সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমার গান

সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমার গান : সঞ্জীব দেবলস্কর

সঞ্জীব দেবলস্কর

 

সবাক চলচ্চিত্রের সূচনা থেকেই বাংলা কিংবা ভারতীয় সিনেমায় সঙ্গীতের ধারাবাহিক প্রয়োগ এমন একটি ধারণার জন্ম দিয়েছে যে সাধারণ দর্শকের মনে এটা বদ্ধমূলই হয়ে আছে সঙ্গীত, বিশেষ করে কণ্ঠসঙ্গীত বুঝি সিনেমার একেবারে অপরিহার্য অঙ্গ। বিদেশি সিনেমাতে কণ্ঠসঙ্গীতের বিলকুল প্রয়োগ না থাকলেও কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটে না। কিন্তু এদেশের হিন্দি, বাংলা সহ প্রাদেশিক সিনেমা হবে আর এতে একটাও গান শোনা যাবে না, এ তো অকল্পনীয়। যে ছবিগুলোকে আর্ট ফিল্ম তকমা দিয়ে একটু আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়, সেগুলোতেও পরিচালক গানকে একেবারে সরিয়ে রাখতে ভরসা পান না। আর বাণিজ্যিক ছবিতে কাহিনি যদি নিতান্ত দুর্বল হয়, ফটোগ্রাফিও যদি হয় তথৈবচ, এমনকি অভিনয়ও যদি একেবারে সাদামাটা হয়, তবুও ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়ে যায় যদি এতে কয়েকখানি খাসা গান থাকে। আর বক্স অফিসে সাফল্যের পেছনে গানের ভূমিকা অতি অবশ্যই প্রধান। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে সিনেমা-ভাষার শব্দ সঙ্গে সঙ্গীত একেবারে গভীরভাবে বিলগ্ন। তবে ধারণাটা এক অর্থে যুক্তিযুক্তও বটে। কণ্ঠসঙ্গীত বাদ দিলেও আবহসঙ্গীতবিহীন কোনও সিনেমা হতেই পারে না। আইজেনস্টাইন, পুডোকিন, গোদার, চার্লি চ্যাপলিনের নির্বাক ছবির সঙ্গে কিন্তু আবহসঙ্গীত বাজত। ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন-এর সঙ্গে যদি পিয়ানোর মিউজিক, ড্রাম বিটস না থাকত তবে দর্শকদের দীর্ঘক্ষণ বসে ছবি দেখা কষ্টকরই হত। পঙ্কজ মল্লিক তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন তিনি এবং রাইচাঁদ বড়াল কীভাবে নির্বাক ছবির প্রদর্শনের সময় পর্দার পাশে হ্যান্ডসদের নিয়ে বসে আবহসঙ্গীত বাজিয়ে যেতেন। তাছাড়াও বিভিন্ন শব্দ ধ্বনি নিয়ে সাঙ্গীতিক আবহ রচনা করা সম্ভব। সঙ্গীত তা সে কণ্ঠসঙ্গীতই হোক আর আবহসঙ্গীতই হোক না কেন, সিনেমার সঙ্গে এর সম্পর্ক গভীর। তা ছাড়া আবহসঙ্গীত যে বিভিন্ন ধরনের এফেক্ট তৈরি করে, প্রয়োজন ভ্রম সৃষ্টি করে বাস্তবকে নিবিড়ভাবে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করে, প্রতীকের মাধ্যমে কোন কিছু উপস্থাপন করে— সে আলোচনার স্থান অবশ্য এখানে নয়। আমরা শুধু বলব শাব্দিক অনুষঙ্গবিহীন চাক্ষিক দৃশ্যায়ন অসম্পূর্ণ। ছবিতে সঙ্গীতের প্রবেশ এই পথ দিয়েই। বাংলা সবাক চিত্রের আত্মপ্রকাশ মানে বাংলা সিনেমায় গানের প্রবেশ। ত্রিশের দশক থেকে পঞ্চাশ ষাট সত্তর দশক পর্যন্ত বাংলা সিনেমা যত কথা বলেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি গেয়েছে গান। সূচনায় তো সিনেমার নায়ক নায়িকাদের সঙ্গীতে পারদর্শী হওয়া অপরিহার্য ছিল।

