সাইবাবা মামলা, আদালত, ন্যায়বিচার, মানবিক অধিকার— অমৃত, না গরল?

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, পরিবেশবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

 

 

 

ছোটবেলায় পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমে ক্রমে ৯০ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধী, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রামযশ কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক জি এন সাইবাবা-র মামলাটি নানাদিক থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাড়া ফেলেছে। দীর্ঘ আট বছর প্রথমে বিচারাধীন ও পরে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তিনি এক অমানুষিক অবস্থায় নাগপুরের কুখ্যাত ‘আন্ডা সেল’-এ বন্ধি, তাঁর জন্য জঘন্য শৌচালয়ে সিসি টিভি, যেটির ফুটেজ সর্বক্ষণ জেল কর্তৃপক্ষ দেখে থাকেন, যে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে শুধু যে বিচারবিভাগের প্রাক্তন ন্যায়াধীশরাই প্রশ্ন তুলছেন এমন নয়, এদেশের করদাতা ও আইন-মানা অসংখ্য সাধারণ নাগরিক এই প্রক্রিয়ায় আইনের প্রতি, বিচার-ব্যবস্থার প্রতি এবং সর্বোপরি, মানুষের প্রতি মমত্বের সভ্যজগতের যে ঐতিহ্য দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে উঠেছে, সে সবের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা দেখতে পাচ্ছেন বলে সরব হয়েছেন।

বোম্বে হাইকোর্ট-এর নাগপুর বেঞ্চ ১৪ অক্টোবর, ২০২২, শুক্রবার এই মামলার শুনানি শেষে রায়দান করে বলে যে দেশের আইন মতে এই মামলা চালানোর জন্য যে যে আইনগত পদ্ধতি গ্রহণ করা অভিযোগকারী সরকারের পক্ষ থেকে আবশ্যিক ছিল, সেই পদ্ধতির মৌলিক বিষয়গুলিই এই মামলার ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি। অতএব, অধ্যাপক সাইবাবা-র বিরুদ্ধে “মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ”-এর যে অভিযোগ এনে মামলা করা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে সেই সব অভিযোগ এই কোর্ট খারিজ করছে, আদালতের ভাষায় মামলাটি “null and void”। পাশাপাশি বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চ অধ্যাপক সাইবাবা-কে অভিযোগ থেকে মুক্তি (discharged) দিয়ে তাঁকে তৎক্ষণাৎ মুক্তি দেওয়ার আদেশ জারি করে (ordered his immediate release)।

বোম্বে হাইকোর্ট-এর এই রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগকারে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি কোর্ট ছুটির দিনে, শনিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২২ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট-এ এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করে (অনেকের মতে ছুটির দিনে এই মামলার শুনানি-র জন্য ভারতের মাননীয় মুখ্য ন্যায়াধীশ মহাশয়ের যে আবশ্যিক অনুমতি লাগে, সেই অনুমতি গ্রহণে যথাযোগ্য আইনগত ও সাংবিধানিক পদ্ধতি পালিত হয়েছে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ আছে, কেননা এই নিয়ে প্রশ্ন ওঠা সত্ত্বেও সাইবাবা-র বিরুদ্ধে অভিযোগকারী কোনও পক্ষই এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব আজও দেয়নি)। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ছুটির দিন, শনিবারে এই মামলার শুনানির জন্য একটি বিশেষ আদালত বসায় এবং সেই আদালত তাঁর রায়ে বোম্বে হাইকোর্ট সাইবাবা ও অন্যান্যদের মুক্তির যে আদেশ দিয়েছিল তা খারিজ করে দিয়ে তাঁদের আবার কারগারে ফেরত পাঠায়। এই রায়ে এক স্থানে স্পষ্ট ভাষায় বলা আছে যে বোম্বে হাইকোর্ট এই মামলা বিচারের সময় অভিযোগ দায়ের করার ক্ষেত্রে কী কী গুরুতর আইনগত ফাঁক রয়েছে, শুধু সেই বিষয়গুলির ওপর বেশি জোর দিয়েছে, এই মামলার “রাষ্ট্রদ্রোহিতা”-র মতো গুরুতর বিষয়কে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেয়নি, অতএব হাইকোর্ট-এর রায় রূপায়ণ স্থগিত (suspended)। সুপ্রিম কোর্ট আবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাইবাবা ও তাঁর সহ-অভিযুক্তদের ৮ ডিসেম্বর শুনানির জন্য হাজির থাকতে বলেছেন।

