উঠ গো ভারতলক্ষ্মী

শঙ্কর রায়

 



সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

পাঁচ সপ্তাহ পেরিয়ে অক্টোবরের মাঝামাঝি যখন রাহুল গান্ধির নেতৃত্বে ভারত জোড়ো যাত্রা কর্নাটক রাজ্যের বেলারি স্পর্শ করে এক হাজার মাইল পদচিহ্ন এঁকে দিল, সেদিন যে শুধুমাত্র পদযাত্রার রেকর্ড গড়ল তা নয়, ‘চার শব্দের স্লোগান ‘নফরৎ ছোড়ো/ভারত জোড়ো’ বা ‘মিলি কদম/জোড়ি ওয়াতন’ যে লাখ লাখ মানুষের চিত্তে এক নব আশাবরী রাগে ঝঙ্কৃত হয়ে উঠবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক/কলমচিদের অনেকে তাতে বিস্মিত হয়েছিলেন।’ তাঁরা ভেবেছিলেন নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে আট বছরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উপর্যুপরি নির্বাচনী বিপর্যয়ের কারণ যখন রাহুল গান্ধির ওপর নির্ভর করা, তাঁর নেতৃত্বে ভারত পদযাত্রাও তখন আরেক ভরাডুবি ঘটাবে। মহাত্মা গান্ধি ১৯৩০-এর মার্চ মাসে ৭৮ জন সত্যাগ্রহী নিয়ে ২৪ দিন ব্যাপী পদব্রজে ৩৮৯ কিলোমিটার পেরিয়ে সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি (নভসারি)-তে থেমে সারা দুনিয়ায় চমক লাগিয়ে দেখিয়েছিলেন দমনপীড়নে বর্বরতাসর্বস্ব ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা সাময়িকভাবে হলেও অহিংস প্রতিবাদের সমুখে স্তব্ধ হতে পারে। সেটা ছিল এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। এই ভারত জোড়ো পদযাত্রাও হতাশাগ্রস্ত অসংখ্য কংগ্রেসি ও কংগ্রেস-অনুগামী মানুষের কাছে এক আশাজাগানিয়া কর্মসূচি।

অসুস্থতা সত্ত্বেও সোনিয়া গান্ধির সেই অভিযানে সামিল হওয়া উৎসাহিত করেছে সাম্প্রদায়িক বিভেদকামী ফ্যাসিবাদী শক্তিবিরোধী নিযুত নিযুত প্রতিবাদী জনতাকে। ভারতের প্রাক্তন নৌসেনা প্রধান অ্যাডমিরাল লক্ষ্মীনারায়ন রামদাস স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রাহুল গান্ধিকে চিঠি লিখে ভারত জোড়ো যাত্রা উদ্যোগকে পূর্ণ সমর্থন করে লিখেছেন, ’The current initiative of Bharat Jodo Yatra is very timely and needed. Hopefully all will join hands across party affiliations and reach out with all important message to say NO to hate and YES to love, peace and fraternity.” নব্বই-স্পর্শ করা শান্তি ও প্রগতিবাদের প্রহরী এবং শান্তির জন্য ম্যাগসেসে পুরস্কার-ভূষিত ভারতের একদা শীর্ষতম যুদ্ধনায়ক আরও লিখেছেন শারীরিকভাবে সক্ষম হলে তিনি রাহুল গান্ধির পাশে হাঁটতেন ও অনেক প্রবীণ মানুষজনকে সামিল হতে উদ্বুদ্ধ করতেন।

শত শত পদযাত্রী সহ রাহুল যেদিন ব্যাঙ্গালোরে পৌঁছেছিলেন, পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন শহীদ গৌরী লঙ্কেশের পরিবারের সদস্যদের অনেকে ও বন্ধুরা। নির্ভয়া সাংবাদিক গৌরীকে সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে ও বিজেপি কুশাসনের অন্তর্তদন্তমূলক প্রতিবেদন পেশ করার জন্য সঙ্ঘ পরিবার-আশ্রিত কাপুরুষ গুন্ডারা খুন করেছিল। পদযাত্রা ৭ সেপ্টেম্বর কন্যাকুমারিকা থেকে শুরু হতেই ভারতীয় জনতা পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীদের অনেকে বিদ্রূপ করেছিলেন রাহুল গান্ধিকে, কেঊ কেউ ‘দিশাহীন’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আর তাদের সুরেই সূর মিলিয়ে সংবাদমাধ্যমের অনেক পণ্ডিত ও পণ্ডিতমন্যরা নাক সিঁটকেছিলেন।

