বজ্রশলাকায় খোদিত মৃৎফলকে লিখিত অজানা ঐশীর উড়ন্ত বই

নয়ন কোনার

 

সিনাই পর্বতে উঠলেন মোজেস। অন্ধকারে ছেয়ে গেল দশদিক। প্রবল দুর্যোগের ক্ষণ। বজ্রের ঝলসানিতে রচিত হল মানবেতিহাসের এক নতুন পর্ব। যখন তিনি ফিরে এলেন তখন তাঁর হাতে বজ্রশলাকায় খোদিত মৃৎফলকে লিখিত ঐশী বিধান – টেন কম্যান্ডমেন্টস, দশানুশাসন। সেটিই সম্ভবত পৃথিবীতে নেমে আসা প্রথম অজানা উড়ন্ত বই। কয়েক সহস্রাব্দের ব্যবধানে, মানবজাতির জীবন যখন আবার এক দুর্যোগঘন আবহে দিশাহীন, তখন আবার এসে পড়েছে আর এক ‘অজানা উড়ন্ত বই’, এসেছে রঞ্জন ঘোষালের হাতে। সেই রঞ্জন ঘোষাল, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র উচ্চৈঃশ্রবা, অ্যামাজনের ম্যাকাওরা নিজেদের লোক মনে করে যাঁর চোখেমুখেকলমে রং মাখিয়ে যায়। বইটি সুধীজনের হাতে তুলে দেবার ভার নিয়েছে ৯ঋকাল বুকস। উল্লেখ্য, মোজেসের দশানুশাসন ছিল ঈশ্বরের দান, ‘অজানা উড়ন্ত বই’ নিরীশ্বরের।

কিছু প্রবন্ধ, কিছু অণুগল্প, একটি নাটক এবং ‘অনুস্মৃতি’র সমাহারে সংকলিত এই বই। ‘অনুস্মৃতি’ নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বই। পাতা ওল্টাতে গিয়ে পাঠক অভিমন্যুদশা প্রাপ্ত হতে পারেন। এই চক্রব্যূহে প্রবেশ করা যায়, তবে শেষ না করে নির্গমনের পথ নেই।

অজস্র বর্ণময় চরিত্রের সমাহার, অপরূপ ভাষাসৌকর্য, হিউমার, উইট, ইনস্ট্যানশিয়েশনের বৈদগ্ধ্যচ্ছটা, শব্দ ও বাক্যের অপ্রত্যাশিত মোচড় এবং সর্বোপরি উদার মানবতাবাদের রসফল্গু পাঠককে বিমোহিত করে রাখে। তবে হ্যাঁ, পাঠকের তরফ থেকেও সিরিয়াসনেস দাবি করে বইটি। একেবারে অদীক্ষিত, অশিক্ষিত মনন নিয়ে এই বই উদ্ধার করা সম্ভব নয়। চক্রব্যূহে প্রবেশের কৌশল কিন্তু সকলের আয়ত্তাধীন নয়। ঐটুকু আয়ত্ত করেই এই বইয়ে প্রবেশ ।

‘বিস্মৃতিকথা’ অধ্যায়ের প্রথমেই পাওয়া যায় ‘দুগ্ধস্বলা’, ‘মুসলমতী’র মতো শব্দ। রঞ্জন ঘোষালের লেখনীতে প্রথম ঝলকে সৈয়দ মুজতবা আলী এবং পরশুরামের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে এই দুজন ছাড়াও যথেষ্ট রসদ জুগিয়েছেন কমলাকান্ত, শিব্রাম, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, বনফুল এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ। এঁদের দোয়াতের কালির সঙ্গে লেখক অজানা এক রাসায়নিক যোগ করেছেন। ওটি তাঁর নিজস্ব। সবমিলিয়ে শৈলী ও বক্তব্যে রচনাগুলি অনুপম হয়ে ওঠে। ঐ প্রবন্ধেই তাঁর পূর্বপুরুষের মুসলমান রমণীর দুগ্ধঋণের কথা যে ভাষায় ব্যক্ত করেছেন তা আজকের মৌলবাদদীর্ণ সংখ্যালঘুশ্বাসরোধী ভারতীয় উপমহাদেশে এক অনন্য সম্প্রীতির বার্তা বহন করে।