দেশের নানা প্রান্তের নাগরিকবৃন্দ, যাঁরা কোনও মতেই “দেশদ্রোহী”-র বর্গভুক্ত নন, তাঁরা প্রকাশ্যেই এই মামলার বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, জানতে চাইছেন বিচারপ্রক্রিয়ার যে সব খামতিকে সামনে এনে বোম্বে হাইকোর্ট-এর এই মুক্তির আদেশ, সেই খামতি সত্ত্বেও কেন সাজা দেওয়া যুক্তিযুক্ত বলে সুপ্রিম কোর্ট মনে করছে।

অক্টোবর ২২, ২০২২ কলকাতার টেলিগ্রাফ ইংরাজি দৈনিক সংবাদপত্রে, বিশাখাপত্তনম, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে কে নেহরু পটনায়েক নামে একজন ভারতীয় নাগরিক সম্পাদকের প্রতি চিঠি লিখে জানিয়েছেন, সাইবাবা ও অন্যান্যদের মুক্তির আদেশ হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের পুনর্বার জেলে পাঠানো নিশ্চয়ই তাঁদের পরিবাদের কাছে এক বিরাট ধাক্কা। তাঁর প্রশ্ন, তাহলে কীভাবে শ্রীমতী প্রজ্ঞা ঠাকুর ও ভারতীয় জনতা পার্টির বিভিন্ন সাংসদ ও বিধায়করা চিকিৎসার জন্য জামিন পাচ্ছেন ও তা উপভোগ করছেন? চিকিৎসার কারণে জামিন নিয়ে প্রজ্ঞা ঠাকুরকে এমনকি ক্রিকেট খেলতে দেখা যাচ্ছে? তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই অধ্যাপক সাইবাবা-র মতো, এমনকি কয়েকজনের ক্ষেত্রে সেই একই ধারায় অভিযোগ রয়েছে, অথচ তাঁরা মুক্ত এবং সাইবাবাকে চিকিৎসার খাতিরে জামিন নাকচ করা হচ্ছে? সাইবাবা-র স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি কি চিকিৎসার জন্য জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কারণ বলে বিবেচিত হবে না? (Sir, The stay on G N Saibaba’s acquittal must have come as a big jolt for his family and well-wishers. How, then did Pragya Singh Thakur, a member of Parliament from Bharatiye Janata Party, get bail on medical grounds in spite of facing charges under the Unlawful Activities (Prevention) Act, after which she was seen playing cricket and dancing? Why was Saibaba’s ill health not enough to grant him relief? K Nehru Patnaik, Visakhapatnam, The Telegraph, 22.10.2022)

নিপাট গান্ধিবাদী, অহিংসার পূজারী, আজীবন গান্ধি-নির্দেশিত পথে, ভারতে “মাওবাদী কার্যকলাপ”-এর আবির্ভাবের বহুকাল আগেই শ্রী হিমাংশু কুমার মহাশয় সস্ত্রীক বস্তারের জঙ্গলে কুঁড়েঘরে আজীবন রয়ে গেছেন। ভারত রাষ্ট্র তাঁকেও নানান হিংসাত্মক ঘটনার কুশীলব বা ব্রেন বিহাইন্ড দ্য ম্যাসাকারস বলে হাজতে পাঠায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলি দায়ের করার ক্ষেত্রে যতটা প্রতিহিংসার ফোড়ন ছিল, তার সামান্য অংশও আইনি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। সরকারের আর্থিক দুর্নীতি এবং সরকারি আধিকারিকদের দলিত আদিবাসীদের ওপর বেআইনি ও বেপরোয়া অত্যাচারের কাহিনি বেপর্দা করাই ছিল তাঁর প্রধান “অপরাধ”। অনেক টালবাহানার পর তিনি আপাতত কারাগারের বাইরে। সাইবাবা ও অন্যান্যদের ক্ষেত্রে বর্তমান রায়ের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য ন্যায়াধীশের উদ্দেশে তিনি হিন্দি ভাষায় সম্প্রতি যে খোলা চিঠি লিখেছেন (১৬ অক্টোবর, ২০২২), সেই চিঠির একাংশের বাংলা অনুবাদ এইরকম:

