চা-বাগানে ক্ষুধা ও অপুষ্টির অন্ধকার

সুশোভন ধর

 

ওঁরা বলেন, চা-বাগানগুলোর কোত্থাও কোনও অনাহার-মৃত্যুর ঘটনা নেই… এমন শান্ত, সবুজ চা-বাগান, যেন স্বর্গের অবিকল চিত্ররূপ – এমন অপরূপ জায়গায় কেনই বা মানুষ খামোখা ক্ষিদের জ্বালায় মরতে যাবে? তাদের কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই?

দু’বছর আগে, যখন দার্জিলিং, তরাই ও ডুয়ার্সের চা-বাগানগুলোয় অনাহারে মৃত্যুর অভিযোগ আগের সমস্ত নজিরকে ম্লান করে দিচ্ছে, তখন, রাজ্য বিধানসভায় শ্রমমন্ত্রী বড় গর্বের সঙ্গে এমনই কিছু বলেছিলেন। বিরোধীরা যখন বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট দেখান, তখন মন্ত্রী তাঁদের কাছে মৃতদের ডেথ সার্টিফিকেট দাবি করেন – এমন ডেথ সার্টিফিকেট দেখাতে হবে, যেখানে মৃত্যুর কারণ হিসেবে অনাহারের উল্লেখ রয়েছে। এখন, চা-বাগানে অনাহারে মৃত্যু তো কোনও বিরল ঘটনা নয়। দুর্ভাগ্যজনক হল এই অস্বীকারের সংস্কৃতি, যাতে নতুন করে আবার জলবাতাস লেগেছে। দেখেশুনে যা মনে হচ্ছে, এক-একটা দিন যাবে, আর পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, কারণ ন্যায্য মজুরি মিলবে না, জীবনধারণের অন্য উপকরণগুলিও মহার্ঘ হয়ে উঠবে – এবং এই অস্বীকারের প্রহসনও উত্তরোত্তর জোরদার হয়ে উঠবে।

পশ্চাৎপট

চা উৎপাদনে ভারতের স্থান চিনের পরেই। ২০১৪ সালে এ-দেশে উৎপন্ন চায়ের পরিমাণ ১.২ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ সালে ৪০০০ কোটি টাকারও বেশি চা রফতানি করে ভারত বিশ্বে চতুর্থ স্থানে ছিল। একইসঙ্গে ভারত আবার বিশ্বে কালো চায়ের (ব্ল্যাক টি) বৃহত্তম উপভোক্তাও বটে (চিন এবং দক্ষিণ / দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি মূলত সবুজ চা-পাতা বা গ্রিন টি ব্যবহার করে। তার সঙ্গে তুলনা করেই এই পরিসংখ্যান)। ২০১৩-১৪ সালে দেশীয় বাজারে ৯১১০ লক্ষ কেজি চা বিক্রি হয়েছিল। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের হিসেব অনুযায়ী গোটা দেশে ৫৬৪ হেক্টর জমিতে চা-বাগান ছিল। ২০১৩-১৪ সালে যত চা উৎপাদন হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ২৪৩৭ লক্ষ কেজি দক্ষিণ ভারতে এবং ৯৬৫১ লক্ষ কেজি উত্তর ভারতে, যার মধ্যে অসম এবং পশ্চিমবঙ্গও পড়ছে। ভারতে চা উৎপাদনে অসম অগ্রগণ্য (৩ লক্ষ ৪ হাজার হেক্টর চা বাগান), তার পরেই পশ্চিমবঙ্গ (১ লক্ষ ৪০ হাজার হেক্টর), তামিলনাড়ু (৭০ হাজার হেক্টর) এবং কেরল (৩৫ হাজার হেক্টর)।

