স্বাতী ভট্টাচার্য
দেশটা যেন নরক হয়ে গেল। গত মাসখানেকের মধ্যে কতজন, কতবারই না বলেছেন এই কথাগুলো। প্রবল গরমে বিদ্যুৎ নেই, জল নেই। ঘরে বসে থাকা যাচ্ছে না, অথচ বাইরে পুলিশের তাড়া, ভাইরাসের ভয়। সহ্য করা অসম্ভব, মুক্তি পাওয়া অসাধ্য। নরকের তো এমনই বর্ণনা পাওয়া যায়। কষ্টের সব সীমা ছাড়িয়ে যেখানে পৌঁছোয় মানুষ, আর প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করে যে এই দুর্ভোগের সমাপ্তি তার আয়ত্তে নেই, তার দুর্গতিতে কেউ বিচলিত নয়, সেই হল নরক।
পাপভোগের জন্য যন্ত্রণাময় নরক, আর কষ্টার্জিত পুণ্যভোগের জন্য স্বর্গ, আজ আবার এ সব কেউ মানে নাকি? সে বলা যায় না, ভোট নিলে হয়তো দেখা যাবে তেমন বিশ্বাস প্রকাশ্যে বা নিভৃতে বাঁচিয়ে রেখেছেন অনেকেই। এমনকী অধিকাংশও হতে পারে। আজকাল যাঁরা সর্ববিদ্যার ঘটে কাঁঠালিকলা, সেই অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের কয়েকজন (যেমন রবার্ট ব্যারো আর রেচেল ম্যাকক্লিয়ারি) অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন, নানা দেশের মানুষের মধ্যে স্বর্গ-নরকে বিশ্বাসের হার সঙ্গে জিডিপি বৃদ্ধির হারের সম্পর্ক নাকি খুঁজে পাওয়া যায়। তবে বাঙালি শহুরে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে বেশি চলে একটা বিজ্ঞান-অনুসারী দেহাত্মবাদ। সেখানে স্বর্গ-নরক মতামত এইরকম যে, ওটা পুরস্কার-তিরস্কারের একটা সিস্টেম। এ জীবনে ভাল কাজের ভাল ফল, মন্দ কাজের মন্দ ফল পাওয়ার নিয়মটা খাপে খাপে মেলে না। তাই নরকের আইডিয়াটা ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছিল।
অনেকে বলেন, আজ আর নরকের দরকার কী? কালেক্টিভ কর্মফল তো এই জীবনেই ভোগ করতে হচ্ছে। লাগামছাড়া দূষণের কর্মফল— গরম বাড়ছে, জলস্তর কমছে, আকাশ ধূসর, বাতাস টক্সিক। কোভিড-১৯ বন্যপ্রাণীদের অরণ্য থেকে উদ্বাস্তু করার ফল, আমফান উষ্ণায়নে সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফল। তা হলে এ দুনিয়াতেই নরকভোগ হচ্ছে না?
কথাটা ভুল হয়তো নয়, কিন্তু ঠিক লাগসইও নয়। ভাগ্যই বলুন আর কর্মফলই বলুন, ব্যাপারটা একটু পার্সোনাল। বিধাতাপুরুষ চিরকাল আঁতুড়ে ঢুকে শিশুর কপালে যা লেখার লেখেন, দেশের পলিসি ডকুমেন্ট লেখা তাঁর কাজ নয়। কালেক্টিভ নরকের কল্পনা করা যেন বছরের শুরুতে “অমুক সাল ভারতের কেমন যাবে” গোছের গড়পড়তা কথা। যে লোকটা খাদ্যরসিক, স্বর্গপ্রাপ্তি বলতে বোঝে অশেষ বিরিয়ানি-হালিম প্রাপ্তি, সে বেচারিকে দেশে পুষ্টির গড় হারে উন্নতির হিসেব শুনিয়ে লাভ কি?
