স্বাধীনতা-উত্তর কালের বাংলা গান: বিবর্তনের ধারা ও পরম্পরা — ৩

স্বাধীনতা-উত্তর কালের বাংলা গান: বিবর্তনের ধারা ও পরম্পরা [৩] -- অনর্ঘ মুখোপাধ্যায়

অনর্ঘ মুখোপাধ্যায়

 


লেখক ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে মগ্ন, কথা ও সুরে সঙ্গীতস্রষ্টা, একটি বাংলা ব্যান্ডের ভোকালিস্ট, গীতিকার, সুরকার ও পিয়ানিস্ট। সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় ও টেকনিকাল বিষয়ে যেহেতু সকলে সমানভাবে অবগত নন, অবগত থাকার কথাও নয়, তাই সকল পাঠকের সুবিধার্থে গত পর্বের মতো এই পর্বে আবারও লেখক নিজে পিয়ানো বাজিয়ে এবং গেয়ে কয়েকটি অডিও ক্লিপের মাধ্যমে বিভিন্ন সঙ্গীতকারদের গানগুলিকে বিশ্লেষণ করেছেন। আগ্রহী পাঠক সেই অডিও ক্লিপগুলি শুনে নিতে পারেন।

 

শচীনদেব বর্মণ, পঙ্কজ মল্লিক আর রাইচাঁদ বড়ালের পাশাপাশি যাঁর নাম মনে আসে, তিনি হলেন হিমাংশু দত্ত। হিমাংশু দত্তর সঙ্গীতের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কবীর সুমন উল্লেখ করেছেন যে সলিল চৌধুরীর মতে হিমাংশু দত্তই হলেন আধুনিক বাংলা সঙ্গীতের পথিকৃৎ। হিমাংশু দত্তর গানের গঠনতন্ত্রকে বিশ্লেষণ করে দেখলে আমরা বুঝতে পারব সলিলবাবুর এই সিদ্ধান্তের যাথার্থ্য।

চাঁদ কহে চামেলী গো” গানটার কথাই যদি ধরি, তবে দেখতে পাব, এই গানে কীভাবে বিলাবল, খাম্বাজ এবং বেহাগ মিশে গেছে পাশ্চাত্য সঙ্গীতে। আবার, “তোমারই বিরহে জানি গো জানি” গানটার Refrain (অর্থাৎ, “জানি ঝরা চামেলীরে” পংক্তিটি) বিচার করলে দেখা যাবে যে কীভাবে হিমাংশু দত্ত গায়ককে তালের আনুগত্য থেকে স্বাধীনতা দিয়ে সেখানে ছন্দের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। “তোমারি পথপানে চাহি” গানটা আদ্যন্ত পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আদলে রচিত— নির্ভেজাল মেজর স্কেলে শুরু হয়ে মেজর স্কেলেই শেষ হয়েছে। আবার ভারতীয় রাগসঙ্গীতের রাগ যোগকে ঈষৎ পরিবর্তন করে, ব্লুজ়্ স্কেলের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে (অর্থাৎ, দুই গান্ধার এবং দুই নিষাদ স্বর ব্যবহার করে) সৃষ্টি করেছেন ‘রাগ পুষ্পচন্দ্রিকা’ শুধুমাত্র “ছিল চাঁদ মেঘের ওপারে” গানে সুর দেওয়ার সময়ে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই গানগুলোর প্রত্যেকটিতেই সঞ্চারীগুলি যথেষ্ট বিস্তৃতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যা রবীন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্র-পরবর্তী সঙ্গীতকারদের গানের শৈলী থেকে খানিকটা স্বতন্ত্র। “আলোক আঁধার যেথা করে খেলা” গানটি দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের হার্মোনিক মাইনর (Harmonic minor) স্কেলে, তার সঙ্গে রয়েছে আশাবরী এবং ভৈরবী ঠাটের সংমিশ্রণ। এছাড়াও প্রথম স্তবকের শুরুতেই বিঠোফেনের “প্যাথেটিক সোনাটা” (Pathetique Sonata)-র প্রথম মুভমেন্টের সুরের reception বা পরিগ্রহণ ঘটেছে। হিমাংশু দত্তর গানে আমরা দেশীয় তাল ব্যবহার করতেই পারি, কিন্তু তাতে গানগুলির মধ্যে অনেকটা সাঙ্গীতিক শূন্যস্থান থেকে যাবে। ধরা যাক, “রাতের দেউলে জাগে বিরহী তারা” গানে যদি কেবলমাত্র দাদরা বা দ্রুত একতাল প্রয়োগ করি, তাহলে গানটা কিন্তু পূর্ণতা পাবে না। তাই দেশীয় ৬ মাত্রা বা ১২ মাত্রার তালের সঙ্গে ইওরোপীয় সঙ্গীতের ওয়ালৎস্ (Waltz)-এর ছন্দ প্রয়োগ করতে হবে। তবেই গানটা সম্পূর্ণ হবে। ওই একই পদ্ধতিতে জয়জয়ন্তী রাগের সঙ্গে ওয়ালৎস্-এর ছন্দের সংমিশ্রণে হিমাংশু দত্ত সৃষ্টি করেছেন “রাতের ময়ূর ছড়াল পাখা”। খেয়ালের আঙ্গিক ভেঙে হিমাংশু দত্ত সৃষ্টি করেছেন, “নতুন ফাগুনে যবে”। সেখানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন অলঙ্করণ পদ্ধতি থাকলেও সেগুলো কিন্তু চিরাচরিত রীতি থেকে অনেকটাই অধিশীলিত এবং সূক্ষ্মতাপূর্ণ। “ঝরো ঝরো ধারা, বিরহ বরিষা” গানে রাগসঙ্গীত আরও বেশি করে অধিশীলিত হয়ে উঠেছে। আবার, “বিরহিনী, চির বিরহিনী” গানটাকে পরিমিত কিন্তু বলিষ্ঠ অলঙ্কারে হিমাংশু দত্ত সাজিয়ে তুলেছেন “রাগ রাগেশ্রী”-তে খেয়ালের আঙ্গিকে। কবীর সুমন যথার্থভাবেই বলেছেন যে গানের চলনের মধ্যে নতুন ধরনের “ইডিয়ম (Idiom)” ব্যবহার করেছেন হিমাংশু দত্ত। সম্ভবত হিমাংশু দত্তর সঙ্গীতের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন বলেই সলিল চৌধুরী তাঁকে আধুনিক বাংলা সঙ্গীতের পথিকৃৎ বলে মনে করতেন।