ভূমাগর্ভ এই বইটি বরিশালের প্রতি লেখকের যাচ্ছেতাই পক্ষপাতিত্বের কথা ঘোষণা করছে, ‘বরিশাল বনাম ধরিত্রীর বাকিটুকু’ প্রবন্ধের ছত্রে ছত্রে তা প্রকাশিত। শশাঙ্ক গাঙ্গুলিকে বরিশালের প্রতিনিধি করে বরিশাল ও বইশাইল্যাদের বর্ণময় আর্ট গ্যালারি রচনা করেছেন লেখক। কেবল এই প্রবন্ধে নয়, ‘অনুস্মৃতি’তে ‘বেদের মেয়ে মারিয়া’ শীর্ষক অণুগল্পেও তিনি এক লহমায় কয়েক শতাব্দী আগে হারিয়ে যাওয়া দেশোয়ালি ভাইবোনদের চিনতে পারেন চেক প্রজাতন্ত্রের মাটিতেও। ‘অনুস্মৃতি’তে আবার দেখি লেখকের সন্তানের ডাকনাম ঘন্টেশ্বর। আপাতদৃষ্টিতে এ শুধু আদরের ডাক এবং খানিকটা কমিক রিলিফ। কিন্তু বরিশালের ম্যাপ খুললেই দেখা যাবে ঘন্টেশ্বর নদ আজও তার সজল প্রবাহে বরিশালকে শস্যশামলা রাখার কর্তব্য অবিচলভাবে পালন করে চলেছে। সেই বরিশালের প্রবাহকে তিনি উত্তরপুরুষে ধরে রাখলেন ঐ নামের মধ্যে।

এই অধ্যায়ের চিত্রশালিকায় একে একে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ, ব্রজেন শীল, বরুণদেব, ইকোল্যালিয়া-আক্রান্ত মামু, লেখকের একজীবনে লরেল-হার্ডি জীবনযাপন, ওপেনহাইমার, রুজভেল্ট প্রমুখ চেনা অচেনা চরিত্রের বর্ণময় উপস্থিতি। শেষ প্রবন্ধ ‘পালা’ যা পরবর্তী অধ্যায় তথা বাংলাসাহিত্যের এক অদৃষ্টপূর্ব সৃষ্টি ‘অনুস্মৃতি’র যথার্থ ভূমিকা রচনা করে। লেখকের সার কথা, পালাতে হবে। পালাতে হবে কৌপীন সম্বল করে, অথবা অবধূতের বেশে। পথে জুটবে অনাহার-আপ্যায়ন, ঠ্যাঙানি-অভ্যর্থনা এবং অপমান-সম্মানের বিমিশ্র নৈবেদ্য। নিরাসক্ত হয়ে সব গ্রহণ করতে হবে। কাছে রাখতে হবে একটি আয়ুধ – চিমটে।

‘অনুস্মৃতি’ একটি আত্মজীবনী, ভ্রমণকথা, থ্রিলার, অ্যাডভেঞ্চার, দর্শন এবং আরো বাড়তি কিছু। লেখক বারংবার ঘরের বাঁধন ছিন্ন করেছেন, পান করেছেন নানা ঘাটের জল, উপবাস-ভিক্ষা-লঙ্গরখানার হাজার স্বাদ তাঁর জিভে – সবজায়গার ছাই উড়িয়ে অভিজ্ঞতার অরূপরতনটি তিনি হাজির করেছেন। এসব করেছেন যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়, ছাত্রজীবন শেষ করে BHEL-এর চাকরিটি ছেড়ে ঝাড়া হাত-পা হবার পর এবং সদ্যোজাত সন্তানকে জীবনসঙ্গিনীর জিম্মায় রেখে। অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীবের পক্ষে কল্পনা করা কষ্টকর, কিন্তু ঘটনাগুলি বাস্তবতার পথে হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছেছে, কল্পনাবিলাসের অবকাশ নেই।