তা হলে নরক কি কেবল একটা কথার লব্জ হয়ে থেকে যাবে? নাকি নীতিশাস্ত্র বা এথিক্সের দৃষ্টিতে তার কোনও একটা উপযোগিতা আজও আছে?
মহাভারত পড়লে মনে হয়, আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অভিমন্যুকে হত্যা করা হয়েছে। অর্জুন প্রতিজ্ঞা করছেন, তিনি পরদিন সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথকে বধ করবেন। যদি না করতে পারেন, তা হলে যেন নরকবাস হয়। কেমন সে নরক? অর্জুন কিন্তু বলেননি, শপথরক্ষায় ব্যর্থ পুরুষ যে নরকে যায়, সেখানে যেন যাই। বরং অন্য অনেকগুলো অপরাধের কথা উল্লেখ করে বলছেন, এই সব কাজ যারা করে, তারা যে নরকে যায় আমার যেন সেখানে স্থান হয়। এর মধ্যে কয়েকটা প্রত্যাশিত— মাতৃহত্যা, পিতৃহত্যা, ব্রাহ্মণহত্যা, গুরুপত্নীগমন, ধর্মচ্যুতি। আবার বলছেন, যে জলে মল-মূত্র-থুতু ত্যাগ করে, তার যে গতি হয়, আমারও যেন তাই হয়। জলের পবিত্রতা নষ্ট করাকে গুরুতর অপরাধের তালিকায় রাখা হচ্ছে।
অর্জুন যেমন নরকের প্রসঙ্গ তুলে সে কাজটা করতে চেয়েছিলেন, তেমনই অর্জুনবধের প্রতিজ্ঞা করে কুরুপক্ষের সংশপ্তক যোদ্ধারা বলছেন, শপথ রাখতে না পারলে তাঁদের যেন নরকবাস হয়। সেখানে হত্যাকারী, পরদারগামীর সঙ্গে স্থান পেয়েছে ন্যস্ত ধন অপহরণকারী। আজকের প্রেক্ষিতে কথাটা মনে ধরে। দু-তিনজন মিলে কৃষি সমবায়ের পুঁজি লোপাট করে ব্যাঙ্কে তালা ঝুলিয়ে দিলে, কিংবা শ্রমিকের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা মেরে দিলে যদি ৩০২, মানে খুনের ধারার মতো কড়া আইন দেওয়া যেত, অনেক গরিব হয়তো বেঁচে যেত। অর্জুনের পাপীদের লিস্টেও রয়েছে, যে উৎকোচ নেয়। দু-চারজন রাজকর্মচারীর ঘুষ-লোলুপতা কত মানুষের জীবন নরক করে তুলতে পারে, সে যুগেও জানা ছিল। আজ গণতন্ত্রেও উৎকোচের প্রতি অসীম সহিষ্ণুতা সমাজের। অথচ উন্নত জীবনের সম্ভাবনার হত্যা তো এক অর্থে জীবহত্যাই। কেবল সেই সত্যটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে নরক ছাড়া আর তো হাতে কিছু নেই।
কিন্তু অর্জুনের লিস্টে সব চাইতে ইন্টারেস্টিং কথাগুলো আসছে এর পর। যে অতিথিকে আহার দেয় না, স্ত্রী-পুত্র-ভৃত্য ও অতিথিকে ভাগ না দিয়ে যে মিষ্টান্ন খায়, যে কৃতঘ্ন, তারা যে লোকে যায়, সেই নরকে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করছেন অর্জুন।