প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পাঁচ মাস পরে কাশ্মিরে গিয়ে শেষ হবে ভারত যাত্রা  কর্মসূচি যাতে কংগ্রেস ছাড়াও প্রায় দেড়শো সংগঠন যোগ দিয়েছে, যারা কোনও রাজনৈতিক দলের অঙ্গুলিহেলনে চলে না। শীতাতপ নিয়ন্তিত ঘরে বসে ডেস্কটপে বা ল্যাপটপে বসে কয়েক হাজার মাইল দূরে ভারত জোড়ো যাত্রায় সামিল হওয়া হাজার হাজার মানুষের মনের কম্পন রেখচিত্র দেখা যায় না, তা সবজান্তা ও নাক উঁচু বুদ্ধিজীবীদের মাথায় ঢোকেনি।

কংগ্রেস কীভাবে নিজেদের সাংগঠনিকভাবে সংহত ও পুনরুজ্জীবিত করবে, সেটা কংগ্রেসের নিজেদের ব্যাপার। তারা এসব নিয়ে ভাববে, পল্লবগ্রাহী উত্তর-সম্পাদকীয়-লিখিয়েরা নয়। কংগ্রেসের কী করা উচিত, কী করা উচিত নয় বা রাহুল গান্ধিকে দিয়ে হবে না, তা বাইরে থেকে ঠিক করা যায় না। মাথায় শুধুমাত্র কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি-নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে সরানোর ভাবনার সঙ্গে ভারত জোড়ো অভিযানের অন্বয় আবিষ্কার গজদন্তমিনারনিবাসী বিলাস। এসব যাঁরা ভাবছেন বা লিখছেন, তাঁদের উদ্বেগ বাস্তবিক। কিন্তু তাঁরা কংগ্রেসের নিচের তলার খবর রাখেন না। ভারত জোড়ো যাত্রায় বিপুল সাড়া সেই উপলব্ধির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে।

যাঁরা লড়াইয়ের মাঠে আছেন, তাঁরা কিন্তু ভারত জোড়ো যাত্রার নিরীক্ষায় আশান্বিত হয়েছিলেন। দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবে অনুষ্ঠিত গত ২২ আগস্টের এক সভায় এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় প্রাগুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অধিকাংশই। সংখ্যায় তারা দেড়শতাধিক। সেই সভার উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন মেধা পাটকর, অরুণা রায়, যোগেন্দ্র যাদব প্রভৃতি সুশীল সমাজের নেতৃস্থানীয় সংগ্রামীরা যাঁরা সারা বছর মাঠে নেমে মানুষের পাশে মানুষের অধিকারের সপক্ষে সোচ্চার হন। নাক সিঁটকানো জনবিচ্ছিন্ন কলমচিরা রাহুল গান্ধির উদ্ভিদ্যমান রাজনৈতিক সচেতনতা (যা নানা নিরীক্ষা, ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে) অনুধাবন করতে পারেননি। কনস্টিটিউশন ক্লাবে অনুষ্ঠিত সভায় যে পরাধীন ভারতের কংগ্রেসের চরিত্র কিছূটা হলেও ফিরে পাওয়ার সঙ্কেত (কংগ্রেস রাজনৈতিক দলের চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক মঞ্চ) পাওয়া গেল, এটা তাঁদের মাথায় আসেনি। যখন দেখেছেন একদিকে যেমন রাহুল গান্ধি হাঁটছেন, মানুষের মধ্যে যাওয়ার চেষ্টা করছেন— যাচ্ছেনও— অন্য পাশে পাশাপাশি চলেছেন যোগেন্দ্র যাদব ও কানহাইয়া কুমার, তাঁদের অনেকের হুঁশ হয়েছে, এটাই আশার কথা।