এই যে ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মত বাঁশি বাজাতে বাজাতে বারবার গৃহত্যাগ, বারবার বিপদকে আলিঙ্গন করে মরণকে বুড়িছোঁয়া করে ফিরে আসা – কিসের টানে? কার ডাকে? অন্তত তিনটে কারণ চিহ্নিত করা যায় ‘অজানা উড়ন্ত বই’ থেকে। প্রথমত, অন্তরের বাউণ্ডুলে কিশোরটির উদ্দাম চাপল্যের কাছে গৃহস্থ মনটির পরাভব। দ্বিতীয়ত, বিশ্বাসের ইস্পাতকঠিন আবরণ উন্মোচন করে ধর্মের অলিগলিতে ঘুরে বিশ্বতানে বাঁধা মানবতার জয়গানের ধ্রুবপদটি নিজের চিত্তবীণায় তুলে নেওয়া। ঈশ্বরের বেদীতে নিরীশ্বরকে প্রতিষ্ঠিত করা। তৃতীয়ত, সভ্যতার শিকড়টির অনুসন্ধান। পাশ্চাত্যরচিত ইতিহাসের ন্যারেটিভকে ধ্রুবসত্য বলে মেনে না নিয়ে ইতিহাসের শিকড়টি সনাক্ত করা।

‘অনুস্মৃতি’র প্রারম্ভেই ছাত্রজীবনের দুষ্টুমিমাখা পলায়ন। একবার মল্লারপুরস্টেশনে বিনা টিকিটে ধরা পড়ে স্টেশনমাস্টারের ছেলেকে পড়ানোর দায়িত্বলাভ। আর একবার গঙ্গাসাগর মেলা থেকে ট্রাকে ফেরার সময় চোরাই কচ্ছপদের সঙ্গে ট্রাকের পাটাতনে নিশিযাপন। সেই শুরু। পরবর্তীকালে সাধুর ভেক ধরে চষেছেন গুলবর্গা, মনমাড, শিরডি প্রভৃতি স্থানে। পুলিশের মার খেয়েছেন, দীনহীন সাধুর কাছে খিচুড়িও খেয়েছেন। সেই সাধুবাবার নিজের ধারণা তাঁর বয়স দুহাজার বছর। এক গামছা বিক্রেতা কুড়ি টাকার গামছা আট টাকায় বেচলে কত টাকার পুণ্য হবে জানতে চাইলে তিনি সেই বিক্রেতাকে অম্লানবদনে বারো টাকার পুণ্যের স্বত্ত্বাধিকার দান করেছেন। পথে দান হিসেবে পেয়েছেন ক্ষীরিকে, এক ছাগল, ভাল নাম পয়স্বিনী। দেখা মাত্রই ক্ষীরি তাঁকে অ্যাডপ্ট করে নিয়েছে। জৈন আশ্রমে গিয়ে জেনেছেন ক্ষীরি নেই, সে মনহরিণী, লেখকের একাকিত্ব কাটাতেই সে আসবে বারবার। তবে জীবনের মহামন্ত্র পেয়েছেন সূফীসাধক বরকত খানের কাছে। তিনি বলেছেন, “ঈশ্বর নেই, আছে শুধু তাঁর প্রেমটুকু।”

