নিহিত কোমলগান্ধার : সিনেমা সঙ্গীত ও ঋত্বিক ঘটক — দুই

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

প্রথম পর্বের পর

 

অযান্ত্রিক (১৯৫৮)

‘নাগরিক’-এর দীর্ঘ ছ’বছর পর অবশেষে মুক্তি পায় ‘অযান্ত্রিক’। অবশ্য ঋত্বিক এই ছ’বছর হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। এই ছ’বছরে তিনি লিখে ফেলেছিলেন ‘মুসাফির’ (১৯৫৭) এবং ‘মধুমতী’ (১৯৫৮)-র চিত্রনাট্য, অভিনয় করেছন ‘ছিন্নমূল’ (১৯৫১) ও ‘তথাপি’ (১৯৫০)-তে, বানিয়ে ফেলেছেন ‘The Life of Adivasis’ (১৯৫৫) ও ‘Places of Historic Interest in Bihar’ (১৯৫৫)-এর মতো তথ্যচিত্র। অবশেষে মনোনিবেশ করেন বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী সুবোধ ঘোষের লেখা ছোটগল্প ‘অযান্ত্রিক’-এ। তৈরি হয় ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম ‘স্বতন্ত্র’ ও ‘ব্যতিক্রমী’ একটি অধ্যায় যেখানে নায়ক কোনও রক্তমাংসের মানুষ নয়, বরং ১৯২০ সালের একটি পুরোনো, ভাঙাচোরা, ঝরঝরে Chevrolet Jalopy গাড়ি (নাম্বার — BRO 117)। এই ছবির শব্দগ্রহণ, সঙ্গীত ও আবহ ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এই অনন্যসাধারণ সিনেমাটি পরবর্তী কালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’ ও Martin Scorsese-র ‘Taxi Driver’-কে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। এই সিনেমার চিত্রগ্রহণে দীনেন গুপ্ত, সম্পাদনায় রমেশ যোশী এবং সঙ্গীতে বিশেষ করে বিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ আলি আকবর খান সাহেবের ভূমিকা চিরস্মরণীয়।

বিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ আলি আকবর খান অত্যন্ত সচেতনভাবে এই ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন এবং শব্দকেন্দ্রিক সঙ্গীত ও সঙ্গীতকেন্দ্রিক শব্দকে এক বিশেষ মার্গে প্রতিস্থাপন করেন, যার পেছনে ঋত্বিক ঘটকের নিজের experiment ও virtual realism-এর আভাস মেলে।

সিনেমার প্রথম দৃশ্যেই বর ও বরকর্তা যারা কিনা সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে, তাদের হাস্যকর উপস্থিতি লক্ষণীয়। তারা দূর প্রদেশে বিয়ে করতে যাবে। অথচ ট্যাক্সি না পাওয়ায় তারা বিভ্রান্ত। তারা হন্তদন্ত হয়ে এদিক ওদিক গাড়ি খোঁজে, কিন্তু না পেয়ে হয়রানির একশেষ হয়। এমন হাস্যকর পরিস্থিতির মধ্যে ও নেপথ্যে সঙ্গীতকার অসাধারণভাবে ব্যবহার করেছেন ‘সাঁওতালি বিয়ের গান’।

পরবর্তী দৃশ্যে আবহসঙ্গীত রূপে ব্যবহৃত হয়েছে ‘চার্চের ঘণ্টা’। বিমল মাস্টারের খোঁজে ছোট ছেলেটির হাত ধরে বরকর্তা ‘কেরেস্তানি’ গোরস্থানের গা ছমছমে পরিবেশে উপস্থিত হল, তখন আবহে ব্যবহৃত চার্চের ঘণ্টাধ্বনি অব্যর্থভাবে এই দৃশ্যটিকে বাস্তবায়িত করে তুলেছে। বিমল মাস্টার নিজে একজন converted খ্রিস্টান, যে কিনা গোরস্থানের ভেতর একটি ভাঙা গ্যারেজ ঘরে থাকে, সেই দৃশ্যটিকে অত্যন্ত ‘Realistic mode’-এ নিয়ে আসে এই ‘ঘণ্টাধ্বনি’।

