সুমন জানা

সুমন জানা | জীবন, জলের খাতা

জীবন, জলের খাতা

 

১.

মোরগ ডেকেছে।
নিমাই দাসের বউ একরাশ
এঁটো বাসন ডুবিয়ে রাখে পুকুরের জলে।
উচ্ছিষ্ট খাদ্যের লোভে
বড় রুইকাতলা আসে, সূর্য উঠে আসে,
মৌরলা আসে না। তারা
ছোট, কিন্তু উচ্ছিষ্ট-ভোজী না,
এই গর্বটুকু নিয়ে মৌরলার ঝাঁক
খাদ্যের সন্ধানহীন পুকুরের জলে
দূর থেকে আরও দূরে ভেসে চলে যায়…

 

২.

নিমকাঠি ভেঙে ভেঙে দাঁতন করেছে বউ
পুকুরের জলে মুখ ধুতে গিয়ে সেও
দেখেছে নিজের মুখ জলের আয়নায়
ঢেউ লেগে লেগে ভাঙা আয়নার মতো
যতবার জোড়ে মুখ ততবারই ভেঙে ভেঙে যায়
ভাঙতে ভাঙতে সব নিমকাঠি শেষে
তখন অন্য গাছে, অন্য কাঠির খোঁজ পড়ে
সেই থেকে সব কাঠি দাঁতনের নিমকাঠি
সব জল শরশঙ্কা দিঘি

 

৩.

ভোরের আলোর মতো ঠান্ডা জল
ধুয়ে দেয় শরীরের সব মিথ্যা, ঘৃণা।
অন্ধকার গৃহকোণে জলছড়া পড়ে,
ধীরে ধীরে ফর্সা হয় নিকোনো উঠোন।
বিগত রাত্রির সব শোকতাপ ভুলে
বকুলগাছের নিচে ফুটে ওঠে মন…

 

৪.

মাঠেঘাটে প্রাতঃকৃত্য নিষিদ্ধ হয়েছে,
আগে যারা আলো ফুটবার আগে খোলা মাঠে যেত,
এখন ঘরের পাশে বদ্ধ শৌচাগারে যেতে অভ্যস্ত হয়েছে।
পুরনো অভ্যাস কিছু থেকে গেছে তবু,
আলো ফুটবার আগে ঘুম থেকে ওঠা,
কাপড় ঘাটের পাড়ে রেখে জলে নামা—
নিমাই দাসের বউ জল থেকে উঠে আসে, যেন
অন্ধকার ভেদ করে প্রথম সকাল

 

৫.

জল বর্ণহীন, আলো বর্ণহীন,
ভুল করে মনে হয়। যে যার নিজস্ব বর্ণ আছে,
পুরোপুরি বর্ণহীন কেউ নয়।
আপাতত বর্ণহীন মনে হয়, তবু
ভোরের আলোর মতো
সাত রং লুকিয়ে খুব অবাক জীবন…

 

৬.

তোমার তো ক্লান্তি নেই
সারমেয় মাতাটির মতো বারবার
সন্তান ধারণে।
ততদূর বিশ্বস্ত তুমিও,
যতদূর গৃহকর্ম, যতদূর সন্তান ধারণ
যতদূর মরে বেঁচে থাকা…

 

৭.

মাথায় দিনের তাপ,
পায়ের তলায় শুধু কর্মব্যস্ত মাটি।
যত কর্ম তত ঘাম,
যত ঘাম তত ঘুম,
যতদিন না নেভে
এ জীবনের বাতি।

 

৮.

ঘুঘুপাখিটির মতো
বসে থাকি শিরিষের ডালে,
কত লোক চলে যায়, কত কথা বলে—
শুনি, আর মনে মনে ইতিহাস গড়ি।
তারপরে একদিন দুপুর গড়িয়ে গেলে
পাতার আড়ালে একা
ঘুমে ঢলে পড়ি…

 

৯.

উঠোনে মুরগির দল পোকা খুঁটে খায়,
এক বাটি মুড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি করে কটি শিশু।
কিছুটা দূরত্বে থেকে খিদে সব দেখে,
মুড়িটুকু শেষ হলে ঝাঁপিয়ে পড়বে,
বাতাসের আস্তিনে লুকোনো শীতের মতো,
গ্রহণের নিশ্ছিদ্র ছায়ার মতো,
ফি হপ্তায় রেশন ডিলারের ওল্টানো হাতের মতো।
খিদের সঙ্গে আসে কলহ ও মাথা ফাটাফাটি,
পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে যেন পার্টিকর্মী ঝুলা।
জীবন সর্বংসহা,
জ্বালা যত বাড়ে, তার হাসি চওড়া হয়,
একটানে ব্যান্ডেজ খুলে নেমে পড়ে হাডুডু খেলায়—

 

১০.

কখনও উৎসব আসে
জীবন রঙিন হয়
তালরসে ডুবে যায় মন।
দাসেদের বউ শিলে
ভুঁইয়াদের চাল বাটে,
এ কদিন যৌথ জীবন।

জীবন রসুইয়ে বড়
তার খুব র‍্যালা        ,
যেমন রান্নার হাত,
গলাও সুরেলা।

সকলেই ডাকে তাকে,
হাতে ধরে সাধে,
জীবন খিচুড়ি তোলে,
মুড়িঘন্ট রাঁধে।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...