অমর মিত্র
২৮.০৪
এ হল ক্রমাগত একই দৃশ্য বর্ণনা করে যাওয়া। একই কথা লিখে যাওয়া। সংক্রমণের ভয়ের কথা বলে যাওয়া। নিয়ত পরিসংখ্যান নেওয়া আক্রান্ত কত, সুস্থ হয়েছে কত। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার মতো করে টেলিভিশন চ্যানেলে সব সংখ্যা স্ক্রল করে যাচ্ছে। টেলিভিশন দেখছি না। অসহ্য মনে হয় রাজনৈতিক নেতাদের তর্জা। কুৎসিত। কেন ভর সন্ধেয় এসব দেখানো হয়, বুঝি না। একই কলহ, গতকাল যা শুনেছে মানুষ আজও তা। সুতরাং দেখি না। দেখি না, দেখলে কোভিডের আতঙ্ক ঘিরে ধরে।
নববর্ষ চলে গেছে ঘরে বসে। বোশেখ মাস তার রুদ্ররূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি এখনও। সকলেই গৃহবন্দি হয়ে আছে। যাদের ঘরে জায়গা নেই, এমন অনেক মানুষ, মধ্যবয়সী, প্রবীণ সকালে বাজারের সময়টুকুতে বাইরে যাবেনই। না গেলে উপায় নেই। পরাশর তার ফুটপাথের চায়ের দোকান প্রতিদিনই খোলে। না খুললে তার পেটে ভাত জুটবে না। বাজারেই তার চায়ের ঝুপড়ি। পাশে শনিমন্দির। সে বাজারের সব্জিবিক্রেতা এবং মাছ-মাংসবিক্রেতাদের চা সরবরাহ করে। পরাশর এই পেন্সিলিয়া খবরিয়ার বাল্যবন্ধু ছিল। ওদের ছিল ডেকরেটিং-এর ব্যবসা। জনপ্রিয় ডেকরেটর। ছোটবেলায় যে কটি বিয়ে হয়েছে, বা অন্য কাজ হয়েছে সবেই জনপ্রিয় ডেকরেটর। তাঁরা পূর্ববঙ্গের মানুষ। কোন জেলার মানুষ তা আমি জানি না। আমি এখন সাতদিনের বাজার একদিনে করি। অনেক জিনিস কিনি। ধরুন একশো টাকার গরম মশল্লা। বড় দুটি ফিনাইলের বোতল। এক কেজি মুড়ি… এমনি এমনি। পরাশর আসে একটি ছোট বোতল নিয়ে একশো সর্ষের তেল। একটা মুড়ির প্যাকেট। একশো ছোলার ডাল। বলে সে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। দোকান চালায় সে আর তার বৃদ্ধা হয়ে আসা স্ত্রী। পরাশর তাদের সেই ভাড়াবাড়িতে থাকে না। প্রোমোটিং হয়ে গেছে। টাকা কী পেয়েছিল জানি না, বস্তির ভিতরে চলে গেছে। মাস্ক মানে কাপড়ের পট্টি, সে শুধু পুলিশের ভয়ে মুখে রাখা, নাকের নিচে নামানো থাকে। হাতে বিড়ি।
এ হল পাড়ার বিশ্বস্ত মুদির দোকান, বাজারের ভিতরে। একদিনও বন্ধ হয়নি এই করোনার কালে। আমি পরাশরকে বললাম, মাস্কটা নাকের উপরে।
দম আটকে আসে, কী আর হবে?
বিড়ি না খাওয়াই ভালো। বললাম, বলতে পারলাম যেহেতু আমি এসব ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন আগে।
পরাশর ক্লিষ্ট মুখে হাসে। উত্তর দেয় না। তার গালে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি, মাথার চুল প্রায় সবই শাদা হয়ে গেছে। ময়লা জামা আর প্যান্ট, হাওয়াই চটি। ফুটপাথের দোকানটি সে করতে পেরেছিল বলে বেঁচে আছে। ওর এক ভাই ডাকাত ধরতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরেছিল। তার নামে একটা শহিদ বেদি হয়েছিল। এখন সেই বেদি নেই। কেন নেই বলতে পারব না।
পরাশরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ভয় করে না?