মাঝে একবার কলকাতা ফেরা। সেই ফাঁকে পরিচয় দিয়েছেন বিস্ময়প্রতিভা দীপক মজুমদারের, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র প্রাণভোমরা। ”মহীনের ঘোড়াগুলি’র অশ্রুত হ্রেষা’ অধ্যায়ে তার বিশদ বিবরণ আছে। এক বিপন্ন সময়ে কতকগুলি উজ্জ্বল তরুণের কি ভয়ংকর পাগলামি। ঐ প্রখর মৌলিকত্ব সহ্য করার ক্ষমতা তখন বাংলাগানের শ্রোতাদের অধিকাংশের ছিলনা। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ তাই উপযুক্ত স্বাগত-অভ্যর্থনা পায়নি। তবে সবার অলক্ষ্যে বাংলাগানের রেনেসাঁ ঘটিয়ে তারা কিছুকালের জন্য গা-ঢাকা দিল। লেখকের অনবদ্য ইনস্ট্যানশিয়েশন, ‘এট্টুখানি ডাঁড়ান, স্যার’ বলে তারা ত্রিশ বছর বেপাত্তা। ইতিমধ্যে শ্রোতারা নতুন প্রজন্মের গানে পাগলের মতো খুঁজছে মহীনের ঘোড়াদের। ঐ ঘরানার সঙ্গীতে উপচে পড়ছে অডিটোরিয়ামগুলো।

ওদিকে লেখক আবার বেরিয়ে পড়েছেন নিরীশ্বরের খোঁজে, সমান্তরালভাবে শুরু হয়েছে সভ্যতার শিকড়ের খোঁজ। তীর্থক্ষেত্রে যাচ্ছেন, মন্দির-মসজিদের দরজা খুলে ভিতরে ঢোকা হচ্ছে না। পথের প্রান্তে তাঁর তীর্থ নেই, পথের দুধারে মানুষের মাঝে তিনি পেয়ে যাচ্ছেন অজস্র দেবালয়। বন্ধু ষষ্ঠীব্রত এবং লেখক স্বয়ং—দুজনেই ভেকধরা। তফাৎ আছে যদিও। ষষ্ঠীব্রত ভেক অর্থাৎ ব্যাঙ ধরেন, হোটেলে চালান দেন। লেখক ধরেছেন সাধুর ভেক। সাধুর ভেক ধরে তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন আর্যাবর্ত। কাশীতে অঘোরীদের পাল্লায় পড়ে নরমাংসও খেতে হয়েছিল। প্রাণটিও পূর্ণচ্ছেদের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। অন্তিম মুহূর্তে পুলিশ এসে বাঁচায়।

এরপর শুরু হয় গা-ছমছমে ভয়ংকর পরিস্থিতির। RAW-এর এজেন্ট হয়ে পাকিস্তানে। তিনি অবশ্য একবারও স্বীকার করেননি। কোন এজেন্টই বা করেন? তিনি কেবল রথদেখার কথাটুকুই কবুল করেছেন। কাশ্মীর উপত্যকায় তিনি খোঁজ করছেন প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের পুঁথির। এজন্য তাঁকে যেতে হচ্ছে হিংলাজ, খুঁজতে হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর গতিপথ, শুনছেন ‘দমাদম মস্ত কলন্দর’, সমস্ত জিগ্‌- স পাজল জড়ো করে বরুণদেব ও সরস্বতীর বৈদিক পরিচয়ের আড়াল থেকে মানবীয় পরিচয় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু RAW যে তাঁকে দিয়ে কলাবেচার কাজটিও করিয়ে নিচ্ছে বুঝতে পাঠকের অসুবিধা হয় না।

বাণীপ্রসন্ন চৌধুরী ও অজিত ডোভালের সঙ্গে একের পর এক রোমাঞ্চকর কর্মকাণ্ড। তিনি ওয়াগার বর্ডারের অপরপ্রান্তে রঙিন ভয়াল রাত দেখছেন, পাকিস্তানি রেঞ্জারদের কাছে বেধড়ক ঠ্যাঙানি খাচ্ছেন, ছাড়া পাচ্ছেন, লান্স নায়েক লল্লু খানের পর্ণকুটীরে আতিথ্য নিচ্ছেন। আর্মি থেকে বিতাড়িত সরলপ্রাণ লল্লুর রোটি কপড়া অউর মকান ব্যতীত কোনও কিছুরই অভাব নেই। তিনি লেখক ও তাঁর সহযাত্রীদের পরিকল্পনার বিন্দুবিসর্গ না জেনে অকপটচিত্তে যথাসাধ্য সাহায্য করছেন। পাকিস্তানের পরমাণু বোমার প্রোজেক্টের অন্ধিসন্ধির খবর জোগাড় করছেন বাণীপ্রসন্ন ও অজিত ডোভাল। লেখক বৌদ্ধ পুঁথিতে ইতিহাসের খোঁজ করতে করতেই দিলেন বরফশীতল সিন্ধুর জলে ঝাঁপ। পাকিস্তানি পুলিশ আবার পিছনে লেগেছে।