জজসাহেব,

আমি আপনাকে এই খোলা চিঠি লিখছি কারণ আমি চাই দেশের মানুষও এই চিঠি পড়ুক। আমার বাবা-মা এবং জ্যেঠামশাই এই দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন, তাদের প্রজন্মের লাখো মানুষ যেমন লড়াই করেছিলেন। তাদের সকলের স্বপ্ন ছিল এমন একটি ভারত গড়ার যেখানে কারও প্রতি অন্যায় হবে না, সবার প্রতি ন্যায়বিচার হবে। আমাদের এই প্রজন্ম, পূর্বপুরুষদের ন্যায়পরায়ণ ভারত নিয়ে দেখা স্বপ্ন পথভ্রষ্ট হয়ে হারিয়ে যেতে দেখছে।

এদেশের সরকার কোনও পূর্ব আইনি পদক্ষেপ ছাড়াই মুসলমানদের বাড়িঘর বুলডোজ করে, কিন্তু কোনও আদালত এটা তার অপমান হিসেবে অনুভব করে না যে, আদালতের সিদ্ধান্ত ছাড়া সরকার কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। সরকার যদি এটা করে তাহলে তা আদালত অবমাননা। কিন্তু জজসাহেবরা কিছু মনে করেন না।

এদেশে জজ লয়াকে গুন্ডা বিজেপি নেতা, মন্ত্রী খুন করে, কিন্তু কোনও বিচারক রাগ করেন না এবং ভাবেন না যে একজন বিচারককে খুন করার পর সেই গুন্ডা জেলে না গিয়ে কীভাবে পালাল? কিন্তু একজন বিচারক সেই গুন্ডা মন্ত্রীর সঙ্গে বিচারক হত্যার প্রমাণ নষ্ট করে পরে পুরস্কার হিসেবে উচ্চ আদালতে বিচারক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

উপজাতীয় এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনি নিয়মিত উপজাতীয় নারীদের ধর্ষণ করছে, কিন্তু আদালত নির্লজ্জভাবে সেই নারীদের অভিযোগ গ্রহণ করে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে। আপনার সমর্থনে ধর্ষকরা তাদের গোঁফে তা দিয়ে নতুন নতুন নারীদের ধর্ষণ করছে। আমি উপজাতীয় শিশু, নারী ও বৃদ্ধ হত্যার ৫১৯টি মামলা আদালতে দিয়েছি কিন্তু আফসোস, আপনারা কোনও মামলায় বিচার করেননি।

ভীমা কোরেগাঁও মামলায় সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি। আর করবেই বা কী করে, গোটা মামলাই সম্পূর্ণ ভুয়া। কিন্তু আপনি এই প্রবীণ সমাজকর্মীদের জামিন দিচ্ছেন না।

জি এন সাইবাবা এবং তাঁর অন্যান্য সহযোগীদের জড়িত মামলার রায়ে বিচারক লিখেছিলেন যে তাঁদের অপরাধ এই যে এই লোকদের কারণে ভারতের উন্নয়ন থেমে যায়, তাই আমি তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিচ্ছি। আর উন্নয়নের অর্থ— আমরা সবাই জানি উপজাতীয়দের জল, জঙ্গল পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়াই আপনার চোখে উন্নয়ন।

থানার ভিতরে সোনি সোরির গোপনাঙ্গে পাথর ভরা হয়েছিল। মেডিকেল কলেজে তার শরীর থেকে বের করা পাথরগুলো আপনার টেবিলে রাখা হয়েছিল, কিন্তু এগারো বছর পর আপনি ন্যায়বিচারে হোঁচট খেয়ে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

আপনি বিলকিস বানর ধর্ষক এবং তার মেয়ের খুনিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য গুজরাট সরকারের অমানবিক সিদ্ধান্তকে ন্যায্যতা দিয়েছেন। দুঃখিত, আপনি আদালতকে ন্যায়বিচার নয়, অন্যায়ের জায়গায় পরিণত করেছেন।

লক্ষ লক্ষ মানুষ এই বিশ্বাসে জাতি হিসাবে একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের প্রতি কোনও অবিচার করা হবে না। কিন্তু আপনি তাদের সমর্থন করছেন যারা প্রতিদিন অন্যায় করে এবং যারা বিচার চায় তাদেরই অপরাধী ঘোষণা করা হচ্ছে।

জজসাহেব, আপনি আদালতের অবমাননা করছেন। দুঃখিত, আপনি খুব দুর্বল এবং ভীত। সরকারকে ভয় পাওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না, কারণ সংবিধান আপনাকে সরকার থেকে ভয় মুক্ত রেখেছে।