সে বলল, ধুর, সামনের বাড়ির মাথায় হয়েছিল, বিলেত থেকে ফিরেছিল, আমাদের হয়নি, এসব বড়লোকের রোগ।
একটু সাবধান হতে হবে পরাশর।
পরাশর বলল, সাবধান হলে তো লেখাপড়া করে আমি তুমি হয়ে যেতাম।
পরাশর ক্রিকেট খেলত ভালো। কিন্তু তা পাড়ার বাইরে যায়নি। পরাশর খুব হিন্দি সিনেমা দেখত। ফার্স্ট শো দেখতেই হবে, মানে শুক্রবারে ম্যাটিনি। ৪১ বা ৬৫ পয়সায় লাইন দিয়ে। আমাদেরও নিয়ে গেছে ঝিল কা উসপার কিংবা রাজকুমার দেখাতে। তারপর আমি সরে এসেছি। পরাশর সিনেমা দেখতে খালপাড়ের সুরশ্রী কিংবা দমদমের লীলা নেত্রয় হেঁটে যেত। একবার সে চিৎপুর রেল ইয়ার্ডে রিজেন্ট সিনেমায় নিয়ে গিয়েছিল লাভ ইন টোকিও দেখাতে। জাপান লাভ ইন টোকিও… লে গয়ে দিল। আমি বেশিদিন পরাশর বা কেলে প্রদীপের সঙ্গ করিনি। সাবধান হয়ে গিয়েছিলাম।
পরাশর বলল, সাবধান হতে আগে কেউ বলেনি, এখন মোদি মমতা বললে সাবধান হয়ে কি আমি তুমি হয়ে যাব, আমার তেলটা দাও চরণ।
আমার ভয় করছিল। মাস্ক নামিয়ে কথা বলছে পরাশর। আমি একটু পিছিয়ে যেতে সে বুঝল। মাস্ক তুলে দিল। বলল, তোমাকে দেখি আর অবাক হই, আমরা এক সঙ্গে শাপমোচন দেখেছিলাম, ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস…।
আমিও অনেককে দেখে অবাক হই, তুমি তো অঙ্ক ভালো পারতে।
ধুর, ও কিছু না, একদিন চা খেতে পারো তো আমার দোকানে, অনেকে খায় বাজার করতে এসে, তুমি খেতে পারো, ফ্রি, কেলাস ফ্রেন্ড তো, সিনেমার পার্টনার, ওয়াইফ দেখবে।
আচ্ছা যাব, করোনা মিটে যাক।
করোনা আর মিটেছে, কে বলছিল এমনি চলবে, চলুক, তুমি সাবধান থেকো। পরাশর তেলের বোতল নিয়ে ছুটল তার চায়ের ঝুপড়িতে।
সেদিন সকালে জয় গোস্বামীর সঙ্গে ফোনে কথা হল। অনেক কথাই হল। একটিও কবিতা লেখেননি এই সময়ে। অদ্ভুত সময়। ওষুধ এবং খাদ্য নিয়েই মানুষ উদ্বিগ্ন। জয়ও তাই। তারপর উপন্যাস, গল্প, কবিতা নিয়ে কিছু সময়। জয় বললেন তিনি কথা বলে যেন মুক্ত হলেন। বইপাড়া, প্রকাশন সংস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন খুব। কবে আবার সব স্বাভাবিক হবে। কবে কবে। অমর আপনি সাবধানে থাকবেন।
দেবেশ রায় ফোন করেছেন বিকেলে। কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না, তখন যন্ত্রটি কানে লাগিয়ে নিলেন। না করোনা নিয়ে নয়, উপন্যাস নিয়ে কথা বলতেই ফোন করা। ভাইরাস, মৃত্যুভয়, পৃথিবীময় মানুষের বিপন্নতা এসব থেকে মুক্ত থাকতে উপন্যাস নিয়ে কথা। উপন্যাস, লোককথা, গীতিকা, কমিউনিস্ট পার্টি… নিয়ে কথা হতে