প্রবুদ্ধ ঘোষ
সাহিত্য গবেষক, দাবা প্রশিক্ষক
আইকন কী? আইকন মানে এমন কেউ, যিনি কোনও বিশেষ বিশ্বাস বা সম্প্রদায় বা জাতি বা সংস্কৃতির প্রতীক কিংবা তার প্রতিনিধিত্ব করেন। গ্রিক শব্দ eikōn-এর অর্থ সাদৃশ্য বা প্রতিরূপ। শব্দটির ধর্মীয় অনুষঙ্গ রয়েছে, বিশেষ কোনও উচ্চমার্গীয় আধ্যাত্মিক ও পবিত্র ব্যক্তির প্রতিরূপকে বলা হত আইকন। আধুনিক সংজ্ঞায়নে আইকন অর্থে, যিনি আদর্শ কোনও ব্যক্তি, যাঁকে অনুসরণ করা যায় এবং যাঁকে সামাজিক উচ্চাবস্থানে বসানো হয়। আইকন জনপ্রিয়। আইকন জনগণের হতে-চাওয়া অথচ না-হতে-পারা আকাঙ্খিত মুহূর্তগুলিকে জয় করেছেন বলেই, তিনি আদর্শস্থানীয় এবং সাধারণীকৃত জনগণের থেকে আলাদা ও বিশেষ। কিন্তু, আইকনকে এখন শুধু জনপ্রিয় হলেই হয় না, বরং জনতোষীও হতে হয়। আর, সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমে ক্রমশ; স্পষ্ট যে, আইকনকে রাষ্ট্রতোষীও হতে হয়।
কিছু মাস আগে কৃষক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু টুইট ঘিরে দেশ উত্তাল হয়েছিল। নয়া কৃষিবিলের বিরুদ্ধে কৃষকদের বিক্ষোভের সমর্থনে দুটো বাক্য লিখেছিলেন পপ গায়িকা রিহানা ও পরিবেশ আন্দোলনের নেত্রী গ্রেটা থুনবার্গ। তারপরই ভারতীয় ক্রিকেটাররা, বিশেষত ‘ধ্রুপদী ২০০৩’ জমানার আইকন ক্রীড়াবিদ্রা, একযোগে টুইট করতে শুরু করেন। সচিন, সৌরভ, কুম্বলে, কোহলি— কে নেই সেই টুইট-তালিকায়? সঙ্গে যোগ দেন বলিউডের তাবড় তারকারা; লতা, অমিতাভ, অক্ষয়, অজয়— তালিকা দীর্ঘ। আর, এঁদের প্রত্যেকের টুইটে কিছু বিশেষ শব্দবন্ধ ও হ্যাশট্যাগের সাধারণীকৃত ব্যবহার— ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধান’ ও ‘অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ভারত’। খটকা জাগে এখানেই। যে মূল বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে কৃষকের সংঘাত, অর্থাৎ নয়া কৃষিবিল, তা নিয়ে তাঁদের কোনও বক্তব্য নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানের একের পর এক বেসরকারিকরণ, বেড়ে চলা বেকারত্ব এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশমুখী দাম নিয়ে ‘আইকন’রা নীরব থাকেন/থাকবেন— এটাই দস্তুর ও স্বাভাবিক! প্রায় দশ মাস কৃষকরা নয়া কৃষিবিলগুলি বাতিলের দাবিতে দিল্লির সীমান্তে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছেন, সেই বিষয়ে তাঁরা নীরব। কিন্তু, রিহানা ও গ্রেটা ভারতরাষ্ট্রের এমন কোন ক্ষতি হঠাৎ করে দিয়েছিলেন, যাতে এঁদের প্রকাশ্য সামাজিক মাধ্যমে বক্তব্য রাখতে হল? কোন