বাংলা গানের স্বর্ণযুগ বলে যে যুগটিকে আমরা চিহ্নিত করি সে যুগটি এক অর্থে বাংলা সিনেমারও স্বর্ণযুগ। এই গ্রুপ সৃষ্টিতে কতিপয় নায়ক নায়িকা জুটি যেমন অবদান জুগিয়েছেন, তেমনি অবদান জুগিয়েছেন গীতিকার-সুরকার সঙ্গীতকার-পরিচালক, সুরকার-গায়ক কিংবা পুরুষকণ্ঠ-নারীকণ্ঠ জুটি। আশির দশক থেকে যে আধুনিক বা সৃজনশীল বাংলা গানের একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায় সূচিত হয় এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল বাংলা সিনেমার জগতে শূন্যতা। বাংলা গানের প্রধান অবলম্বন যে সিনেমা এটা যে কত শক্তি সত্যি তা বোঝা যায় এদিকে তাকালে। বছরে তিরিশখানা ইপি রেকর্ডে ষাটখানা গান ছাড়া বাংলা আধুনিক গানের আর তো কোনও প্রকাশমাধ্যমও ছিল না। সিনেমাকে আঁকড়ে ধরেই তো বাংলা, বিশেষ করে রোমান্টিক আধুনিক গানের সেই প্রবল উৎসারণ। হ্যাঁ, এটাও বলা যায়, কালজয়ী সব গানের সহায়তা পেয়েই তো ওই সময়ের বাংলা সিনেমার এত বাড়বাড়ন্ত। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানের অবলম্বনেই তো উত্তম-সুচিত্রার জয়যাত্রা; ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’র মাদকতা ছিল বলেই গ্রীবাবাঁকানো অভিব্যক্তি; সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যার আকর্ষণ না থাকলে ছবিটি কি দর্শককে মোহাবিষ্ট করতে পারত? ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’ যদি হেমন্তর কণ্ঠে ফুটে না উঠত তবে কি দর্শক-শ্রোতা ওমনি ওমনি রেডিওর সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ত যেমন দেখিয়েছিল শাপমোচন ছবিতে? মণিহারের সেই নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থপাখির পথ ভুলে যাওয়া, কেন গেলে পরবাসে বলে বধুয়ার আকুতি, কে যেন গো ডেকেছে আমায়-র মতো অনুভূতি জাগানো গানের টানেই যে বাঙালিসমাজ সিনেমামুখী হয়ে উঠেছিল। কমলকুমার মজুমদারের মতো বিদগ্ধজন, যাঁর শিল্পবোধ, সাহিত্যবোধ এবং সিনেমাবোধ ছিল প্রখর, তিনিও সিনেমার গানের জন্য একরাশ প্রশ্রয়বাক্য ব্যয় করতে দ্বিধা করেননি। ‘চলচ্চিত্রে গানের ব্যবহার’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছেন:

এদেশের মতো এত গানপাগলা দেশ আর কোথাও নেই। আমাদের দেশের ছবিতেই তো গান থাকবে। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের ছবিতেই এত গান নেই। আমাদের গানে আনন্দের চটুলতা আছে, গভীরতাও আছে। আমাদের ছবির একটা নিজস্ব রূপ, একমাত্র রূপ বলতে পারি, হোক না হাসির ছবি, সুখের কি দুঃখের, গান আছে কিনা জানতে চাই সবার আগে আমরা। পরিচালনার অভাব হলে ক্ষমা করি, ফটোগ্রাফি আশ্চর্য না হলেও বসে থাকি, তারপরও একটা গানও যদি ভালো না হয় সহ্য হয় না আমাদের।