অন্যান্য কৃষিপণ্যের মতোই চায়ের ক্ষেত্রেও উৎপাদন-পরবর্তী পর্যায়গুলিতে চায়ের মান বর্ধিত হতে থাকে, এবং সে কারণেই এ পর্যায়গুলি গুরুত্বপূর্ণ। প্রসেসিং-এর প্রতিটি পর্যায়েই – যেমন ব্লেন্ডিং, প্যাকেজিং, মার্কেটিং – এই মূল্য যোগের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ফলত এই ধাপগুলি অতীব লোভনীয় এবং এগুলি মূলত ক্রেতা দেশগুলির চা কোম্পানিগুলি করে থাকে। এখান থেকেই বড় কর্পোরেটদের মুনাফা করা শুরু হয়। বিশ্বের মোট চায়ের বাজারের ৮৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে কয়েকটা মাত্র বহুজাতিক। ফলে তাদের মার্কেটিং দক্ষতা এবং প্রভাব সহজেই অনুমেয়। এই হচ্ছে চায়ের বাজার — যেখানে ভিড় করে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা এবং তাদের মাথায় বসে রয়েছে কর্পোরেটরা। এই পিরামিডের সবচেয়ে দুর্বল এবং ভঙ্গুর বিন্দুতে যে চা-শ্রমিকরাই থাকবেন, তা বুঝতে আলাদা বুদ্ধি লাগে না। এখানে তাঁদের দরকষাকষির ক্ষমতা প্রায়শই নেই, থাকলেও খুবই সামান্য। ফলে, বিশ্ববাজারে চায়ের দাম শিখর স্পর্শ করছে, কিন্তু চা-শ্রমিকরা আজ থেকে ৩০ বছর আগে যা মজুরি পেতেন, এখনও প্রায় তা-ই পাচ্ছেন, এবং অনেকক্ষেত্রে তা কমেও গিয়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্ববাজারে প্রভুত্ব করছে চারটি কর্পোরেশন: ইউনিলিভার (লিপটন এবং পিজি টি প্রস্তুতকারক), টাটা টি (টেটলি প্রস্তুতকারক), ভ্যান রিস (একটি চা ট্রেডিং কোম্পানি) এবং জেমস ফিনলে (একটি চা প্যাকিং কোম্পানি)।

পরিসংখ্যান বলছে, চা-শিল্প শ্রমিক সংখ্যার দিক থেকে ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম। সারা দেশের ১৬৮৬টি টি-এস্টেট এবং ১৫৭৫০৪টি ছোট বাগিচার মোট শ্রমিক সংখ্যা ৩৫ লক্ষেরও বেশি, যার বেশিরভাগই মহিলা। ভারতের দুই প্রধান চা উৎপাদক অঞ্চল অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের চা-শ্রমিকরা মূলত আদিবাসী। ঔপনিবেশিক বাগান মালিকেরা আজ থেকে ১৫০ বছরেরও আগে এঁদের পূর্বপুরুষদের ঝাড়খণ্ড, বাংলা, বিহার, ওডিশা, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি থেকে জোর করে তুলে এনে এই বাগানগুলিতে কাজে লাগিয়েছিল। বর্বরতার সেই উচ্চতা স্পর্শ না করলেও একে অনায়াসেই আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস সরবরাহের দেশীয় সংস্করণ বলা যেতে পারে, কারণ যে নীতি ও পদ্ধতি সেখানে অনুসৃত হয়েছিল, এখানেও কার্যত তা-ই হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতি

চা-বাগানগুলির ভেতরে বিপর্যয় যে সমানে বেড়েই চলেছে বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট এবং অন্যান্য ফিল্ড এনকোয়ারি থেকে তা স্পষ্ট। আমরা বিশ্বের অন্যতম প্রধান চা উৎপাদক এবং রফতানিকারক। ফলে এই শিল্পের ভেতরের ছবিটা দেখে আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু, প্রকৃত সত্যটা হচ্ছে, নিজের চায়ের স্বাদ তেতো করতে না-চাইলে কেউ এর ভেতরে তাকাবেন না। বন্ধ বাগানগুলির কথা বলছি, এমনকী খোলা বাগানগুলিতেও দুই দশকের বেশি সময় ধরে অনাহার-প্রায় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাজ্যের হাজার-হাজার চা-শ্রমিক এক ভয়ানক সংকটে নিমজ্জিত। অনাহার, ভয়ানক অপুষ্টি এবং তজ্জনিত রোগব্যাধি এক স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এদিকে, কয়েক বছর অবহেলা অনিয়ম চালানোর পর মালিকদের স্বচ্ছন্দে লুটপাট চালিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে।

