রবিদার সঙ্গে… মন্টো সফরে…

সুদীপ বসু

 

“রাগিণীর আলাপ নই, সেতারের তার নই/আমি কেবল একটি আওয়াজ, পরাজয়ে ভেঙে পড়ার আওয়াজ।” মির্জা গালিবের এই পংক্তিদুটি রবিদা (রবিশংকর বল) আমাকে মাঝেমাঝেই শোনাত। বলত এটা নাকি ওর জীবনের সঙ্গে মিলে যায়। এখন অবশ্য এ কথা অনর্থক হয়ে গেছে, ১২ই ডিসেম্বর এই মরপৃথিবী ছেড়ে ওর চলে যাবার পর। জয়পরাজয়ের ঊর্ধ্বে এখন রবিশংকর বল — সেসব বিচারের দায়িত্ব হয়তো নেবে আগামীদিনের পাঠক। অনেক বছর ধরে রবিদার ঘনিষ্ঠ ছিলাম, পছন্দ-অপছন্দ মিলিয়ে মানুষটি আমায় টানত — অস্বীকার করি না। সেই বন্ধুত্ব শিলীভূত হয়ে গিয়েছিল অন্তত একটা সময়ে — ২০১১-র শেষদিক থেকে ২০১২-র শেষদিক পর্যন্ত।

২০১১-র শেষে — দিনক্ষণ এখন আর আমার স্মৃতিতে ধরা নেই — রবিদা একদিন সন্ধের মুখে হঠাৎ ফোন করে বলল, একটা দারুণ প্রকল্প আছে। কী প্রকল্প জিজ্ঞেস করাতে শুধু বলল তুমি কাজ করে আনন্দ পাবে, এখন এই অবধি-ই। কাল দেখা হলে বাকিটা বলব।

একটু খটকা ছিল। রবিদা যে বিষয়টা আমার ভালো লাগবে বলে বিশ্বাস করে, সেটা তো আমার ভালো না লাগতেই পারে। বন্ধু বলে তো বিশ্বাস বা রুচি খাপে খাপে সবসময় আটকে যায় না। যাইহোক পরদিন দেখা হতে শুনলাম উর্দু সাহিত্যিক ডাকসাইটে কথাকার সদত হসন মন্টোর একটু অচেনা ততটা প্রচারিত নয়, এমন গল্পের একটা কালেকশন হবে। সম্পাদনা করবে রবিশংকর বল। রবিদা বলল এটা একটা বিরাট বিস্তারের কাজ, মন্টোকে সবাই দেশভাগের লেখক বা প্রতিবাদী লেখক বলেই জেনে এসেছে, আমি ওর অন্য একটা পরিচয়ও তুলে ধরতে চাই যেখানে প্রান্তিক ও ক্ষুধার্ত মানুষ না জেনেই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়, যেখানে একজন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক খুব ছোট পরিসরে খুব বড় করে দেখা হয়। মানুষের জীবনের আসল বিষয় দুটি — ক্ষুধা আর যৌনতা। এই দুটি বৃত্তির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ-মানুষীর সম্পর্কের ওপর অজস্র অসামান্য ছোটগল্প লিখেছিলেন মন্টো, যেগুলিকে এক মলাটে আনাই ছিল রবিদার লক্ষ্য। কমিউনিস্ট বা রিঅ্যাকশনারি নয় — মানুষ মন্টোর একটি মানবিক ছবি ফুটিয়ে তোলাই ছিল রবিদার উদ্দেশ্য।

সত্যি বলতে কি, মন্টোর এই অন্য ঘরানার গল্পগুলির ব্যাপারে তখনও অবধি আমারও খুব একটা জান পহেচান ছিল না। প্রথমত, মন্টোর নামটা আমি তখনও ‘সাদাত হোসেন মান্টো’ উচ্চারণ করতাম আর ওর অনেক গল্পই ছিল আমার না-পড়া। কিন্তু মন্টো সম্পর্কে যতটুকু পড়া ছিল, ওঁর ওই নিজস্ব কবরের ওপর উৎকীর্ণ করার জন্য লেখা সমাধিলিপিটি সহ, তাতে করে মন্টোকে নিয়ে কাজ করতে আমার তুমুল উৎসাহ ছিল। পড়েছিলাম যে মানুষটা পরিষ্কারভাবে জানত যে সে তার সমসময়কে নিয়ে গল্প লেখে। তার গলগুলি যদি অশ্লীল হয়, তবে বুঝতে হবে তার সময়টাই ছিল অশ্লীল। বেশ্যাবৃত্তিকে যদি মুছে দেওয়া যায় তবে তার গল্পগুলোতে তারা আর আসবে না।

