ভাষা চিন্তা মন: শারীরিক অবকাঠামো — একটি সহজপাঠ [৯]

অশোক মুখোপাধ্যায়

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: শব্দ থেকে ধ্বনি

দ্বিতীয় সঙ্কেততন্ত্র

বিবর্তনের একেবারে আদিপর্ব থেকেই নানারকম পুনর্বচনযোগ্য অর্থবহ শব্দ, অর্থাৎ, মুখের কথ্য ভাষা সৃষ্টি করার পাশাপাশি মানুষ পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের একটা সরল পদ্ধতি আবিষ্কার ও আয়ত্ত করেছিল। সেটা হল ইশারা ভাষা বা সঙ্কেত ভাষা। এই পদ্ধতিতে মানুষ হাত পা মাথা কাঁধ নাড়িয়ে নাড়িয়ে এবং/অথবা চোখের চাউনি দিয়ে নানারকম খবর আদানপ্রদান করত। পৃথিবীতে এখনও কিছু অনুন্নত মানবগোষ্ঠী আছে যাদের কথ্য ভাষার পরিধি খুব সঙ্কীর্ণ এবং তারা বেশিরভাগ জরুরি তথ্য ইশারায় বা সঙ্কেতের সাহায্যে একে অপরের কাছে পৌঁছে দেয়। এছাড়া, আগুন জ্বালিয়ে কিংবা অরণ্যদেবের কমিক্‌সের মতো ঢাক ঢোল মাদল শিঙা ঘন্টা শাঁখ বাজিয়েও মানুষ দূরদূরান্তরে সংবাদ প্রেরণ করেছে।

আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রেড ইন্ডিয়ান জনজাতির লোকেরা একবার নদীতে তাদের মাছ ধরার অধিকার হরণকারী ফেডারেল আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন কংগ্রেসের কাছে একটা স্মারকলিপি জমা দিয়েছিল। তাতে কিছুই লেখা ছিল না। ছিল শুধু একটা ছবি। তাতে সাতটি জনজাতির সাতটি কুলকেতু (totem)-র প্রতীক, আর প্রতিটি কুলকেতুর সঙ্গে একটা করে মাছের ছবি সুতো দিয়ে সংযুক্ত করে দেখানো ছিল।

কোনও ঘটনা বা বস্তুর কথা মনে রাখার জন্য মানুষ কাপড়ে, শাড়ির আঁচলে, দড়িতে গিঁট দিয়ে রাখত, গাছের ডাল থেকে দড়িতে ঢিল বেঁধে ঝুলিয়ে দিত। এখনও ঠাকুর দেবতার থানে এরকম দড়িবাঁধা ঢিল দেখা যায়, যাদের কাজ দেবদেবীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া— ঢিল যারা বেঁধেছে তাদের মনস্কামনা পূরণ করার দাবি বা আবদার। আবার অনেকে মনে রাখার জন্য রুমালে গিঁট বেঁধে রাখে। অস্ট্রেলিয়ার বুশম্যানরা লাঠি বা কাঠের দণ্ডে নানারকম আঁচড় কেটে স্মারক হিসাবে ব্যবহার করে। পেরুর একটি জনজাতি গাছে এক বিশেষ ধরনের দড়ির ফাঁস— ওরা বলে “কুইপু”— বেঁধে কোনও কাজ স্মরণে রাখার ব্যবস্থা করে। একালের মানুষও কোনও নতুন জায়গা বা দেশ ঘুরে এলে সেখানকার কিছু কিছু স্মারক দ্রব্য বা ‘স্যুভেনির’ সংগ্রহ করে তার স্মৃতি সংরক্ষণ করে।

আমরা মৌখিক ও লিখিত ভাষা ব্যবহার করলেও এই সঙ্কেত ভাষা আজও ব্যাপকভাবে আমাদের মধ্যে চালু আছে। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে আমাদের পরস্পরের মধ্যে অনেকরকম বার্তা জ্ঞাপন হয়ে থাকে। কথা বলা বা আলোচনার সময় অধিকাংশ বক্তাই হাত এবং/অথবা মাথা নাড়ায়। একটিও শব্দ ব্যয় না করে শুধু মাত্র হাত নাড়িয়ে কাউকে কাছে ডাকা যায়, দূরে চলে যেতে বলা যায়, বিরক্ত করতে নিষেধ করা যায়, অপেক্ষা করতে বলা যায় এবং বিদায় জানানো যায়। হাতের ইশারায় আমরা একজনকে কিছু দিতে বলতে পারি, দিলে প্রত্যাখ্যান করতে পারি, স্নেহ আশীর্বাদ ও অভয় জ্ঞাপন করতে পারি, সভার কোনও প্রস্তাবে সমর্থন/বিরোধিতা জানাতে পারি, সভার সঞ্চালক বা শ্রোতৃমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। এই সবই হচ্ছে বহু প্রচলিত পদ্ধতি। এবং এগুলো সারা পৃথিবীতে সমস্ত ভাষা ও জাতির মানুষের মধ্যেই কমবেশি একভাবে চালু হয়ে রয়েছে।

