাশই ঠিক করে দিয়েছে, গানটি হাজার হাজার লোকে শুনবে, নাকি কোটি কোটি শ্রোতার কানে কানে ঘুরবে। তাই সেই দিকটা একটু বুঝে নেওয়া যাক।

১৯০২ সালে ফ্রেড গাইসবার্গের হাত ধরে কলকাতার মাটিতে গ্রামোফোন রেকর্ডিংয়ের প্রচলন হল এবং প্রথম রেকর্ডটাই ছিল গহরজানের গানের। গহরজান সম্পর্কে গাইসবার্গ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন:

She sings in some twenty languages including Hindustani, Turkish, Persian, Bengali, Kachee [= Katchi], Medrasi [= Madrasi], Burmese, Gujrali [= Gujarati], Tailungi [= Telugu].

গহরজান ছাড়াও এই সময়ের উল্লেখযোগ্য গায়কদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লালচাঁদ বড়াল (যাঁর পুত্র রাইচাঁদ বড়াল কয়েক দশক পরেই বাংলা, ওড়িয়া আর হিন্দি-উর্দু ভাষার সঙ্গীতকে উপহার দিয়েছিলেন অনেক অভূতপূর্ব কম্পোজিশন)। লালচাঁদ বড়াল ১৯০৪-এ পরপর রেকর্ড করলেন, “তুমি কাদের কুলের বৌ”, “তোমার ভালো তোমাতে থাক” এবং “অনুগতজনে কেন তুমি এত করো প্রবঞ্চনা” (নিধুবাবুর টপ্পা)।

তারপর ১৯০৮ সালে ভারতে এলেন আরেকজন রেকর্ডিস্ট, নাম জর্জ ওয়াল্টার ডিলনাট। ১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বম্বেতে আসেন এবং সেখানকার রেকর্ডিং সেশন শেষ হওয়ার পরেই গোটা এপ্রিল মাস জুড়ে কলকাতায় রেকর্ডিং সেশন শুরু করলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে বাংলা ছাড়াও রেকর্ড করা হয় ওড়িয়া সঙ্গীতের চার শিল্পী কুমুদিনী দেবী, অলোক কানুনগো, বাসুদেব মহাপাত্র এবং লোকনাথ কানুনগোর গান, খোদ কলকাতায়।

কিন্তু এই সময়ের শিল্পীদের রেকর্ড করা গানের ক্ষেত্রে আমরা বৈচিত্র্যময় যন্ত্রানুষঙ্গ বা অর্কেস্ট্রেশন দেখতে পাই না— শুধুমাত্র একটা হারমোনিয়াম এবং/অথবা তানপুরা আর একটা তবলা দিয়েই রেকর্ডিং হত। তখন মেকানিকাল সাউন্ড রেকর্ডিংয়ের যুগ; তাই একটাই প্রশস্ত শঙ্কু আকৃতির নলের সামনে বসে ভোকালিস্টকে জোরালো গলায় উঁচু স্কেলে গান গাইতে হত আর অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রীরা বসতেন কণ্ঠশিল্পীর খানিকটা পেছনে। প্রশস্ত শঙ্কু আকৃতির নলের মধ্য দিয়ে আসা শব্দতরঙ্গ নলের অপর প্রান্তে থাকা কম্পমান পর্দা বা ডায়াফ্রামের মধ্য দিয়ে তার সঙ্গে সংযুক্ত একটি সূচাকৃতি স্টাইলাসের শরীরে যে কাঁপন ধরাত, তা-ই ঘূর্ণায়মান মোমের সিলিন্ডারের ওপর শব্দতরঙ্গগুলোকে খচিত করত। পাশ্চাত্যের মতোই ১৯২০-র দশকে বাংলাতেও এল ভিনাইল ডিস্ক এবং ইলেকট্রিকাল রেকর্ডিং ব্যবস্থা এবং আগের শঙ্কু আকৃতির নলের জায়গায় এবার এল মাইক্রোফোন। কণ্ঠশিল্পী এবং বাদ্যযন্ত্রীদের আগেকার মতো উঁচু স্কেলে এবং জোরালো গলায় গান গাওয়ার কিংবা যন্ত্র বাজানোর বাধ্যবাধকতা খুব একটা আর থাকল না। তাছাড়াও একসঙ্গে অনেকগুলো যন্ত্রও ব্যবহার করার অবকাশ পাওয়া গেল। এইভাবে বাংলার সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তা ধীরে ধীরে ঘটিয়ে দিল বিবর্তন। গানের মেলোডি বা মূল সুরের পাশাপাশি এবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল অ্যারেঞ্জমেন্ট বা যন্ত্রানুষঙ্গও, আর সেখানেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটতে লাগল বাংলা সঙ্গীতে বারংবার।