আইনের বাইরেও যে নৈতিক অনুশাসনের একটা বড় জায়গা আছে, অর্জুনের কথা দিয়ে যেন তা মনে করাচ্ছেন ব্যাসদেব। এ কথাটা খুব জরুরি। কোনও কালেই সব খারাপ কাজের শাস্তি দেশের দণ্ডবিধিতে থাকতে পারে না। অতিথিকে অভুক্ত বিদায় দিলে, বৌ-ছেলেকে ভাগ না দিয়ে নিজে ভালমন্দ সাঁটালে, উপকারী মানুষের উপকার স্বীকার না করলে যে অপরাধ হয়, সে যুগেও রাজা তার শাস্তি দিতে পারতেন না। আজও কোনও আইনসভা তার জন্য আইনের কোনও ধারা নির্দিষ্ট করতে পারে না। এ সব কাজকে নরক-যোগ্য বলে দাবি করাটা মনে হয় যেন অনেকটা আজকের পার্লামেন্টে প্রাইভেট মেম্বার্স বিল আনার মতো। সভার সকলে যা অপরাধ বলে মানেনি, তেমন কাজকে শাস্তিযোগ্য বলে স্বীকৃতির প্রস্তাব দিয়ে রাখা।
নিজের কর্তব্যচ্যুতির অপরাধ কত বড় ক্ষতি করতে পারে, তা কি আমরা আজ অনুভব করছি না? যে লোকেরা নিজের সংক্রমণের সম্ভাবনা জেনেও তা গোপন করে অপরকে আক্রান্ত করল, যারা বাড়িতে কাজের লোকের ঢোকা বন্ধ করল মাইনে বাকি রেখেই, যারা নিজের শহরে অতিথি (শ্রমিক)-কে অভুক্ত রেখে নিজেরা চর্বচোষ্য রেঁধে, ছবি তুলে পোস্ট করল, তাদের কাজ আমাদের কাছে তেমনই অসহ্য মনে হয়, যেমন হয় জামিন-অযোগ্য নানা ধারার অপরাধ।
অনেকে ফেসবুকে আবেদন করছেন, শ্রমিকদের অনাহারমৃত্যু চলছে, এখন পাবদার ঝাল কিংবা স্টাফড রিসোটোর ছবি পোস্ট করবেন না। এই আকুতি তো এক পাপবোধ থেকেই। অন্যের কষ্ট দেখেও যে নিরুদ্বিগ্ন থাকে, তাকে কোনও আইনে শাস্তি দেওয়া চলে না। কিন্তু সে পাপী বইকি। সেই কথা বোঝাতেই যিশুকে ল্যাজ়ারাসের গল্প বলতে হয়েছিল। যে ধনী নিজে গান্ডেপিন্ডে খায় কিন্তু দরজার পাশে কুকুরের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করা ভিখারিকে খাওয়ায় না, তার নরকে স্থান হয়েছিল। কারণ অভুক্তের ক্ষুধা দূর করার ক্ষমতা ওই ধনীর ছিল, কিন্তু সে তা করেনি।
এই লজিক ঠিক হলে বলতে হয়, রাজনৈতিক নেতাদের একটা বড় অংশের জন্য নরকে সিট বুক করা আছে। লকডাউনে মানুষের প্রবল আর্তির মুখে কাউন্সিলার, বিধায়ক, সাংসদদের একটা বড় অংশ হাত উল্টে, ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে যে নেতারা পথে নামতে ও কয়েকশো কিলোমিটার হাঁটতে বাধ্য করলেন, সেই গণতন্ত্রের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যে কোনওদিন কাঠগড়ায় তোলা যাবে এটা বিশ্বাস হয় না৷ অথচ এইসব শ্রমিকদের প্রতি যে কতখানি অন্যায় করা হল তা প্রতিটি ভারতবাসী উপলব্ধি করতে পারছেন। কটা কমিউনিটি কিচেন নির্বাচিত নেতারা আয়োজন করেছেন, আর কটা করেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা, সে হিসেব নিলেই বোঝা যাবে যে গণতন্ত্রে নিষ্ক্রিয়তাও পাপ। জেলে পাঠানো যাবে না, তা বলে নরক-যোগ্য বলায় ক্ষতি কি? “বউ-পেটানো স্বামীকে যদি আদালতে টেনে না নিয়ে যেতে পারি, তাহলে বানভাসি গ্রামে ত্রিপল চুরি-করা নেতা যে নরকে যায়, সেখানে যেন আমার স্থান হয়।” লক্ষ করুন, এমনভাবে কথার নৈতিকতা এখানে যে কারও প্রতি বিদ্বেষ, কারও অহিতকামনার প্রকাশ এ নয়। নিজে শাস্তি সইবার অঙ্গীকার করে অন্যের কাজের শাস্তিযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
