নভেম্বর বিপ্লব: উৎস, দ্বন্দ্ব ও প্রাসঙ্গিকতা

নভেম্বর বিপ্লব: উৎস, দ্বন্দ্ব ও প্রাসঙ্গিকতা -- অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত

অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত

 



অর্থনীতির শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যকর্মী; গৌড়বার্তা পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত

 

 

 

 

রাজপথ কাঁপে বারবার বিদ্রোহে
পাহাড় ছুঁয়েছে গর্বিত যত শির
অন্যগন্ধ ছড়িয়ে আমরা ধোব
বজ্রমেঘেই সব ধূলো পৃথিবীর…

–মায়কোভস্কি

আজ থেকে মোটামুটি শ দেড়েক বছর আগে মার্কস বলেছিলেন, “দার্শনিকরা বিভিন্নভাবে পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন, আসল কথা হল কীভাবে তাকে বদল করা যায়।” আর একটা বিপ্লব দেখিয়েছিল কীভাবে একটি আধা-পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বদলে ফেলে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা যায়… দেখিয়েছিল কীভাবে শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে বলা যায় ‘এই পৃথিবীটা তোমার নয়, আমার নয়… আমাদের।’ কেউ মালিক নয়, সবার সমান অধিকার… শ্রমিক, কৃষক, নারী, শিশু কিংবা বর্ষীয়ান নাগরিক সবার, যা এতদিন পুঁজিবাদী সমাজে অসম্ভব ছিল।

১৯১৭-র ৭ নভেম্বর (পুরোন ক্যালেন্ডারে ২৫ অক্টোবর) থেকে ১৭ নভেম্বর— এই এগারো দিনে রুশদেশের একদল মানুষ, যারা বলশেভিক নামে পরিচিত, পালটে দিলেন দেশটাকে… আজ থেকে একশো বছর আগে এই বিপ্লব বিশ্বে প্রথম শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রের জন্ম দিল, লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক দর্শনকে বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগ করে দেখালেন। সমস্ত পৃথিবীকে চমকে দিয়ে তারা সূচনা করলেন সর্বহারার রাজত্বের… পরের একশো বছর সমগ্র বিশ্ব এই বিপ্লবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে, শিখেছে, এগিয়েছে। যদিও ইতিমধ্যেই বিপ্লবের জন্মদাতা সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হয়েছে— সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরাও জয়ের আনন্দে ঘোষণা করছে ‘ইতিহাসের পরিসমাপ্তি’-র। বিপ্লব পরাস্ত, কিন্তু বিপ্লব দীর্ঘজীবী হবেই… শতবর্ষ আগে এক অভূতপূর্ব বিপ্লবের সাফল্য, আবার পরবর্তীতে সেই বিপ্লবকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, উভয়ই আমাদের শিক্ষা দেয়। বিশেষ করে যখন বর্তমান নয়া উদারবাদী সময়ে আমার চারপাশ এক অন্ধকার নৈরাজ্যময় পরিবেশের সঙ্কটে দীর্ণ, নভেম্বর বিপ্লবই পথ দেখাতে পারে।

শতবর্ষের অবসরে নভেম্বর বিপ্লবকে আবার বুঝতে হবে। কীভাবে একটা পরিস্থিতি তৈরি হল… মেহনতি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হল… নতুন ধরনের দেশ তৈরি হল…। কীভাবে এই বিপ্লবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব উঠে এসেছিল, কীভাবে সেইসব দ্বন্দ্বের মীমাংসা করা গেল বা গেল না, আজকের পরিস্থিতিতেই বা নভেম্বর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা কী? আমাদের আলোচনা ঘুরে বেড়াবে এর আশেপাশেই…

 

শুরুর শুরু…

নভেম্বর বিপ্লব কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। অথবা অত্যন্ত নাটকীয় বা অতি চমকপ্রদ ঘটনাও নয়। সুদীর্ঘ প্রস্তুতি ছাড়া এই বিপ্লব সম্ভব হত না… একের পর এক সংগ্রামের ঢেউ বিপ্লবের বার্তা নিয়ে আছড়ে পড়েছিল জার শাসিত রাশিয়ার প্রতিটি প্রান্তে, অগণিত বিতর্ক আর প্রতিরোধে আক্রমণে গতি রুদ্ধ হয়েছে বারবার, তবু তাকে থামানো যায়নি। লেনিনের যোগ্য নেতৃত্ব দ্বিতীয় আর্ন্তজাতিকের বিভিন্ন মূল প্রশ্নগুলিকে এড়িয়ে গিয়ে নীরব থাকার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেছে… রাষ্ট্র ও বিপ্লব সম্বন্ধে সঠিক বোঝাপড়ায় পৌঁছে তার ভিত্তিতে মতাদর্শগত সংগ্রাম গড়েছে, তারপর ধাপে ধাপে তদানীন্তন রাশিয়ার সমাজের গরিষ্ঠতম অংশের শ্রমিক-কৃষকদের একজোট করে একটি গণরাজনৈতিক চেতনার উন্নততর অগ্রণী লেনিনীয় পার্টি গঠন করে তার নেতৃত্বে এই মহান বিপ্লব সম্ভব করেছে।