জাদুবলে তাঁদের প্রত্যেকের টুইটের বয়ানে এমন সাদৃশ্য? ‘লকডাউনে ঘরে থাকুন’ বলায় তাঁদের যে সম্মিলিত উৎসাহ ছিল, ‘দেশের শিক্ষাক্ষেত্রগুলি থেকে লকডাউন তুলে নেওয়া হোক’ বলায় তার ছিটেফোঁটাও নেই। রাষ্ট্রের যখনই নিজস্ব মতাদর্শগত অনুশীলন পুনঃপ্রচারের প্রয়োজন হয়, এমনই টুইট বা বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়ে। তা সে পিএম কেয়ার্স ফান্ডের (যে তহবিলের আর্থিক লেনদেনের কোনও হিসেব দেবে না বলে জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অফিস) বিজ্ঞাপন হোক বা ‘রাষ্ট্রীয় একতা’র জবরদস্তি প্রচার। প্রচারের মুখ হন আইকনরা। হ্যাঁ, তাঁরা আইকন, তাঁরা আন্তর্জাতিক পরিসরে স্ব স্ব ক্ষেত্রে মহান, তাঁরা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তাঁদের যাপন থেকে কথন সবই সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে জনতার কাছে পৌঁছে যায়। ভারতবর্ষে চলচ্চিত্র ও ক্রীড়ার দর্শকবৃন্দের সংখ্যাগরিষ্ঠ এঁদের ভালোবাসেন বলেই এঁরা জনপ্রিয় এবং আইকন হয়ে উঠেছেন। এঁরা যে জনমানসের অধিনায়ক হয়ে আছেন, তার ভেতর অনেকেই নয়া কৃষিবিলের দ্বারা ক্ষতির সম্ভাবনা আঁচ করেছেন কিংবা রান্নার গ্যাস বা ডিজেলের দামবৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এঁদের জনপ্রিয় করে তুলতে সেই মানুষদের ভূমিকাও রয়েছে, যাঁরা সিঙ্ঘু সীমান্তে দশ মাস অবস্থান করছেন। ভারত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিজয়ী হলে যাঁরা উল্লাসে দুই গ্রাস ভাত বা দুটো রুটি বেশি খান, তাঁদের মধ্যে দ্বিশতাধিক কৃষক সরকারবিরোধী আন্দোলনে মারা গেছেন এবং অনেক শ্রমজীবী রুজি-রোজগার হারিয়ে ফেলেছেন। এই অভিনেতাদের চলচ্চিত্রায়িত সংলাপ ও দুষ্টদমনকারী ভূমিকা যাঁদের মুখে মুখে ফেরে, তাঁদের অনেকেরই বাড়িতে হাঁড়ি চড়ছে না লকডাউন পরবর্তী পরিস্থিতিতে। কিন্তু, জনগণের প্রাণাধিক প্রিয় আইকনেরা, নায়করা একটি শব্দও খরচ করেননি তাঁদের বুঝতে চেয়ে। অন্নদাতারা বিপন্ন হলে দেশ বিপন্ন হয় না? মূলবাসীর জঙ্গলের অধিকার কর্পোরেটের হাতে গেলে ‘দেশ’ আইডিয়াটি অক্ষত থাকে? অথচ, রিহানা ও গ্রেটার দুটো টুইটে এঁরা মনে করলেন যে, দেশের সংহতি বিপন্ন? এঁরা কোনও এক আশ্চর্য সমাপতনে ঠিক একই সময়ে বুঝে যান জাতীয়তাবাদী সংহতির প্রয়োজনীয়তা? দেশ মানে কি দেশের প্রাথমিক অর্থনীতিক্ষেত্রের উৎপাদকরা নয়, বরং ‘ভার্চুয়াল প্রতিপক্ষের’ বিরুদ্ধে হ্যাশট্যাগের সঙ্ঘবদ্ধতা? মুষ্টিমেয়র উন্নয়নের জন্য শাসকের হয়ে বিজ্ঞাপনের জাদুছড়ি ঘোরানো?