ব্রাহ্ম আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেসব ব্রহ্মসঙ্গীত রচিত হয়েছে, তার স্বরবিন্যাসে ছিল নতুনত্ব। ভারতীয় রাগরাগিণীর ধারা বজায় থাকলেও গায়নশৈলী হয়ে উঠল অনেকটা সফিস্টিকেটেড বা অধিশীলিত। রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল, অতুল প্রসাদ বা রজনীকান্তর গানের মধ্যেও সেই নবোদ্ভাবিত গায়নশৈলী বজায় ছিল। এমনকি বিবেকানন্দ রচিত গানগুলোতেও এই বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশক থেকেই ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়ে নতুনভাবে আলোচনা শুরু হয়েছিল এই বঙ্গদেশেই। রবীন্দ্রনাথ ‘সঙ্গীত ও ভাব’ প্রবন্ধে লিখলেন:

…রাগরগিণীর উদ্দেশ্য ভাব প্রকাশ করা মাত্র। কিন্তু এখন তাহা কী হইয়া দাঁড়াইয়াছে? এখন রাগরাগিণীই উদ্দেশ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। যে রাগরাগিণীর হস্তে ভাবটিকে সমর্পণ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল, সে রাগরাগিণী আজ বিশ্বাসঘাতকতাপূর্বক ভাবটিকে হত্যা করিয়া স্বয়ং সিংহাসন দখল করিয়া বসিয়া আছেন। আজ গান শুনিলেই সকলে দেখিতে চান, জয়জয়ন্তী, বেহাগ বা কানেড়া বজায় আছে কি না। … আজকাল ওস্তাদবর্গ যখন ভীষণ মুখশ্রী বিকাশ করিয়া গলদ্‌ঘর্ম হইয়া গান করেন, তখন সর্বপ্রথমেই ভাবের গলাটা এমন করিয়া টিপিয়া ধরেন ও ভাব বেচারিকে এমন করিয়া আর্তনাদ করিয়া ছাড়ান যে, সহৃদয় শ্রোতামাত্রেরই বড়ো কষ্ট বোধ হয়। … কোন্‌ কোন্‌ রাগরাগিণীতে কী কী সুর লাগে না-লাগে তাহা তো মান্ধাতার আমলে স্থির হইয়া গিয়াছে, তাহা লইয়া আর অধিক পরিশ্রম করিবার কোনো আবশ্যক দেখিতেছি না। এখন সঙ্গীতবেত্তারা যদি বিশেষ মনোযোগ-সহকারে আমাদের কী কী রাগিণীতে কী  কী ভাব আছে তাহাই আবিষ্কার করিতে আরম্ভ করেন, তবেই সঙ্গীতের যথার্থ উপকার করেন।

আবার ১৮৮৫ সালে যখন কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গীতসূত্রসার’ গ্রন্থ লিখছেন, তখন সেখানে তিনি আমাদের দেশে প্রচলিত নাদ এবং ধ্বনির উৎপত্তি-বিষয়ক অবাস্তব আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে আমলই দেননি, বরং ইংরেজি জানা সঙ্গীতের শিক্ষার্থীদের বারংবার ফিজিওলজির বই পড়ে স্বরোৎপত্তি এবং স্বরক্ষেপণ বিষয়ে চর্চা করতে বলেছেন। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল, কৃষ্ণধনবাবু ১৮৮৫ সালে বসেই যে মতকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, সেই অবৈজ্ঞানিক মত এখনও বর্তমান ভারতের অধিকাংশ সঙ্গীতশিক্ষক প্রচার করেন। রবীন্দ্রনাথের মতোই কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ও জোর দিয়েছিলেন গানের ভাবার্থ এবং সঠিকভাবে রসের অবতারণার ওপরে। আর সেই প্রসঙ্গেই তিনি তাঁর সমসাময়িক গায়নরীতির বিরোধিতা করে বলেছেন:

রাগ-রাগিণী ও তাল, লয় বিশুদ্ধ হইল কিনা, কেবল সেই বিষয়ে ওস্তাদেরা অধিক মনযোগী হওয়াতে, হিন্দুস্থানী গানের ভাবার্থ লোপ পাইয়াছে; … যেখানে যে রসের প্রয়োজন, তাহার অবতারণপূর্বক শ্রোতার মনে সেইরূপ ভাবোদ্দীপনের চেষ্টা না পাইয়া, ওস্তাদগণ সর্বদা দুঃসাধ্য কর্তব্যপূর্ণ গলাবাজি দ্বারাই লোকের মনাকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। ইহাতে তাঁহাদের পরিশ্রম বৃথা যায় ও অভীপ্সিত ফল লাভও হয় না। … বাস্তবিক সঙ্গীতালোচনার এই কুরীতি সর্বত্র প্রচলিত। ইহা যে আমাদের জাতীয় নিকৃষ্ট রুচির পরিচয় দিতেছে, তাহার সন্দেহ নাই। শ্রোতৃবর্গের রুচি উন্নত হইলে, ব্যবসায়ী ওস্তাদেরাও তদনুসারিণী শিক্ষা ও সাধনা অবলম্বন করিতে বাধ্য হন।