রাশিয়া উনবিংশ শতকের শেষদিকে একটি পশ্চাদপদ পুঁজিবাদী দেশ হিসাবেই গড়ে উঠছিল। যেখানে ঐতিহাসিকভাবেই স্বাধীনচেতা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল না। রুশ অর্থনীতিও মুলত কৃষিনির্ভর ছিল। ভূমিদাস প্রথার ভিত্তিতে বড় জমিদারিই ছিল গ্রামাঞ্চলে সামন্ত্রতান্ত্রিক শোষণের উৎস। ১৮৬৯ সালে ভূমিদাস প্রথার বিলোপ করা হলেও রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলে নানা উপায়ে শোষণ চলতেই থাকে, জমিদারদের পাশাপাশি ধনী কৃষক বা কুলাকদের রমরমা ছিল চোখে পড়ার মত। গ্রামীণ কমিউন বা মীর-গুলি আসলে ভূমিসংস্কারের নামে কৃষকদেরকে আধা-সর্বহারা আধা-ভূমিদাসে পরিণত হতে বাধ্য করেছিল। লেনিন একেই প্রুশিয়ান পথে পুঁজিবাদী বিকাশের প্রথম ধাপ বলেন। ইতিমধ্যে এই শতকের শেষ দশকে রুশ শিল্পায়ন গতি পায়, তবে একদম রাষ্ট্রীয় (অর্থাৎ জারের) উদ্যোগে ও বিদেশি পুঁজির বদান্যতায়। যার অনিবার্য পরিণতি হিসাবে রাশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণির উত্থান ঘটে; পাশাপাশি বাড়তে থাকে শ্রমিকের দাবী আদায়ের লড়াই। ১৮৭৫ সালে প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়, ১৮৮১ থেকে ১৮৮৬-র মধ্যে ৪৮টি ধর্মঘট হয়, আশি হাজার শ্রমিক তাতে যুক্ত হয়… তারপর ১৯৯৫, ১৯৯৬ লেনিনের ‘মুক্তি সংগ্রাম সংঘ’-এর নেতৃত্বে সেন্ট পিটাসবার্গ ও অন্যত্র শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ১৮৯৮ সালে মার্কসীয় সাম্যবা্দের অনুপ্রেরণায় গঠিত হল রাশিয়ান সোশাল ডেমোক্র্যাট অ্যান্ড লেবার পার্টি’ (RSDLP), যা পরবর্তীতে শ্রমিক সর্বহারার শ্রেণিসংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। বিংশ শতকের গোড়ায় দলটি দুই দলে ভাগ হয়ে যায়— একদিকে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা, অন্যদিকে প্লেখানভ ও মার্টভের আনুগামী মেনশেভিকরা। যেখানে মেনশেভিকরা ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলনের কথা বলছিল, বলশেভিকরা শ্রমিক-কৃষকের সম্মিলিত প্রয়াসে বিপ্লবের পক্ষে ছিল। বলশেভিকদের নেতা লেনিন বিশ্বাস করতেন, অতি অল্প সংখ্যক সচেতন ও অগ্রসর শ্রমিক পার্টির নেতৃত্বে সমাজের সব স্তরের শ্রমজীবী সর্বহারা মানুষকে একত্রিত করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হবে। তিনি লিখলেন, ‘কী করিতে হবে’ (১৯০২), ‘গ্রামের গরিবদের প্রতি’ (১৯০৩), ‘এক পা আগে এক পা পিছে’ (১৯০৪)। একটা শক্তিশালী মার্কসবাদী শ্রমিক শ্রেণির পার্টির নেতা হিসাবে লেনিন ও বলশেভিকদের জনপ্রিয়তা অনেকগুণ বেড়ে যায়… ১৯০১-১৯০৪ সালের মধ্যে একদিকে একাধিক সফল জঙ্গি ধর্মঘট সম্ভব হয়, অন্যদিকে ১৮৯১-৯২ সাল থেকে ছোট বড় মন্বন্তরে বিপর্যস্ত কৃষকদের অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠে..

 

রক্তাক্ত রবিবার…

১৯০৫ সালের ৯ জানুয়ারি্র এক রবিবারে বিপুল সংখ্যক রাশিয়ান জনতা জার ২য় নিকোলাসের শীতকালীন প্রাসাদ আক্রমণ করলে পুলিশ ও সেনা নির্মমভাবে তা দমন করে, মারা যায় নারী ও শিশু সমেত ৩০০ জন… বিপ্লব ব্যর্থ হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি আগামী দিনের বিপ্লবের ভিত শক্ত করে। যদিও রাশিয়ার জারের স্বৈ্রতান্ত্রিক শাসনে কোনও পরিবর্তন আনা যায়নি, তবুও এই আধা-বুর্জোয়া শাসনকে টিঁকিয়ে রাখার স্বার্থে ‘ডুমা’ নামের একটি নির্বাচিত সীমিত অধিকারের সংসদ গঠন করা হয়। কিন্তু পাশাপাশি এই প্রথম তৈরি হল শ্রমিক ও সৈন্যদের নির্বাচিত নিজের সংগঠন ‘সোভিয়েত’, একে একে কৃষক, জাতিগত সংখ্যালঘুদের সোভিয়েতগুলি গঠিত হল। সোভিয়েতগুলি শাসনের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠতে শুরু করল, হাততোলা ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি ঠিক করা শুরু হল… সোভিয়েতগুলি হয়ে উঠল বিপ্লবী শক্তির আঁতুরঘর।