… আপনি শুধু ন্যায়বিচারকে হত্যা করছেন না, আপনি মানবতা, গণতন্ত্রের আইন, সংবিধান সবাইকে হত্যার জন্য দায়ী।

এবং পরিশেষে আমি বলতে চাই যে আমি এই চিঠিটি আপনাকে অবমাননা করার জন্য লিখেছি কারণ যারা জনসাধারণের প্রতি অবিচার করে তাদের আমি সম্মান করতে পারি না। দয়া করে আমাকে আপনার অবমাননার জন্য কারাগারে বন্দি করার আদেশ দিন, যেখানে আপনার সহায়তায় ফাদার স্ট্যান স্বামী এবং পান্ডু নরোটেকে (সাইবাবা-র সঙ্গে অভিযুক্ত) যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল সেভাবে আমাকে হত্যা করা যেতে পারে।

আমি চাই শিশুরা অন্তত আমাকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে স্মরণ করুক, যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছে এবং মানুষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে এবং নিহত হয়েছে।

ভারতের একজন ন্যায়পরায়ণ নাগরিক
হিমাংশু কুমার

আইন ও বিচারব্যবস্থা মূলত যাদের মদত দিচ্ছে বলে হিমাংশু কুমারের অভিযোগ, তাঁর সেই অভিযোগের কি কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই? অতি সাম্প্রতিক কালের ঘটনাবলি কিন্তু হিমাংশু কুমারের বক্তব্যকেই অনেকাংশে মান্যতা দিচ্ছে। ওড়িশা বিধানসভার প্রাক্তন মন্ত্রী এবং ঐ রাজ্যের একজন বরিষ্ঠ বিজেপি নেতা শ্রী জয়নারায়ণ মিশ্র-কে ওড়িশা পুলিশ একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে। ভারতের সর্বত্র যা ঘটে, এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যথারীতি কারাগারে “অসুস্থ” হয়ে পড়েছেন, তাঁকে নিয়ে একের পর এক বড় বড় সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর গন্তব্য হয় দিল্লির অভিজাত হাসপাতাল, অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস। দিল্লির হাসপাতালে তাঁর যখন চিকিৎসা চলছে, তখন স্বাস্থ্যের কারণে ৫০ হাজার টাকা জামিনদারের নিশ্চিন্ততা সাপেক্ষে তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হয়।

উদিপি-র বিজেপি-র জেলাসচিব এ বালাচন্দ্রকে একটি হত্যার সাহায্যকারী হিসেবে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জুন ৮, ২০২১-এ। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী দেখেন যে এই বালাচন্দ্র গাড়ি চালিয়ে ইয়াদামোগি গ্রামের জনৈক উদয় কুমার গাঙ্গিয়া-কে পিষে মেরে ফেলেন। জুন ২১, ২০২২ এই বালাচন্দ্রকে ভারতে সুপ্রিম কোর্ট স্বাস্থ্যের কারণে জামিন মঞ্জুর করে।

সাইবাবা-র ক্ষেত্রে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ৪ এপ্রিল, ২০১৬ তাঁর জামিন মঞ্জুর করে। ঠিক সেই সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে এক বিরাট “সাপ্লিমেন্টরি চার্জশীট” পেশ করে ভারত ও মহারাষ্ট্র সরকার আরও নানান আজগুবি অভিযোগের তালিকা যোগ করে। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের দুই মহামান্য বিচারপতিদ্বয়, ন্যায়াধীশ জে এস খেহার এবং ন্যায়াধীশ সি নাগাপ্পন মহারাষ্ট্র সরকারকে তীব্র তিরষ্কার করে মন্তব্য করেন যে, যে পদ্ধতিতে নানান আইনি অপকৌশল ব্যবহার করে সাইবাবা-কে বন্দি করা হচ্ছে তা “extremely unfair.”

তাঁরা আরও বলেন যে অধ্যাপক সাইবাবা-কে জেলবন্দি করে রাখার কোনও আইনি কারণ নেই। তাঁদের মন্তব্য,

there was no point in keeping Saibaba, who is a wheelchair-user, in Nagpur Jail indefinitely.