এরপরের দৃশ্যেই গাড়িটির (যার নাম জগদ্দল) আবির্ভাব। ১৯২০ সালের শেভ্রলে জেলোপি গাড়িটির অত্যন্ত ভগ্নদশা ও হাস্যরসের উদ্রেক ঘটায় এর যথাযথ আবহসঙ্গীত যেখানে সঙ্গীত পরিচালক জলতরঙ্গ, ঢাক ও ক্ল্যারিওনেট-এর অসামান্য ব্যবহার করেছেন যা অনেকটা বিয়েবাড়ির ব্যান্ডপার্টির মতো শোনায়। এরপরে গাড়ির চলার গতি, লয় ও দুলুনিকে মাথায় রেখে ব্যবহৃত হয়েছে সেতার, কীর্তনের সুরে। সেতারের মতো তারের যন্ত্রে কীর্তনের সুর এক্ষেত্রে বিশেষ হাস্যরসের সৃষ্টি করে।

এর কিছু পরে অবশ্য সেতারের জায়গা দখল করে নেয় সরোদ ও বাঁশির যুগলবন্দী যখন আরোহীদের তাদের গন্তব্যে (অবশ্য পথে বিস্তর দুর্ভোগের পর) নামিয়ে বিমল মাস্টার তার ‘জগদ্দল’-কে নিয়ে ফিরে চলে। পথে গরুর পাল, রাঢ বাংলার প্রাকৃতিক শোভায় বাঁশির ব্যবহার এখানে সার্থক প্রয়োগ। অবধারিতভাবে উঠে আসে একটি গানও। একটি জলাশয়ের পাশে, ‘জগদ্দল’-এ হেলান দিয়ে ড্রাইভার বিমল মাস্টার গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে একটি বহুল জনপ্রিয়, একদা জ্ঞান গোঁসাই ও পরবর্তীকালে পান্নালাল ভট্টাচার্যের গাওয়া একটি বিখ্যাত কালী-কীর্তন, ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’। পরবর্তী শটে যখন ক্যামেরার সামনে একা ড্রাইভার বিমল মাস্টার, নেপথ্যে বেজে ওঠে নহবতের সানাই। এই নহবৎ সঙ্গীত দৃশ্যটিকে এক বিশেষ মর্যাদালাভে সাহায্য করে।

এই সিনেমাতে একটি ভিখারির চরিত্র যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকৃত করে। কখনও comic relief আবার কখনও satire-এর ভঙ্গিতে সে অবতীর্ণ হয়। ভিখারিটির উপস্থাপনাতেও সঙ্গীতের ব্যবহার এ সিনেমায় বিশেষ গুরুত্ব পায়। আচমকা সে বিমল মাস্টারের গাড়ির সামনে চলে আসায় এক বিশেষ হাস্যরসের সৃষ্টি হয় যাকে সুরকার জলতরঙ্গ ও সেতারে কীর্তনের সুরের মাধ্যমে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলেন। অনিবার্য ভঙ্গিতে এরপরেই উঠে আসে আদিবাসী সঙ্গীত। আমরা দেখতে পাই রাস্তার মাঝে থমকে আছে ‘জগদ্দল’। মাঠ ঘাট ডিঙিয়ে এগিয়ে চলেছে বিশাল এক সাঁওতালি মিছিল। আবহে বেজে ওঠে সাঁওতালি বাঁশি ও ধামসা। আদিবাসী সঙ্গীতের অনন্যসাধারণ treatment ঋত্বিক ঘটকের এই সিনেমার পরতে পরতে জেগে থাকে।

পরবর্তী মুহূর্তে ঋত্বিক আদিবাসী সঙ্গীত ছেড়ে এগিয়ে গেছেন ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের দিকে। সদ্য বিবাহিত একটি দম্পতিকে বিমল মাস্টার তার গাড়িতে চাপিয়ে রিসর্টে পৌঁছে দিয়ে আসে। একটি বিশেষ দৃশ্যে সদ্য বিবাহিতা রমণীটি আনমনে পা দিয়ে লাল মাটি, কাঁকড় ঘাঁটে। নেপথ্যে অনবদ্যভাবে জেগে ওঠে সেতার ও জলতরঙ্গের যুগলবন্দি।