সোভিয়েতগুলিতে প্রাধান্য ছিল সোশাল রেভলিউশনারিদের (এসআর), বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে, কোথাও মেনশেভিকদের, কোথাও বলশেভিকদের। ছিল নৈরাজ্যবাদী থেকে জায়নবাদী, সোশাল ডেমোক্র্যাটরা… সমস্ত বিপ্লব পর্বের প্রথমদিকে বলশেভিকরা সংখ্যালঘু হলেও দ্রুত তারা রাশিয়ার মেহনতি জনগণের সমর্থন পেতে শুরু করে। এমনকি এসআর-দের বামপন্থী অংশও বলশেভিকদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। ১৯১০ সাল থেকে নিরন্তর শ্রমিক আন্দোলনে রাশিয়ার শহরগুলি কেঁপে উঠতে লাগল।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ফেব্রুয়ারি বিপ্লব

১৯১৪ সালে শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ… মহাজনি পুঁজির প্রতিনিধি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির নিজেদের মধ্যে আধিপত্যের সংগ্রাম যা শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সামাজতন্ত্রের বিকাশের পথ সুগম করেছিল, ঠিক যেমনটি মার্কস বলেছিলেন… আর্ন্তজাতিক পুঁজিপতিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। জারের রাশিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধের অভিঘাতে রাশিয়ার অভ্যন্তরে তীব্র সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হয় আকাশছোঁয়া, মজুরি হ্রাস পায়… লক্ষ্ লক্ষ মানুষ কাজ হারায়… গ্রাম থেকে শহরে শরণার্থীর ঢেউ আছড়ে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৯১৬-১৭-র চরম খাদ্যসঙ্কটের কারণে শিল্পাঞ্চলগুলিতে শ্রমিকবিক্ষোভ শুরু হয়… বলশেভিকরা তাদের অবস্থান দৃঢ় করে। ১৯১৬ সালে লেনিন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’-এ বললেন বিপ্লবকাল আসন্ন। শান্তি ও রুটির দাবিতে শ্রমিকরা মিছিল বের করে, যোগ দেয় সৈনিকদের একটা বড় অংশ আর কৃষকরা। তৈরি হয় পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত। ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারিতে অবশেষে ক্রমাগত আন্দোলন আর বিশৃঙ্খলার কারণে জার দ্বিতীয় নিকোলাস সিংহাসন পরিত্যাগ করে এবং লেনিনের অনুপস্থিতির সুযোগে মেনশেভিক কেরেনেস্কির অর্ন্তবর্তী সরকার গঠিত হয়।

 

নভেম্বর বিপ্লব ও সর্বহারার রাজত্ব

কেরেনেস্কির সরকার আদপে বুর্জোয়া স্বার্থে পরিচালিত সরকার। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সরকার বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। তবুও শ্রমিকদের চাপে ধর্মঘট করার অধিকার সহ বেশ কিছু সংস্কার করতে বাধ্য হয়। সরকারের প্রধান লক্ষ্য বিপ্লবের অবসান ঘটিয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রেখে বুর্জোয়াদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। লেনিন তাঁর এপ্রিল থিসিসে ঘোষণা করলেন, যুদ্ধকালীন বিশৃঙ্খলা বুর্জোয়া বিপ্লবের সঙ্গে সর্বহারার বিপ্লবকে মিলিয়ে দিলেও তা সাময়িক… শ্রমিক-কৃষকের যৌথশক্তিই এই শাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করে সর্বহারার শাসন প্রতিষ্ঠা করবে…। হলও তাই। ৭ নভেম্বর, ১৯১৭ চূড়ান্ত ব্যর্থ কেরেনস্কির সরকারকে সরিয়ে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের সর্বহারা শ্রমিক কৃষক ও সেনাবাহিনির গণজোট এই সরকারকে বিনা রক্তপাতে উচ্ছেদ করল। প্রতিষ্ঠিত হল পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র। লেনিন ঘোষণা করলেন সোভিয়েতনির্ভর প্রজাতন্ত্র গঠনের কথা।

 