এছাড়া, মাথা নাড়িয়ে কোনও বিষয়ে ‘হ্যাঁ’, কিংবা, ‘না’ বলা, চোখের নানারকম চাউনিতে নানারকম অনুভূতি বা মনোভাব ব্যক্ত করা, ঠোঁট বাঁকিয়ে কাঁধ নাচিয়ে কিছু বোঝানো— এসবের সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত ও অভ্যস্ত।

সকলেই দেখেছেন, ক্রিকেট খেলায় আম্পায়াররা মুখে ঘোষণা করলেও হাত ও পায়ের বিভিন্ন মুদ্রাতেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। নো-বল স্টাম্পড রান-আউট এলবিডব্লিউ হল কি হল না, থার্ড আম্পায়ারকে ডাকা হল কিনা— খেলোয়াড় এবং দর্শকরা— সঙ্কেতগুলি জানলে— কথা না শুনেও, ভাষা না জেনেও, ওতেই বুঝে নেন। ফুটবল খেলায় রেফারি হাত পা ও বাঁশির বিভিন্নরকম আওয়াজের সাহায্যে সমস্ত সিদ্ধান্ত জানান এবং লাইন্সম্যানরা পতাকা নাড়িয়ে রেফারি ও সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর ফলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মঞ্চে রেফারি লাইন্সম্যান খেলোয়াড় ও দর্শকদের ভাষার বিভিন্নতা সত্ত্বেও অফসাইড ফাউল কর্নার ফ্রিকিক বুঝতে এবং কোন সিদ্ধান্ত কাদের পক্ষে কোন দলের বিরুদ্ধে গেল জানতে অসুবিধা হয় না।

সঙ্কেত ভাষার আরও অনেকরকম ব্যবহার আছে।

মাঝসমুদ্রে যখন বেতার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেই অবস্থায় দুটো দূরব্যবহিত জাহাজের নাবিকেরা পতাকা নাড়িয়ে নিজেদের মধ্যে সংবাদ আদানপ্রদান করে থাকেন। এটা অনেককাল ধরে চলে আসছে। রেলগাড়ির চালক ও গার্ড বাঁশি বাজিয়ে পতাকা নেড়ে ও টর্চবাতির সাহায্যে নিজেদের মধ্যে গাড়ি ছাড়ার বিষয়ে বার্তাবিনিময় করেন। সড়ক ও রেল পরিবহনের ট্র্যাফিক সিগন্যাল (লাল মানে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে; সবুজ মানে এগিয়ে যেতে পারো, ইত্যাদি) সারা বিশ্বের প্রচলিত ও পরিচিত সঙ্কেতপদ্ধতি। আবার মূক ও বধিরদের জন্য কয়েকটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হাতের মুদ্রাকে বর্ণমালার মতো করে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্যবহৃত ব্রেইল লিখনপদ্ধতিও এক ধরনের সঙ্কেত ভাষালিপি।

প্রকৃতপক্ষে ভাল অভিনেতা হতে গেলে বিভিন্ন ইশারা বা সঙ্কেত অর্থাৎ শরীরী ভাষা ঠিক ঠিক মতো আয়ত্ত ও প্রয়োগ করতে হয়। এই ভাষাতেই আদিম মানুষ সুদূর প্রাচীনকাল থেকে নৃত্য ও অভিনয় চর্চা শুরু করেছিল। আধুনিককালে এরই একটা শিল্পসম্মত রূপ দিয়ে “মাইম” হিসাবে মঞ্চে প্রয়োগ করা হচ্ছে।