এমতাবস্থায় সিনেমার গানকে উপেক্ষা করে কার সাধ্যি। বিশিষ্ট দক্ষিণী চলচ্চিত্রকার আদুর গোপালকৃষ্ণন যতই ফরমান জারি করেন না কেন যে সঙ্গীতময় সিনেমাকে পুরস্কার প্রদানকারী জুরি বোর্ড বিবেচনাধীনেই আনবে না— তবুও ছবিতে গান থাকবে— সেটা রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক, হীরেন বসু, কানন দেবী, সরযুবালা, উমাশশী দে, কৃষ্ণচন্দ্র দে, নজরুল ইসলাম, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া, মলিনা দেবীদের আমলের জামাই ষষ্ঠী, জোর বরাত, ঋষির প্রেম, প্রহ্লাদ, চণ্ডীদাস, সীতা, দক্ষযজ্ঞ ইত্যাদি ছবির যুগ থেকে একেবারে সাম্প্রতিক কালের উনিশে এপ্রিল, সেদিন দেখা হয়েছিল, ওয়ান্টেড, অটোগ্রাফ, গোরস্থানে সাবধান, মনের মানুষ, শুকনো লঙ্কা, আরেকটি তারার খোঁজে, মহানগর কলকাতা, ইতি মৃণালিনী, তখন তেইশ, বাইশে শ্রাবণ, কাগজের বউ, চ্যাপলিন, ইচ্ছে, রঞ্জনা আমি আর আসব না, উড়ো চিঠি, ভূতের ভবিষ্যৎ, অপরাজিতা তুমি, এলার চার অধ্যায়, ল্যাপটপ, চিত্রাঙ্গদা, পাঁচ অধ্যায়, হেমলক সোসাইটি, রূপকথা নয়, সত্যান্বেষী, প্রমোশন, তিয়াসা পর্যন্ত চলে আসছে।

বাংলা সিনেমার সঙ্গে গানের এই গভীর সম্পর্কের কথা যদি সূত্রাকারেও না বলা হয় তবে আলোচনা অসম্পূর্ণই থাকবে। ষাটের দশকের ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবির সেই ‘আমি যামিনী, তুমি শশী হে’, ‘আমি যে জলসাঘরে’, ‘চম্পাচামেলী’ এই গানগুলো প্রথম শোনার স্মৃতি উসকে দিলে অনেকের মনই স্মৃতিভারাতুর হয়ে যাবে। ‘সাগরিকা’ ছবিতে শ্যামল মিত্রের ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ কিংবা ‘দ্বীপের নাম টিয়ারঙ’ ছবির ‘সাত সাগর পাড়ি দিয়া তোরে লইয়া যাই’ কিংবা ‘মায়ামৃগ’ ছবিতে ‘মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য’ গানগুলো শুনে কোন সিনেমাপ্রেমী স্থির থাকতে পারেন? ‘নীল আকাশের নিচে’ ছবিতে হেমন্তর কণ্ঠে ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘পলাতক’ ছবিতে ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই’ একটা সময় কত শ্রোতাকে বাউল বানিয়েছে! বাংলা সিনেমাই আমাদের শুনিয়েছে রাগপ্রধান গান ‘ত্রিবেণী তীর্থ পথে কে গাহিল গান’, শুনিয়েছে বাউল বাতাসকে সাথী করা ঝড়ের গান, এনে দিয়েছে দখিনা বাতাসে মন কেন কাঁদে-র অনুভূতি। সিনেমার গানেই বাঙালি দেখেছে ভোরের আকাশে প্রভাতী পাখির জেগে ওঠার চিত্রকল্প, আষাঢ় শ্রাবণে ঝরো ঝরো বর্ষণের ছবি, চঞ্চল ময়ূরী রাতের আভা। বাংলা সিনেমাতেই চলে যেতে যেতে দিনগুলি শুনিয়ে গেছে আশ্বাসের বাণী ‘আঁধারের শেষ পাখির গানে গানে ভোর হবে’। বাংলা সিনেমার প্রেমিকেরা কত স্নিগ্ধ অনুভবে বলেছে ‘কে প্রথম চেয়ে দেখেছি, কে প্রথম ভালোবেসেছি?’ সিনেমা অনুষঙ্গ সরিয়েও প্রেমিক প্রেমিকারা ভাবুন তো দেখি এ প্রশ্নের উত্তর কি এত সহজ, ‘তুমি, না আমি?’