বিপ্লবের পথে— মার্কস থেকে লেনিন

কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-র ভূমিকায় ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস্‌ লিখেছিলেন, শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণি (সর্বহারা) নিজেকে শোষক ও নিপীড়ক শ্রেণির (বুর্জোয়া) কবল থেকে উদ্ধার করতে গেলে সেইসঙ্গে গোটা সমাজকে শোষণ, নিপীড়ন ও শ্রেণিসংগ্রাম থেকে চিরদিনের মত মুক্তি না দিয়ে পারে না… এটা একান্তই মার্কসের চিন্তা। মার্কস যেভাবে পুঁজিবাদী বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার নিজস্ব দ্বন্দ্বের কথা বলেছিলেন, পুঁজিবাদকে উৎখাত করেই শ্রমিক শ্রেণির একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে শোষণহীন শ্রেণিহীন সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে হবে— তাই প্রতিটি শ্রেণিসংগ্রামই রাজনৈতিক সংগ্রাম। আরও একধাপ এগিয়ে লেনিন ঘোষণা করলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদই পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাক‌শর্ত। ব্যক্তিপুঁজি সংহত ও কেন্দ্রীভূত হয়ে একচেটিয়া পুঁজিতে পরিণত হলে ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যবাদের স্তরে পৌঁছয়, এই সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলকে চূর্ণ করেই পুঁজির শ্রেণি-শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠবে… নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে লেনিন ঠিক এটাই করে দেখিয়েছিলেন, গণতন্ত্রকে সঙ্গে রেখে অগ্রণী শ্রমিক শ্রেণির (এক্ষেত্রে বলশেভিকরা) নেতৃত্বে লেনিন আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে সর্বহারার স্বার্থে শোষণমুক্তির জন্য গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত করেন। মার্কসের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করেই সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতিতে লেনিন রাশিয়ার মাটিতে মার্কসবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।

 

প্যারী কমিউন থেকে নভেম্বর বিপ্লব— শ্রমিক কৃষক ণজোট ও সোভিয়েত

ইতিহাসের থেকে শিক্ষা নিয়েই বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বারবার বলেছেন কার্ল মার্কস। প্রচলিত ধারণা ছিল উন্নত পুঁজিবাদের বিকাশের দেশ থেকেই শ্রমিক শ্রেণির অগ্রণী অংশের নেতৃত্বেই সমাজতন্ত্র বিকশিত হবে। লেনিনও আশা করেছিলেন জার্মানির অগ্রণী শ্রমিক শ্রেণি রাশিয়ার শ্রমজীবী মানুষদের পথ দেখাবে। কিন্তু জার্মানি বা ফ্রান্সে বিপ্লব পরাজিত হলে তিনি ‘এক দেশে’ সমাজতন্ত্রের ধারণাকে ব্যবহার করে বিপ্লবের স্তরের তত্ত্ব হাজির করলেন। নভেম্বর বিপ্লবের পূর্বসূরি প্যারী কমিউনের সময় শাসক শ্রেণি কৃষকদের কমিউনার্ডদের বিরুদ্ধে সফলভাবে ব্যবহার করেছিল, ফলে বিপ্লব ব্যর্থ হয়। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে লেনিন  রাশিয়ায় শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর শক্তিশালী হাতিয়ারকে ব্যবহার করেন, দেশের সমস্ত শোষিত জনগণকে বিপ্লবের সপক্ষে চালিত করে ক্ষমতা দখলকে স্থায়ী করলেন— জনগণ, একমাত্র জনগণই পারে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে…। প্রকৃতপক্ষে লেনিন সঠিকভাবেই অনুমান করেছিলেন যে রাশিয়ার মত আধা-পুঁজিবাদী দেশে, যেখানে জনগণের বৃহৎ অংশ প্রান্তিক কৃষিজীবী, সমাজবাদের জন্য শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনকে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে হবে, এমনকি প্রয়োজনে পাতি বুর্জোয়াদের সঙ্গেও তারা সাময়িক বোঝাপড়া করবে। লেনিনের একথাটিও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল যে, দেশের ভিতরে গণ-জোট তৈরির পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণির বিশ্বজোড়া আন্দোলনের সঙ্গে গোটা শ্রমজীবী জনগণকে একাত্ম করতে পারলে বিপ্লব সফল হবে।

শ্রমিক-কৃষক বোঝাপড়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল সোভিয়েতগুলি। “সোভিয়েতগুলির হাতে চাই সমস্ত ক্ষমতা”— এটাই ছিল বিপ্লবের দাবি… ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর স্বতঃস্ফুর্তভাবে গড়ে ওঠা শ্রমিক, কৃষক, সৈন্যদের সোভিয়েত (বিশেষ করে রাজধানীর সর্ববৃহৎ পেট্রোগ্রাড সোভিয়েত) ক্ষমতার নতুন ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে… প্রথমে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা সোভিয়েতগুলিতে সংখ্যালঘু হলেও, কৃষকদের হাতে জমি-শ্রমিকের হাতে শিল্প, যুদ্ধবিরোধী অবস্থান, অবদমিত জাতিসমূহের স্বশাসন… এইসব দাবিগুলি বলশেভিকদের দ্রুত জনপ্রিয় করছিল। ৭ নভেম্বরের ঠিক প্রাক্কালে সোভিয়েতগুলির কেন্দ্রীয় সভায় বলশেভিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে (বামপন্থী এসআর ও আর্ন্তজাতিকতাবাদী মেনশেভিকদের সমর্থন নিয়ে) ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেয়।

 