একদিকে এই নতুন গায়নশৈলীর বাস্তব সম্মত ধারণা আর অপরদিকে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠা যন্ত্রানুষঙ্গ— এরই সমন্বয়ে গড়ে উঠল আধুনিক বাংলা গানের ভিত্তি। পঙ্কজ কুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, কমল দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটক, দিলীপ কুমার রায়, সুবল দাশগুপ্ত, শচীন দেব বর্মন বা হিমাংশু দত্তর মতো কম্পোজারদের হাতেই পরিণতি পায় আধুনিক বাংলা গান। দেশীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার সঙ্গে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অভূতপূর্ব সামঞ্জস্যপূর্ণ মেলবন্ধন তাঁরা সৃষ্টি করেছিলেন, তা এখনও শিক্ষণীয় বিষয়।

যদি রবীন্দ্রনাথ বা কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বকে সাঙ্গীতিকভাবে সচেতন বাঙালি জাতি গ্রহণ না করত, তবে আমরা সুধীরলাল চক্রবর্তীর “খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায়” গানে Blues-এর আভাস পেতাম না; শ্যামল মিত্রের গাওয়া “আমার এ বেভুল প্রাণের সঙ্গোপনে” গানটা রচনা করার সময়ে অলোকনাথ দে কয়্যারের ব্যবহার করতে পারতেন না; পঙ্কজ কুমার মল্লিক তাঁর কালজয়ী ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে কর্ডের ব্যবহার বা ‘ডাক্তার’ সিনেমাতে “চৈত্রদিনের ঝরা পাতার পথে” গানে কীর্তনের সঙ্গে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের গায়নশৈলী মেশাতে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন; নজরুল তাঁর “নুরজাহান” গানে তুর্কি সুরের সঙ্গে পাশ্চাত্য আর ভারতীয় সঙ্গীতের নির্যাস মেশানোর আগে দশবার ভাবতেন আর পাশ্চাত্যের চার্চের ক্যারোল বা গস্পেলের সুরে “সঙ্ঘশরণ তীর্থযাত্রাপথে” বা “কাণ্ডারী হুঁশিয়ার” কবিতাতে সুর দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারতেন না; কমল দাশগুপ্ত যুথিকা রায়ের সঙ্গে নজরুলের “রুমুঝুম রুমুঝুম নূপুর বাজে” গানটা গাইবার সময়ে পিয়ানোতে কর্ড আর তার সঙ্গে বৈষ্ণব মাধুকরী কীর্তনীয়াদের খঞ্জনি ব্যবহার করতেন না; শচীনকর্তার “আঁখিদুটি ঝরে হায়” গানটাতে হয়ত স্পেনের আন্দালুসিয়ান ফোক মিউজিকের সঙ্গে বাংলার পল্লীগীতি আর সিন্ধুভৈরবী রাগের মেলবন্ধন শোনার সৌভাগ্য আমাদের হত না; ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ সিনেমাতে মিউজিক ডিরেক্টর রাইচাঁদ বড়ালের সৃষ্টি করা এবং মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া “জগন্নাথ জগৎবন্ধু”-র মতো একটা কীর্তনাঙ্গের গানে চেম্বার অর্কেস্ট্রা আর তার সঙ্গে অ্যাম্বিয়েন্সে বাজতে থাকা টেনর স্যাক্সোফোনের সুমধুর বৃন্দ-বাদন আমরা শুনতে পেতাম না; হয়ত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অমিয় বাগচী রচিত “তোমার দুয়ারখানি খোলা” গানটাকে ভৈরবী রাগে সুর দেওয়ার পর অ্যারেঞ্জমেন্ট করার সময়ে ইওরোপের ব্যারক পিরিয়ড (Baroque Period)-এর আদলে শুধুমাত্র স্ট্রিংস, ব্রাস আর ফ্ল্যুটের সমাহারে সিম্ফনির আবহ ব্যবহার করতেই পারতেন না; হয়ত হিমাংশু দত্ত বা দিলীপ কুমার রায়ের গানকে আমাদের জনসমাজ “ম্লেচ্ছসংস্পর্শদোষ”-এর অছিলায় বয়কট করে দিত; কালীপদ সেন হয়ত ‘মেজদিদি’ সিনেমায় “জনম-মরণ পা ফেলা আর পা তোলা তোর ওরে পথিক” গানটায় দাদরা তালের মধ্যে waltz-এর ভাব ফোটাতে ব্যর্থ হতেন; রবীন চট্টোপাধ্যায় হয়ত ‘লালুভুলু’ সিনেমার সাউন্ডট্র্যাকে হার্মোনিকা (চলতি ভাষায় “মাউথ অর্গান”) ব্যবহার করার কথাই চিন্তা করতে পারতেন না; হয়ত বাংলার গানের জয়যাত্রাই কয়েক দশক বা শতকের জন্য পিছিয়ে পড়ত!

 

[ক্রমশ]

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...