লন্ডনের চিঠি: বড়দিনে যিশুর খোঁজে

লন্ডনের চিঠি: বড়দিনে যিশুর খোঁজে | প্রবীর মুখোপাধ্যায়

প্রবীর মুখোপাধ্যায়

 

আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে আর যাই হোক না কেন নাতি-নাতনিকে নিরাশ করার অধিকার থাকে না। আমাদের জানা ছিল না, কিন্তু আমাদের দুই নাতি-নাতনির জানা ছিল যে আমরা, অর্থাৎ ওদের দাদু-দিদা, বড়দিনের সময়ে ওদের সঙ্গে থাকব আর ওরা আমাদের সব উৎসব ঘুরিয়ে দেখাবে। গত ইস্টারে আমরা না কি এই কথা ওদের দিয়েছিলাম। অতএব কী আর করা যাবে। এই প্রবল শীতে গাবদা গোবদা কাপড়জামা নিয়ে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আমরা স্বামী-স্ত্রী হাজির হলাম লন্ডনে।

ছেলের কর্মসূত্র হওয়ার সুবাদে আর নাতি-নাতনির আকর্ষণে বিগত বছর দশেক ধরে অনেকবারই লন্ডনে এসেছি। আর সে কারণেই এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে আমরা বেশ পরিচিত আর এর খামখেয়ালিপনা সম্বন্ধে মোটামুটি অবহিত— এই রোদ্দুর, এই বৃষ্টি। জুলাই-আগস্ট এই মাস দুয়েক ছাড়া ঠান্ডাটা সব সময়েই থাকে। ডিসেম্বর মাসে কখনও আসিনি— শুনেছিলাম প্রচন্ড ঠান্ডা, ঝোড়ো হাওয়া আর মাত্র ঘন্টাচারেকের দিনের আলোর কথা। কিন্তু আগেই বললাম না, এই বয়সে এসে নাতি-নাতনির আদেশ অমান্য করার অধিকার আর থাকে না— তাই এবারে আসতেই হল।

আমাদের জামাকাপড় দেখে দমদমে অনেকেই মুচকি হেসেছিলেন হয়ত। কিন্তু গ্যাটউইক এয়ারপোর্টে যখন নামলাম তখন সব রাস্তা বরফে ঢাকা। বাড়িতে পৌঁছে পা পিছলে না যায় এমন খুব সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে যখন ভেতরে ঢুকলাম তখন মালুম হতে শুরু করেছে ঠান্ডা কাকে বলে! পরের দিন সকালে বাড়ির বাগান থেকে শুরু করে চারদিক সাদা বরফের চাদরে ঢাকা। দুদিন পরে বরফ গলে বেরিয়ে এল বাগানের ঘাসের সবুজ রং। আমাদেরও শরীর পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে একটু মানিয়ে নিয়েছে। পরের দিন সকালে ঝকঝকে রোদ্দুর, তা বলে ঠান্ডার কমতি নেই। যাওয়ার কথা হাইড পার্কের উইন্টার ওয়ান্ডারল্যান্ডে। এর কথা আগে শুনেছি অনেকবার, কিন্তু বড়দিনের সময়ে আগে কখনও আসিনি বলে ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি।