বিভিন্ন পক্ষের দ্বন্দ্ব— অপেক্ষা না বিপ্লব

বিপ্লবের প্রাক্কালে যে বিতর্কটি প্রধান হয়ে ওঠে, তা হল বিপ্লবের সঠিক সময়— এ বিষয়ে সোশালিস্ট রেভেলিউশনারি ও মেনশেভিকদের সঙ্গে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকদের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। ১৯০৫ সালের বিপ্লবের প্রেক্ষিতে রুশ সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য স্পষ্ট হয়… মেনশেভিকরা মনে করত আগে পুঁজিবাদের পূর্ণ বিকাশ, তারপর সমাজতন্ত্র। সুতরাং পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তরে না পৌঁছানো পর্যন্ত বুর্জোয়া শক্তির সঙ্গে সমঝোতা জরুরি। অন্যদিকে লেনিন বললেন শ্রমিক শ্রেণি বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত হয়েছে, এবার ক্ষমতা দখলই লক্ষ্য। কেরেনেস্কির সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে মেনশেভিকরা দাবী করে অর্ন্তবর্তী সরকারের দ্বারা পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত না হলে বিপ্লব সম্ভব নয়। এমনকি সোভিয়েতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণপন্থী এসআর অংশও বিপ্লবের বিরুদ্ধে মত দেয়। কিন্তু লেনিন জানালেন, এটাই ক্ষমতা দখলের সময় (এপ্রিল থিসিস), বললেন— সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদের বিস্তার সমাজতন্ত্রের জন্ম দেবে না। অপেক্ষা করার দরকার নেই…

 

বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব– সোভিয়েত সমাজতন্ত্র রক্ষা

৭ নভেম্বর (বা ২৫ অক্টোবর) বেলা আড়াইটায় সোভিয়েতে সভায় দাঁড়িয়ে লেনিন ঘোষণা করলেন, সরকারের পতন হয়েছে। ১৭ নভেম্বর আরেকটি সম্মেলনে বিপ্লবের প্রক্রিয়া শেষ হয়। দুনিয়া কাঁপানো সেই দশ দিনে প্রায় বিনা রক্তপাতে প্রতিষ্ঠা হল পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক সরকার… শ্রমিক কৃষকের পাশে এসে দাড়িয়েছিল সরকারপন্থী সেনারা। গঠিত হয়েছিল সম্মিলিত শক্তির লালফৌজ। বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে সোভিয়েতগুলির সরকার গঠন হল। যদিও এর পরের বছরগুলি (১৯১৭-১৯২২) অবশ্য প্রতিবিপ্লবীদের আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েছে রাশিয়া… দেশের ভিতরে বুর্জোয়া শক্তিগুলি, মেনশেভিক ও সোশাল রিপাব্লিকদের দক্ষিণপন্থী অংশ, বুন্দিস্ট এমনকি ট্রটস্কির ন্যায় বলশেভিকদের একটা অংশও, যারা জার্মানির সঙ্গে শান্তিচুক্তির বিপক্ষে ছিল, লেনিনের বিরুদ্ধে যায়। গোটা রাশিয়া জুড়ে বিপ্লব-বিরোধী প্রতিবিপ্লবী আক্রমণে, শ্বেত অভ্যুত্থানে কয়েক লক্ষ মানুষ মারা যান, তবুও রাশিয়ার বিপ্লবী গণফৌজ সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়। রাশিয়ার বাইরেও বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্যে ভীত আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স সহ ইউরোপের বুর্জোয়া শক্তিগুলি প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে সাহায্য করেছিল। বুখারিনের মত বলশেভিক দলের বামপন্থী অংশ অবিলম্বে পুঁজিবাদী দেশগুলির বিরুদ্ধে বিপ্লবে অংশ নেওয়ার পক্ষপাতী ছিল, কিন্তু লেনিন রাশিয়ার সদ্য প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্রের স্থায়িত্বের জন্য সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে ছিলেন, ব্রেস্ত-লিটভস্ক চুক্তির সপক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়ে বলেন— সাম্রাজ্যবাদের উন্নত শক্তির আগ্রাসী শক্তির সামনে প্রয়োজন কৌশলনৈপুণ্য, সাময়িকভাবে পশ্চাদপসরণ। বিপ্লবী তত্ত্বের প্রয়োগ ও রণকৌশল স্থির করার এই সাফল্য লেনিনের নেতৃত্বকে অমর করেছে, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রকে শক্ত করেছে। পরের ঘটনা ইতিহাস।

 

জাতিসত্তার মুক্তির বিপ্লব

নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল লেনিনের জাতিসত্তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। পুঁজিবাদী ভাবনা জাতির বিকাশকে নিজস্ব শ্রেণির বিকাশের সঙ্গে অভিন্ন হিসাবে দেখে, জাতীয়তাবাদী ভাবনার মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষকে ভাগ করতে চায়। এর বিরুদ্ধে লেনিন যেভাবে রাশিয়ার জনগণকে জাতিদম্ভের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, শতবর্ষ পরেও তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। ভারতের মত নানা জাতি-ভাষাভাষী গোষ্ঠীতে বিভাজিত রাশিয়াতে জারের রাজত্বে অন্যান্য অ-রুশীয় জনগোষ্ঠীর উপর রুশীয়দের আধিপত্য ছিল। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলির প্রতি ক্ষমতাবান রুশীয় জাত্যাভিমান প্রবল দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। জটিল এই জাতিদ্বন্দ্বের প্রশ্নের বাস্তবসম্মত সঠিক সমাধানসুত্র এবং বলশেভিক পার্টির ভিতরে ও বাইরে নিরন্তর আলাপ-আলোচনা-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে তার তাত্ত্বিক নির্মাণ এক আলোকবর্তিকা হয়ে উপস্থিত হয়েছিল পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত জনজাতির কাছে। বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিপীড়িত জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে বাস্তবায়িত করে, তাদের সামগ্রিক বিকাশকে সুনিশ্চিত করে জাতিগুলিকে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে সম্পৃক্ত করে।

