এই বেশ ভাল আছি!

প্রবুদ্ধ বাগচী 

 

সেটা আশির দশকের মাঝামাঝি। পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক মানচিত্রের হিসেবে তখন দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের শাসনকাল। জরুরি অবস্থা, কংগ্রেসি অপশাসন এসবের পরে মাত্রই দশ-এগারো বছর গড়িয়েছে। সরকারি উদ্যোগে ভূমিসংস্কার কর্মসূচির পাশে পাশে সাক্ষরতা অভিযান চলছে পুরোদমে। নির্বাচিত ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রামে গ্রামে এক নতুন উদ্দীপনার জোয়ার। রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস-আই, তাদের বিধানসভায় আসনসংখ্যা তেমন না-হলেও ভোটব্যাঙ্ক নিছক কম নয়— অন্তত ১৯৮২-র বিধানসভা নির্বাচনেও তারা চল্লিশ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছে। কিন্তু এই আবহেও একটা অন্যকণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল সেই সময়ের লেখালেখির উঠোনে। গ্রামবাংলার কথা জানা নেই, তবে শহর কলকাতাকে কেন্দ্র করে যে বৃহত্তর কলকাতার ছড়ানো চেহারা— যার বিস্তার উত্তর শহরতলি থেকে দক্ষিণ শহরতলি জুড়ে থাকা দুই চব্বিশ পরগনার একটা বড় অংশ, সঙ্গে হাওড়া ও হুগলি— মূলত এই পুরসভা এলাকাগুলির নাগরিক পরিসরে একটা ভাবনা তখনই ডানা মেলতে আরম্ভ করেছিল। সেটা এই যে, কমবেশি দশ বছরের শাসনকালের প্রতিক্রিয়ায় শাসক বামফ্রন্টের মধ্যে বেশ কিছু বিচ্যুতির লক্ষণ বেশ স্পষ্ট। এটা যে শুধু ছোট ছোট নাগরিক গোষ্ঠীতে আলোচিত হচ্ছিল তা-ই নয়, কোথাও কোথাও বাম দলগুলির দীর্ঘদিনের কর্মীরা, যারা জরুরি অবস্থা বা সত্তর দশকের কণ্ঠরোধী লড়াকু সময় পেরিয়ে এসেছিলেন, তাঁরাও এতে সায় দিয়ে ফেলছিলেন। এমনকি কোথাও কোথাও এইসব একটা বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী নিজেদের মতো করে তৈরি করে ফেলছিলেন আঞ্চলিক ছোট একেকটি সংগঠন। মনে পড়তে পারে, উত্তর চব্বিশ পরগণার পানিহাটি এলাকায় তৈরি হয়েছিল এমন এক সংগঠন, হুগলির শ্রীরামপুরেও গঠিত হয়েছিল এরকম সংস্থা, যাদের প্রায় সব সদস্যই মূল বামদলগুলির সদস্য বা সমর্থক ছিলেন। দক্ষিণ কলকাতার তালতলা হাইড রোড এলাকার শিল্পাঞ্চলেও ঘটেছে একই জিনিস— শাসক বামফ্রন্টের শ্রমিক সংগঠনের পরিচিত নেতা দল ছেড়ে এসে যুক্ত হয়েছেন অন্য সংগঠনে, যারা মূলত শাসকের প্রতিবাদী অবস্থানেই ছিলেন।