এখানে তাই প্রশ্ন উঠবে আইন বনাম ন্যায় নিয়ে, সভ্যসমাজে কাকে বলব আইন আর কাকেই বা বলা হবে ন্যায়বিচার। এদিক থেকে দেখলে, আইন-প্রণালী ও বিচারব্যবস্থাকে স্থাণু, অনড় হিসেবে দেখা মোটেই আইন ও বিচারব্যবস্থার আধুনিক ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত যে সব কাজ করলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের নাগরিকদের রাষ্ট্র-বিরোধী ধারা ১২০বি মোতাবেক বিচার করতে বসত (আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা-র ধারা), যেমন তারা করেছিল বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম, আসফাকউল্লা প্রভৃতি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে, সেই ধারাগুলিই যদি রয়ে যায়, তবে পূর্বতন মামলার জের হিসেবে বর্তমান সরকারের অনেক নীতির বিরোধী মানুষরা বাঘাযতীন-ক্ষুদিরামদের মতন “শাস্তি” যে পাবেন সন্দেহ কি! এখানেই প্রশ্ন ওঠে, বিরোধ দেখা দেয় আইনব্যবস্থা ও ন্যায়নীতির মধ্যে। পরাধীন ভারতে বিদেশি শাসকের পক্ষে যা স্বাভাবিক বিচার, সেই একই আইনের ভিত্তিতে স্বাধীন ভারতে তা বিচারের নামে ভ্রষ্টাচার। মনে রাখতে হবে যে আজকে যে বা যারা শাসকের আসনে আসীন, অনতি-অতীতে তারাই ছিল সেই সময়ের সরকারের বিরোধীপক্ষে, তাই বর্তমান বিচারধারা যখন তাদের ওপর প্রযুক্ত হত, তারা তখন সেই বিচারধারাকে অন্যায় বলে চিহ্নিত করত।

আরও কথা বলার আছে। এমনকি বিদেশি শাসনকালেও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র উপায়ে বিদ্রোহ করলেও আপতকালে সেইসব নমস্য বিদ্রোহীদের সাধারণ প্যারোল এবং স্বাস্থ্য কারণে প্যারোল মিলত। অনেক কংগ্রেসি নেতা, এমনকি সুভাষচন্দ্র স্বয়ং ভারত ত্যাগের আগে এমনই স্বাস্থ্যজনিত কারণে জামিনে মুক্ত ছিলেন। এইসব দেখে সাইবাবা সম্পর্কে ভূতপূর্ব ন্যায়াধীশ লকুরের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য—

He has been in jail since May 9, 2014, that is, for more than eight years. Yet, he has not been released. Is compassion missing somewhere? Justice?

যেসব বিভিন্ন আইন প্রয়োগ করে সাইবাবা ও অন্যান্যদের আবার কারাগারে ফেরত পাঠানো হল, ভূতপূর্ব ন্যায়াধীশ লকুর সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে সেইসব আইনের অপপ্রয়োগ বলে অভিহিত করে ধৈর্যের সঙ্গে তাঁর যুক্তিগুলির বিশ্বাসযোগ্য ও ন্যায়সম্মত ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। বোম্বে হাইকোর্টের রায় যে কেবল “টেকনিক্যাল বিষয়”-এর ওপর ভিত্তি করে সাইবাবা ও অন্যান্যদের মুক্তি দিয়েছেন, এমনটা নয়; হাইকোর্টের মাননীয় ন্যায়াধীশবৃন্দ এই বিচারপদ্ধতির অসারতা এবং আইনসঙ্গত পদ্ধতির বিপরীতটাই যে ঘটেছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। ন্যায়াধীশ লকুর-ও দেখিয়েছেন যে সাইবাবা ও অন্যান্যদের মামলায় Terrorist and Disruptive Activities Act বা (TADA)-র ২০-এ(২) ধারাটি, যা এই আইনমতে কোনও মামলা শুরু করার পূর্বশর্ত নির্ধারণ করেছে, সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, “No court shall take cognizance of any offence under this Act without the previous sanction of the Inspector- General of Police, or as the case may be, the Commissioner of Police.”  

এই ধারার একটি এবং কেবলমাত্র একটিই অর্থ হয়— এই আইনমতে মামলা শুরু করতে গেলে সেই মর্মে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মামলা শুরুর আগেই অনুমতি নিতে হবে, মামলা শুরু করার পরে নয়! কিন্তু এই হবুচন্দ্র রাজার দেশে যে একুশে আইনমতে বিচারব্যবস্থাকে চালনার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, সেখানে এই মামলা শুরু করার পর, সাক্ষীদের জেরা করা পর এবং প্রাথমিক চার্জশিট দেওয়ার পর এই অনুমতি নেওয়া হয়েছে। এই পদ্ধতি কি ভারতীয় আইন ও বিচারব্যবস্থাসম্মত? এই বিষয়ে ভারতীয় সাধারণ নাগরিকরা কী ভাবছেন তা নিয়ে না মাননীয় ন্যায়াধীশবৃন্দ, না সরকার, কেউই ভাবিত বলে মনে হয় না!