ইশারা ও সঙ্কেত ভাষার এই সর্বজনীন ও সুদীর্ঘকাল ব্যাপ্ত ব্যবহার থেকেই আমরা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন— যা শুধুমাত্র মানুষেরই অর্জন— এবং সেই সংক্রান্ত পাভলভের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কারটির তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম হব।

পাভলভ বললেন,

বিকাশ লাভ করতে করতে প্রাণীজগতে যখন মানুষের আগমন হল, তখন স্নায়বিক কার্যকলাপের কর্মপদ্ধতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ঘটল। অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে দর্শন, শ্রবণ, ইত্যাদি গ্রাহক যন্ত্রের বিশেষ ধরনের কোষগুলিতে যে উদ্দীপনা সঞ্চারিত হয় এবং যার ছাপ গুরুমস্তিষ্কের মধ্যে থেকে যায়, তার দ্বারাই বাস্তবের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে। এটা আমরাও আমাদের চারপাশের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে অনুভূতি, সংবেদন বা ধারণা হিসাবে পাই— শোনা বা দেখা শব্দ ছাড়াও। এটা হল বাস্তবের প্রথম সঙ্কেত যা আমাদের ও পশুদের উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে। কিন্তু কথা হল বাস্তবের দ্বিতীয় সঙ্কেত তন্ত্র (second signal system) যা প্রথম সঙ্কেতের সঙ্কেত (signal of signals), যা শুধু আমাদেরই রয়েছে।[1]

এই দ্বিতীয় সঙ্কেত বা সঙ্কেতের সঙ্কেত বলতে কী বোঝানো হয়েছে ভালো করে বুঝবার জন্য ইশারা ব্যবহারের একটা কল্পিত ঘটনা ধরে এগোনো যাক।

মনে করা যাক, কোনও আদিম জনগোষ্ঠীর একদল লোক সেই আদ্যিকালে শিকার করতে বেরিয়েছে। একজন যাচ্ছে সকলের থেকে বেশ খানিকটা আগে আগে— অনুসন্ধান করার জন্য। বাকিরা পেছন পেছন সাবধানে এগোচ্ছে, শিকারের হদিশ পেলেই দৌড়ে যাবে আক্রমণ করতে বা ঘিরে ফেলতে। এখন, প্রথমজন হয়ত একটা হাতি দেখতে পেল। সে যা দেখল, অর্থাৎ, যে দর্শন সংবেদন লাভ করল, সেটা হল প্রাথমিক সঙ্কেত, যা বস্তু থেকে সরাসরি ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত এবং স্নায়ুকোষের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অঞ্চলে পরিবাহিত। এবার সে, ধরা যাক, নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে পেছনকার শিকারী দলকে বুঝিয়ে দিল, “অমুক দিকে একটা হাতি ঘুরছে।” এতে তাদের কাছেও একটা সাঙ্কেতিক বার্তা পৌঁছে গেল— হাতির খবরযুক্ত সঙ্কেত। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, এটা সরাসরি হাতি থেকে আসেনি। এসেছে অন্য একটা সঙ্কেত হিসাবে। হাতিবিষয়ক সঙ্কেত। তাই এটা দ্বিতীয় সঙ্কেত বা সঙ্কেতের সঙ্কেত।

দুটোর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

একটা হল, প্রথম সঙ্কেত আসছে কোনও বস্তু থেকে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষ সংবেদন হিসাবে। সংবাদটা এখানে মূর্ত, সকলের কাছেই একরকম। যাঁরা হাতি দেখতে পাবেন, তাঁদের সকলের কাছেই সেই হাতির একইরকম সংবেদন পৌঁছবে। এমনকি অদ্বৈত বেদান্তবাদী, যিনি দূরে হাতি দেখতে পেলে হয়ত বলতে পারেন, “হাতি কাকে দেখছ? ব্রহ্ম বই তো নয়”, তিনিও সেই হাতির তাড়া খেলে ব্রহ্মকে ব্রহ্মতালুতে জমা করে সোজা দৌড় লাগাবেন। হাতিকে তখন হাতিই দেখবেন। কিন্তু দ্বিতীয় সঙ্কেতটা আসছে অন্য সূত্র থেকে। দুই বা ততোধিক ব্যক্তির পারস্পরিক খবর প্রেরণ-গ্রহণের মাধ্যমে। সংবাদটা এখানে বিমূর্ত। সকলের কাছে একরকম নয়। সঙ্কেতটা নিয়ে যাদের মধ্যে বোঝাপড়া আছে, তারাই বুঝবে। অন্যেরা তার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারবে না।