এখানে একটু মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, ক্ষমতায় আসার পরে বামফ্রন্টের সবচেয়ে নেতিবাচক কাজ ছিল মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন। এই ঘটনায় প্রতিবাদ উঠে এসেছিল শরিক দলের পক্ষ থেকেও। কুমিরমারি পঞ্চায়েতের গ্রাম-প্রধান (আরএসপি দলের সদস্য) স্বয়ং জ্যোতিবাবুর কাছে দরবার করতে গিয়েছিলেন উদ্বাস্তুদের হয়ে। শোনা যায়, মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বারে তিনি এমন হুমকি ও দাবড়ানি শোনেন যে আর তাঁর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয়নি। রীতি মেনেই শাসক বামফ্রন্ট মরিচঝাঁপির নিপীড়নের ‘সপক্ষে’ সাফাই গায়, তার সঙ্গে জুড়ে যায় ‘বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্র’ থিওরি। কিন্তু মোটের ওপর এই ঘটনা খুব বেশি জনমনে প্রভাব ফেলেনি, ব্যাপারটা প্রচারিতও হয়েছিল কম। জ্যোতির্ময় দত্ত বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো দু-একজন সাংবাদিক-লেখক এটা নিয়ে কলম ধরেছিলেন, বাকিরা সরব হননি। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি যে সময়টার কথা বলছি, সেই সময়, শুধু নাগরিক মহল্লায় মৃদু আলোড়ন তুলেই ব্যাপারটা থিতিয়ে গিয়েছিল এমন নয়। এর চেয়েও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ওই সময়টায় বেশ কিছু পত্র-পত্রিকায় এই বিশেষ বিষয়টি চর্চার কেন্দ্রে উঠে আসে। গল্পে-উপন্যাসে বা নিবন্ধের একটা প্রধান উপজীব্য ছিল বামদলের শাসনক্ষমতা অর্জনের সূত্রে তাদের নীতি-বিচ্যুতি। সেইসব লেখায় থাকত এমন সব চরিত্র যাঁরা বামদলের কর্মী, অনেক পুরনো সংগ্রামের সৈনিক। হয় দেখানো হত তাঁরা নতুন জমানায় নিজেদের আর মানাতে পারছেন না বলে দ্বন্দ্বে ভুগছেন বা পরিণামে হয়তো-বা বসে যাচ্ছেন। অথবা পুরনো মূল্যবোধ বা পার্টির দর্শন এড়িয়ে গিয়ে মেতে উঠছেন নতুন স্রোতের আবর্তে— আগে যিনি একটা বিড়ি দুজনে ভাগ করে খেতেন, এখন লম্বা বিদেশি সিগারেট না হলে তাঁর চলে না, আগে যে নড়বড়ে কাঠের টেবিল আর কেরোসিন কাঠের চেয়ারেই সাজানো থাকত দলীয় অফিস এখন সেখানে বাহারি সেক্রেটারিয়েট টেবিল ও গদি আঁটা চেয়ার। এইরকম আর কি!

এই ধরনের পরিবর্তনের একটা ইশারা রেখেছিলেন সমরেশ বসু তাঁর ‘তিন পুরুষ’ উপন্যাসে— তবে সেটা আরও আগের কথা, ওই লেখা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬২ সালে, কমিউনিস্ট পার্টি তখন ভাগ হয়নি আর ক্ষমতাতেও আসেনি। কিন্তু আশির দশকের মধ্যভাগে ‘অগ্রণী’, ‘সত্তর দশক’, ‘অনূষ্টুপ’ বা ‘অনীক’ ইত্যাদি পত্রিকায় এরকম অনেক গল্প বেরিয়েছে যাতে গল্পকাররা চিহ্নিত করতে চেয়েছেন বাংলার সমাজ-রাজনীতির এই এক দিকচিহ্ন। খেয়াল রাখতে হবে, এই সময়টায় কলকাতার প্রায় সংবাদপত্রই ছিল বামফ্রন্টের সমালোচক। যার সবটাই ঠিক ছিল, এমন নয়। আজকের ভাষায় টিআরপি বাড়ানোর মরিয়া চেষ্টায় তারা নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর খবর লিখত। সাধারণভাবে প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে শাসক বামফ্রন্টের খুব একটা সখ্য ছিল না, সেই প্রগাঢ় অনুরাগ আরেকটু পরের ব্যাপার। তবে এইসব সাহিত্যিক দৃষ্টান্তগুলির সঙ্গে সংবাদপত্রের ভাষ্যের তেমন আনুপাতিক যোগ ছিল বলে মনে হয় না। এইসব লেখাগুলি যারা লিখতেন তাঁরা মোটামুটি বামপন্থী মেজাজের লোক, যাঁরা হয়তো সুদীর্ঘকাল ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে লড়াই করা বাম নেতাদের একেবারে বিপরীত অবস্থানে দেখতে পছন্দ করতে পারেননি। সেই সময়ের কিছু থিয়েটারেও এই বিষয়টি উঠে এসেছিল— ক্ষমতায় থাকা বামপন্থীদের সমালোচনার ইঙ্গিত ছিল সেই সব প্রযোজনায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় ওই সময়েই লিখছিলেন ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও, আমার লাগছে’— লিখছিলেন বিদ্রূপ পংক্তি ‘ফুলকি ছেড়ে ফুল ধরেছেন/ মিছিল ছেড়ে মেলা’! এই মুহূর্তে ‘সংবাদ প্রতিদিন’ দৈনিকপত্রের রবিবাসরীয় পত্রিকা ‘রোববার’-এ তরুণ মজুমদারের একটি ধারাবাহিক লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, যা মূলত ২০০৬-পরবর্তী পটভূমিতে রচিত— ‘ঘরের মধ্যে ঘর’ শীর্ষক এই উপন্যাসেও রয়েছে এমন সব চরিত্র যারা তিন দশকের বাম শাসনে দৈনন্দিন বিলাস-ব্যসনে অভ্যস্ত আর তার ঠিক পাশেই আনা হচ্ছে এমন চরিত্র যিনি এগুলি থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে সরে এসেছেন ওই স্রোত থেকে। তবে ২০০৬-পরবর্তী পরিস্থিতি একটা সম্পূর্ণ আলাদা বাস্তবতা, এখানে তার কথা আমরা আনতে চাইব না।