এই পদযাত্রা নিঃসংশয়ে ইতিবাচক। এর সফল রূপায়ণ কংগ্রেসের মরা গাঙে বান ডাকতে পারে। প্রবীণ কংগ্রেসিরা আশান্বিত যে এই যাত্রার মধ্যে দিয়ে নিচের তলার কর্মীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন আবার। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত ১৩৭ বছরের পার্টি চাঙ্গা হয়ে উঠবে, এই আশায় নবীন-প্রবীণ সবাই উজ্জীবিত। বাস্তবে কী হবে তা আগে থেকে জ্যোতিষীর মত ভবিষ্যদ্বাণী করা হাস্যকর। নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এই পদযাত্রার ভাবনা, এটা ভাবা ঠিক নয়।

ভারত জোড়ো অভিযান সঙ্ঘ পরিবারের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ছড়ানোর চক্রান্তর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সোচ্চারতা। এই সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা ভারতকে বিভেদের বিষে অশান্ত, অগ্রগতিবিহীন এক অন্ধকার সড়কে ঠেলে দিতে চায় যার প্রধান মদতদাতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্‌ আর গোটা ভারতীয় জনতা পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। মোদি সরকারের সর্বনাশা ও ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট (আদানি-আম্বানি) পদলেহী অর্থনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার পদযাত্রীরা, যে নীতিগুলির জন্য সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে-পড়া কোটি কোটি মানুষ বিপন্ন। এই পদযাত্রায় সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দু রাষ্ট্র আওয়াজ অন্তরালে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ-সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার মদত জোগাচ্ছে, জোগাবে।

কংগ্রেসের শক্তিবৃদ্ধি কি সত্যিই দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক হবে? এ প্রশ্ন মৌলিকভাবে জরুরি, কিন্তু এখন লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্রের শকটকে শুধু রোখা নয়, ভেঙে চূর্ণ করাও। সেই সঙ্কল্প রূপায়ণের ভিত গড়বে এই কর্মসূচি, সেই প্রত্যাশা কোটি কোটি মানুষের। তাছাড়া এই মুহূর্তে দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার্থে মোদি-শাহর ফ্যাসিবাদী সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর বিকল্প কিছু নেই। তার জন্য সমস্ত বিরোধীপক্ষকে একটা জায়গায় আসতেই হবে। এই পদযাত্রা সেই সম্ভাবনাকে সবল করবে।

ভারত জোড়ো অভিযানের মাঝেই ১৭ অক্টোবর কংগ্রেসের সভাপতি পদে মল্লিকার্জুন খার্গের বিপুল ভোটে জয়লাভ ১৪ দশক-জিইয়ে থাকা একটি দলের পক্ষে এক উল্লেখজনক ঘটনা। অনেকদিন পরে খোলাখুলি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হল এবং স্বাভাবিক ও সুষ্ঠূভাবেই (যদিও পরাজিত ডঃ শশী থারুর মৃদুভাবে কারচুপির অভিযোগ করেছেন, জলঘোলা করেননি)। খার্গে সম্পর্কে বিজেপি কুৎসাত্মক প্রচার করেছে, যা দেশের বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সবচেয়ে বিক্রীত দৈনিকে বেরিয়েছে— বিজেপির হ্যান্ড আউট থেকে উৎকলিত। এতে কংগ্রেসের সদস্য ভোটারেরা প্রভাবিত হননি। খোলাখুলি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সভাপতি নির্বাচন কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ শক্তি সংহতকরণে সহায়ক হবে, এমন আশা করা যায়।

এই প্তথম এক কংগ্রেসি নেতা সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন, যাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক হিসেবে আর যিনি দলিত পরিবারে জন্মেছেন। পরাজিত ডঃ শশী থারুর কংগ্রেসকে চাঙ্গা করতে অশীতিপর নবনির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করবেন। ডঃ থারুর এক অসাধারণ সাংসদ, সুপণ্ডিত ও সুবক্তা। লোকসভায় তাঁর মতো বাগ্মী এখন কেউ নেই, এটা অনেকেই মনে করেন। অন্যদিকে খাড়্গে হিন্দি, ইংরেজি ও একাধিক দক্ষিণভারতীয় ভাষায় ভাষণ দিতে পারেন, থারুরের মতো তিনি বোধিচিত্ত না হলেও তাঁর ভাষা আপামর মানুষের ভাষা।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...