এরপর তিনি ঘুরলেন আঙ্কোরভাটের বিষ্ণুমন্দির, তার প্রতিপাদ স্থান মাচ্চুপিচ্ছুতে, লেখকের ভাষায় যা মৎস্যপুচ্ছের অপভ্রংশ। নিউ জার্সিতে দেখা করলেন কিশোর শ্রমণ রিম পো ছে’র সাথে। তাঁকে জানতেই হবে ডি এন এ এবং জেনেটিক কোডের রহস্য। জানতেই হবে ব্রহ্মজ্ঞানের স্বরূপ। যা লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘অনুস্মৃতি’র শেষাংশে।অশ্মবিদারী নির্ঝরের মতো আছড়ে পড়বে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। স্নান করতে হবে তার পংক্তিতে। চিনতে হবে আদিনাথ বসাকের তাঁতের বুনোন। শুনতে হবে চার্বাকের ভাষ্য। বাংলাসাহিত্যে চিরকাল এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকবে ‘অনুস্মৃতি’।

‘ব্যাঙালোরের বাঙালি’ অধ্যায়ে লেখক বাংলার বাঙালিদের আঁতে ঘা দিয়ে জানিয়েছেন ওখানে লোডশেডিং ও ঘাম নেই। লব্ধপ্রতিষ্ঠ বাঙালিদের দাপট, চিত্রশিল্পী সমীর মণ্ডলের গৃহকাতরতা, আর এক প্রবাসী রামানন্দ, বালাব্রুয়ি ও ‘শেষের কবিতা’র সম্পর্ক, IIScতে বাঙালিদের আধিপত্য, রবি ঠাকুরের মাথায় নারকেল ফাটানো, বাঙালি-অধ্যুষিত অঞ্চলে দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করার জন্য মন্ত্রীর আকুলতা এবং ব্যাঙালোর পুলিশের কর্মকুশলতা – সমস্ত কিছু অপরূপ চিত্রময়তায় ব্যক্ত হয়েছে। প্রবন্ধগুলি পাঠ করে পাঠকের মনে যুগপৎ গর্ব ও আফশোসের সঞ্চার হবে।

‘বেশরমের পরণকথা’ এই বইয়ের সবচেয়ে কঠিন অংশ। যথেষ্ট মনোযোগী না হলে প্রবন্ধগুলি ভেদ করে এর অন্তঃস্থলে পৌঁছন সম্ভব নয়। ‘সম্বর সম্বর মহিমা তব’ প্রবন্ধে ডালকে কেন্দ্র করে দাক্ষিণাত্যের সংস্কৃতির গভীরে পৌঁছেছেন লেখক। ডাল আমাদের নিত্যদিনের আহার্য। প্রত্যহের ম্লানস্পর্শ লেগে আমাদের সন্ধানী দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। ডালের ডায়াস্পোরিক চরিত্রটি বিশ্লেষণ করতে করতে লেখক আনুষঙ্গিক অনেক বিষয়কে উদ্ঘাটিত করেছেন। পরিশেষে অন্তরা মালী ও রবি ঠাকুরকে একই ফ্রেমে ধরে একটু মজাও করেছেন। মজা ছড়িয়ে আছে আড্ডাসংক্রান্ত প্রবন্ধটিতেও। আড্ডায় পুরুষের এবং পরচর্চায় নারীর একচেটিয়া অধিকার আর একবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বসন্তমামা রঞ্জন ঘোষালের সৃষ্ট একটি অতি জনপ্রিয় চরিত্র। বহু আখ্যানে তিনি হাজির হয়েছেন। কিন্তু এখানে যেভাবে এক পরাজিত জাতির স্বপ্নপূরণের বাসনাকে বাঙ্ময় করেছেন তা অতুলনীয়। তাঁর প্রসঙ্গ ধরে লেখক ম্যাজিক রিয়ালিজমকে নতুনভাবে চিনিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, “বিশ্বাস করি ম্যাজিক রিয়ালিজমে স্বপ্নের শুধুমাত্র শুরু। তারপর কত মরূদ্যান, কত নক্ষত্র-বাতাস আমাদের পরাজয়ের বেদনাকে, অসাফল্যের লজ্জাকে এসে ঢেকে দেয়। নতুন স্বপ্নরা অঙ্কুরিত হয়। বিশ্বাস করি যাদু-বাস্তবতা তৃতীয় বিশ্বের জয়লাঞ্ছন। বিশ্বাস করি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ও শিল্পকীর্তি রামায়ণ-মহাভারতের কল্পভূমি থেকেই আবার রচিত হতে থাকবে। রচিত হবে ল্যাটিন আমেরিকা আর পূর্ব ইউরোপে। সেই যাদুসত্য যা অপমান ও যুদ্ধ পীড়ন থেকে উঠে আসে। যে শিল্পিত ভাবনা – একাধারে যাদু ও সত্য।”