খুব নির্ভরযোগ্য সূত্রেই জানতাম, ১৯৮৭-র বিধানসভায় বিপুল জয়ের পরে বামফ্রন্টের একটা অংশ চাইছিলেন ক্ষমতার এই বৃত্তটা থেকে বেরিয়ে আরও বেশি জনমুখী হতে। এমন কথাও উঠেছিল, কেউ বলছিলেন, এই দশ বছরের অভিজ্ঞতায় মানুষের যতটা উপকার করা যায়, করা গেছে— এর থেকে আর এগোনো সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং আবার আমরা ফিরে যাই ক্ষমতার বাইরে, নতমুখে মানুষের কাছে গিয়ে বলি, এর থেকে বেশি ‘রিলিফ’ আর আমরা ক্ষমতায় থেকে তাঁদের দিতে পারব না। আসুন, আবার আমরা বৃহত্তর মুক্তির জন্য লড়াইয়ে নামি। বলা বাহুল্য, এই র‍্যাডিকাল মত বেশিরভাগই মানেননি, সুতরাং নতুন করে ক্ষমতার চিটেগুড়ে আটকে থাকা ছাড়া বিকল্প কিছু ছিল না। এটা ভাল কি খারাপ সেই বিষয়ে দলের বাইরে থেকে কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে একটা কথা বলতে পারা যায়, আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই রাজ্যের শিল্পাঞ্চলে একটা বড় ইস্যু হয়ে ওঠে বন্ধ কারখানা— একের পর এক শিল্পকারখানা তখন পর পর বন্ধ হয়ে যেতে থাকে এবং তার শ্রমিকরা অত্যন্ত দুরবস্থায় পড়ে। এই বিষয়টায় তথাকথিত ‘শ্রমিকদরদি’ সরকারের ভূমিকা মোটেও ভাল ছিল না। অনেক জায়গাতেই আঞ্চলিকভাবে শ্রমিকদের সংগঠিত করে কারখানা চালুর আন্দোলন শুরু করেছিলেন বামফ্রন্টের আওতার বাইরে থাকা নানা সংগঠন। শ্রমিকদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সরকার-সমর্থক শ্রমিক ইউনিয়ন এগুলিকে সন্দেহের চোখে দেখেছে ও চেষ্টা করেছে এদের আটকে দেওয়ার। এই বিষয়টাও উঠে এসেছিল সমকালীন গল্পে, আখ্যানে। এটাও উল্লেখ করা দরকার বন্ধ কারখানা চালু করার আন্দোলন কিন্তু মূল ধারার সংবাদপত্রে তেমন জায়গা পেত না, বরং তারা একটা প্রবাদ চালু করে দিয়েছিল যে ‘ইউনিয়নবাজি’ করেই নাকি এইসব কারখানা লাটে উঠে যাচ্ছে আর এই বিষয়ে মূল দায় বামপন্থীদের। আদৌ ঘটনা তা ছিল না। সরকারে থেকে ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা’ করার অজুহাতে বহু ক্ষেত্রে সরকারি প্রশাসন প্রত্যক্ষভাবে মালিকের স্বার্থ দেখেছে। এই নিয়ে অনেক আগে ‘চোখ’ ছবি করেছিলেন উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, সেটা বামফ্রন্টের গোড়ার দিক। পরে এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এই রাজ্যে, শুধু পাল্টে গেছে কুশীলব। আর এই যাবতীয় ‘মেটামরফোসিস’ একরকমভাবে ধরে রেখেছে সমসময়ের বাংলার সাহিত্য, এটা একরকম আশীর্বাদ। এই সময়কাল ইতিমধ্যেই প্রায় চার দশকের পুরনো হতে চলেছে, আগামী গবেষকদের কাছে এই তথ্যগুলি পাওয়া খুব কঠিন হবে না যে ওই সময়ের লেখালেখির শরীরে কোথাও ঠাঁই পেয়েছিল রাজনৈতিক বিচলনের ছায়া।