এই আইকনরা জনপ্রিয়তার ন্যূনতম মাপকাঠি বহুদিনই পার হয়ে এসেছেন, তাঁদের মোট ভক্তসংখ্যার অবদানেই বলিউড ভারতের সবচেয়ে বাণিজ্যসফল চলচ্চিত্রশিল্প আর ক্রিকেট সবচেয়ে বাণিজ্যসফল খেলা। আইকনদের যাঁরা জনপ্রিয়তার শীর্ষে রেখেছেন, তাঁদের কিছু প্রত্যাশা থাকে আইকনদের থেকে। এই প্রত্যাশার দিগন্ত এমনই যে, ভক্তরা সর্বদাই তাঁদের আদর্শের মণিকোঠায় সযত্নে তুলে রাখেন এঁদের। ভারত খেলায় হারলে আইকনদের জনগণের রোষানলে পুড়তে হয় আবার সেই জনগণই জেতার আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠে এঁদের দেবজ্ঞানে পুজো করেন। হয় নিজেদের চিন্তাসূত্র, নিজেদের রাজনৈতিক আকঙ্খা, নিজেদের মতামতের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চান প্রিয় আইকনের চিন্তা, রাজনীতি ও মতামতকে। আইকনের সামাজিক অবস্থান ও আভিজাত্যে উপনীত হতে পারবেন না জেনেও, যতটা সম্ভব তাঁকে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে চান। আইকনরা তা জানেন, তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জানে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলি ও রাষ্ট্র। বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলি এই আইকনদের দিয়ে ‘আমার পছন্দ’ বলিয়ে নিয়ে জনমানসে তার প্রভাব বিস্তার করতে চায় ও উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি বাড়াতে চায়। আর, রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ কীভাবে এঁদের ব্যবহার করে নেয়? আইকনরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে মহান হয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠার পরেই তাঁদের জনতোষী করে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। জনতোষের মধ্যে দুটি বিষয় থাকে— সম্মতি ও সংখ্যাধিক্য।
ক্রিকেটার শেষ বলে ছয় মেরে খেলা জেতালে কিংবা বিদেশের মাঠে বুকচেতানো শতরান করলে গোটা দেশ অজানা মন্ত্রবলে এক হয়ে যায়, কোনও হ্যাশট্যাগ ছাড়াই। প্রিয় অভিনেতার ছবিমুক্তির প্রথম সপ্তাহেই দুশো কোটির টিকিট বিক্রি হলে সব সঙ্কট আপাতভাবে মুছে গিয়ে দেশ এক হয়ে যায়, কোনও টুইটযুদ্ধ ছাড়াই। তাহলে, সেই আইকনদের কেন হ্যাশট্যাগ ও সাজানো সংহতিবাক্য লিখতে হয়? একদা যে কভার ড্রাইভ বা রাগী যুবার বাস্তবপ্রকাশে দেশকে হর্ষোত্তেজনায় সমবেত করেছিল, সেইসব সযত্নছবি ভেঙে ভার্চুয়াল মাধ্যমের কাল্পনিক শত্রুতার অজুহাত গড়ে নিতে হয়? কারণ, রাষ্ট্র তাঁদের জনতোষের দিকে ঠেলে দেয়। আইকনদের তখন রাষ্ট্রের হয়ে সম্মতি আদায় করে আনার প্রয়োজন পড়ে। সংখ্যাধিক্যের সম্মতি শাসকের অনুকূলে নিয়ে আসা। সমাজের সংখ্যাধিক্য জনমানসে কারা প্রভাব বিস্তার করে? আইকনরা। কোনও মতামতকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত বলে নির্মাণ করে, সেই মতামতকেই দশচক্রে স্থাপন করার বিশেষ জ্ঞাপনকৌশল কারা বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রচার করতে পারে? আইকনরা। এই রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞাপনে ক্রিকেটে বা চলচ্চিত্রে কার কত অবদান, কোন অনবদ্য মেধা ও দক্ষতায় দেশের জনমানসে ঠাঁই করে নিয়েছেন— সেই সবই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়। রাষ্ট্রের মতাদর্শ মেনে মতামত তৈরি করে দেওয়ার গুরুদায়িত্বই তখন একমাত্র প্রয়োজনীয়। আইকনের প্রতি জনগণের প্রত্যাশার দিগন্তে থাকে সমমতের প্রকাশ, ন্যায়-অন্যায়ের