যে দেশে চা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পানীয়, সেখানে খুব অল্প মানুষই এ-সম্পর্কে ওয়াকিবহাল যে, সেই চা যেখানে চাষ হয়, সেই বাগানের ভেতর একটা মহামারী নীরবে শ’য়ে শ’য়ে চা শ্রমিকের জীবন নিয়ে নিচ্ছে।

২০০০ থেকে ২০১৫-র মধ্যে উত্তরবঙ্গের ১৭টা বন্ধ চা-বাগানে ১৪০০ জন শ্রমিক মারা গিয়েছেন। এই বাগানগুলিতে দেখা গিয়েছে মৃত্যুর মূল কারণ ভয়াবহ অপুষ্টি। অন্য বাগানগুলিতেও এ ধরনের মৃত্যু কম নয়, কিন্তু সেগুলো প্রায়ই খবরে আসেনি।

এই অনাহারে মৃত্যুগুলির একটা বড় অংশই ঘটেছে ডুয়ার্সের চা-বাগানগুলিতে, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারে। এই অনাহারের থাবা বন্ধ হয়ে যাওয়া বাগানগুলির শ্রমিক পরিবারগুলির ওপর সবচেয়ে বেশি। তাঁদের উপার্জনের একমাত্র পথ বন্ধ, ফলত দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি, এবং ভয়াবহ মৃত্যুহার।

গত দশকে চা-বাগানে মৃত্যু উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫-তে এটা কার্যত মহামারীর আকার ধারণ করেছিল। সে বছর রেড ব্যাঙ্ক চা-বাগানে ৫০ জন, বান্ধাপানিতে ২২ জন এবং রায়পুরে ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। সেই সময়েই ১৪ বছর ধরে বন্ধ হয়ে থাকা ঢেকলাপাড়া চা-বাগানে ৩৯ জনের মৃত্যুর খবর সামনে আসে। বন্ধ হয়ে থাকা ডানকান চা-বাগানেও মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১০০। এই মৃত্যুর ঘটনাগুলি সবই বন্ধ চা-বাগানের। কোনও কাজ নেই, ফলে উপার্জনও নেই। বেঁচে থাকাটাই সেখানে এক নিত্যদিনের সংগ্রাম।

১৯৫১-র প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট অনুযায়ী চা-শ্রমিকদের সমস্তরকম কল্যাণমূলক সুযোগসুবিধা পাওয়ার কথা। শ্রমিকরা, যাঁদের অর্ধেকের বেশি মহিলা, মজুরি (নগদে এবং রেশনের খাবারে) এবং ওয়েলফেয়ার স্কিমগুলির (যেমন, ঘর, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি) ওপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল। এগুলি দেওয়ার কথা বাগান মালিকদের। শ্রমিকদের জীবনধারণ সুরক্ষিত করার জন্য এবং খাদ্য এবং পুষ্টিতে তাঁদের এই সামান্য অধিকারটুকু সুনিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, হাতে গোনা কিছু বাগান মালিকই সেটা পুরোপুরি পালন করে।

যার ফলে, যেসব বাগানগুলি চালু রয়েছে সেখানেও মর্মান্তিকভাবে কম মজুরি, পানীয় জল, শৌচাগারের অভাব, খাবার তো একে যথেষ্ট কম পুষ্টিগুণসম্পন্ন, তায় সেটারও অভাব, এবং এই এতগুলি অভাবের অনিবার্য ফলশ্রুতিতে অনাহারে মৃত্যু আজ এক বাস্তবতা। আর এই ভয়াবহ চিত্র পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা নেই। কারণ চা-শ্রমিকদের মজুরি মর্মান্তিক থেকে আরও মর্মান্তিক হচ্ছে। এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আবাসের সুযোগসুবিধাগুলি স্রেফ লোপাট হয়ে যাচ্ছে।

