স্বাধীনতা-উত্তর কালের বাংলা গান: বিবর্তনের ধারা ও পরম্পরা — ২

স্বাধীনতা-উত্তর কালের বাংলা গান: বিবর্তনের ধারা ও পরম্পরা [২] -- অনর্ঘ মুখোপাধ্যায়

অনর্ঘ মুখোপাধ্যায়

 



ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে মগ্ন, কথা ও সুরে সঙ্গীতস্রষ্টা, একটি বাংলা ব্যান্ডের ভোকালিস্ট, গীতিকার, সুরকার ও পিয়ানিস্ট

 

 

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

[সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় ও টেকনিকাল বিষয়ে যেহেতু সকলে সমানভাবে অবগত নন, অবগত থাকার কথাও নয়, তাই সকল পাঠকের সুবিধার্থে এই পর্বে নিজে পিয়ানো বাজিয়ে এবং গেয়ে কয়েকটা অডিও ক্লিপের মাধ্যমে বিভিন্ন সঙ্গীতকারদের গানগুলোকে বিশ্লেষণ করেছি। আগ্রহী পাঠক সেই অডিও ক্লিপগুলি শুনে নিতে পারেন।]

 

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত বা দ্বিজেন্দ্রলাল যখন বহির্বিশ্বের সঙ্গীতের সঙ্গে দেশজ সঙ্গীতের মেলবন্ধনে একের পর এক সুর সৃষ্টি করছেন, তাঁদের সমকালীন কণ্ঠশিল্পীদের অনেকেই এই গানগুলোর কথা এবং সুর আয়ত্ত করে ফেললেও তখনও গায়কীকে আয়ত্ত করতে পারেননি। তাঁদের গায়কীতে তখনও নতুন গায়নশৈলী প্রবেশ করেনি, (বলা ভালো, তৎকালীন শিল্পীদের গায়কীতে আধুনিকতার প্রবেশ ঘটেনি)। নিদর্শন হিসেবে উৎসুক পাঠক-পাঠিকারা দ্বিজেন্দ্রনাথ বাগচী বা বেদানা দাসীর রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডগুলো শুনে দেখতে পারেন (তখন অবশ্য ‘রবিবাবুর গান’ হিসাবে লেবেল করা হত)। এমনকী, কমলা ঝরিয়া বা যুথিকা রায়ের গায়কীতেও এই সাবেক  শৈলী পরিলক্ষিত হয়।

বৈপ্লবিক পরিবর্তন যাঁদের হাত ধরে এল, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সঙ্গীতকার ছিলেন শচীনদেব বর্মণ, হিমাংশু দত্ত, দুর্গা সেন, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, কমল দাশগুপ্ত, দিলীপকুমার রায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী বা অনুপম ঘটক। পরে, এঁদের দেখানো পথ ধরেই এসেছেন অলোকনাথ দে, রবীন চট্টোপাধ্যায়, রাহুলদেব বর্মণ, নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভি বালসারা, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত, ভূপেন হাজারিকা, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দের মতো দিকপাল সঙ্গীতশিল্পী এবং কম্পোজ়াররা। আমাদের এই একুশ শতকে বিগত দুই দশকের অধিকাংশ গায়ক এবং গীতিকারের গানের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য খুঁজে পাওয়া বড়োই দুষ্কর ঠিকই, কিন্তু এমন দুরবস্থা আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগে ঘটেনি— প্রত্যেক ভোকালিস্ট, প্রত্যেক কম্পোজ়ার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হতেন এবং আমৃত্যু সেই শৈলীকে ধারণ করে রাখতেন তাঁরা। শচীনদেব বর্মণ বা হেমাঙ্গ বিশ্বাস আজীবন তাঁদের সঙ্গীতে বাংলার গণমানুষের পল্লীগীতি আর রাগসঙ্গীতের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সঙ্গীতের যতটুকু সমান্তরালভাবে চলে, ঠিক ততটুকু উপাদান ব্যবহার করেছেন। আবার সলিল চৌধুরীর অনেক গানে দেখা যায় হার্মোনি, ট্রানসপোজিশন আর কাউন্টারপয়েন্টের প্রাচুর্য। রাহুলদেব বর্মণ উপমহাদেশের সঙ্গীতের সঙ্গে ব্যাপকভাবে Soul, Psychedelic Rock এবং Acid Rock-এর ধারাকে মিশিয়ে দিয়েছেন। নচিকেতা ঘোষ আবার অনেক ক্ষেত্রেই ছুটেছেন রিলেটিভ মেজর/রিলেটিভ মাইনর স্কেলের পারম্পর্য অনুসরণ করে অথবা Jazz-এর atonal scale-এর প্রয়োগ করে একটা রাগের সঙ্গে অন্য রাগকে সংযুক্ত করতে করতে। আবার, দুর্গা সেন, দক্ষিণামোহন ঠাকুর, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, কমল দাশগুপ্ত, হিমাংশু দত্ত, সুধীরলাল চক্রবর্তী, অনুপম ঘটক বা রবীন চট্টোপাধ্যায় ভারতীয়, ইউরোপীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মেলবন্ধনে একেকটা কালজয়ী কম্পোজিশন সঁপে দিয়ে গেছেন বাংলার আধুনিক সঙ্গীতের ভাণ্ডারে। আর বহুক্ষেত্রেই তাঁরা তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ পদ্ধতিকে নিজেরাই বিনির্মাণ করে সৃষ্টি করেছেন নতুন কোনও গান, বিশেষত, চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে। আমি সঙ্গীতশিল্পের স্বল্পবিদ্যায় যতটুকু শনাক্ত করতে পেরেছি তার ভিত্তিতেই তৎকালীন সঙ্গীতকারদের গান নিয়ে কিছুটা আলোচনা রাখতে চেষ্টা করব‌।