আর স্বর্গ? তা কি কেবল ভাল ছেলে হয়ে থাকার প্রাইজ়? পুত্র অভিমন্যুর মৃত্যুতে কাঁদতে কাঁদতে সুভদ্রা নানা পুণ্যবান, কীর্তিমান মানুষের উল্লেখ করে বলছেন, তাঁদের যোগ্য স্বর্গ যেন তাঁর তরুণ পুত্রও লাভ করে। তারা কারা? দানশীল ব্রাহ্মণ, যুদ্ধ-অপরাঙ্মুখ বীর, সদাচারী রাজা, সর্বভূতে প্রীতিযুক্ত অনিষ্ঠুর ব্যক্তি— এবং সেই সঙ্গে, একভার্য পতি। যে পুরুষের একটিই ভার্যা, তার উপযুক্ত স্বর্গে তুমি যাও, ছেলেকে বলছেন মা। এই একটি কথায় যেন এক নারীর বহুদিনের অবরুদ্ধ হাহাকার বেরিয়ে এসেছে। তাঁর স্বামীর তিনি একমাত্র পত্নী নন, প্রধানা পত্নীও নন। দ্রৌপদীই পঞ্চপাণ্ডবের হৃদয়-সম্রাজ্ঞী। অপর নারীর প্রতি অনুরক্ত স্বামীর স্ত্রী হয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট, শ্বশুরবাড়িতে ছোট হয়ে, নিচু হয়ে থাকার কষ্ট সুভদ্রার মতো রাজকন্যাকেও সইতে হয়েছিল। কত মেয়েকে যে আজও সইতে হয়। বাবা কি দাদার যতই নামযশ, ধনজন থাকুক, আদরিনী কন্যার এই বেদনা ঘোচানোর ক্ষমতা তাদের সে দিনও ছিল না, আজ নেই। কারণ নারীর প্রেমের পূর্ণাহুতি গ্রহণ করেও সম্পূর্ণ হৃদয় দান না করা পুরুষের অপরাধ বলে গণ্য হয় না, যতক্ষণ সে স্ত্রীর ভরনপোষণের দায় স্বীকার করছে। সংসারে শাশুড়ি বা বড় জায়ের আধিপত্যও প্রত্যাশিত। তার শাস্তি কেউ চাইতে পারে না। তা বলে কি মেয়েরা নিজের অপূর্ণতার আক্ষেপ, দীনতার দুঃখকে ভুলতে পারে?
শাস্ত্র, সমাজ, এমনকী নৈতিকতার পরেও থেকে যায় ভালবাসা। অন্যের দুঃখ নিজের হৃদয়ে বুঝতে পারা, আর তার ইচ্ছাকে মান্যতা দেওয়ার ক্ষমতা। অন্যকে দুঃখ দিয়ে যিনি নিজের সুখ চান না, অন্যের অধিকার অতিক্রম করে নিজের প্রতিষ্ঠা চান না, নীতি-পরায়ণতা তার অন্তরের নির্দেশ, বাইরের বিধান নয়। আহা, এমন মানুষের সঙ্গে বাসই তো স্বর্গবাস। পরিবারেই এমন মানুষ বিরল, সমাজজীবনে, ধর্মজীবনে, রাজনীতিতে এমন মানুষ কদাচিৎ দু-একজন আসেন। যাঁরা তাঁদের স্পর্শ করতে পারেন, তাঁরা অমৃতের স্বাদ পান ইহজীবনেই।
হেডার ছবিটি মকবুল ফিদা হুসেনের আঁকা। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া।
পুরাণ ও এপিকের উপাদান এই লেখাকে কাঙ্খিত মাত্রা দিতে পেরেছে। পড়ে সমৃদ্ধ হলাম।