প্রবল উৎসাহে বইয়ের খোঁজ শুরু হল। বাংলা ভাষায় তো মন্টোর ওপর তেমন কোনও বই নেই। যা আছে তাতে মন্টোর পার্টিশনের গল্পগুলিই বিধৃত হয়ে আছে। মন্টোকে দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল সমাজমনস্ক ও দেশভাগের বেদনাজর্জরিত হিসেবেই শুধু পোর্ট্রে করা হয়েছে। মানুষের জীবনের অলিগলিগুলো যে মন্টো চিনতেন, বিশেষ করে দরিদ্র গণিকাদের, তাদের হতাশা কামনা প্রেম ঘৃণাকে হাতের পাতার মতো জানতেন, সেসব বিষয়ে সম্পাদকদের তেমন একটা উৎসাহ দেখা যায় না।

ইংরাজিতে অনেক বই আছে মন্টোর লেখা নিয়ে। প্রথমেই খালিদ হাসান সম্পাদিত ‘বিটার ফ্রুট’ বইটির কথা মনে পড়ে। হালকা হলুদ কভারঅলা বেশ স্বাস্থ্যবান গ্রন্থ। এই বইটি হাতে পেয়ে রবিদা আবার আমাকে ডাকল। বুঝতে পারলাম এই বই থেকে রবিদা গল্পের পর গল্প খুঁড়ে মন্টোকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছে। আর গল্পগুলো আমাকেও পড়ে দেখতে দিচ্ছে যাতে ওই দিগন্ত-আবিষ্কারের আনন্দ আমিও কিছুটা পাই। সত্যিই অসামান্য সব লেখা। কী মানবিক, কী ক্ষুরধার। ‘খালেদ মিয়া’, ‘পেরিন’, ‘লাল রেইনকোট পরা মহিলা’, ‘মোজেল’, ‘সাতটি জাদুফুল’, ‘বুনো ঝোপের পেছনে’ — কী সব চরিত্র, কী দেখার চোখ, কী ভাষার ক্ষিপ্র গতি। জোগাড় হল আরও বেশ কিছু ইংরেজিতে অনূদিত মন্টোর রচনা সংগ্রহ। আমাদের, রবিদা ও আমার উভয়েরই যেহেতু উর্দুজ্ঞান নেই, তাই ইংরেজি থেকেই মন্টোকে পড়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। মন্টোর নিজের ওপর লেখা অসাধারণ, একটি রচনা ‘মন্টোকে’ হাতে এল। হাতে এল ‘আমার পাঠকদের প্রতি’। অনবদ্য রচনা। রবিদা আর আমি আলোচনা করলাম বড় লেখক হতে গেলে, চারপাশের নির্মম বাস্তবতাকে বিদ্ধ করতে গেলে, আগে নিজেকে নির্মমভাবে বিদ্ধ করতে শিখতে হয়। মন্টো শিখেছিলেন।

আরও কিছু বই রবিদা অনলাইনে কিনল। আমিও দু-একটা জোগাড় করলাম। ‘তুতু’ গল্পটিকে নিয়ে একটা গল্প আছে। অনেকদিন আগে, এই গ্রন্থপরিকল্পনার অনেক আগে, যাদবপুরে একটি অনুষ্ঠানে কবি অমিতাভ গুপ্ত এই গল্পটির কথা বলেছিলেন। তখন থেকেই এই আশ্চর্য গল্পটির খোঁজে ছিলাম আমি। মন্টোর ‘রচনাসংগ্রহ’ তৈরি করার সময় এই গল্পটির আবার ডাক পড়ল। কিন্তু মন্টোর কোনও কালেকশনেই এর হদিশ পাওয়া গেল না। স্বয়ং অমিতাভবাবুও মনে করতে পারলেন না কোত্থেকে এটি পড়েছিলেন। খুঁজে খুঁজে যখন হন্যে তখন মনে মনে ভাবলাম হয়তো এটি আদৌ মন্টোর লেখা গল্প না… হয়তো… হতেও তো পারে। হঠাৎ একদিন রাতের দিকে রবিদার ফোন। দিল্লি থেকে এক বন্ধু দুটি বই পাঠিয়েছে মন্টোর রচনার ইংরেজি অনুবাদের। দুটি স্বল্পপরিচিত বই, তার মধ্যে একটিতে পাওয়া গেছে ‘তুতু’কে। পরদিন দুপুরেই আমি হাজির হলাম রবিদার কাছে।