মাইক্রোফোন এবং ভিনাইল ডিস্কে রেকর্ডিং পদ্ধতির প্রচলনের পর থেকে দুই পর্বে বিভক্ত করে নিচ্ছি আধুনিক বাংলা গানের সময়কালকে। প্রথম পর্বে বিচার করব গত শতকের ৩০-এর দশক থেকে ৫০-এর দশক পর্যন্ত সময়কালকে, আর দ্বিতীয় পর্যায়ে রাখব ৫০-এর দশক থেকে ৭০-এর দশক। প্রথম পর্বের উল্লেখযোগ্য যুগান্তকারী কম্পোজারদের মধ্যে শচীনদেব বর্মণ, হিমাংশু দত্ত, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, কমল দাশগুপ্ত, দিলীপকুমার রায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী বা অনুপম ঘটক (যদিও শচীনদেব বর্মণ ‘৭০-এর দশক অবধি স্বমহিমায় রাজত্ব করে গেছেন)।

আমি যাঁদের রেকর্ড শুনে শুনে বেড়ে উঠেছি, তাঁদের মধ্যে একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি হলেন শচীনদেব বর্মণ। এই মুহূর্তে উনি ঠুংরির আদলে গাইছেন “আমি ছিনু একা“, তো পরক্ষণেই পাশ্চাত্য শৈলীতে “ঘুম ভুলেছি নিঝুম নিশীথে” গাইছেন, অথবা বিশুদ্ধ পল্লীগীতির সুরে শোনাচ্ছেন, “তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে“, কিংবা খেয়ালের শৈলীতে উস্তাদ ফৈয়াজ খানের বন্দিশ অনুবাদ করে গাইছেন, “ঝনঝন ঝনঝন মঞ্জিরা বাজে“। এক কথায় বলতে গেলে, শচীনকর্তা তাঁর সঙ্গীতের মধ্যে বহুত্বকে ধারণ করেছেন। “আঁখি দুটি ঝরে হায়” গানটায়  অবলীলায় মিশে যাচ্ছে স্পেনীয় জিপসিদের তৈরি করা মেজর ফ্রিজিয়ান স্কেল (Major Phrygian Scale), রাগ বসন্ত মুখারি আর রাগ পিলু। আবার, “শুনি টাকডুম টাকডুম বাজে, বাজে ভাঙা ঢোল” বা “আমি টাকডুম টাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল” গানদুটো কীর্তনের আঙ্গিককে ধারণ করে এগিয়ে চলেছে। নজরুলগীতি পরিবেশন করার সঠিক গায়নশৈলীকে যাঁরা নির্মাণ করেছেন, শচীনদেব তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, শচীনদেব বর্মণ যখন বম্বেতে চলচ্চিত্রের জন্য গান তৈরি করছেন, তখন অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর সৃষ্টি করা অনেক বাংলা গানের সুর সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে ব্যবহার করেছেন। যেমন, “বধূ গো, এই মধুমাস বুঝি গো বিফল হল” গানটার সঞ্চারীর সুরটাকে ব্যবহার করেছেন “চুপ হ্যায় ধরতি, চুপ হ্যায় চাঁদ সিতারে” গানে; কিংবা, “ওয়াঁহা কৌন হ্যায় তেরা মুসাফির” গানটায় “দূর কোন পরবাসে তুমি চলে যাইবা রে” গানটার আংশিক ছোঁয়া রয়েছে। আবার, “কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া”-র সুরেই “সুন রে পবন, পবন পূর্বাইয়া” তৈরি করেছেন। শচীনদেব তাঁর অনেক গানেই পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সুর ব্যবহার করেছেন ঠিকই, তবে খুবই কঠোর পরিমাপ করেছেন সেই বিষয়ে।