হিংস্রতার ধূসর ছবি

উত্তরবঙ্গের বন্ধ এবং অনুৎপাদক চা-বাগানগুলিতে এই আবহমান ক্ষুধার জ্বালা বছরের পর বছর ধরে ওই এলাকার এক স্থানীয় বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। স্বৈরাচারী মজুরি-কাঠামো এবং ম্যানেজমেন্ট ও সরকারের তরফে চরম উদাসীনতা শ্রমিকদের জীবনকে আজ সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে ছেড়েছে।

খোলা চা-বাগানগুলির শ্রমিকদের অবস্থাও যে ভালো কিছু নয় আগেই বলেছি। ন্যূনতম মজুরি অসম্ভব রকমের কম, বর্তমানে বেশিরভাগেরই দিনে ১৩২ টাকা ৫০ পয়সা, এবং এর অনিবার্য থাবা পড়ে তাঁদের স্বাস্থ্যের ওপর। সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবার বীভৎস অপুষ্টির শিকার।

২০১৪ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী অর্ধেকের বেশি শ্রমিকদের বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) দেখা গিয়েছিল ১৮.৫-এর নিচে। ভারতীয়দের ক্ষেত্রে আদর্শ বিএমআই হওয়ার কথা ২৩ থেকে ২৪-এর মধ্যে। বিএমআই কম থাকার অর্থ স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির আশঙ্কা অনেক বেড়ে যাওয়া। অথচ বিপুলসংখ্যক চা-শ্রমিকদের বিএমআই দেখা গিয়েছিল ১৪-র আশেপাশে। যেসব পরিবারে সদস্যদের বিএমআই ১৭ থেকে ১৪-র নীচে ঘোরাফেরা করছে, দেখা গিয়েছে তাঁদের মৃত্যুহার অন্যদের দ্বিগুণ। পুষ্টির সামগ্রিক ঘাটতির এই ছবিটাই প্রমাণ করে গোটা চা-শ্রমিক সম্প্রদায় কী মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সর্বোচ্চ আয়ুষ্কাল অনেকদিন ধরেই কমছে, এবং এখন সেটা ৬৫ বছর। ১০৭টি বাগানের মধ্যে কোনও হাসপাতাল বা চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই!

শিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ৪২টি বাগানে কোনও স্কুল নেই, ফলে বাচ্চাদের মিড-ডে মিল পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। বর্তমানে বন্ধ বাগানগুলির শ্রমিকদের উপার্জনের একমাত্র বিকল্প পথ নদীতে পাথর ভাঙা। যে সামান্য টাকা এর থেকে পাওয়া যায়, তাতে তাঁদের প্রয়োজন তো মেটেই না, দুর্দশা আরও বাড়তে থাকে।

প্রখ্যাত শিশু-চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞ ড. বিনায়ক সেন একবার একটা সমীক্ষা করেছিলেন। তাঁর মতে, এই অঞ্চলে ক্রমাগত অনাহারে মৃত্যুর কারণের সঙ্গে খাদ্য এবং পুষ্টির উৎসের অভাবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এই দিকটিতে গুরুতর আপোষ করা হয়। এখানে পুষ্টিকর এবং বৈচিত্রপূর্ণ খাদ্য পাওয়া যায় না। শৌচব্যবস্থাও খুবই অস্বাস্থ্যকর। এঁদের কেউই ভর্তুকিযুক্ত রেশন পায় না। পানীয় জল এবং শৌচালয়ের ব্যবস্থাও নেই। এই সীমিত খাদ্য এবং নিম্নমানের স্বাস্থ্যবিধির পরিণতি যা হওয়ার তাই হচ্ছে – ভয়াবহ স্বাস্থ্যহানি।