বাঁশির প্রয়োগও এই সিনেমার যত্রতত্র দেখা যায়। বিশেষত সেই দৃশ্যটি যেখানে বিমল নবদম্পতিকে গন্তব্যে পৌঁছে ফিরে আসছে। পেছনে রয়ে যাচ্ছে রিসর্ট, নববিবাহিত বউ এবং কুয়াশার মতো কিছু স্মৃতি। মুহূর্তে নেপথ্যে হালকা সুরে বেজে ওঠে বাঁশি। দিকদিগন্ত ছাপিয়ে সেই বাঁশির আওয়াজ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এরপরে পুনর্বার ব্যবহৃত হয় সেতার ও জলতরঙ্গ। রাস্তার ধারে, একটি দৃশ্যে, বিমল মাস্টার ও জগদ্দল পাশাপাশি দাঁড়ায়। নেপথ্যে উক্ত যন্ত্রদুটির যুগলবন্দির আওয়াজ ছাপিয়ে হঠাৎই সেখানে জায়গা করে নেয় সরোদের গম্ভীর অথচ করুণ সুর। ভীমপলশ্রী রাগে।

বাঁশির মতো জলতরঙ্গও বহুল ব্যবহৃত হয় এই সিনেমাতে, এমনকি একটি দৃশ্যে, যেখানে ইস্পাত কলকারখানা, কোলিয়ারি দেখানো হয়েছে, সেখানেও ব্যবহৃত হয়েছে জলতরঙ্গ। এর ঠিক পরে পরেই আরও একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই আদিবাসী মজুরদের। তারা ট্রাকে করে কোলিয়ারিতে কাজে চলেছে। লেভেল ক্রসিংয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে বিমল মাস্টারের গাড়ি ও আদিবাসী মজুরদের ট্রাক। নেপথ্যে অনবদ্যভাবে ব্যবহৃত হয়েছে আদিবাসী মহিলাদের সম্মিলিত গান। তারা গান গাইতে গাইতে কাজে চলেছে। তাদের এই গান যেন দেশ-কালের গণ্ডি ছাপিয়ে বহুদূর বিস্তৃত হয়।

হাস্যরসসমৃদ্ধ দৃশ্যেও উঠে এসেছে দেশজ গান। আমরা এমনই একটি দৃশ্যের মুখোমুখি হই সিনেমাটিতে যখন দেখি বাজারের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত পাঞ্জাবী ড্রাইভারের সঙ্গে দ্বৈরথে মেতে ওঠে বিমল মাস্টার। পাঞ্জাবী ট্যাক্সি ড্রাইভার খোসমেজাজে পাঞ্জাবী গান গাইলে, বিমল মাস্টারও তাকে টেক্কা দেবার জন্য চিৎকার করে ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়’ গেয়ে ওঠে। অসাধারণ দক্ষতার সাথে ঋত্বিক এই দুই ভিন্ন মেজাজের মানুষকে গানের মাধ্যমে চিনিয়ে দেন।

রাতের কোলিয়ারি শহরকে দেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে বাঁশি ও সরোদ। রাতের গভীরতা ও মাদকতাকে দেখাতে গিয়ে বাঁশি ও সরোদের এমন অপূর্ব কোলাজ খুব একটা চোখে পড়ে না আমাদের।

পরবর্তী দৃশ্যে আমরা পরিচিত হই ভৈরবী রাগের সাথে। একটি সকালবেলার দৃশ্য ভেসে ওঠে যেখানে দেখি গাড়ির মধ্যে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে বিমল মাস্টার। দূরে বাচ্চাদের দল খেলা করে। সকালবেলার দৃশ্যে সেতারের ভৈরবীর আবহ দৃশ্যটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ওঠে। ম প প-তে এর চলন অনবদ্যভাবে এই দৃশ্যটিকে একটি বিশেষ স্বীকৃতি দেয়।