কিন্তু আজ? ২০০৬-পরবর্তী সময়ে রাজ্যের ‘পালাবদল’ নিয়ে আমরা দেখেছিলাম এক ঐতিহাসিক আবর্ত। শাসকদলের অবিমৃষ্যকারিতার পাশে পাশে আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করেছিলাম বাংলার লেখক-কবি-অভিনেতা-নাট্যব্যক্তিত্ব-গায়ক-চলচ্চিত্র পরিচালক সকলেই সোচ্চার হয়ে সওয়াল করেছিলেন ‘পরিবর্তন’-এর পক্ষে— সব কিছু বদলে নতুন করে শুরু করতে হবে, এই ছিল তাদের শপথ। সত্তর দশকের শেষে কংগ্রেসি অপশাসন ও স্বৈরিতার প্রতিস্পর্ধী হিসেবে জনমানুষের যে স্বরক্ষেপ তার সঙ্গে এর মিল বা অমিল কতটুকু ছিল তা জানি না, কিন্তু জগদ্দল স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে একটা কিছু করার নিখাদ অভিপ্রায়ে কিছু ঘাটতি ছিল বলে মনে হয় না। মূলত জমি আন্দোলন নিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হলেও ক্রমে ক্রমে দেখা গেল মানুষ চলতি সবকিছুকেই নাকচ করতে চাইছেন, চাইছেন একটা আনকোরা নতুন কিছু। ২০১১-র বিধানসভায় সেই ‘বদল’ শেষ পর্যন্ত এসেও গেল মহাসমারোহে। বাম শাসনের অবসানে সবাই ভাবলেন বুঝি ‘বসন্ত এসে গেছে’।

বাম শাসনের দশ বছর অতিক্রমণের মতোই আজও কিন্তু ‘পরিবর্তন’-এর এক দশক অতিক্রান্ত। গ্রামীণ মানুষের হাতে কিছু অনুদান-নির্ভর ভরসা ছাড়া রাজ্যের সামাজিক জীবনে আজ আর খুব বলার মতো কিছু নেই। আশির দশকের মাঝ-সময়েও মানুষ দুহাত তুলে সমর্থন করতেন সরকারকে। সমালোচনাটা তখনও এসেছিল আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক মহল থেকেই— তারাই তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বা অপছন্দ জানিয়ে দিচ্ছিল নানা মাধ্যমে। আজকের সেই ‘পরিবর্তন’-এর সরকারে পরিব্যাপ্ত দুর্নীতি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান নিয়ে স্বপ্নহীন এক বাস্তবতা। বিরোধী দল কী করবেন বা কী কতটুকু করতে পারেন সেটা এই আলোচনার উদ্দিষ্ট নয়, খেয়াল রাখার কথা এইটাই যে আজকের লেখালেখি ও শিল্পমাধ্যম এই সমকালীন পরিস্থিতি বিষয়ে বড় চোখে লাগার মতো নীরব। এটা কোনও চাপিয়ে দেওয়া শর্ত নয় যে সবাইকেই তাঁর লেখনীতে বা শিল্পমাধ্যমে সমকালীন রাজনৈতিক সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরতেই হবে। তবে ইতিহাসের ধারা বলে, এমনটা হয়েই থাকে। একটা সময়ে দাঁড়িয়ে কোনও সংবেদনশীল মানুষই চোখ বন্ধ করে নিজের সৃষ্টিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না— অবশ্যই চয়েস তাঁর।