শচীন দেব বর্মণ

 

যদিও কৃষ্ণচন্দ্র দে, উস্তাদ বাদল খাঁ এবং ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তিনি সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা পেয়েছেন, তবুও তাঁর ভিতরে সঙ্গীতের বুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছে শৈশবে তাঁদের বাড়ির মাধব এবং আনোয়ার নামক দুই পরিচারকের দ্বারা। তারপরেই তিনি আগরতলার জনৈক পল্লীগায়ক এবং ফকির সাহেব আলীর সান্নিধ্য লাভ করেন। তাঁর আত্মজীবনী “সরগমের নিখাদ” থেকে ধার করে বলা যেতে পারে:

… জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাটির টান অনুভব করে মাটির কোলে থাকতেই ভালোবাসতাম। আর বড় আপন লাগত সেই সহজ সরল মাটির মানুষগুলোকে যাদের গুরুজনেরা বলতেন ‘সাধারণ’ লোক। … পূর্ববঙ্গের এই অঞ্চলের এমন কোনও গ্রাম নেই বা এমন কোনও নদী নেই, যেখানে আমি না ঘুরেছি। ছুটি ও পড়াশোনার ফাঁকে আমি গান সংগ্রহ করতাম। আমার এখনকার যা কিছু সংগ্রহ যা কিছু পুঁজি সে সবই এই সময়কার সংগ্রহেরই সম্পদ। আজ আমি শুধু ওই একটি সম্পদেই সমৃদ্ধ, সে সম্পদের আস্বাদন করে আমার মনপ্রাণ আজও ভরে ওঠে। যে সম্পদের জোরে আমি সুরের সেবা করে চলেছি, তার আদি হল আমার ওইসব দিনের সংগ্রহ ও স্মৃতি।

এতদসত্ত্বেও একটাই খেদ থেকে যায়। সম্ভবত, গণনাট্য সংঘের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণেই বাংলার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নিয়ন্তারা শচীনকর্তাকে ১৯৪০ সালের পর থেকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। ফলে, ১৯৪৪ সালে তাঁকে আজীবনের জন্য বম্বেতেই চলে যেতে হল।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা ভাবলেই যে সমস্ত কালজয়ী শিল্পীদের কথা স্মরণে আসে, তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রধান হলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। একদিকে তিনি যেমন রবীন্দ্রনাথের গানের গায়কীতে প্রকৃতভাবে আধুনিকতার স্ফূরণ ঘটিয়েছিলেন, তার পাশাপাশি আধুনিক গানের গায়কী এবং যন্ত্রানুষঙ্গের একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা তিনি তৈরি করেছিলেন। রেকর্ডিস্ট ও সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার মুকুল বসু আর রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গে যৌথভাবে ভারতীয় সিনেমাতে প্লেব্যাকের পদ্ধতি প্রয়োগ করার কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার তিনি। রামোন নোভারো এবং বিং ক্রসবির গায়নশৈলী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা গানের গায়কীতে পঙ্কজ কুমার মল্লিক ক্রুনিং (Crooning)-এর প্রচলন ঘটালেন, (এমনকী, সেই পদ্ধতি ব্যবহার করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার ক্ষেত্রেও)। ‘ডাক্তার’ সিনেমায় “চৈত্রদিনের ঝরাপাতার পথে” গানে ক্রুনিংয়ের অভিনব প্রয়োগ করেছেন তিনি। “গানখানি মোরা রেখে যাব” গানটার প্রিলিউডের যন্ত্রসঙ্গীত পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আদলে একটা ছ মাত্রার আল্লেগ্রো (Allegro) মুভমেন্টের পরিবেশ সৃষ্টি করে। আবার সেই একই পঙ্কজ কুমার মল্লিক যখন ‘রাইকমল’ সিনেমার জন্য সুর করেছেন এবং সোলো/ডুয়েট/কোরাসে প্লেব্যাক করছেন, তখন তিনি যেন একজন দক্ষ কীর্তনীয়া কিংবা বাউল হয়ে উঠছেন। এই চলচ্চিত্রের গানগুলিতে পঙ্কজবাবুর গলার সেই বিখ্যাত ক্রুনিং প্রায় নেই বললেই চলে। আকাশবাণীতে পঙ্কজ কুমার মল্লিক তাঁর কালজয়ী ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে কর্ড তো বটেই, রীতিমতো হার্মোনি আর কাউন্টারপয়েন্ট ব্যবহার করেছেন— চেলো, ভায়োলা আর কন্ট্রাবাস সহযোগে চেম্বার স্ট্রিং অর্কেস্ট্রা পুরো আলেখ্যটাকে বহন করে নিয়ে গেছে, রয়েছে পিয়ানো, অর্গ্যান আর ভাইব্রোফোনের প্রয়োগ। ওই আলেখ্যতেই পঙ্কজবাবুর নিজের গাওয়া “জয়ন্তী মঙ্গলা কালী” গানের মধ্যে আমরা দেখতে পাই মধ্যপ্রাচ্যের সুরে মিশে গেছে আহির ভৈরব রাগ আর সাঁওতালি লোকগীতির সুর; আর গানটা‌ এগিয়ে চলেছে আজানের আঙ্গিক আঁকড়ে ধরে। মহাপ্রস্থানের পথে’ সিনেমায় ব্যবহৃত সংস্কৃত শিবস্তোত্র “হে চন্দ্রচূড়ঃ”-তে সুর দেওয়ার সময়ে আশাবরী ঠাটের বিভিন্ন রাগ প্রয়োগ করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গেই উনি প্রাচীন গ্রিক সঙ্গীতের Aeolian Mode-কে ব্যবহার করেছেন। কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কুন্দনলাল সায়গলকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ানোর সিদ্ধান্তও ছিল তাঁর একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তারপরেই সায়গল একটু একটু করে আধুনিক বাংলা গানেও কৃতিত্বের ছাপ রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ যে যে রচনায় সুরারোপ করার কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেননি, সেগুলোতে সুর দেওয়ার গুরুভার তিনি পঙ্কজ কুমার মল্লিকের হাতেই আগাম অর্পণ করে গেছিলেন। প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘মুক্তি’ সিনেমাতে পঙ্কজবাবু ব্যবহার করেছিলেন তাঁর নিজের সুর দেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থের “শেষ খেয়া” কবিতা।