জাতিসত্তার প্রশ্নেও লেনিনকে ঘরে বাইরে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। জাতিবাদ আসলে বিকাশমান পুঁজিরই একটা বহিঃপ্রকাশ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিপ্লবের পথ রুদ্ধ করবে— এই ছিল মোটামুটিভাবে অধিকাংশ মার্কসবাদীদের ধারণা। লেনিন এই ধারণার বাইরে বেরিয়ে (প্রসঙ্গত, রোজা লুক্সেমবার্গের সঙ্গে লেনিনের বিতর্কটি উল্লেখযোগ্য— যেখানে রোজা সরাসরি জাতির স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন, লে্নিনের মত সামগ্রিক জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জাতিগুলির পূর্ণ বিকাশ) বললেন, শ্রেণিগতভাবে পশ্চাদপর জাতিগুলির জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার (পরে স্তালিন দ্বারা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনে ফেরত) আর উন্নত জাতিগুলির জন্য শ্রেণিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারই একমাত্র সমাধান (দ্রষ্টব্য, লেনিন-বুখারিন সমঝোতা)। ১৯১৮ সালের ১২ জানুয়ারি ‘শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সম্বন্ধিত ডিক্রি’-তে ঘোষণা করা হল, “রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র স্বাধীন জাতিসমূহের সমবায়ের নীতির ভিত্তিতে সোভিয়েত জাতীয় প্রজাতন্ত্রগুলির একটি যুক্তরাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হল।” এর ফলে রাশিয়ায় বিভিন্ন জাতিসমুহের মধ্যে মার্কসবর্ণিত সমানে সমানে ঐক্যের ভাবনার ভিত্তিতে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরবর্তী্তে অবশ্যই এই প্রক্রিয়ার ভাঁটা পড়লে রুশীয় আধিপত্য ফিরে আসে, তেমনই প্রবল জাতিসত্তার দাবী শেষপর্যন্ত সোভিয়েতের পতন ত্বরান্বিত করে।

 

ধর্ম ও রাষ্ট্র— যেমন লেনিন করে দেখালেন

যখন নাগরিক সমাজের মধ্যে থেকে রাজনৈতিক রাষ্ট্র সহিংস পথে উদ্ভূত হয়, যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতার ছাঁচের মধ্যেই মানুষ তাদের মুক্তি অর্জনের জন্য লড়াই করে, রাষ্ট্র তখন যতদূর সম্ভব ধর্মের বিলুপ্তির জন্য, ধর্মের ধ্বংসসাধনের পথে যেতে পারে এবং অবশ্যই যাবে…

(Karl Marx— On The Jewish Question)

লেনিন বললেন—

ধর্ম নিপীড়নের একটি রূপ, যা অভাব ও বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে অন্যের জন্য নিত্য শ্রমে ভারাক্রান্ত জনগনের উপর ব্যাপকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়… ধর্ম শোষণের হাতিয়ার, তাই ধর্মনির্ভরতার অবসান সমাজতন্ত্রের চেতনাকে বিস্তার করবে।

১৯১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, সোভিয়েত রাশিয়া রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশনামা জারি করে। সমস্ত ধরনের ধর্মীয় আচরণ থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করা হয়, বিদ্যালয়কে চার্চ থেকে বিযুক্ত করা হয়, মঠ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি জনগণের সম্পত্তি বলে বিবেচিত হল… নাগরিক কর্তব্যকে নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের ওপরে রাখা হল…। ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসকে (ধর্মে বিশ্বাস ও অবিশ্বাস, উভয়েই) স্বীকার করেও নভেম্বর বিপ্লব-উত্তর রাশিয়া বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে ব্যবহার করে পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিল সন্দেহ নাই।

 

বিপ্লব-উত্তর দ্বন্দ্বসমূহ— শ্রেণিরাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র

