বিলকিস বানো এবং ভারতের আবেগ-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা

তানিয়া লস্কর

 



প্রাবন্ধিক, পেশায় আইনজীবী

 

 

 

 

ট্রমা-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে বিলকিস বানোর মামলাটিকে আর পাঁচটি লিঙ্গভিত্তিক অপরাধের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। বরং সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিস্থাপন করতে নারীদেহকে কীভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, এই মামলা তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ

 

গত ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখে ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় তাঁর কোর্টে একজন মহিলা আইনজীবীকে একটি মামলা বারবার তালিকাভুক্ত করার আর্জি করতে নিষেধ করেন। তাঁর মতে এটা বিরক্তিকর বা ‘irritating’। মামলাটি ছিল বিলকিস বানো ধর্ষণ মামলা। সাম্প্রতিককালে সারাদেশে এটি একটি চর্চিত মামলা। ২০০২ সালে গুজরাত গণহত্যার সময় বিলকিস বানোকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয় এবং তাঁর পরিবারের দুজন শিশুসহ মোট ৭ জন সদস্যকে মেরে ফেলা হয়। উল্লেখ্য যে বিলকিস তখন ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০০৮ সালে আদালত সেই মামলায় ১১ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে ও তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু গত বছর ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সেই ১১ জন অভিযুক্তের বাকি সাজা মকুব (remission) করে দিয়ে তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে বিলকিস বানোর আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টে আপিল দায়ের করেন। সেটির শুনানির জন্য দুজন বিচারপতির একটি বেঞ্চ বানিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে মাননীয়া বিচারপতি বেলা ত্রিবেদী মামলার শুনানি গ্রহণ করতে আপত্তি জানান। কারণ তিনি ২০০৪ সালে গুজরাত সরকারের আইনসচিব ছিলেন এবং এই মামলায় গুজরাত সরকার একটি পক্ষ। সুতরাং আইন মতে, তাঁর এই মানলার শুনানি গ্রহণ করা উচিত নয়। তাই এই মামলা যেন দ্রুত তালিকাভুক্ত করে আরেকবার নতুন বেঞ্চ বানিয়ে দেওয়া হয়, সেজন্যই এই আর্জি।

যাই হোক, এরপর নিয়মমাফিক সে মামলা তালিকাভুক্ত হয়, নতুন বেঞ্চ নিযুক্ত করে দেওয়া হয় এবং গত ২৭ মার্চ মাননীয় বিচারপতিদ্বয় বি ভি নাগারাত্থা এবং কে এম জোসেফ-এর বেঞ্চ কেন্দ্র তথা রাজ্য সরকারকে তাদের পক্ষ তুলে ধরতে নোটিস জারি করেছে। নানা পত্র-পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, শুনানি শুরুর সময়েই বিচারপতিরা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁরা আবেগতাড়িত হয়ে নয় বরং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই রায় দেবেন।

স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে যে নিয়মমাফিক সেটাই তো হওয়ার কথা। যাঁরাই উচ্চতম ন্যায়ালয়ে মামলা করেন, তাঁরা তো এই আশা নিয়েই মামলা করেন যে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই রায় দেওয়া হবে। তাই এটা আলাদা করে ঘোষণা করার বিষয় হয়ে উঠছে কীভাবে? যাই হোক, মামলাটি বিচারাধীন। তাই আমরা আশা রাখব যে রায় বেরোনোর পর এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

তবে উক্ত ঘোষণা আরেকটি দিক থেকে বিচার্য বটে। সেটি হল এই মন্তব্যের দার্শনিক দিক বা jurisprudential value। আইন এবং আবেগ কি দুটি বিপরীতমুখী বিষয়? বর্তমান সময়ে আইনি গবেষণায় একটি বিষয় খুব গুরুত্ব পাচ্ছে, তা হল Trauma-informed Court বা ট্রমা-সচেতন বিচারব্যবস্থা। ভারতবর্ষে আপাতত চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (Child Welfare Committee) এবং জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড (Juvenile Justice Board) ইত্যাদির পরিচালনায় এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেজন্য এই ধরনের মামলাগুলির শুনানির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ইন-ক্যামেরা প্রসিডিং বা প্রক্রিয়াটি মুক্ত আদালতে না করে বন্ধ ঘরে শুধু বিশেষ লোকজনের উপস্থিতিতে শুনানি গ্রহণ করা হয়। কোথাও কোথাও চাইল্ড ফ্রেন্ডলি কোর্ট নামে শিশুদের জন্য বিশেষ আদালতও গঠন করা হয়েছে। যেহেতু যৌন-নির্যাতন একটি ট্রমাটাইজিং বা মানসিক আঘাতকারী ঘটনা। সুতরাং বিচার প্রক্রিয়ার সময় শিশুরা যেন re-traumatise বা পুনরায় ট্রমাটাইজ না হয়ে পড়ে সেইজন্য এমন ব্যবস্থা।

লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের প্রতিরোধে ক্ষেত্রেও ট্রমা বা মানসিক আঘাত একটি চর্চিত দিক। ২০১৬ সালে নির্ভয়া মামলার পর বর্মা কমিটি নামে যে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়, যার ভিত্তিতে ২০১৮ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধিতেও কিছু নতুন নিয়মের সংযোজন করা হয়েছে সেখানেও এই বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। বর্মা কমিটির রিপোর্ট ‘ধর্ষণ’-এর প্রচলিত সংজ্ঞাটির আরও বিস্তৃতি ঘটিয়ে সেটির প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ট্রমা-সচেতন প্রতিবিধানের পরামর্শ দিয়েছে। সেই পরামর্শের ভিত্তিতেই নির্যাতিতাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম বা victims compensation scheme চালু করা হয়েছে। যাতে ধর্ষণ নির্যাতিতাদের মনে শরীরে এবং সমাজে তাঁদের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে অনিষ্ট সাধন করে তাঁরা সেগুলোর মোকাবিলা সক্ষমভাবে করতে পারেন। ফার্স্ট-ট্র‍্যাক কোর্টের কথা বলা হয়েছে, যাতে দীর্ঘ সময় ধরে নির্যাতিতাদের আদালতের চক্কর কাটতে না হয়।

সুপ্রিম কোর্ট বোধিসত্ত্ব গৌতম ভার্সেস শুভ্রা চক্রবর্তী সহ আরও নানা মামলায় বারবার বলেছেন যে ধর্ষণ কোনও মহিলার শুধু শারীরিক ক্ষতি করে না তাদের মানসিক এবং সামাজিক ক্ষতিও করে। সেসব রায়ে বিচারপতিরা ট্রমা-সচেতন হয়ে আবেগ এবং অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়েই আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন। এই রায়গুলো বিভিন্ন সময় জুরিস্টদের কাছ থেকে উচ্চ-প্রশংসাও পেয়েছে। সুতরাং আইন এবং আবেগকে যে সবসময় বিপরীতমুখী হতে হবে তা নয়। বরং আবেগ এবং অনুভূতি আইনকে আরও বেশি মানবিক করে তুলতে পারে।

ট্রমা ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে এই বাড়তি কথাগুলি বলতে হল, কারণ ট্রমা-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে বিলকিস বানোর মামলাটিকে আর পাঁচটি লিঙ্গভিত্তিক অপরাধের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। বরং সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিস্থাপন করতে নারীদেহকে কীভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, এই মামলা তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। মুক্তির পরের দিন থেকেই ধর্ষণকারীদের সংবর্ধনা দেওয়ার ছবি সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। বিলকিস নিজে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে কান্নাভেজা গলায় জানিয়েছেন যে তিনি বর্তমানে ভীষণ ভয়ের মধ্যে আছেন। তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। এ অবস্থায় মামলার পর মামলা করে তাঁকে বারবার তাঁর পুরনো ট্রমাকে পুনঃযাপন বা relive করতে হচ্ছে। সুতরাং এক্ষেত্রে ট্রমা-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি অতি-প্রয়োজনীয়।

বলা হয়, যে যখন কোনও অপরাধ সংঘটিত হয় তখন তা তিনটি ভিক্টিম-এর জন্ম দেয়। প্রথমত, যাঁর বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তিনি প্রধান বা প্রাথমিকভাবে নির্যাতিত বা victim। দ্বিতীয়ত, তাঁর পরিবার। তৃতীয়ত, সমাজ বা রাষ্ট্র। সেজন্যেই যেকোনও ফৌজদারি মামলায় রাষ্ট্র একটি পক্ষ। এই মামলাটিও সেরকম একটি মামলা। আশা রাখব, এই মামলায় প্রাথমিক পক্ষ বিলকিস বানো-সহ বাকি দু-পক্ষের প্রতিও যথাযথ ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে। কারণ সুবিচার পাওয়া আমাদের দেশে সাংবিধানিক অধিকার।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...