বই সম্পাদনা তো নয়, এ এক মন্টো আবিষ্কারের পাশাপাশি যেন আত্ম-আবিষ্কারের খেলাও। হাতে এল মন্টোর নির্বাচিত গল্প — একটি খলিদ হাসানের অনুবাদে, অন্যটি আতিশ তসিরের ভাষান্তরে। রবিদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুলেখক মবিনুল হক কথা দিলেন মূল উর্দু থেকে তিনি মন্টোকে অনুবাদ করে দেবেন। আরেকটি অসামান্য বই হাতে এল — রক্ষানন্দ জলিলের ‘নেকেড ভয়েসেস : স্টোরিজ অ্যান্ড স্কেচেজ’।

অনুবাদের দায়িত্ব কাকে কাকে দেওয়া যাবে তা নিয়ে রবিদা প্রথম থেকেই উত্তেজিত ছিল। ঠিক হল শুধু নামীদামী লোক দেখলেই হবে না — মন্টোকে বোঝার ক্ষমতা রাখে এমন গভীর বোধসম্পন্ন মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রসঙ্গত বলি, এই সংগ্রহের তিনটি অনবদ্য গল্পের অসামান্য অনুবাদ করেছেন রিঙ্কু বসু যিনি ঘটনাচক্রে আমার স্ত্রী। গল্পগুলির নাম ‘সাতটি জাদুফুল’, ‘তুতু’ ও ‘ওপর, নীচে আর মাঝখানে’।

আমার ওপর দায়িত্ব বর্তাল বেশ ক’টি গল্প অনুবাদের পাশাপাশি একটি জুতসই জীবনী রচনার। মন্টোর জীবনী লেখার ক্ষেত্রে আমি মূলত আয়েশা জালালের ‘পিটি অফ পার্টিশন : মন্টো’স লাইফ টাইমস অ্যান্ড ওয়ার্কস অ্যাক্রস দ্য ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ডিভাইড’ বইটিকে ব্যবহার করেছিলাম। ‘মন্টো, একটি ক্ষত’ নামে একটি ভূমিকা লিখেছিল রবিশংকর বল। এছাড়াও অবশ্য রবিদা মন্টোর বেশ ক’টি গল্প এবং একটি নাটকের (ঘূর্ণি) তর্জমা করেছিল। রবিদার স্ত্রী সীমা বল ও মেয়ে তিয়াষা এই কর্মযজ্ঞে অনুবাদক হিসেবে আনন্দে অংশ নিয়েছিলেন।

সব হয়ে যাওয়ার পর রবিদা দায়িত্ব নিল বাংলা অনুবাদগুলি বলরাজ মনরা ও শরদ দত্ত সম্পাদিত ও রাজকমল প্রকাশনী প্রকাশিত মন্টোর পাঁচ খণ্ডের হিন্দি ‘দস্তাবেজ’-এর সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার। এ কাজে অবশ্য আমি কোনওভাবে কাজে লাগতে পারিনি।

দুটো ঘটনা মনে আছে। কিছু লেখার প্রুফ দেখে জমা দিয়েছি। রবিদা বোধহয় বাড়ি বসে আবার সেগুলো মেলাচ্ছিল। হঠাৎ সন্ধেবেলা একটা ফোন, অল্প টালমাটাল কণ্ঠস্বর, ‘আগে বাংলা বানানটা ভালো করে শেখো, তারপর বাংলা সাহিত্য করবে।’ এটুকু বলেই রবিদা ফোন কেটে দিল।

প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর ২০১২ হলেও বইটা হাতে পেয়েছিলাম ২০১৩-র বইমেলার মাঠে, সদ্য বাঁধাই হয়ে এসেছে খবর পেয়ে হাজির আমি আর রবিদা। দে’জ পাবলিশিং-এর ম্যারাপের বাইরে তখন হৈ হট্টগোল। এসে উপস্থিত হয়েছেন ডাকসাইটে গায়ক ও সুরকার অনুপম রায়। তাকে ঘিরে মেলা। আমরা এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছি সদ্যজাত সন্তানকে প্রথমবার চোখে দেখবার অভিপ্রায়ে। বেশ ক’বার ফোন করার পর দে’জ-এর তরুণ কর্ণধার অপু এক কপি মন্টো এনে আমাদের হাতে তুলে দিলেন। সেই মুহূর্তটা জীবনে কোনওদিন ভোলবার নয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...