‘আমরা কে ডা’ ইতিহাসের রেট্রোস্পেকটিভ। শুধু অতীতই নয়, আছে বর্তমান এবং ভবিষ্যতও। ‘অমৃতকুম্ভের খোঁজে’ দেখা যায় শঙ্করকে, নন্দী সহ। অসুররা তাঁর কৃপাপ্রার্থী। দেবতারাও তাঁর অনুগত। তিনি আর্যদের নিজস্ব সম্পত্তি নন। ‘গান গেয়ে তরী বেয়ে’ বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অণুরচনা। এক টালমাটাল সময়ে বৌদ্ধ পদকর্তারা তাঁদের সন্ধ্যাভাষায় রচিত জ্ঞানভাণ্ডারকে লুকিয়ে ফেলতে কৃতসংকল্প হন। নৌকায় বসে কম্বলী পাদ তাঁর সর্বশেষ পদটি আবৃত্তি করতে থাকেন। ভবিষ্যতের ঢেউ এসে দুলিয়ে দেয় সেই নৌকা। ঢেউয়ের অপর প্রান্তে শিলাইদহের তরুণ জমিদার লিখছেন ‘সোনার তরী’, তিনি সেই কবিতা লেখার প্রায় দশ বছর পর আবিষ্কৃত হবে চর্যাপদের পুঁথি। বিশ্ববাসী চমকিত হবে হাজার বছরের ব্যবধানের দুই সত্যদ্রষ্টার রচনায় ভাবসাদৃশ্য দেখে। ‘বৃক্ষদেবতারা’ শীর্ষক নকশাটি বাংলার অলস, উদ্যমহীন, প্রতিবাদহীন বাঙালি জাতির গালে একটি সপাট থাপ্পড়।

‘মহীনের ঘোড়াগুলির অশ্রুত হ্রেষা’ অধ্যায়ের কথা আগেই বলা হয়েছে। মহীনের প্রথম প্রকাশের সময় ‘সংবিগ্ন পাখিকুল ও কলকাতা বিষয়ক’ অ্যালবামের মুখবন্ধটি এখানে পাওয়া যাবে। বাংলার সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। ধূর্জটি চট্টোপাধ্যায়ের প্রেরণা কিভাবে একঝাঁক প্রতিভাধর তরুণকে তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণের সংবাদ চোখে জল এনে দেয়। দীপক মজুমদারের মতো বোহেমিয়ান চরিত্র সর্বদেশে সর্বকালে বিরল। বস্তুত তাঁর প্ররোচনাতেই লেখক ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের বাউণ্ডুলেপনা ও প্রতিভার বিকাশ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। আছে অনবদ্য দুটি স্মৃতিচারণা। পরিশেষে আজকের জনপ্রিয় শিল্পী অনুপম রায় যখন তাঁর রঞ্জনকাকুর কাছে ‘চৈত্রের কাফন’ গানটির ইতিহাস ও কাঠামো জানতে চান এবং ‘রঞ্জনকাকু’ যখন সস্নেহে তাঁর আব্দার মেটান তখন একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। সত্তরের দশকের রিলে রেসের ব্যাটন পৌঁছে যায় আজকের দিনের শিল্পীর হাতে। উত্তরাধিকারের ধারায় অতীতগৌরবের শিখা চিরজ্বাজ্জ্বল্যমান থাকে।