লাগল। পূর্ববঙ্গ, মণি সিং— মণিদা, ললিতবাবু…। দেবেশদার এখন ৮৪ হবে। ভয় জয় করার মন্ত্র তিনি জানেন। বললেন, পড়ো, লেখো, ভাবো, গান শোনো…, সাবধানে থেকো অমর। আগের দিন দেবেশদা বলেছিলেন তাঁর ভয় করছে। আজ ভয়ের কথা উচ্চারণ করলেন না। গল্প-উপন্যাস, কবিতা দিয়ে ভয় জয় করার মন্ত্র দেবেশদাই জানেন। বললেন, অমর সাবধানে থেকো, স্বপ্নময়, তপন কেমন আছে, ভালো আছে তো সকলে? সাবধানে থাকতে বোলো।
আমার সামনে পরাশরের মুখটি ভেসে এল।
২৯.০৪ তারিখে অমিতাভ প্রামাণিক লিখেছেন,
কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য টিকার লার্জ-স্কেল উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে। করছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ টিকা প্রস্তুতকারক ভারতেরই এক সংস্থা – পুনের সিরাম ইনস্টিট্যুট অফ ইন্ডিয়া। এখনও অবধি পৃথিবীতে সম্ভবত তারাই সবচেয়ে এগিয়ে, পেছনে আছে ব্রিটেন আর নেদারল্যান্ডের কয়েকটি সংস্থা। তবে এখনই তা বাজারে পাওয়া যাবে না। সামনের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভারতীয় এই সংস্থা প্রায় দু’ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার মত ভায়াল বানিয়ে ফেলবে।
হু-এর ড্রাফট লিস্টে আশির ওপর সংস্থার নাম আছে, যারা কোভিডের টিকা প্রস্তুতের জন্যে লড়ে যাচ্ছে। এপ্রিলের প্রথমে হিউম্যান ক্লিনিক্যাল শুরু করেছিল আমেরিকার মডার্না কোম্পানি আর চিনের সাইনোভ্যাক। আট নম্বরে নাম ছিল অক্সফোর্ডের। কিন্তু পরে শুরু করেও সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ল্যাবরেটরির প্রফেসর অ্যাড্রিয়ান হিল। শুধু এগিয়ে না, বহুদূর এগিয়ে।
কীভাবে? হিউম্যান ক্লিনিক্যাল স্টাডিজ হয় তিন ফেজে। প্রথম অল্পসংখ্যক নির্দিষ্ট প্রকৃতির (৪০-৪৫ জন) মানুষের ওপর টিকার সেফটি টেস্ট করা হয়, দেখা হয় এই টিকা নিয়ে তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কিনা। তার রেজাল্ট পেতে অন্তত তিন মাস। তারপর এটাই লার্জ স্কেলে (৫০০০+) করা হয়, দেখা হয় সেখানেও সেফটি নিয়ে কোনো আশংকা আছে কিনা। সেটা শেষ হতে আরও মাস ছয়েক। তারপর তৃতীয় ফেজে লার্জ স্কেলে এফিকেসি টেস্ট করা হয়, অর্থাৎ টিকাটা যে কার্যকরী, তার প্রমাণ পাওয়া। সেটা শেষ হতে অন্তত আরও ছ মাস। তারপর অ্যানালিসিস ইত্যাদি হয়ে স্পেসিফিকেশন তৈরি, কে বানাবে তার চুক্তিপত্র ইত্যাদি হয়ে বাজারে আসতে দেড়-দু’ বছর লেগেই যায়।