পঙ্কজ কুমার মল্লিক

 

১৯২৯ সাল থেকেই আকাশবাণী-র ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলার ঘরে ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীত সহ উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রকারের গান পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১৯৭৬ সালে দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তরফ থেকে আকাশবাণীর কলকাতার কার্যালয়ে নির্দেশ জারি করে আচমকা বন্ধ করে দেওয়া হল সেই অনুষ্ঠান এবং, সবচেয়ে বড় কথা, তার সঙ্গেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-কে উত্তম কুমার পরিচালিত একটি অনুষ্ঠান দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়। যদিও জনমতের চাপে পড়ে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র সম্প্রচার আবার বহাল রাখা হল, কিন্তু পঙ্কজ মল্লিকের ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’ আর ফিরিয়ে আনা হল না রেডিওতে।

পঙ্কজ মল্লিকের সমসাময়িক আরেকজন অন্যতম কিংবদন্তি সঙ্গীতকার হলেন রাইচাঁদ বড়াল। একথা আগেই বলেছি যে তাঁর পিতা লালচাঁদ বড়াল ছিলেন একজন সুগায়ক। ফলে, রাইবাবুও বেড়ে উঠেছেন সাঙ্গীতিক আবহাওয়ার মধ্যে। রাইচাঁদ বড়াল নিজে একজন দক্ষ তবলাবাদক এবং পিয়ানিস্ট ছিলেন। বাংলা নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে তিনি পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গেই সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। সঙ্গীত পরিচালক এবং সুরকার হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন আকাশবাণীতে। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে বাংলার তথা ভারতীয় সঙ্গীতের সামঞ্জস্যপূর্ণ মেলবন্ধনে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য গান। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, তাঁর সুরে কানন দেবীর গাওয়া “সে নিল বিদায়” গানটার কথা। গানের প্রিলিউডে বেহালা চলেছে ইউরোপীয় সঙ্গীতের পথে— প্রথমে জি শার্প মাইনর (G♯ minor) স্কেলে শুরু হয়ে এসে থামল জি শার্প মেজর (G♯ Major) স্কেলে। তারপরে প্রবেশ করেছে কানন দেবীর কণ্ঠস্বর। গানের দ্বিতীয় স্তবক পর্যন্ত পুরোটাই পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আদলে গড়া। তারপর রয়েছে কীর্তনাঙ্গে সৃষ্ট তৃতীয় তথা শেষ স্তবক। এই দুই ভিন্ন রীতির সঙ্গীতের সঙ্গে সংযোগস্থাপন করার উদ্দেশ্যে রাইবাবু সেতারে ফুটিয়ে তুললেন জোড়-ঝালা আর তার সঙ্গে পালা করে করে একবার স্ট্রিং অর্কেস্ট্রা, আর একবার পিয়ানোতে স্ট্যাকাটো (Staccato)-র মতো কর্ডের অবরোহন।