বিচারের আদর্শ এবং বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক যাপনক্ষেত্রে আদর্শায়িত বয়ানভঙ্গি। কিন্তু, আইকনের প্রতি জনগণের প্রত্যাশার দিগন্তের বাইরেও তো আইকনরা রক্তমাংসের মানুষ, তাঁদের ‘ব্যক্তিগত’ যাপন আছে। আর, সর্বোপরি রয়েছে চির-আইকন থেকে যাওয়ার বাসনা। জনপ্রিয়তায় সচিন বা অমিতাভের নতুন করে কিছু পাওয়ার নেই কিন্তু, হারানোর ভীতি আছে। রাষ্ট্র যদি সব স্বীকৃতি কেড়ে নেয়, রাষ্ট্র যদি সংখ্যালঘিষ্ঠের দলে ফেলে দেয়? নিশ্চয়তা ও স্থিতি অটল রাখার দোলাচলে কে না ভোগে? তাঁরা গলা মেলান রাষ্ট্রের সমস্বরে। তাঁদের জনতোষ ক্রমে রাষ্ট্রতোষে পরিণত হয়। ক্রিকেট বা অভিনয়ের দক্ষতায় যে জাতীয়তাবাদী কল্পকাঠামো তাঁরা জনমানসে একদা নির্মাণ করেছিলেন, রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের চাপে সেটাই আরও উগ্র-দ্বেষকামী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র তাঁদের ব্যবহার করে নেয় তাঁদেরই ভক্তদের বিরুদ্ধে; যে মানুষগুলি বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থায় মারা গেলেন, তাঁরাও অনেকে সচিনের শারজা-মরুঝড় বা চোয়াল-ভাঙ্গা কুম্বলের লড়াই বা অমিতাভের বিজয় বা লতাজির ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগোঁ’-র ভক্ত ছিলেন। অক্ষয়ের ‘সিং ইজ কিং’ (২০০৮) ছবি বা সানি দেওলের ‘বর্ডার’ (১৯৯৭) ছবি পাঞ্জাবের যে পরিবারগুলিকে মহান গৌরবে অভিনন্দিত করেছিল, তাঁরাই তো আজ সিঙ্ঘু সীমান্তে রাষ্ট্রবিরোধিতায় শহীদ হচ্ছেন, মার খাচ্ছেন। তাঁরাও চেয়েছিলেন যে, তাঁদের অসহায়তায় বা মরণপণ লড়াইয়ের সমর্থনে আইকনরা কিছু শব্দ, ন্যূনতম বাক্যব্যায় করুন। কিন্তু, আইকনদের সামাজিক-রাজনৈতিক উত্তরণকল্পে এঁরা অস্তিত্বহীন হয়ে যান। সত্যজিতের ‘নায়ক’ (১৯৬৬) ছবির অরিন্দম মুখার্জ্জী জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে কিছুতেই আর বীরেশের আহ্বানে সাড়া দিতে পারেননি; অরিন্দম বীরেশের বিরুদ্ধেও কিছু বলেননি, হয়তো সে প্রয়োজনও তখন তাঁর ছিল না। ‘অরিন্দম’রা এখন ‘রাষ্ট্রীয় ঐক্যের’ বয়ানে বীরেশের বিরুদ্ধে বলতে বাধ্য হচ্ছে, রাষ্ট্রের অমোঘ নির্দেশ জেগে থাকছে শুধু সাদৃশ্যমূলক টুইট পুনঃপুনঃজ্ঞাপনে কিংবা জনবিরোধী নীতির বিজ্ঞাপিত বয়ানে। কিন্তু, রাষ্ট্রের এই নিয়ন্ত্রণ, এই নির্দেশ কি নতুন?
বেনিতো মুসোলিনি ক্ষমতায় আসীন হয়েই ক্রীড়াকে শাসনব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী করে তুলেছিলেন। ‘কালচো’ বা ফুটবল ছিল তাঁর ফ্যাসিস্ত-শাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম অস্ত্র। মুসোলিনির জমানায় ইতালি ফুটবল বিশ্বকাপ জেতার পরে ইতালির সেই সময়ের সর্বাধিক জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম তথা ‘ইল পোপোলো দি’ইতালিয়া’ সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল রাষ্ট্রাধীন সংহতি, শৃঙ্খলা, সৌহার্দ্য ও সাহসের কথা! জন তুনিস তাঁর ‘দ্য ডিক্টেটরস ডিসকভার স্পোর্ট’ প্রবন্ধে লিখেছেন যে, ক্রীড়াকে, বিশেষত ফুটবলকে ও ফুটবলারদের এমনভাবে ব্যবহার করা হত যেন জনমানসে রাজনৈতিক প্রশ্ন না ওঠে। ইতালি ১৯৩৪ ফুটবল বিশ্বকাপ জেতে ভিত্তোরিও পোজোর ‘নজরদারি’তে। পোজোর তত্ত্বাবধানে ইতালির সাফল্যের হার আকাশছোঁয়া— অষ্টআশিটি খেলায় ষাটটিতে জয়লাভ করেছিল তারা। জন ফুট ইতালির ফুটবল ইতিহাস আলোচনায় বলেছেন যে, ১৯৩৮ সালে ভিত্তোরিও পোজো তাঁর খেলোয়াড়দের