এখানেই আসছে দ্বিতীয় পার্থক্য। প্রথম সঙ্কেত সর্বদাই এবং সকলের কাছেই অর্থ বহন করে, উদ্দীপকের স্বকীয় বস্তুগত গুণ বা বৈশিষ্ট্য হিসাবেই। হাতির প্রত্যক্ষ সংবেদন সমস্ত মানুষের কাছেই একরকম এবং সমান অর্থবহ। কিন্তু দ্বিতীয় সঙ্কেত তখনই অর্থবহ হয় যখন তা নিয়ে সঙ্কেতপ্রেরক ও গ্রাহকের মধ্যে আগে থেকেই একটা বোঝাপড়া থাকে। অর্থাৎ, সঙ্কেতটা এখানে পূর্ব-আলোচিত, আরোপিত, কৃত্রিম। যে বিশেষ অঙ্গভঙ্গির দ্বারা হাতি বোঝানো হল, তার মধ্যে হাতির কোনও প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। যদি একদল লোক সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা হাতি দেখলে ওইভাবেই একে অপরকে জানাবে, তাহলেই ওই ইশারাগুলি হাতিসূচক হবে। যে জানবে না, সে দূর থেকে শুধু হাত-পা নাড়াই দেখবে। অন্য আর একটা জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণ অন্যভাবে হাতিবাচক ইশারা বা সঙ্কেত তৈরি করতে পারে।

আর একটা উদাহরণ।

ধরা যাক, (যখন রেডিও সঙ্কেত প্রযুক্তির বিকাশ হয়নি) একটা বিপন্ন জাহাজের নাবিকরা মাঝসমুদ্রে লাল পতাকা নাড়িয়ে আর একটা জাহাজের নাবিকদের বোঝাতে চাইছেন যে তাঁদের জাহাজ বিপদে পড়েছে। দ্বিতীয় কোনও জাহাজের নাবিকরা কি বার্তাটা স্বভাবত নিজে-নিজেই ধরতে পারবেন? খানিক আন্দাজ করতে পারলেও পুরো আবেদনটা বুঝতে পারবেন না, যদি সমস্ত জাহাজিদের মধ্যে আগে থেকেই এরকম একটা বোঝাপড়া তৈরি করে রাখা না থাকে। একই ব্যাপার রেডক্রস চিহ্নের ক্ষেত্রেও ঘটে। একটা চওড়া লাল রঙের যোগ চিহ্নের মধ্যে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য বিষয়ক কোনও তাৎপর্যই স্বতঃনিহিত নেই। পৃথিবীর সমস্ত দেশের মানুষ এই চিহ্নটাকে এই অর্থে মেনে নিয়েছে। সমস্ত দ্বিতীয় সঙ্কেতের চরিত্রই এইরকম। পূর্ব-আরোপিত, বহুস্বীকৃত, কৃত্রিম অর্থপ্রযুক্ত।

এইবার ইশারার বদলে ‘হাতি’ শব্দটা বসিয়ে দেখা যাক কী হয়।

ধরা যাক, পূর্বোক্ত অনুসন্ধানকারী একদিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করে উঠল, “হাতি, হাতি!” অমনি শিকারীর দল সেইদিকে ছুটতে শুরু করল। কারণ, নিজেরা হাতি না দেখলেও, শুধু ‘হাতি’ শব্দটা শুনেই, অর্থাৎ, কিছু অর্থবহ ধ্বনি শুনেই হস্তির সঙ্কেত বা খবরটা তারা পেয়ে গেল। এই সুনির্দিষ্ট আওয়াজ বা শব্দটাও একটা সঙ্কেত। কিন্তু এটা হাতির দর্শন বা গন্ধযুক্ত সংবেদন নয়, প্রথম সঙ্কেত নয়; অনুসন্ধানকারীর দৃষ্ট হাতির প্রথম সঙ্কেতের একটা ধ্বনি সঙ্কেত। সেইদিক থেকে দ্বিতীয় সঙ্কেত বা সঙ্কেতের সঙ্কেত। ইশারাটা ছিল দৃশ্য সঙ্কেত, আর শব্দটা হল শ্রাব্য সঙ্কেত। কিন্তু দুটোই হচ্ছে দ্বিতীয় সঙ্কেত, ভাষা সঙ্কেত।