‘সাড়ে-বত্রিশ’ শীর্ষক অধ্যায়টি, নামেই মালুম, পাঁচমিশেলি প্রবন্ধের সংকলন। এর মধ্যে ‘আমার কবিতা-পড়া, না-পড়া’ প্রবন্ধটি সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের এবং যাঁরা কবিতা লেখা শুরু করেছেন তাঁদের অবশ্যপাঠ্য। কি এক অদ্ভুত অজানা কারণে কবিতার কাছে আম-পাঠকের দাবি প্রাচীনত্বের এবং সহজবোধ্যতার চেনা খোলসটি ফিরিয়ে আনা। একে লেখক সমূলে উৎখাত করেছেন। অক্ষম কবিযশোপ্রার্থী কলমচির অনুকরণপ্রিয়তা ও কুম্ভীলকবৃত্তির নেশাতেও পড়েছে কশাঘাত। সুচিত্রা মিত্রকে নিয়ে প্রবন্ধটি এক অচেনা সুচিত্রা মিত্রের কিছু মিষ্টি দিক তুলে ধরে। সবথেকে ভাল লাগে এটা দেখে যে, সুচিত্রা মিত্র, মহীনের ঘোড়াগুলির মতোই, উত্তরসূরীদের গায়নে চিরজীবী চিরপ্রবহমানা হয়ে রইলেন।

‘অজানা উড়ন্ত বই’য়ের একদম শেষে আছে ‘সভ্যতার সংকট : একটি রবিযাত্রা’, লেখকেরই রচিত ‘Crisis of Civilisation : A Journey with Tagore’-এর বাংলা অনুবাদ। অনুবাদ না বলে রূপান্তর বলাই ভাল। বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ সকাতরে জানতে চাইছেন সভ্যতার সংকট কেটেছে কিনা, পৃথিবী আজও হিংসায় উন্মত্ত কিনা, সকলের অন্ন জুটছে কিনা। কবির এই প্রশ্নের সামনে নতমস্তকে নীরব থাকা কীই বা করতে পারে বর্তমান সময়। তবু তিনি তো রবীন্দ্রনাথ। তাঁর শেষ বিশ্বাস, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। তিনি আবার শোনাবেন, ‘নব অরুণোদয় জয় হোক’। তাই হোক।

এই বই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার বই নয়। কিন্তু পড়া শুরু করলে একে ছেড়ে থাকাও অসম্ভব। পড়া হয়ে গেলেও কোন এক অমোঘ আকর্ষণবলে বারবার টান দেয়। প্রচ্ছদ এবং বিন্যাসও চমৎকার। দুএকটি মুদ্রণপ্রমাদ আছে। যেমন, ‘অনুস্মৃতি’ হয়ে গেছে ‘অণুস্মৃতি’। এছাড়া দ্বিতীয় সংস্করণে একটি ভূমিকা ও একটি নির্ঘন্ট থাকলে পাঠকের আরও সুবিধা হবে। চেতনার তলদেশ তোলপাড় করে দেওয়া এই বই পাঠ করার আগে ও পরে পাঠক আর একই ব্যক্তি থাকবেন না একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। চিন্তায় ও অভিজ্ঞতায় সবাইকে এই বইটি সমৃদ্ধতর করবে। সার্থকভাবে বিশ্বপরিক্রমার স্বাদ দেয় এই বই। নিঃসন্দেহে সংগ্রহযোগ্য মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে এসে-পড়া এই অজানা উড়ন্ত বই।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4877 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...