নভেম্বর বিপ্লব রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এবং একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রমিক শ্রেণির একনায়কতন্ত্রই রাষ্ট্রের একমাত্র শ্রেণিচরিত্র, কিন্তু বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় রাষ্ট্রের চরিত্রের মূল্যায়নে বিরোধ তৈরি হল। শ্রমজীবী মানুষ নয়া সমাজতন্ত্র গড়ার মূল চালিকাশক্তি হলেও শ্রেণির একনায়কতন্ত্রের বদলে শ্রেণির অগ্রণীবাহিনি অর্থাৎ পার্টির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পরবর্তীতে যা পার্টির নেতাদের নেতৃত্বে পরিণত হয়। শ্রেণিকেন্দ্রিকতার সঙ্গে পার্টিকেন্দ্রিকতার এই দ্বন্দ্ব শেষপর্যন্ত আন্তঃপার্টি গণতন্ত্রকে খর্ব করে মাত্রাতরিক্ত কেন্দ্রিকতা ও আমলাতান্ত্রিকতার জন্ম দেয়। ফলে জনগণের ব্যপকতম অংশগ্রহণের বদলে দুটি বিপরীতধর্মী শক্তিকেন্দ্রের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে পরে। একটি, কেন্দ্রীভূত বলশেভিক পার্টি অন্যটি বিকেন্দ্রিত শ্রমিক-কৃষক-সৈনিকদের সোভিয়েত। প্রশ্ন দেখা দিল, এই দুই ক্ষমতার মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে কীভাবে তার মীমাংসা হবে? লেনিনের (পরে স্তালিনেরও) মতে পার্টি সোভিয়েতের শিক্ষক, পথপ্রদর্শক ও নেতা হলে কীভাবেই বা কমিউনের নীতিগুলি পরিচালিত হবে? জনগণের কি ক্ষমতা থাকবে পার্টির সিদ্ধান্ত নাকচ করার, বা পার্টির প্রতিনিধিকে সরিয়ে দেওয়ার? বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় সঠিক সময়ে শাসনের রূপের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন না হওয়ায় পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

 

বিপ্লব-উত্তর দ্বন্দ্বসমূহ— আর্থিক কাঠামো নির্মাণ

বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় আরেকটি দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত থেকে যায়, তা হল নতুন সমাজের নতুন শ্রেণিসম্পর্কের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। যা নিহিত ছিল সম্পত্তি-সম্পর্কের মধ্যে…। বিপ্লবের পরে সমাজতন্ত্রের কারণে কৃষিতে সম্পত্তি-সম্পর্কের পরিবর্তন হলে শ্রমিক-কৃষক মিত্রতায় বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, আবার উৎপাদনের হাতিয়ারসমুহের (যেমন,জমি) সামাজিকীকরণ না হলে বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ শ্রেণিহীন সমাজ গঠন সম্ভব হবে না। সোভিয়েত রাশিয়া সফল হয় কৃষির ‘যৌথকরণ’-এর মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নের জন্য উদ্বৃত্তের জোগান দিতে। সোভিয়েতের শেষ লগ্নে উৎপাদিকা শক্তির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আর্থিক ব্যবস্থাপনার লাগাতার পরিবর্তন না হওয়ায় তৈরি হওয়া বদ্ধতার সঙ্গে নব্য রাশিয়ার উচ্চাকাঙ্খার বিরোধ দেখা দিলে নেতা গর্বাচভের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তিগুলিকে ভেঙে ফেলা হতে থাকে। যার ফলে গোটা কাঠামোটিই ভেঙে পড়ে।

 

বিপ্লব-উত্তর দ্বন্দ্বসমূহ— মতাদর্শগত চেতনা, নীতি ও কৌশল, মৌলিক পরিচয়সত্তার দ্বন্দ্ব

নভেম্বর বিপ্লব সফল হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার জনগণের, বিশেষ করে শ্রমজীবী শ্রেণির অগ্রণী অংশের মতাদর্শগত মৌলিক চেতনার বৃদ্ধি। গ্রামশির কথায়, যাকে পালটা একটা মতাদর্শগত পরিমণ্ডলের উপরে থাকতেই হয়। তাই নভেম্বর বিপ্লবকে শক্তি জুগিয়েছিল কোনও পাল্টা সন্ত্রাস নয়, শ্রমিক আর মুজিক কৃষকের অকুণ্ঠ মতাদর্শগত সমর্থন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এই মতাদর্শের ক্ষেত্রে গুরুতর অবহেলার কারণে সোভিয়েতের অভ্যন্তরে কৌশলগত প্রশ্নে বিভিন্ন স্ববিরোধিতা শুরু হয়। লেনিনের ‘নভেম্বর বিপ্লব আর্ন্তজাতিক সাম্রাজ্যবাদের তথা উপনিবেশিকতাবাদের অবসানের জন্য লড়াই করবে’ এই মতাদর্শের বিপরীতে স্তালিনের রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ সমাজতন্ত্রকে রক্ষার জন্য লড়াইয়ের বাস্তবতার নিরিখে রাশিয়ার নীতিগত পরিবর্তন সমাজতন্ত্র নির্মাণে নতুন দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছিল (দ্রষ্টব্য স্তালিন বনাম ট্রটস্কি)।

 