এই প্রসঙ্গে একটা কথা আগেভাগে বলে নিই। বড়দিন আমাদের ছোটবেলা থেকেই উৎসবের সময়। সার্কাস দেখা, কেক-পেস্ট্রি খাওয়া, চিড়িয়াখানা জাদুঘর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে বেড়াতে যাওয়া, পিকনিক করতে যাওয়া এ সবই এই সময়ের। বড়দিন যে যিশু-র জন্মদিন এটাও জানা ছিল। কিন্তু আমাদের বড়দিনের সঙ্গে যিশু-র জন্মদিনের বিশেষ কোনও সম্পর্ক ছিল না। এই যোগাযোগ হল যখন ক্লাস নাইনে স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হলাম। স্কুলে বাইবেলের ক্লাস হত, এই বিষয়ে পরীক্ষা-ও হত। ছাত্ররা যাতে পরীক্ষা এড়িয়ে যেতে না পারে সেইজন্য হাফ পেপার ভূগোল পরীক্ষা শেষ হলে পরীক্ষা হল থেকে বেরোতে না দিয়ে স্ক্রিপচার পরীক্ষা হত। স্কুলের পুরনো ছাত্ররা নানা মজার কথা খাতায় লিখত, আর তার জন্য শাস্তিও পেত। যেমন যীশু পরম দয়ালু,/তাঁহার দয়ায় দাড়ি গজায়/শীতকালে খায় শাঁখালু— এইসব আর কি! বিষয়টা একেবারে নতুন বলে আমি খুব আগ্রহ নিয়ে স্ক্রিপচার ক্লাস করতাম, এমন কি সোমবার স্কুল শুরুর আগে স্কুলের চ্যাপেলে প্রেয়ারে, যেখানে খ্রিস্টান ছাত্রদের যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক, সেখানেও বিশেষ অনুমতি নিয়ে যোগ দিতাম। যিশুর সঙ্গে এই আমার যোগাযোগের শুরু। কিন্তু স্কুল ফাইন্যাল পাশ করে কলেজে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে এই যোগাযোগ হল ছিন্ন। পরবর্তী সময়ে অন্য অনেক ধর্মস্থানের মতো বিভিন্ন গির্জাতেও বেড়াতে গেছি। এমনকি এই করোনা অতিমারির আগেই ব্যান্ডেল চার্চে বড়দিনের মিড-নাইট ম্যাস অনুষ্ঠানে গেছি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনায়।

ফিরে আসি এখনকার প্রসঙ্গে। ২০২০ সালে ব্যবস্থা হয়েছিল ইস্টারের সময়ে রোমে বেড়াতে যাব নাতি-নাতনির সঙ্গে। কিন্তু কলকাতা থেকে যেদিন রোম রওনা হবার কথা তার ঠিক আগের দিন মধ্যরাত থেকে করোনা অতিমারির কারণে ঘোষণা হয়ে গেল লক-ডাউন। যিশুর অনুগামীদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রচেষ্টা তখনকার মত গেল ভেস্তে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে লেগে গেল দুবছর। ২০২২-এর ইস্টারে সেই রোম আর ভ্যাটিক্যান ইত্যাদি ভ্রমণ করা গেল, কিন্তু সঙ্গে নাতি-নাতনি দুজন থাকতে পারল না যেহেতু ওদের তখন স্কুল খোলা। তাই এবার ওরা মতলব করেছিল, বড়দিনে আমাদের নিয়ে বেড়াবে আর উৎসব দেখাবে।

মনের কোণে সুপ্ত আশা ছিল ইংল্যান্ডের লোকেরা বড়দিন আর যিশুকে কীভাবে মেলায় সেটা দেখতে পাব। এয়ারপোর্ট থেকে আসার সময়ে-ই দেখেছি বিভিন্ন লোকালয়ে রাস্তার ওপর সুন্দরভাবে আলো দিয়ে সান্টা ক্লজ, রেন ডিয়ার বা স্লেজ গাড়ি তৈরি করা হয়েছে। রুচিশীলতার একটা সুন্দর মাত্রাবোধ আছে, তাই কোথাওই বাহুল্য বা বাড়াবাড়ি নেই, সবের মধ্যেই একটা স্নিগ্ধতা। কিন্তু আশ্চর্য, যিশু এবং ক্রুশচিহ্ণ খুঁজে পাইনি।

হাইড পার্কের উইন্টার ওয়ান্ডারল্যান্ড এক বিশাল এলাকা জুড়ে, নানা ধরনের ‘রাইডস’, ভুতুড়ে বাড়ি, খাবারের দোকান এসবের ছড়াছড়ি। একেবারে ছোট বাচ্চা থেকে বুড়ো অবধি সকলের মনোরঞ্জনের অবাধ ব্যবস্থা। মানুষজনের ভিড়ে ভিড়াক্কার, এমনকি অনেকেই নিজের পোষ্য কুকুরটিকেও নিয়ে এসেছে মেলায়। এত ভিড়ের মধ্যেও কিন্তু ধাক্কাধাক্কি নেই, সবাই অন্যকে পথ ছেড়ে দেয়, অদ্ভুত এক সামাজিক শৃঙ্খলা। নাতি-নাতনির সঙ্গে নানা ‘রাইড’-এ চড়ার অনেক আবদার সাবধানে এড়িয়ে শেষ অবধি বিরাট নাগরদোলায় চড়তেই হল। আনন্দমেলায় দাদু-দিদা-কে নিয়ে এসে এদের যে কী আনন্দ! বড় বড় আলোর মালায় ঝলমল করছে মেলাপ্রাঙ্গণ, নানা রঙের আলোর খেলা, সব মিলিয়ে জমজমাট এক বিরাট অঞ্চল। কিন্তু এতবড় বড়দিনের মেলাতেও আমি যাকে খুঁজছি সেই যিশুর দেখা নাই রে, যিশুর দেখা নাই!