নির্দেশ দেন যে, যতক্ষণ না ফ্যাসিবাদ-বিরোধী জনগণের চিৎকার থামে, ততক্ষণ যেন তারা ফ্যাসিস্ত সেলাম ঠুকে দাঁড়িয়ে থাকে। ১৯৩৮ সালে ইতালি বিশ্বকাপ জেতার পরে একদিকে যেমন ফুটবল ইতালির সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বাণিজ্যসফল খেলা হয়ে ওঠে, তেমনই মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের মতাদর্শ প্রচার সহজতর হয়। শুধু ইতালিই নয়, বরং আইকনদের উগ্র জাতীয়তাবাদী করে তোলায় স্পেনের জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ভূমিকাও কিছু কম নয়! ফ্রাঙ্কো তাঁর স্বৈরাচারী প্রকল্পে সামিল করিয়েছিলেন সান্তিয়াগো বার্নাবিউকে এবং রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবকেও। ফ্রাঙ্কো গোটা রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবের পরিচালন সমিতিকে উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করে কাতালানদের সংখ্যালঘিষ্ঠ করে দেন এবং সান্তিয়াগো বার্নাবিউয়ের মতো তৎকালীন অনেক আইকনই ফ্রাঙ্কোর মতাদর্শের হয়ে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সে যুগে টুইট বা হ্যাশট্যাগ বা ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যমের আধিপত্য ছিল না; কিন্তু, সাম্প্রতিক ভারতরাষ্ট্রের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে কি?

উইলিয়ম শকলি অর্ধ-পরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টরের ওপরে গবেষণায় নোবেল পেয়েছিলেন। আইকন তো বটেই! তিনি নাজি জমানাকে সমর্থন করেছিলেন, কারণ, হিটলারের জাতি-শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন। বিখ্যাত দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার, যাঁর অস্তিত্ববাদী ও সময়-বিশ্লেষক চিন্তাধারা থেকে এখনও গবেষণার রসদ পান অনেকে, তিনি ছিলেন নাজি সদস্য এবং জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রচারক। দাবার চতুর্থ বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্দার আলেখাইন আধুনিক দাবার বহু তত্ত্বকে পাল্টে দিয়েছিলেন। এখনও বহু দাবাড়ু তাঁকে আইকন হিসেবে মানেন, তাঁর দাবাতত্ত্ব অনুশীলন করেন। সেই আলেখাইন ১৯৪১ সালে ছটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন নাজিদের সমর্থনে ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে। তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন ও গভীর যুক্তিবোধসম্পন্ন আলেখাইন প্রবন্ধগুলিতে লিখেছিলেন যে, ইহুদিদের দাবা খেলার ধরন নাকি কাপুরুষোচিত ও আর্যদের দাবা নাকি নান্দনিক। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে আলেখাইন বিপন্নতার কথা স্বীকার করেছিলেন যে, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে নাজিরা জোর করে এই প্রবন্ধগুলি লিখিয়েছিল— ভিসা পাওয়ার জন্যে তিনি নাকি জাতিবিদ্বেষী বয়ানের প্রবন্ধগুলি লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। এজরা পাউন্ড, সাহিত্যজগতে আধুনিকতাবাদের নমস্য ব্যক্তি, চল্লিশের দশকের শুরুতে ফ্যাসিবাদের পক্ষে জাতীয় সংহতির আহ্বান রেখেছিলেন ইতালিয়ান রেডিওতে। আলেখাইন, হাইডেগার, পাউন্ডের মতো স্ব স্ব ক্ষেত্রে বহু মহান ব্যক্তি তাঁদের দক্ষতার্জিত জনপ্রিয়তার তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রের পক্ষে জনতোষী মতামত গড়ে তুলেছিলেন। রাষ্ট্র ক্রমশ তার সুসংবদ্ধ ফ্যাসিবাদী পদ্ধতিতে গ্রাস করে নেয় আইককনদের, আর, তাঁদেরই করে তোলে প্রচারমাধ্যম। আইকনরা হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রতোষী।