তাই সেপ্টেম্বরে টিকা আসবে শুনে আমি ভেবেছিলাম, নিশ্চয় পরের বছরের সেপ্টেম্বর। কিন্তু না, এই বছরেরই।
তবে এর মধ্যে বেশ খানিকটা ‘যদি’ আছে। সেটা এবার বলি।
প্রফেসর হিল বহু বছর ধরে কাজ করছেন ম্যালেরিয়ার টিকা নিয়ে। শিম্পাঞ্জির শ্বাসনালীতে আক্রমণ করার এক ভাইরাস হচ্ছে তাঁর টিকার বাহন। যেহেতু ওটা শিম্পাঞ্জির শরীরে থাকে, মানুষের ও থেকে বিপদ থাকার কথা নয় (যদি না ওটা মিউটেট করে হিউম্যান ভাইরাসে পরিণত হয়, যেমন হয়েছে বাদুড় থেকে সার্স-এ)। ওটাকেই ব্যবহার করে মানুষের ইমিউন রেসপন্স স্টাডি করে যে জিনিসটা উনি তৈরি করেছেন, সেটা ম্যালেরিয়া নিবারণে কার্যকরী হয়নি। এখানে বলে রাখা কর্তব্য যে ম্যালেরিয়ার জীবাণু কোনো ভাইরাস নয়, সেটা একটা প্যারাসাইট, যার নাম প্লাসমোডিয়াম। প্যারাসাইট আর ভাইরাস পুরো আলাদা জিনিস। বহু ভাইরাসের কার্যকরী টিকা আছে, কিন্তু প্যারাসাইটের টিকা ঝামেলার ব্যাপার।
গত কুড়ি বছর ধরে সারা বিশ্বে গোটা সত্তরটা হিউম্যান ক্লিনিক্যাল হয়েছে ঐ ম্যালেরিয়ার সম্ভাব্য টিকার ওপরে এবং দেখা গেছে জিনিসটা কার্যকরী নয়, কিন্তু নিরাপদ, এর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই শরীরে। ২০১৪ সালে ঐ বাহনের মধ্যেই মার্সের জেনেটিক মেটিরিয়াল ভরে সারা গিলবার্ট বানিয়েছিলেন মার্সের টিকা, সেটা কার্যকরী হয়েছে। ফলে কোভিডের সংক্রমণ বেড়ে প্যানডেমিক হতে এখন ম্যালেরিয়া ছেড়ে ঐ একই সেফ ‘ভেহিকল’-এর মধ্যেই প্রফেসর হিল নভেল করোনা ভাইরাসের (যেটা কিনা একটা আর এন এ ভাইরাস) কিছু জেনেটিক মেটিরিয়াল ভরে দিয়েছেন। এতে কী হওয়া উচিত? শরীরে ঢুকলে শরীরের ইমিউনিটি সেলগুলো ঐ শিম্পাঞ্জির ভাইরাসকে আক্রমণ করে গিলে ফেলবে। সেই সেলের মধ্যে করোনার জেনেটিক মেটিরিয়াল থাকায় তাকে প্রতিহত করার জন্যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে ফেলবে সেই সেলগুলো। কিন্তু এটা তো আসলে হিউম্যান ভাইরাস নয়, তাই কোভিডের মত হিংস্রতা নেই তার। সেই অ্যান্টিবডি শরীরে জমা থাকবে। পরে সত্যিসত্যিই যদি সে শরীরে এই মহামারী করোনা ঢোকে, তাহলে ঐ অ্যান্টিবডির মিসাইল ঘায়েল করে দেবে করোনাকে। এই হচ্ছে থিওরি।
এতে সুবিধে কী হচ্ছে? যেহেতু জিনিসটা অলরেডি সেফ বলে বিবেচিত হয়েছে, তাই এর সেফটি ক্লিনিক্যালের আর দরকার হচ্ছে না। ফেজ ওয়ান, ফেজ টু তো সেফটি টেস্ট। অন্যেরা যেখানে সবে ফেজ ওয়ান ক্লিনিক্যাল শুরু করছে, প্রফেসর হিল এর ফলে ফেজ ওয়ান আর ফেজ টু ক্লিনিক্যাল বাদ দিয়ে সরাসরি চলে যাচ্ছেন ফেজ থ্রিতে। অক্সফোর্ডের যুক্তিও গ্রাহ্য করে নিয়েছে নিয়ামক সংস্থারা। অলরেডি ১১০০ হিউম্যান ভলেন্টিয়ার এই টিকা তাদের শরীরে নিয়ে নিয়েছেন। আরও ৬০০০ জন অপেক্ষা করছেন টিকা নিতে। এই ৭১০০ জনের ওপর একযোগে সেফটি আর এফিকেসি টেস্ট শুরু হবে। এদের রেজাল্ট পেতে পেতে অগাস্ট সেপ্টেম্বর।