 

এরপর আসব সুধীরলাল চক্রবর্তীর প্রসঙ্গে। সুধীরলালের গানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং তার বিভিন্ন উপশাখার প্রভাব যথেষ্ট প্রকট এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রভাব ছিল না বললেই চলে। সর্বপ্রথম গজলের শৈলীকে আধুনিক বাংলা গানের সঙ্গে মিশিয়েছিলেন নজরুল। তাঁর পথ ধরেই এসেছিলেন সুধীরলাল। নজরুলের গজল-অনুসারী গানে ছিল তালের প্রতি বাধ্যতামূলক আনুগত্য। কিন্তু সুধীরলালের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা নেই। তাঁর গানে তাল আর সুর সমান্তরালভাবে চলছে; কেউই অপরের আনুগত্য স্বীকার করছে না। উদাহরণস্বরূপ “কেন ডাকো পিয়া পিয়া” গানটার কথা বলা যেতে পারে। আবার কাওয়ালির আঙ্গিকে যখন তিনি “আঁখি তার ভোলে যদি” তৈরি করছেন, তখন কিন্তু তাঁর গানের বাণী এবং সুর গানের তালকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে।

 

ও তোর জীবনবীণা আপনি বাজে” গানটা “রাগ শ্যাম কল্যাণ”-এর স্বরগুলোর ওপর গড়ে উঠলেও, গানের চলনে কিন্তু ফুটে উঠেছে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আঙ্গিক, আর তাল দাদরা হলেও ছন্দগতভাবে এই গানটা একটা ওয়ালৎস্। আবার ঐ ওয়ালৎস্-এর আঙ্গিক ব্যবহার করেই সুধীরলাল সৃষ্টি করেছেন “এ জীবনে মোর যত কিছু ব্যথা” এবং “মধুর আমার মায়ের হাসি”। “খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায়” গানে ব্যবহৃত হয়েছে ব্লুজ়্ স্কেল এবং গানটার সঞ্চারীতে খুব সূক্ষ্মভাবে ক্ষণিকের জন্য হলেও সুধীরলাল প্রয়োগ করেছেন “রাগ দরবারি কানাড়া”।

তাঁর গানের প্রসঙ্গে কবীর সুমন বলেছেন:

বাংলার বৈঠকি গানে কালোয়াতি, মায় এক ধরনের তাল-ঠোকা কালোয়াতির প্রাধান্য ছিল দীর্ঘকাল। সুযোগ পেলেই গলাটা খেলিয়ে দেওয়া, বড় গলায় দু-একটা তান মেরে দেওয়ার এক অনাধুনিক প্রবণতা সেখানে আগেও ছিল, এখনও আছে। অনাধুনিক, কারণ গলার ওই গিটকিরি ও কাজ কম্পোজিশনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়, আরোপিত।… সুধীরলালের সুর সূক্ষ্ম কারুকাজে মোড়া। সেই সূক্ষ্মতা কম্পোজিশনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানেই তাঁর সুরচিন্তা ও কম্পোজিশনের নিজস্বতা। সুরকার সুধীরলালের সুররচনার এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কণ্ঠশিল্পী সুধীরলালের চোস্ত গায়কির সম্পর্ক নিবিড়।

 

আধুনিক বাংলা গানের আরেকজন সুরকার তথা গীতিকার তথা গায়কের প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা আবশ্যক। তাঁর নাম দিলীপকুমার রায়। পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রভাবে জীবনের শুরু থেকেই সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। ব্রিটেন, ইটালি এবং জার্মানিতে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় এবং ক্রিয়াত্মক পাঠ নিয়ে দেশে ফিরে এসে ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ সাহেব, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে এবং অচ্ছনবাঈয়ের কাছে ভারতীয় সঙ্গীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন।

ইওরোপে থাকাকালীন তিনি রোমাঁ রোলাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন। রোলাঁ দিলীপকুমার রায়ের সম্পর্কে লিখেছেন:

He sings with nasal intonations and his voice reaches quite high, with a singular suppleness in the ceaseless blossoming of vocal improvisations and ornaments…

দিলীপকুমার রায় তাঁর সঙ্গীতে আজীবন ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারার সঙ্গে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় সাধন করার বিষয়ে পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। “আমি চেয়েছি, আমি নিয়েছি শরণ তোমারি” গানটার কথাই ধরা যাক। সেখানে দেখা যাচ্ছে যে একদিকে ইমন কল্যাণ, শ্যাম কল্যাণ, বেহাগ, ইমন মিশে রয়েছে, আর অপর দিকে তবলাকে অনুসরণ করে গিটারে ছন্দে ছন্দে বাজছে কর্ড, সঙ্গে রয়েছে কন্ট্রবাস। আবার, “যদি দিয়েছ বঁধূয়া” গানে প্রায় ঐ একই সুর এবং যন্ত্রানুষঙ্গ রেখে সঞ্চারীতে যোগ করলেন গজ়লের অন্যতম উপাদান তাল-ফেরতা: একবার ছয় মাত্রায়, আরেকবার সাত মাত্রায় সঞ্চারীর স্তবকটা গেয়ে আবার ফিরে এলেন আট মাত্রার তালে। তাঁর কালজয়ী গান “সেই বৃন্দাবনের লীলা অবিরাম সবই” গড়ে উঠেছে কীর্তনের আঙ্গিককে ধারণ করে, বিশেষত “ওরা জানে না, তাই মানে না”— এই পংক্তিতে কীর্তনের অন্যতম উপাদান “আখর”-এর প্রয়োগ করেছেন দিলীপকুমার রায়। “তোমারই ভালোবাসা তরে আশা” গানে কীর্তনের আঙ্গিকে মিশে গেছে রাগ বারোয়া, রাগ বিলাবল, রাগ খাম্বাজ, রাগ ললিত, রাগ ভৈরব, রাগ কিরওয়ানি এবং রাগ কালেংড়া। “চাঁদের আলো উচ্ছলে” নামক আরেকটা গানে তিনি ব্যবহার করেছেন প্রায়-বিস্মৃতপ্রায় রাগ সরপর্দা বিলাবল। রামপ্রসাদী সুরের সঙ্গে কীর্তনের গায়নশৈলী এবং ভারতীয় রাগসঙ্গীতের বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে সৃষ্টি করলেন “জ্বলবার মন্ত্র দিলে মোরে” গানটা। তাঁর প্রায় সব গান ভক্তিমূলক হলেও, সঙ্গীতে সুরারোপ করার ক্ষেত্রে তিনি যে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, সেই কাজগুলো বাংলার সঙ্গীতের বহু Genre-এর গানে সুর সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসাবে পরিগণিত হওয়ার দাবী রাখে।

 

[ক্রমশ]

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...