নভেম্বর বিপ্লব— শতবর্ষের এপারে আমার ভারত

১৯১৭ থেকে ২০১৭— এই একশো বছরের এপারে নভেম্বর বিপ্লব আমাদের পথ দেখাবে… যেমনভাবে নভেম্বর বিপ্লব উদ্দীপ্ত করেছিল গোটা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে— চিন, ভিয়েতনাম, কিউবা, বলিভিয়া, হাঙ্গেরি সহ বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার রাষ্ট্রগঠন সম্ভব হয়েছিল… দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লালফৌজের লড়াই অবিস্মরণীয়, বিশ্বব্যাপী দারিদ্র, ক্ষূধা, বেকারত্ব, শ্রমিকের অধিকার… জল-জঙ্গল-জমির লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে নভেম্বর বিপ্লব। চিরাচরিত পুঁজিবাদী শাসনের বিপরীতে সমাজতন্ত্র- সর্বহারার রাজত্ব, সাম্যের প্রতিষ্ঠা সারা পৃথিবীর সামনে একটা চ্যালেঞ্জ উপস্থিত করেছিল। এর পরিণতিতে পুঁজিবাদী দেশগুলি বাধ্য হয়েছিল বিভিন্ন জনকল্যাণকর ব্যবস্থা গ্রহন করতে… আজকাল যে গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াইয়ের কথা বলি আমরা, তা কোনও বুর্জোয়া শ্রেণিশাসনের পরিণাম নয়, তা হল নিপীড়িত শ্রমজীবী জনগণের সংগ্রামের ফল, সমাজতন্ত্রের উপহার। নভেম্বর বিপ্লব তাই আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

নভেম্বর বিপ্লবের ঢেউ ভারতেও এসে পৌঁছয়। যা ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নির্মাণ করেছে, দিশা দেখিয়েছে। আজকের ভারত সেই অসামান্য অভিজ্ঞতার আলোয় কতটা আলোকিত হল? হতে পারল? ভারতের শ্রমজীবী মানুষ কি পারল সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে, কিংবা নভেম্বর বিপ্লবের ন্যায় শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যবদ্ধ গণজোট গড়তে? প্রশ্নগুলি আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে (যদিও বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নাই) দেখব ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন তার জন্মলগ্ন থেকেই বহুবিভক্ত— বিপ্লবের সঠিক সময়ের প্রশ্নে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গী হওয়ার প্রশ্নে, সংসদীয় বুর্জোয়া ব্যবস্থায় অংশীদারিত্বের প্রশ্নে, নির্বাচন না সশস্ত্র অভ্যুত্থান— এইরকম বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্নের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে দৃঢ়। নভেম্বর বিপ্লব যেভাবে লেনিনের নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শগত চেতনার উন্নতিসাধন করে তাদের অগ্রনী সৈনিকে পরিণত করেছিল এবং তাদের নেতৃত্বে কৃষক-শ্রমিক ঐক্য প্রসারিত করে বিপ্লব সম্ভব করেছিল, ভারতের সামাজিক কাঠামো রাশিয়ার মত হলেও সেইভাবে মতাদর্শের চেতনা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। ফলত ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন তার প্রস্তুতিপর্বেই থিতু হয়ে আছে, এখনও। লেনিনের সোভিয়েত যেভাবে জাতি ও ধর্মের সমস্যার সমাধান করেছিল, ভারতের কমিউনিস্টরা কি সেইভাবে জাতি ও ধর্মের পরিচয়বাদী রাজনীতির মোকাবিলা করতে পেরেছে? আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন আছে। লক্ষ করলে দেখব ভারতের সফল আলোড়ন সৃষ্টিকারী সমাজবদলের লড়াইগুলি (তেভাগা, তেলেঙ্গানা বা নকশালবাড়ি বা অন্যান্য) মূলত কৃষক আন্দোলন, যা প্রকৃতিতে যতটা লেনিনীয় তার চেয়েও বেশি মাওপন্থী। অথচ সমাজতান্ত্রিক লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেবে শ্রমিক শ্রেণির অগ্রণী অংশ। ভারতের শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন মূলত ট্রেড ইউনিয়নের দাবিদাওয়ার স্তরেই সীমিত, সেখানে সমাজবদলের বাস্তবতা অনুপস্থিত। এমনকি এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে মধ্যবিত্তের মত পেটিবুর্জোয়া শ্রেণি (কখনও রেশন ডিলার, ব্যবসায়ী, ঠিকাদারদের ন্যায় লুম্পেন প্রলেতারিয়েত)।

আজকের ভারতে যখন একদিকে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি রাজনৈতিক ক্ষমতায় শক্তিশালী হচ্ছে, অন্যদিকে অন্যান্য জাতিবাদী এবং আঞ্চলিক দলগুলির ন্যায় সুবিধাবাদ ও জনপ্রিয়বাদে বিশ্বাসী কতকটা নৈরাজ্যবাদী শক্তিগুলির উত্থান এবং পারস্পরিক লড়াই নয়া উদারনৈতিক ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তিকে সংহত করছে, পরিচিতি সত্তার রাজনীতির আড়ালে শ্রেণিভিত্তিক লড়াইকে দূর্বল করছে (যদিও ভারতীয় বাস্তবতায় ক্লাস এবং কাস্টের পারস্পরিক পরিচিতিকে অগ্রাহ্য করা কতদূর সঠিক এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে)। একে প্রতিহত করতে গেলে নভেম্বর বিপ্লবের অভিজ্ঞতাই আমাদের পাথেয় হবে। নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্বেই বৈষম্যহীন শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে উঠবে, এটাই নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা।

কৃতজ্ঞতা

  1. অনিমেষ চক্রবর্তী
  2. সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট বলশেভিক পার্টির ইতিহাস
  3. অনীক
  4. লেনিন, কালেক্টেড ওয়ার্কস্‌
  5. মার্কস, ইন্টারনেট আর্কাইভ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...