অক্সফোর্ডের এই জেনার ল্যাবরেটরির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে ভারতের সিরাম ইনস্টিট্যুট অভ ইন্ডিয়া। তার প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অশীতিপর প্রাজ্ঞ টিকাব্যবসায়ী সাইরাস পুনাওয়ালা এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা না করেই তিনি ঠিক করেছেন, তাঁর সংস্থা ঝুঁকি নিয়ে এখন থেকেই এই টিকা তৈরি শুরু করে দেবে, যাতে রেজাল্ট হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে অন্তত দু কোটি ভায়াল তৈরি হয়ে থাকে বাজারে ছাড়ার জন্যে।
যদি কাজ না হয়? পুনাওয়ালা বলেছেন, কী আর করা যাবে, ফেলে দেব। এর জন্যে যা টাকা নষ্ট হবে, তা স্বীকার করে নেব। কিন্তু যদি কার্যকরী হয়, তবে অন্তত চার মাস এগিয়ে বিশ্ববাসীকে আমরা জোগাতে পারব প্রাণদায়ী টিকা।
প্রার্থনা করুন, যেন এঁদের কাজ ফলপ্রসূ হয়। সামনের পুজোর আগে এটাই তবে একমাত্র খুশির খবর হতে পারে।
২৯ এপ্রিল ২০২০
অভিনেতা ইরফান খান প্রয়াত হলেন ৫৩ বছর বয়সে। কোলোনের অসুখে তাঁর মৃত্যু। বড় অভিনেতা। বয়স কম। শোকের ছায়া নেমেছে শোক আর বিপর্যয়ে ডুবে থাকা দেশে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের হলিওক সোলজারস নামে একটি বৃদ্ধাশ্রমে ৭০ জন মারা গেলেন। স্টেট ও ফেডারেল কর্মকর্তারা এই মুহূর্তে তদন্তে করছেন ঠিক কীভাবে এই মারণ রোগ ঢুকেছে বৃদ্ধাশ্রমে। অসহায় বৃদ্ধরা শ্বাসকষ্ট এবং নিমোনিয়া ঠেকাতে পারেননি।
এক কারপেন্টার থাকেন নয়াবাদের ওখানে। তিনি আমাকে ফোন করলেন হঠাৎ। জানুয়ারিতে আমার ঘরে কিছু কাজ করেছিলেন। তার আগে গত বছর। এমনিই ফোন করলেন। কাজকর্ম সব বন্ধ। সাবধানে থাকতে বললেন। ঘরবন্দি মানুষ সকলে সকলের খোঁজ নিচ্ছেন।
৩০শে এপ্রিল সকালে লুতফুন্নাহার লতা লিখলেন নিউইয়র্ক থেকে।
এই কয়েকদিন আগে নিউইয়র্কের অনেক ছবি পাঠিয়েছিলেন তিনি আমাকে। ২০১৮ সালের এপ্রিলের ২১-২২ দারুণ কাটিয়েছিলাম আমরা। সেইসব আনন্দ মুহূর্তের ছবি। আজ তিনি এক অনন্ত বিষাদের কথা লিখলেন।