এখানেও লক্ষণীয়, ‘হাতি’ নামক এই বাংলা শব্দের মধ্যে কিন্তু আসল হাতির প্রত্যক্ষ সংবেদনের কোনও অর্থ স্বতঃনিহিত নেই। আমরা বাঙালিরা যাকে দেখতে পেলে বলি ‘হাতি’, তাকেই ইংরেজরা দেখলে বলে ‘এলিফ্যান্ট’, রাশিয়ানরা বলে ‘স্লোন’, ইত্যাদি। শব্দটা তখনই আসল হাতির অর্থবহ হবে, যখন আমরা আগে থেকে শব্দটার ওই অর্থ মেনে নেব, অর্থাৎ, তাদের কাছেই হবে যারা ওই ভাষাটা জানবে।

এইসব কারণে প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্কেতের মধ্যে আরেকটাও বড় পার্থক্য আছে। প্রথম সঙ্কেত গ্রাহকসাপেক্ষে সর্বজনীন হলেও, যার সঙ্কেত সেই বস্তুসাপেক্ষে সব সময়েই বিশেষ, এক এবং অদ্বিতীয়। যে হাতি চোখের সামনে আছে, শুধু তারই প্রথম সঙ্কেত (দর্শন সঙ্কেতের আকারে) মস্তিষ্কে আসবে। কিন্তু দ্বিতীয় সঙ্কেত গ্রাহকসাপেক্ষে পূর্বনির্ধারিত ও বিশেষ হলেও বস্তুসাপেক্ষে নির্বিশেষ, সাধারণ, বহুজনীন। ‘হাতি’ শব্দটা শুনলে, যারা এই বাংলা শব্দটির সঙ্গে পরিচিত, তাদের কাছে কোনও বিশেষ হাতির সংবেদন যাবে না। দুনিয়ার সমস্ত হাতির একটা স্পষ্ট বিমূর্ত ছবি মস্তিষ্কে গড়ে উঠবে। কিংবা, বলা যায়, প্রথম সঙ্কেত মারফত হাতির যে প্রত্যক্ষণ (perception) স্মৃতিতে ধরা আছে, ‘হাতি’ নামক এই শব্দ সঙ্কেত সেই স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার একটা শর্তাধীন উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে। এমনকি, ‘হাতি’ এই লিপি সঙ্কেতও একই কাজ করতে পারে। মানুষ এইভাবে দুনিয়ার বিভিন্ন বস্তুকে একে একে আলাদা আলাদা শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করতে ও সেই সঙ্কেত একে অপরের কাছে পাঠাতে পারে। মানুষের এই শব্দভাণ্ডার যত বেড়েছে, ততই ইশারা ভাষার পরিধি সঙ্কুচিত হয়ে গেছে, গুরুত্ব কমেছে, কথ্য ভাষার পরিসর ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই প্রখ্যাত রুশ লেখক এম ইলিন এবং ওয়াই সেগাল বিবর্তনের ধারায় ইশারা ভাষা থেকে কথ্য ভাষার এই অর্জন সম্পর্কে ভারি চমৎকার রসিকতা করে বলেছেন: “মানুষের জিহ্বা হাতের সঙ্গে কাজ বদল করে নিল।”[2]

ইশারা ভাষা ও এবং পরে কথ্য ভাষা— এই দুইয়ের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সঙ্কেত গ্রহণের পরিধি ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধির ক্ষমতাকেই পাভলভ নাম দিয়েছেন দ্বিতীয় সঙ্কেত তন্ত্র। বলেছেন:

চতুষ্পার্শ্বের জগৎ থেকে পাওয়া সংবেদন ও অনুভূতিগুলি যেমন আমাদের পক্ষে বাস্তবের প্রথম সঙ্কেত বা মূর্ত সঙ্কেতগুচ্ছ, তেমনই কথা, যা আসলে বাক্‌যন্ত্রগুলি থেকে কর্টেক্সে প্রবাহিত সূক্ষ্ম দেহানুভব সংবেদন, হচ্ছে দ্বিতীয় সঙ্কেতগুচ্ছ বা সঙ্কেতের সঙ্কেত। এগুলি বাস্তবের বিমূর্ত রূপ যার দ্বারা বাস্তবের সাধারণীকরণ সম্ভব হয়। এটা আমাদের অতিরিক্ত, মানুষ হিসাবে বিশেষ এবং উচ্চতর মানসিক ক্ষমতা, যার সাহায্যে মানবগোষ্ঠীর সাধারণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় গড়ে ওঠে। এ থেকেই শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি হয়েছে বিজ্ঞান যার মাধ্যমে মানুষ পারিপার্শ্বিক জগৎ এবং নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়ার রাস্তা খুঁজে পায়।[3]