২০১৫ সালে একটি সেশন কোর্ট সাইবাবা ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করে। পুলিশের দায়ের করা অভিযোগগুলি এবং সেই অভিযোগের মান্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য পেশ করা দলিল-দস্তাবেজ দেখে এবং প্রাথমিক জেরার ভিত্তিতে সেই কোর্ট সাইবাবা ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে এই মামলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও তথ্যের অভাবে মামলাটি খারিজ করে। সরকারপক্ষ তখন দ্রুততার সঙ্গে একটি অতিরিক্ত চার্জশিট দিয়ে সেই অভিযোগের ভিত্তিতে সাইবাবা ও অন্যান্যদের কারাবাস চালিয়ে যাওয়ার সপক্ষে যুক্তি দেয় এবং আদালত তা গ্রহণ করে সাইবাবা ও অন্যান্যদের কারাবাসের মেয়াদ বৃদ্ধি করে।

সাইবাবা ২০১৪ সালেই জামিনের আবেদন করেন। এই আবেদনের পেছনে মূল যুক্তি ছিল যে টাডা আইনে বিচার শুরু করার আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে অনুমতি নেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা আইনে নির্দিষ্ট করা আছে, এক্ষেত্রে সেই শর্ত পূরণ করা হয়নি। বস্তুত সেই অনুমতি আসে বিচার শুরু হওয়ার বেশ কিছু মাস পরে, ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল। অন্য একটি ক্ষেত্রে পুলিশ একটি অনুমতি পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কোর্টের রেকর্ড বলছে যে সেই অনুমতির সঙ্গে সাইবাবা-র মামলার কোনও সম্পর্কই ছিল না। কিন্তু সাইবাবা-র জামিন অগ্রাহ্য করার ক্ষেত্রে এই অনুমতিটি দেখিয়েই তা করা হয়, যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় ‘ipso facto bad in law’।

সাইবাবার সঙ্গে অন্যান্য যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাঁরা জামিন পেয়েছেন, কিন্তু সাইবাবার বিরুদ্ধে যেভাবে মামলা পরিচালনা করে তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করা হচ্ছে, তা ন্যায়াধীশ লকুর-এর মতে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে নজিরবিহীন ঘটনা। এমন অনেক নজিরবিহীন ঘটনার সমাহারে অধ্যাপক সাইবাবা আজও কারাগারে, যেখানে প্রমাণিত তথ্য হল যে তিনি ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী, অন্যের সাহায্য ছাড়া তাঁর দৈনিক আবশ্যিক কাজকর্ম নির্বাহই করা সম্ভব নয়, সেখানে তিনি প্রতিবন্ধী হওয়ার জন্য যেসব সাংবিধানিক সুবিধা পাওয়ার অধিকারী, তিনি সেগুলি থেকেও বঞ্চিত। আমাদের বিচারব্যবস্থার মূল সুর হল কারাগার আসলে সংশোধনাগার, সেখানে একজন ব্যক্তি সামাজিক নাগরিকের সমতুল্য। হায় আমাদের সংবিধান, হায় আমাদের নাগরিকদের অধিকারের পক্ষে নেতাদের আবেগমথিত বিবৃতির ফুলঝুরি! সুপ্রিম কোর্টের এক প্রাক্তন ন্যায়াধীশ, ভি কে কৃষ্ণ আয়ার বলেছিলেন, একটি দেশের কারাগারে বন্দিদের প্রতি কী আচরণ করা হচ্ছে, তাই দেখে সেই দেশের সভ্যতার মান নির্ধারণ করা সম্ভব। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বিচারকে ঘিরে এতজন প্রতিষ্ঠিত ও অভিজ্ঞ ন্যায়াধীশরাই যেখানে খামতি দেখছেন, সেখানে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলবেনই এবং একটি গণতান্ত্রিক দেশে সেইটিই সবচেয়ে অভিপ্রেত ও নৈতিকতা-সম্মত কাজ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...