রাগাশ্রয়ী থেকে লোকসঙ্গীত, ক্যাবারে থেকে ব্রহ্মসঙ্গীত, হাসির গান থেকে ভূতের আবহ, নিসর্গ বন্দনা থেকে প্রাণহীন শহরের ইতিকথা— কী নেই বাংলা সিনেমায়। রাধাকৃষ্ণ লীলাবিষয়ক কীর্তন, রাগাশ্রয়ী শ্যামাসঙ্গীত, চার্চ প্রেয়ার থেকে হোলির গান, দেশাত্মবোধক থেকে ব্যঙ্গাত্মক— কত বিচিত্র তার গানের সম্ভার! অভিশপ্ত চম্বলের দেহাতি গান ‘প্যার করেছি, মরেছি, জানি না তো কী করেছি’, ‘সাগিনা মাহাতো’র ‘ছুট্টিসি পঞ্ছি ছোট্ট ঠোঁটে রে’, ‘জয়জয়ন্তী’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর একগুচ্ছ শিশুসঙ্গীত— এ তো সিনেমা শিল্পের মধ্যে এক সংযোজন।

বছর আটেক আগে সিনেমার গান বিষয়ক একটি নিবন্ধে বলেছিলাম যে, সাম্প্রতিক সিনেমায় ভালো সঙ্গীতের অভাবেও ‘ফ্যামিলি অডিয়েন্স’ শ্রেণিটি অন্তর্হিত হতে চলেছে, এবং সিনেমা হলগুলির শাসনভার চলে যাচ্ছে টিকিট ব্ল্যাকার, শহরতলির মস্তান, বস্তির বিনোদনকামী দর্শক এবং কিছুটা অপরাধজগতের দর্শকদের হাতেও। এ প্রক্রিয়াকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে এসেছে মাল্টিপ্লেক্স এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রদর্শনী। পকেটে পাঁচসিকে আর হাতে ঘণ্টাদেড়েক সময় থাকলে আগে যে কেউ সিনেমায় চলে যেতে পারেন এরকম কথা বলে ভিন্ন এক প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় এক সমালোচককে আক্রমণ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। আমরা এ বাক্য থেকে একটি কথাই এখানে গুরুত্ব সহকারে শুনব, হ্যাঁ সিনেমা দেখাটা আগে সহজ কর্মই ছিল, এবং শুরুর আগে বা বিরতির সময় হলের লন বা ব্যালকনির সামনের সামান্য খোলা জায়গাতেই দর্শক টুকটাক ভালোলাগা-মন্দলাগা বা উচ্ছ্বল হয়ে মুগ্ধতার কথা বলতেন। এ দর্শক আর নেই, এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন বাংলা সিনেমাও হাইটেক হাইবাজেটের দিকে চলেছে। কিন্তু সমস্যা হল অত্যাধুনিক যান্ত্রিক প্রকৌশলের সহায়তায় নির্মিত ছবি যে আবার মফস্বল শহর বা শহরতলির হলগুলোতে দেখানোও যায় না। এ হলগুলোর উপযোগী সিনেমাতেও যদি আবার কিছুটা হাইটেকের ছোঁয়া না থাকে তবে দর্শক আসবেই না। অতএব এক ধরনের বাংলা সিনেমা তৈরি হল যার শৈল্পিক দিক নয়, গানের দিকই বর্তমানের বিবেচ্য। তাই এদিকেই একটু আলোকপাত করা যাক। হঠাৎ একটা নতুন ট্রেন্ড। বাংলা বাণিজ্যিক ছবি বেশ বাজার পাচ্ছে, দক্ষিণ ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এতে লগ্নিও করছেন, এতে অভিনয় করছেন স্টার শিল্পীরাও। আর এতে নাচ-গানের যথেষ্ট সংস্থানও রয়েছে। এসব ছবির গানগুলোর চিত্রায়ন অবশ্য কিছু টিভি চ্যানেলে নিয়মিতভাবে দেখানোও হয়। বোম্বাই সিনেমার অবিকল রূপায়ণে হিন্দি গানের অনুকরণেই গান সহযোগে এসব সিনেমার নৃত্য প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গেই জেনিভা, লিসবন, সিঙ্গাপুর, ভেনিস, পুরুলিয়া— কাঁহা কাঁহা মুলুকে এ গানের চিত্রগ্রহণ হয়েছে তাও স্পষ্ট অক্ষরে দেখানো হয়। তবু সাবঅলটার্ন দর্শকের বাইরে দর্শক জোটানো সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য এসব সিনেমার গান দিনকতক বস্তির ঘুপচিতে মোবাইলে মোবাইলে বাজে, শহরতলি বা মফস্বলের সিনেমায় এনরেগায় কাজ করা, জবকার্ডধারী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, সর্বশিক্ষার সাইকেল পাওয়া স্কুলছুট কৈশোরোত্তীর্ণা বালিকাটি, সস্তা জিনস পরা এমএলএর সাকরেদস্য সাকরেদ, পঞ্চায়েতের দালাল, শহরের বাড়িতে বাড়িতে দিনভর বাসন মেজে ক্লান্ত মহিলাটি, রাস্তার ধারের খুচরো বিক্রেতার সৌখিন ঘরণী এবং তস্য পিসিশাশুড়ি, গ্রামীণ হায়ারসেকেন্ডারি স্কুলপালানো প্রেমিক প্রেমিকা, ফ্ল্যাটবাড়ির কেয়ারটেকার— এরাই বাঁচিয়ে রেখেছে ‘১০০% লাভ’, ‘রংবাজ’, ‘জলহাওয়া’ এরকম টাইটেলের সিনেমা। এদের সাময়িক পছন্দের গানের কলিগুলি বড্ড স্থূল— ‘আশ্বিনের ফিভারে/তোমার সুন্দর ফিগারে’, কিংবা যথেষ্ট হিন্দি শব্দের মিশ্রণ দিয়ে ‘হে হে লিসন টু মি/আই লাভ ইউ’। আবার এরকমও লিরিক— ‘মন খালি খালি তুই তুই করে/এখন আর কী করি/হয়ে যা তুই ফেরারি/প্রেমের জলে হাবুডুবু খাই’। অবশ্য এসব গান এবং ছবিকে আলোচনায় আনা মানে শ্রোতাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানো।