অনেক বাগানই কিন্তু রুগ্ন হয়ে রয়েছে সামগ্রিক অব্যবস্থার ফলস্বরূপ। এদের কাউকেই প্রকৃত অর্থে রুগ্ন বলা চলে না। সমস্যা তৈরি হয় যখন দূরদর্শিতার অভাব, সুষ্ঠু আর্থিক এবং প্রশাসনিক পরিকল্পনার অভাবে কোনও বাগানের ফল ভালো না-হতে শুরু করে, তখন। তার সঙ্গে প্রচারের ঘাটতি এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না-করাও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না-হওয়ার জন্য দায়ী। যেসব মানুষগুলির জীবনযাত্রা এই বাগানকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, তাঁদের ওপর এই ঘটনাগুলির ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এই ক্ষিদেজনিত মৃত্যুর ভয়াবহ ঘটনাগুলিকে বন্ধ করার এবং শ্রমিকদের তাঁদের দারিদ্রক্লিষ্ট জীবন থেকে বের করে আনার একমাত্র রাস্তা হল চা-শিল্পকে তাঁদের পরিচালন পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন এনে বাগানগুলি যাতে সক্রিয় থাকে এবং সুষ্ঠুভাবে চলে তার ব্যবস্থা করা। এর সঙ্গে অবশ্যই এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, শ্রমিকরা যেন তাঁদের প্রাপ্য সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত না-হন।

উপসংহারের পরিবর্তে

সমস্ত চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি তো আবশ্যিক বটেই, তার সঙ্গে তাঁদের সামাজিক সুরক্ষা এবং অন্যান্য চাকরিগত সুযোগসুবিধাগুলিকেও নিশ্চিত করতে হবে। এই সুযোগসুবিধাগুলির মধ্যে পড়বে বিনামূল্যে পানীয় জল, থাকার সুব্যবস্থা, ইলেকট্রিসিটি, চিকিৎসা, জ্বালানি, সর্বোচ্চ ভর্তুকিযুক্ত রেশন, শিক্ষা; এবং সুরক্ষাপ্রদানকারী যথোপযুক্ত জামাকাপড়, ছাতা, কম্বল, জুতো ইত্যাদি জিনিসপত্রের যথাযোগ্য সুবিধা। এর ফলে শ্রমিকদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে এবং তাঁদের ব্যাধির আশঙ্কা কমবে। এর জন্য প্রথম এবং প্রধানত চা-শ্রমিকদের বহিরাগত হিসেবে দেখা বন্ধ করতে হবে। বৈষম্য বন্ধ করতে হবে। আপনি যদি চা-শ্রমিকদের জীবনযাপন একটু গভীরভাবে লক্ষ করেন, আপনার ঔপনিবেশিক শাসনের কথা মনে পড়ে যাবে। মনে পড়বে, সেই ক্রীতদাসদের ভয়ঙ্কর জীবন যাঁদের শ্রমিক হিসেবে জোর করে নিয়ে এসে খাটিয়ে ছিবড়ে করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হত।

থাকার জায়গা, চিকিৎসার সুযোগসুবিধা এবং তাঁদের যে খাবার দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের নিরিখে কোনও তুলনাতেই আসে না। এর সঙ্গে যোগ করুন থাকার জায়গার ভয়াবহ অবস্থা। এটা অত্যন্ত জরুরি যে, বর্ধিত মজুরি এবং আইন অনুযায়ী তাঁদের যা-যা সুযোগসুবিধা প্রাপ্য সেগুলির সঙ্গে তাঁদের চিকিৎসারও যথাযোগ্য ব্যবস্থা করা। যাতে শ্রমিক পরিবারগুলি সঠিক চিকিৎসা এবং ওষুধের সুযোগ পান, তাঁদের জীবন খোয়াতে না-হয়।

যে ভয়ানক বৈষম্য আজ চা-শ্রমিকদের এবং তাঁদের পরিবারকে এই মৃত্যুর কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তা নির্মূল করতে সরকার, চা-কোম্পানির মালিকদের এবং তাদের ম্যানেজমেন্টের অবিলম্বে জেগে ওঠাটা আজ সময়ের দাবি। একমাত্র তা হলেই অনাহারে মৃত্যুর এই ‘নীরব মহামারী’ ঠেকানো সম্ভব।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4877 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...