বস্তুর শব্দ (শ্রাব্য) বা লিপি (দৃশ্য) সংবেদন থেকে মানুষ যে প্রত্যক্ষণ লাভ করে তাকে বলা হয় ধারণা (idea/concept) এবং মানবমস্তিষ্কের এই বিশেষ ক্ষমতাকেই বলা হয় অবধারণ (conception), বা অন্য ভাষায় বিমূর্তায়ন (abstraction), সাধারণীকরণ (generalization), ইত্যাদি। এর থেকে মনে হয়, মানবমস্তিষ্ক যেন বস্তুজগতের যে কোনও সংবেদনকে প্রথম সঙ্কেত থেকে দ্বিতীয় সঙ্কেতে অনুবাদ করে নিতে এবং স্মৃতিতে সংরক্ষণ করতে পারে। প্রত্যক্ষণ থেকে অবধারণের এই ক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়েই মানুষ চিন্তা করতে শিখেছে।

এখন প্রশ্ন হল, মানবমস্তিষ্ক বাইরের উদ্দীপনায় কীভাবে সাড়া দেয়? মানুষও অন্যান্য উচ্চতর প্রাণীর মতোই বিভিন্ন সংবেদনকে সংযোজিত করে বাহ্যিক পরিবেশ সম্পর্কে একটা পূর্ণাঙ্গ অনুভূতি লাভ করে। কিন্তু সচেতন জাগ্রত ও সক্রিয় অবস্থায় তার ভিত্তিতেই সে ক্রিয়া করে না। সে এই প্রত্যক্ষ অনুভূতিসমূহ থেকে কথ্য শব্দ অবলম্বন করে বিমূর্ত ধারণায় যেতে চেষ্টা করে, পূর্ব অভিজ্ঞতার স্মৃতির সঙ্গে তুলনা করে দেখে নেয়, ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্পর্কেও কিছু না কিছু ভেবে দেখতে চায়, তারপর অঙ্গসঞ্চালন করে। তারও আবার জবাবি সংবেদন আসে এবং মস্তিষ্ক তার উপর নির্ভর করে সঞ্চালন ক্রিয়াকে প্রয়োজনমতো সংশোধন করে নেয়। এই জন্যই সুস্থ মানুষের জাগ্রত অবস্থায় সমস্ত আচরণই হচ্ছে চিন্তাভিত্তিক বা পূর্বপরিকল্পিত ক্রিয়া (premeditated action)।

পূর্ণবয়স্ক মানুষের জীবনে কথ্য শব্দের এই ব্যাপকতর সঙ্কেতজ্ঞাপক ভূমিকাকে উল্লেখ করে পাভলভ বলেন:

বয়ঃপ্রাপ্তির সমগ্র পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে গুরুমস্তিষ্কে আসা সমস্ত বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উদ্দীপকের সঙ্গে একটি করে শব্দ যুক্ত থাকে, যা সেই উদ্দীপকের সঙ্কেত হিসাবে কাজ করে, তাদের জায়গা দখল করে নেয় এবং সেই সমস্ত উদ্দীপকের ঘটানো প্রতিটি ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে সক্ষম হয়।[4]

কেন না,

A word is as real a conditioned stimulus for man as all the other stimuli in common with animals, but at the same time more all-inclusive than any other stimuli.[5]

মানবমস্তিষ্কের এই কার্যকলাপকে তাই সাধারণভাবে পাঁচটা ধাপে ভাগ করে ফেলা যায়:

সংবেদন → প্রত্যক্ষণ → অবধারণ → অঙ্গ সঞ্চালন → জবাবি সংবেদন। এর প্রবাহ-নকশা উপরে ১৬ নং চিত্রে দেখানো হল।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]


[1] Pavlov n.d.a, 262.
[2] ইলিন ও সেগাল ১৯৮৫, ১০৬।
[3] Pavlov n.d.a, 285.
[4] Cited, Platonov 1959, 5.
[5] Cited, Platonov 1959, 15.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...