এই দিন চলে যাবে জানি। জানি সূর্য উঠবেই। হ্যাঁ অনেক মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে, আরো হয়ত চলে যাবে তবু জানি একদিন আবার সব ঠিক হবে। হয়ত কিছুটা ভিন্নতা নিয়ে। আমাদের কাঁধের কাছে নিশ্বাস ফেলছে মৃত্যু। প্রথম দু’সপ্তাহ অদ্ভুত স্তব্ধতা নিয়ে কেটেছে তারপর থেকে শুরু হয়েছে মৃত্যুর মিছিল। এখন কেমন যেন পাথর হয়ে আছি।
মার্চের শুরুতেই নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে একজন মহিলার করোনা ভাইরাস পজেটিভ ধরা পড়ার পরে সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং শুরু করা হয়েছে। এর কিছুদিন পরে শুরু হয়েছে লকডাউন।
একটা আতংক নিয়ে শুরু হলেও প্রথম দিকে সপ্তাহ দুয়েক কেটেছে একরকম হানিমুন স্টেজে। কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস কি, কেমন, কিভাবে হয়, হাত ধোয়া ছাড়া আর কি কি আছে এর থেকে মুক্তির উপায়। এ রোগ হলেই বা কি কি করনীয় এইসব সাত সতেরো ভেবে।
দীর্ঘকাল ঘরে পাওয়া যায়নি যাদের, তাদের নিয়ে বাড়িতে একসাথে সবাই সময় কাটাতে পারছেন। স্বামী বা স্ত্রী এমন করে এত কাছাকাছি দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী থাকতে পারেননি। সন্তানদেরকেও এত সময় নিয়ে কাছে থেকে দেখা হয়নি। আত্মীয় পরিজন বন্ধু বান্ধব কেউ কারো বাড়িতে আসছেনা কেউ কোথাও যাচ্ছেও না ফলে অখন্ড অবসর ভালোবাসার ঘাটতি পুরিয়ে নেবার। কিন্তু কি আশ্চর্য! সবাই আমরা কেমন অসাড় হয়ে আছি।
বাড়িতে যাদের মা বাবা রয়েছেন তাদেরকেও ভাল করে কাছে থেকে দেখা হয়নি বহুকাল। কাজের লোক না থাকায় ঘরের কাজ সহভাগ করে নিতে নিতে কেটেছে সময়। এভাবে অনেকটা সময় পরিবারের সাথে থাকায় তা বেশ একটা হানিমুনে থাকার মত কেটেছে।
কিন্তু সমস্যা শুরু হয়েছে যখন লকডাউনের সময় কেবল বেড়েই চলেছে। সেই হানিমুন পিরিয়ডও শেষ। এখন দিনে দিনে আতংকও কাছে এসে পড়েছে আবার ঘর থেকেও বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই তখন নানা রকম মানসিক অবসাদ এসে ভর করছে। ভয় ভাবনা অক্ষমতা চারিদিকে মৃত্যুর সাইরেন! দিনে দিনে পাগল করে তুলছে সবাইকে।
ফেসবুকের বন্ধুরা কেউ উপন্যাস লিখবেন বলেছিলেন, কেউ ঘর গোছাবেন কেউ বা এক পৃথিবী পড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন কিন্তু মনে হয় আমরা কেউই তেমন কিছুই করতে পারিনি। অফুরান সময় তবু কেমন অথর্ব হয়ে আছি যেন সবাই। বাংলাদেশের অবস্থা সম্ভবত ততোটা খারাপ এখনো না। তবু সেখানে সবাই কঠিন নিয়ম মেনে চলছেন সেটা আশার কথা। টেস্ট খুব বেশি হচ্ছে বলে মনে হয় না। টেস্ট নেই তো করনা নেই, তাই বলব এখনো ভাল।