তাই এটা বেশ অবাক করে যে, বামফ্রন্টের দশ বছরেই যে সচেতন স্বর একরকম মাথা তুলছিল ভ্রান্তির দিকে চিহ্নিত করে, নথিবদ্ধ করতে চাইছিল একটা ভিন্ন মতকে— আজ শুধু ভুল নয়, ব্যাপ্ত সামাজিক অর্থনৈতিক অবনমনের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কোথাও তেমন কোনও স্বতন্ত্র স্বর আর নেই যা রাজার নিরাবরণ দেহপট-কে তর্জনী তুলে দেখিয়ে দিতে পারে। বামফ্রন্টের শেষ আমলে, ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’-এর মতো নাটক হয়েছে, হয়েছে ‘পশুখামার’-এর প্রযোজনা। ‘তারা’ বা ‘কমরেড’ ছবিতে প্রকাশ্যে বিদ্রূপ ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে শাসকের উদ্দেশে— আজ কি সব এতদূর পর্যন্ত ‘ঠিকঠাক’ যে এমন ভাবনাই কারও মগজে ঠোক্কর দিচ্ছে না আর? নাকি গহীন নীরবতায় মুখের ভাষা আর সৃজনের প্রচ্ছদকে আড়াল করাই আজ শিল্পের বা সাহিত্যের শর্ত? হয়তো এই ‘শান্তিকল্যাণ’-এর একটা সামাজিক ব্যাখ্যা আছে। তা হল এই যে, উত্তর-স্বাধীনতা পর্ব থেকে বাংলার রাজনীতির সঙ্গে কমিউনিস্ট দল-সহ অন্যান্য বামপন্থী সহমর্মী দলগুলির একটা সুদীর্ঘ আত্মিক ও সাংস্কৃতিক যোগের ঐতিহ্য থেকেই গিয়েছিল। তাদের ধারাবাহিক গণআন্দোলনে রাজ্যের মানুষের অংশগ্রহণ, তাদের সমর্থন সবই ছিল বাঙালির কালচার। পঞ্চাশের দশক থেকে আশির দশক অবধি অধিকাংশ শিক্ষিত চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত বাঙালি মননে ও চেতনায় ছিলেন  সাংস্কৃতিকভাবে বামঘেঁষা। হয়তো তাই বামপন্থী চেনা মানুষগুলির বদলে যাওয়ায় তাঁরা কিছুটা অভিমানাহত হয়েছেন আর তাঁদের সমালোচনা করে সবক শেখানোর দায়ও নিজেরাই তুলে নিয়েছিলেন নিজেদের হাতে। ২০১১-এর পালাবদলের সঙ্গে কৌশলে সেই বামাদর্শের ‘গোলমরিচ’ মিশিয়ে দেওয়া চেষ্টা হলেও আদপে তা ছিল স্থূলে ভুল— ফলে এই সার্বিক অবনমন-কে আজ আর ‘অভিমান’-এর চোখ দিয়ে বিচার করার মানুষ কার্যত অনুপস্থিত।

‘পরিবর্তন’-এর সরকার ছিল আদপে একটা মরুঝড় যা থিতিয়ে যাওয়ার পর বোঝা যায়, ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কম নয়। আমরা কেউ এত নিবিড় সমাজ-বিশ্লেষক নই, তাই এর অব্যর্থ মূল্যায়ন আমাদের কাজ নয়। আফসোস এইটুকুই, আজকের সাহিত্য আজকের ছবি-নাটক সমকালীন এই রাজনৈতিক বাস্তব থেকে যেন কিছুটা সরে এসে নিরাপদ অবস্থান নিতে চাইছে। এটা ইতিহাসের  অপচয়। সাম্প্রতিক সময়ে দুটি বিপরীত দৃষ্টান্ত আমাদের চোখে এল। এই মুহূর্তে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার ‘রবিবাসরীয়’ পাতায় একটি ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে, ওই লেখায় রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির একটা প্রসঙ্গ এসেছে, এসেছে সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি হওয়া একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ছবিতে। তবে এটা সাধারণ ধারার থেকে আলাদা করে দেখাই ভাল। আপাতত আমরা অসহায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় পর্ব ‘ঢোলগোবিন্দের মনে ছিল এই’ উৎসর্গ করেছিলেন কন্যাপ্রতিম পরিবর্তনের কাণ্ডারি-কে— আজ তিনি জীবিত থাকলে কী অবস্থান নিতেন জানি না। তবে  আগামী পঞ্চাশ বা একশো বছর পরের ইতিহাসে এই নীরবতা আদপে হয়তো চিহ্নিত হবে আমাদের কলঙ্কচিহ্ন হিসেবেই— কে জানে! আপাতত, ‘এই বেশ ভাল আছি’— কী বলেন?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...