রাঢ়বাংলার পটভূমিতে রচিত সিনেমায় রাঢ়ের সঙ্গীত ও সংস্কৃতি উঠে আসবে না এটা হয় না। ঋত্বিক এখানে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন পুরুলিয়ার ছৌ-কে। সিনেমারই একটি বিশেষ দৃশ্যে দেখা যায় গ্রামবাংলার একটি মেলা ও তাকে ঘিরে মানুষের ভিড়। সেখানে ছৌ শিল্পীদের আগমন ও সঙ্গীত পরিবেশনাও দৃশ্যমান। এই দৃশ্যের continuation-এ দেখা যায় একটি মন্দির। বিমল মাস্টার সেখানে পুজো দেয়। পুরোহিত তাকে একটি প্রসাদী ফুল দেয়। মন্দিরের পরিবেশে নেপথ্যসঙ্গীত রূপে উঠে এসেছে সেতার ও সরোদের ধুন। তার সাথে অনবদ্যগতিতে উঠে এসেছে আদিবাসী ধামসার বোল।

এরপরের দৃশ্যেই আমাদের আশ্রয় নিতে হয় সরোদে। একদল বাচ্চা জগদ্দলকে লক্ষ্য করে কাদা ছোঁড়ে। বিমল মাস্টার তাদের আটকাতে গিয়ে নিজেও আহত হয়। ক্লান্ত মনে সেই জায়গা ছেড়ে একটি পুরনো ঝিলের ধারে বিমল জগদ্দলের কাদা পরিষ্কার করে ও অবচেতনে গাড়ির সঙ্গে সুখ দুঃখের গল্প বলে। এই দৃশ্যটিকে আরও প্রাঞ্জল করে তোলে সরোদের করুণ সুর।

এই দৃশ্যের পর আমরা দেখতে পাই বিমল মাস্টারের সাথে সেই নববিবাহিতা রমণীটিকে যে কিনা ইতিমধ্যেই তার প্রেমিক তথা স্বামী দ্বারা পরিত্যক্ত। সেই মুহূর্তে বিমল মাস্টার ছাড়া তার অন্য কোনও অবলম্বন নেই। বিমল মাস্টার তাকে কলকাতার ট্রেনে তুলে দেয়। ট্রেন দূরে হারিয়ে যায়। এই গুমোট পরিবেশটিকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে সুরবাহার। বিলাসখানী টোড়ী রাগে সুরবাহারের এই অসাধারণ composition-টি সিনেমার একটি অন্যতম প্রধান সম্পদ।

পূর্বেই বলা হয়েছে আদিবাসী সঙ্গীত একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এই সিনেমায়। একটি দৃশ্যে বিমল মাস্টারের গাড়ি জঙ্গলের মধ্যে খারাপ হয়ে যায়। বিমল জল আনতে জঙ্গলে ঢোকে। সহসা ধামসা ও শিঙা বেজে ওঠে। এরপরেই অসাধারণ দক্ষতার সাথে ঋত্বিক আদিবাসী লোকউৎসবের একটি বড় অংশকে ক্যামেরায় ধরেন। ক্যামেরায় উঠে আসে নবান্ন। আদিবাসীদের নতুন ধান ঘরে তোলার উৎসব। বিমল মাস্টার একা খোলা আকাশের তলায় এসে দাঁড়ায়। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে তার। নেপথ্যে হালকাভাবে সরোদ বাজে। অনেকটা রাগেশ্রী রাগের ছোঁয়ায়। পরক্ষণেই তা ধামসা, মাদল ও সাঁওতালী শিঙার আওয়াজে ডুবে যায়। ভেসে ওঠে আদিবাসী রমণীদের নাচ। সব মিলিয়ে এই দৃশ্যে ব্যবহৃত সঙ্গীত সিনেমাটিকে একটি অন্য স্তরে উন্নীত করে। এই সেই স্তর যেখানে রাগসঙ্গীত ও ভূমিজ সঙ্গীত মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