গত কিছুদিন ধরে চলছে ফেসবুক লাইভের পরিবেশনা। কবিতা, গান, কোভিড নিয়ে আলোচনা। ভালো লাগছে সে সব। সোম থেকে শুক্র আমাদের সবার স্কুল কলেজ অফিস সব বাসা থেকে করতে হচ্ছে ফলে অন্য কিছুতে মন দেবার সময় কম।
আমরা যারা রয়েছি নিউইয়র্কে, আমরা রয়েছি মৃত্যুর সারিতে। অনেক অনেক মৃত্যু। অনেক চাপা কষ্ট নিয়ে আমরা কেউ কারো কাছে যেতে পারি না। পারছি না আবার কবে পারব তা-ও জানি না।
তবু আমরা সবাই যে যার মত করে বাঁচবার চেষ্টা করছি। প্রতিদিন নিয়ম মত ভোরে ঘুম থেকে উঠছি। স্নান করছি। গান চালিয়ে দিয়ে প্রতিদিন ঘরের কাজগুলো সারছি। রান্না করছি। স্বাস্থ্য মান বজায় রেখে খাওয়া দাওয়া করার চেষ্টা করছি। মেথি, কাঁচা ছোলা ভিজিয়ে স্প্রাউট করি, লাল আটার সাথে ফ্লাক্সিড (তিশি) পাউডার মিশিয়ে রুটি বানিয়ে রাখি। এন্টিসেপ্টিক হিসেবে এলোভেরা আর কাঁচা হলুদ যেমন খাচ্ছি, রান্নাতেও হলুদের পরিমান আগের চেয়ে একটু বেশীই দিচ্ছি।
ফোনে দীর্ঘ কথা বলা আর নিউজ দেখা প্রায় বন্ধ করেছি। কিছুক্ষণ হাঁটছিও। ভোরে উঠে স্নান সেরে কিছুটা সময় মেডিটেশানের মত চোখ বুজে নীরব হয়ে পড়ে থাকি। প্রার্থনা করি, ভেন্টিলেশান থেকে বেরিয়ে আসা বোনটি আস্তে আস্তে সুস্থ হোক। আই সি ইউ তে থাকা ভাইটি হাই ফ্রিকোয়েন্সি অক্সিজেন থেকে বেরিয়ে পড়ুক, ওর ফুস ফুস একাই কাজ করতে শুরু করুক। বাংলাদেশ থেকে সদ্য আসা তিন সদস্যের পরিবারটির তিনজনই সুস্থ হয়ে উঠুক। বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কে পড়তে আসা মেয়েটি দুই দফা অসুস্থতার কষ্ট কাটিয়ে উঠে ঝর ঝরে কন্ঠে টেলিফোনে কথা বলুক। ঢাকায় আমার পিতার মত মায়াভরা ছায়াবৃক্ষ ডঃ অনিসুজ্জামান সুস্থ হয়ে উঠুন। আমার ভোরের প্রার্থনায় বাজুক তোমার নাম!
জয়িত্রী বলল, আমিও প্রার্থনা করি তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন, সকলে সুস্থ হয়ে উঠুন, মার্কো তুমি কি পরাশরকে দেখেছিলে?
হ্যাঁ, চায়ের গ্লাসে কী দ্রুত চামচ ঠুনঠুন করে, সুরে বাজে তা, ঐটাই সে পারে, তাই তার দোকানের বেঞ্চে বহুসময় বসে থাকা যায়, সাবধানে থাকলে সে হয়ত মিউজিসিয়ান হতে পারত।
জয়িত্রী বলল, শুধুই সাবধানে থেকে কেউ কিছুই করতে পারে না মার্কো, আমি প্রার্থনা করি পরাশর ভালো থাকুক, সুরে বাজাক চায়ের পেয়ালা।
মার্কো পোলো, দূর পৃথিবী হেঁটে আসা মানুষ, সেযান শহরের মেয়রের আতিথ্যে রয়েছেন। মার্কো বললেন, তোমার কথা সত্য হোক জয়িত্রী, সুরে বাজুক সমস্ত পেয়ালা, পানপাত্র।