তবে সাম্প্রতিক সিনেমা, যে সিনেমাগুলোকে একেবারে হার্ডকোর আর্টফিল্ম পর্যায়ে ফেলা যায়, সে সঙ্গে সেমি-আর্টফিল্ম এবং বাণিজ্যিক সাফল্য চেয়েও শৈল্পিক দিকে সচেতন যে সিনেমাগুলোকে নান্দনিক পর্যায়ে ফেলা যায়— এ সিনেমাগুলো কিন্তু সঙ্গীতছুট নয়, আবার সঙ্গীতনির্ভর মেলোড্রামাটিকও নয়।

‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ সিনেমাটির মধ্যে আর্টফিল্মের বৈশিষ্ট্য থাকলেও এটা মূলত একটি বাণিজ্যিক ছবিই। এ ছবির গানের পরিকল্পনায় পরিচালক যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সেকালের মঞ্চ অভিনেত্রীর ভূত চরিত্রের কণ্ঠে একেবারে উনিশ শতকীয় গায়কিতে গান ‘তুমি কি এঁলে না ফিরে আঁমারে কথা দিলে’ কিংবা রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদলে ভূতেদের কোরাস ‘আমরা চৌধুরী প্যালেসের ভূত’। এই একটি গানের মধ্যে ইংরেজি, হিন্দি ঠুংরি, মুজরা, কাওয়ালি এমনকি পল্লীগীতির কোলাজ দর্শক-শ্রোতাদের ভিন্ন ধরনের আনন্দ দিয়েছে। ‘বং কানেকশন’-এ রয়েছে একাধিক গান। এতে আবার রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে ভিন্ন ধরনের মিউজিক সংমিশ্রণ, হামিং সংযোজন— দৃশ্যতই চিত্রায়নের জন্য। এই গান শ্রুতিমাধ্যমে শোনার নয়, শুনলে মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি হতে পারে। শুনে দেখুন ‘ও মাঝিরে’ বা ‘তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হত না’— এ গানে আবার সুকুমার রায়কে গামছা গলায় কিংবা বনলতা সেনকে বাসন মাজা মেয়ের ভূমিকায় দেখার চিত্রকল্পটা কেমন যেন অসহনীয়। তবে এখানে যে আন্তর্জাতিক সপ্রতিভতা রয়েছে! দেশীয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির খণ্ড খণ্ড টুকরোর সঙ্গে বিশ্বায়তনিক খণ্ড সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে এক ধরনের চমক সৃষ্টির প্রয়াস রয়েছে যে!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...