মৃত্যুকেন্দ্রিক সঙ্গীতও এই সিনেমায় প্রবলভাবে উঠে এসেছে। সিনেমার শেষাংশের একটি দৃশ্যে দেখা যায় — কেরেস্তানী গোরস্থানে একটি খ্রিস্টান কবরের সামনে বসে এক আদিবাসী রমণীর বিলাপ। বিলাপের সেই মনখারাপ করা সুরে বাড়তি সংযোজন ঘটায় গির্জার ঘণ্টাধ্বনি। বিলাপের সুর ও গির্জার ঘণ্টাধ্বনি (যা কিনা মৃত্যুর সংকেতবাহী) এই অনবদ্য সংমিশ্রণ অতি অবশ্যই পরিচালক ও সঙ্গীতপরিচালকের মুনশিয়ানার দাবি রাখে।

সিনেমা যতই শেষের দিকে এগিয়ে চলে, একই সূত্রে এগিয়ে চলে সাঙ্গীতিক কারিকুরি। সিনেমার শেষের দিকে দেখা যায় বিমল মাস্টার জানপ্রাণ লাগিয়ে ‘জগদ্দল’কে আবার আগের মতো করবার চেষ্টা করছে। নেপথ্যে জলতরঙ্গ ও নানাবিধ যান্ত্রিক আওয়াজকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা শব্দমণ্ডল ও তবলা লহরী দৃশ্যটিকে বিশেষ মাধুর্য প্রদান করে। সব মিলিয়ে যেন এক সাঙ্গীতিক যুদ্ধচেতনার আভাস, দৃশ্যটিকে আরও পরিপূর্ণতা দান করে দ্রুততায় বেজে ওঠা সরোদ। কিন্তু সমস্ত চেষ্টা বিফল হয়। ‘জগদ্দল’ আর সেরে ওঠে না। লোহাপট্টির লোকেরা তাকে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হয়। একটি কাব্যিক অবয়বকে ঘিরে বেড়ে ওঠা একটি মানুষের স্বপ্ন এভাবেই মাথা কুটে মরে।

জগদ্দলের অনুপস্থিতিকেও অসাধারণভাবে দেখানো হয়েছে একটি পাঞ্জাবী গানের মধ্য দিয়ে। ক্যামেরায় উঠে আসে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড ও সেই পাঞ্জাবী ড্রাইভারের গান। সেখানে আর বিমল মাস্টার বা তার জগদ্দল নেই। পাঞ্জাবী লোকগীতিটিও কোথাও যেন ভীষণ melancholic notes-এ পরিণত হয়েছে।

সিনেমা শেষের সাঙ্গীতিক রূপটি আরও তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে যেখানে জগদ্দলকে ভেঙেচুরে লোহাপট্টির লোকেরা নিয়ে যায়। বিমল মাস্টার অসহায়ভাবে একা তাকিয়ে থাকে। নেপথ্যে সরোদে বেজে ওঠে দরবারী কানাড়া। ‘পুরুষের কান্না’রূপে উঠে আসা দরবারী এখানে বিমল মাস্টারের দুঃখকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। শেষ দৃশ্যে ব্যবহৃত হয় একটি অসামান্য music sequence। ভগ্নমনোরথে বিমল জগদ্দলের শেষযাত্রা দেখে। আচমকাই বেজে ওঠে জগদ্দলের হর্ন। সম্ভবত তার ‘লোহার’ লাশ নিয়ে যাবার সময় সেটি পড়ে যায়। একটি বাচ্চা তা নিয়ে খেলা করতে করতে হর্ন বাজিয়ে ফেলে। এ যেন ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। বিমল মাস্টারের বিহ্বল দৃষ্টি ছাপিয়ে বেজে ওঠে সরোদ (দরবারী রাগে)। তার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতে স্থান নেয় আদিবাসী গান ও ধামসা। ছবি শেষ হয়।

(এরপর আগামী সংখ্যায়)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...