 

পরের গন্তব্য হিভার ক্যাসেল— রাজা অষ্টম হেনরির রাজপ্রাসাদ। এই রাজা ছিলেন টিউডর রানি এলিজাবেথ-এর পিতা। বড়দিন উপলক্ষে এই ক্যাসেলকে, এর পাশের বাগানকে, পাশের বনাঞ্চলকে আর নদীকে আলো দিয়ে সাজানো হয়। দূরদূরান্ত থেকে লোকেরা দেখতে আসে। এখানেও ছোটদের জন্য কিছু রাইড, মেরি-গো-রাউন্ড এসবের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মূল আকর্ষণ ক্যাসেলের ভেতরে যাওয়া আর বাইরের আলোকসজ্জা। ‘হেরিটেজ’-এর প্রাচীন বৈশিষ্ট্য কীভাবে বজায় রাখতে হয় তা এদেশের লোকেরা জানে। সেইজন্য এইসব জায়গা অনন্য হয়ে থাকে। তেমন-ই অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম। অন্ধকারের মধ্যে বনের স্বল্পালোকিত রাস্তায় শিশুদের সঙ্গে হেঁটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা আগে ছিল না, এবারে হল। কিন্তু না, এখানেও খুঁজে পেলাম না যিশু-কে আর ক্রুশচিহ্ণ-কে।

বড়দিনে পারিবারিক ভোজ, পরের ‘বক্সিং ডে’-তে আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে ভোজ সব হল। এবার গেলাম ‘মিডল টেম্পল’-এ ‘ক্রিসমাস ক্যারল’ দেখতে। ১৮৪৩-এ লেখা চার্লস ডিকেন্সের এই নাটক গত দশ বছর ধরে মিডল টেম্পল-এ অভিনীত হয়ে চলেছে বড়দিন উপলক্ষে। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। কিন্তু এখানেও যিশুর দেখা নাই রে, যিশুর দেখা নাই।

এখন অবধি এই বড়দিনে দেখলাম প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও কী সুন্দরভাবে সপরিবার সবান্ধব এই উৎসব অতিবাহিত করছে সকলে। মানুষের ভিড় আছে, গুঁতোগুঁতি ধাক্কাধাক্কি নেই, গাঁক গাঁক করে মাইক বাজানো নেই, উৎকট কিছু দেখানোর নেই।

হ্যাঁ, আরেকটা দিকও দেখেছি। রেলপথে স্ট্রাইক চলেছে মাঝেমধ্যেই, এমনকি ব্রিটিশ ইতিহাসে সর্বপ্রথম নার্সরা এবং অ্যাম্বুলেন্স চালকেরা আন্দোলন করছেন, পোস্ট অফিসেও কর্মবিরতি করছেন অনেক কর্মচারী। বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও সীমানায় যারা দেশে প্রবেশকারীদর কাগজপত্র পরীক্ষা করে সেই বর্ডার ফোর্সের কর্মচারীরাও আন্দোলন করছে। তাই পুলিশ আর সেনাবাহিনির লোক এনে সেই কাজ করাতে হচ্ছে। এসবেরই কারণ মুদ্রাস্ফীতি। কিন্তু পুলিশ দিয়ে, লাঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে, গ্রেপ্তার করে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা হচ্ছে না— বিভিন্ন স্তরে আলোচনা চালানো হচ্ছে।

সব মিলিয়ে এখন অবধি যিশুর দেখা না পেলেও বড়দিন ভালই কাটছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4658 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...