একথা আগেই বলেছি যে ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ সিনেমাতে মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। মূলত মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্লেব্যাক করেছেন চৈতন্যরূপী অসীম কুমারের লিপে। “জগন্নাথ জগৎবন্ধু” গানটার কথা তো আগের পর্বেই বলেছি, এরপর ওই সিনেমার “সেই সে পরাণনাথ” গানটার কথাও বলতে চাই। দৃশ্যটার শুটিং হয়েছিল জগন্নাথ মন্দিরের গর্ভগৃহে। তাই, আবছা টেনর স্যাক্সোফোন, স্ট্রিং অর্কেস্ট্রা আর ফ্লুট অর্কেস্ট্রার পাশে এই গানে অর্গ্যানের প্রয়োগ যেন ক্রিসমাসের রাতে চার্চের ইউক্যারিস্ট (eucharist)-এ ক্যারোল গানের আমেজ বয়ে নিয়ে এসেছে। ওই সিনেমাতেই অসীম কুমারের লিপে যখন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে দিয়ে গাওয়াচ্ছেন “কঁহা মোর প্রাণনাথ”, তখন ভোকালিস্টের গলায় কীর্তনাঙ্গের আকুতির সঙ্গে যন্ত্রানুষঙ্গের মাধ্যমে ইউরোপীয় অপেরার ট্র্যাজেডির আবহ তৈরি হচ্ছে।

এই একই রাইচাঁদ বড়াল যখন সায়গলকে দিয়ে “প্রেম নহে মোর মৃদু ফুলহার” গানটা গাওয়াচ্ছেন, তখন সেখানে কিন্তু শুধুই কীর্তন রয়েছে, এবং যন্ত্রসঙ্গীতেও কোথাও ইউরোপীয় পলিফোনি (polyphony)-র ছিটেফোঁটাও নেই। আবার সায়গল যখন রাইবাবুর সুরে “এ গান তোমার শেষ করে দাও” গাইছেন, তখন প্রিলিউডে ব্লুজ় (Blues)-এর মাইনর পেন্টাটোনিক (minor pentatonic) স্কেলের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।

‘স্বামীজি’ সিনেমাতে রাইচাঁদের সুরে “মন চলো নিজ নিকেতনে” গেয়েছেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। গানটার ছন্দ এবং তাল কীর্তনের পথে অগ্রসর হলেও স্বরবিন্যাস কিন্তু পুরোপুরি কীর্তনকে অনুসরণ করছে না, বরং কীর্তনের নির্যাসটুকু গ্রহণ করেই স্বতন্ত্রভাবে এগিয়েছে।

‘অঞ্জনগড়’ সিনেমাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত “সর্ব খর্বতারে দহে” হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর উৎপলা সেন ডুয়েট গেয়েছেন। সেখানে রাইচাঁদ বড়াল সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে যখন গানটার অর্কেস্ট্রেশন করছেন, তখন প্রিলিউডে একটা আল্লেগ্রো (Allegro) মুভমেন্ট ব্যবহার করছেন।‘নতুন ফসল’ সিনেমাতে নির্মলেন্দু চৌধুরী আর প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে ডুয়েটে “সাধ করে পুষিলাম ময়না” গাওয়ানোর সময়ে রাইবাবু বিশুদ্ধ ভাটিয়ালি সুর ব্যবহার করেছেন। আবার, ঐ সিনেমাতেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য কীর্তনাঙ্গে কম্পোজ় করেছেন “বন্ধু, তুমি যে আমার প্রাণ” গানটা।

রাইচাঁদ বড়াল

 

এক কথায় বলতে গেলে, রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গীত ছিল তাঁর সঙ্গীত-বিষয়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল এবং বহুত্বের ধারক-বাহক: দেশীয় সুরের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সুর কোথায়, কীভাবে এবং কতটুকু মিশবে, না কি মিশবেই না— তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করে সৃষ্টি করে গেছেন প্রতিটি গান।

 

[ক্রমশ]

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...