তবু, এই সমর্পণের উদাহরণই কি সব? ১৯৮২ সালে করিন্থিয়াসের তথা ব্রেজিলের তারকা এবং বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম শিল্পী সক্রেটিস সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। রাষ্ট্রের বহু প্রলোভন ও হুমকি উপেক্ষা করে ’১৫ তারিখ ভোট’ লেখা জার্সি পরে আন্তর্জাতিক খেলায় খেলতে নামেন। রাষ্ট্রীয় মতাদর্শে পরিচালিত মাধ্যমগুলিকে উপেক্ষা করে প্রকাশ্যে ভাষণ দেন দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে। ব্রেজিলে সক্রেটিস আইকন হয়ে ওঠেন। ইউক্রেনের ফুটবল দল কিয়েভ স্টার্ট ১৯৪২ সালে নাজিদের থেকে প্রস্তাব পেয়েছিল ফুটবল খেলার। কিন্তু, শর্ত একটাই— জিতলেই কনসেনট্রেশন শিবিরে যেতে হবে। স্টার্ট দল হারিয়েছিল পরাক্রমী জার্মান বায়ুসেনার দলকে। জার্মানির সেরা ফুটবল দল ফ্লেকাফের বিরুদ্ধে খেলায় মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়েও ‘হাইল হিটলার’ বলেননি কেউ। শেষপর্যন্ত ৫-৩ গোলে জিতে যান তাঁরা। নাজিরা হেরে যাওয়ার আরও একটা সুযোগ দিয়েছিল কিয়েভ স্টার্টের ফুটবলারদের, কিন্তু সেই খেলাতেও রুখ দলকে হারিয়ে দেন তাঁরা। সবাইকে কনসেন্ট্রেশন শিবিরে পাঠিয়েছিল ক্ষিপ্ত গেস্টাপোবাহিনি এবং ত্রুসেভিচ, ক্লিমেঙ্কো আর কুযমেঙ্কোকে গুলি করে হত্যা করেছিল। কিন্তু, ধুলোকাদারক্ত মেখে প্রতিরোধের নতুন বয়ান তৈরি হয়েছিল। ববি ফিশার ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েতের দাবা-দর্প চূর্ণ করেছিলেন একাই, হয়ে উঠেছিলেন সত্তর-দশকের আমেরিকার নায়ক ও মেধা-আইকন। কিন্তু, সেই আইকনত্বের দায়ভার ঝেড়ে ফেলে ইরাকযুদ্ধের জন্যে দুষেছিলেন নিজের দেশ আমেরিকাকেই। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে রাজনৈতিক সাদা-কালোর তফাৎ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আর, তিনি যে রাষ্ট্রের বদান্যতায় নয় বরং স্বীয় দক্ষতাতেই বিশ্বশ্রেষ্ঠ, তা রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বিবৃতি দিয়ে। রাষ্ট্রতোষী না হয়ে অন্যায়কে প্রত্যাখ্যানের সাহস যাঁরা দেখিয়েছিলেন, তাঁদের ইতিহাসটাও মনে রাখা জরুরি।

প্রায় দশ মাস ধরে চলমান কৃষক আন্দোলন ক্রমেই বিদ্রোহের চেহারা নিয়েছে এবং রাষ্ট্র ব্যর্থ হচ্ছে তার সমাধানে। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্তে দেশবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। ইস্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় দেশের শিক্ষা-পরিসর ক্রমেই উচ্চ বা অতি-উচ্চ শ্রেণির ক্রয়যোগ্য হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তা রাষ্ট্রের কাছে বেশ লজ্জারই বিষয়। আইকনেরাও একথা বুঝলে পারেন যে, বিপন্ন মুহূর্তে দেশের ধারক শক্তির পাশে দাঁড়ালেই জাতীয় সঙ্ঘবদ্ধতা বাড়ে। অরিন্দমের মতো নিরপেক্ষতার ভানটুকু করার অবকাশ ফুরিয়ে এসেছে। রাষ্ট্রের কঠোর নির্দেশে হয় রাষ্ট্রের বিজ্ঞাপন ও হ্যাশট্যাগ পুনরুৎপাদন করে যেতে হবে, নয়তো সেই সাজানো বয়ানকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আইকন-মুখোশ সরিয়ে তাঁদের দায়িত্ব কৃষক-শ্রমিক তথা দেশের পক্ষে দাঁড়ানোর। আর, জনগণও অপেক্ষায় থাকুক, দেশরক্ষার এই দ্রোহ থেকেই নতুন ভারতের কোনও আইকন নিশ্চিত উঠে আসবে।

সাহিত্য গবেষক, দাবা প্রশিক্ষক