শিব এব কেবল

শিব এব কেবল : তুষ্টি ভট্টাচার্য

তুষ্টি ভট্টাচার্য

 

ছবি এঁকেছেন হিরণ মিত্র

এই সময়ে যখন সারা বিশ্ব করোনা ত্রাসে ভুগছে, মহাকাশ কিন্তু রয়েছে অন্য মেজাজে। প্রতি মুহূর্তে একের পর এক রহস্যের পর্দা সরিয়ে চলেছে। করোনায় মৃত্যু, সংক্রমণ, আতঙ্ক থেকে চোখ সরিয়ে টেলিস্কোপে নজর রাখতেই চমকে উঠলেন বিজ্ঞানীরা (১৬ই এপ্রিল ২০২০)। আমাদের ছায়াপথ মানে মিল্কি ওয়ে (Milky Way) গ্যালাক্সির মাঝেই যেন লালচে-নীলচে ফুল ফুটেছে। কী উজ্জ্বল সেই ফুল, যেন আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। লহমায় লহমায় রংও বদলাচ্ছে। লাল রিংকে কেন্দ্র করে ফুলের নীলচে পাপড়িরা যেন নেচেই চলেছে। নাচ থামার কোনও লক্ষণ নেই। ফুল তো নয়, আসলে একটি বিরাট তারা। ছায়াপথের রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি চলে এসে এমন ছটফট করছে। ইউরোপিয়ান সাদার্ন অবজারভেটরির (ESO) দীর্ঘতম টেলিস্কোপে ধরা দিয়েছে এই তারা। নাম এস২ (S2)। চলতি কথায় ড্যান্সিং স্টার। ভারী জাঁদরেল ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের আকর্ষণের কারণে নিজের কক্ষপথে ঘুরে ঘুরে নেচে চলেছে এই তারা।

বিজ্ঞানের এই বিস্ময়ে সৃষ্টি বরং নতুন কল্পনার পথ দেখল। মিল্কি ওয়ে বা ছায়াপথ তৈরির গ্রিক পুরাণের কাহিনি মাথায় এল আমার। একদিকে করোনার সন্ত্রাস মনে করাল নটরাজের ধ্বংসাত্মক নাচকে। আর তাঁর তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত লাস্য যেন পার্বতীরূপী ওই নৃত্যরত তারাটির গায়ে লেগে রইল। আমার সঙ্গে সঙ্গে একইভাবে বিস্মিত হয়ে, কল্পনায় ভর করে প্রাজ্ঞ চিত্রকর হিরণ মিত্র এঁকে ফেললেন তিনটি ছবি। বিজ্ঞানের সঙ্গে যে শিল্পের বিরোধ নেই, একথা বারবার প্রমাণিত হয়ে যায়।

সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র আমিই বর্তমান ছিলাম। আমিই লীলাচ্ছলে ব্রহ্মারূপ সৃষ্টি করেছি। বিষ্ণুরূপ ধারণ করে পালন করেছি আবার রুদ্ররূপে সংহার করেছি। আমি, তুমি, ব্রহ্মা এবং রুদ্র নামে যিনি উৎপন্ন হয়েছেন, সকলেই এক। এদের মধ্যে কোনও ভেদ নেই, ভেদ থাকলে বন্ধনও থাকত। তবুও আমিই একমাত্র সনাতন এবং সকলের মূল স্বরূপ, যা সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত স্বরূপ। আমি জন্মরহিত, শাশ্বত, সর্বকারণের কারণ। আমি স্ব-স্বরূপে বর্তমানে, সমস্ত জ্যোতির জ্যোতি, আমিই তুরীয়, অন্ধকারের অতীত, আদি ও অন্তহীন। যখন আলো ছিল না, অন্ধকারও ছিল না, দিন ছিল না, রাত্রিও ছিল না, সৎ ছিল না, অসৎও ছিল না, তখন কেবলমাত্র আমি ছিলাম। আমিই মহা ঈশ্বর। নৃত্য ও সঙ্গীত আমিই সৃষ্টি করেছি। তাণ্ডব ও লাস্য এই দুটি নৃত্যের মধ্যে তাণ্ডব নৃত্যে কাল-মহাকাল বেশে পৃথিবী ধ্বংসের উদ্দেশ্যে এই নৃত্য আমার। আর লাস্য তাণ্ডবের নারীসুলভ অভিব্যক্তি। এই আবেগময় মধুর ও সুচারু নৃত্যকলা পার্বতীর। এই নৃত্য সৃষ্টির।

আর ওই মহাশূন্য? মহাকাশে নৃত্যকলা পরিবেশন করে কে? মনে পড়ে হেরাকে? যে একদিন ঘুম ভেঙে দেখেছিল, তারই বুকে স্বর্গীয় স্তন্যসুধা পানরত এক অচেনা শিশুকে। বিরক্ত হেরা ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল সেই শিশু হারকিউলিসকে। আর তার দুধের ধারা বয়ে চলেছিল এক অনন্ত পথে। যে দুধেলো বৃত্তপথের নাম ছায়াপথ রেখেছিল কে যেন! দেখোনি কি ওই পথে দুগ্ধধারার নৃত্য? অমৃত পথ সে যে! সে পথে নিয়ত সন্তরণশীল নক্ষত্রের ঝাঁক, আলো নিয়ে খেলা করে। আলোর ইশারা পেয়ে নাচে, থইথই মহানৃত্যের আসর সেখানে দিনরাত। যদিও দিনরাতের অস্তিত্ব সেখানে নেই। দিন ও রাতের সঙ্গমস্থল সেই মহাকাশ। আর তারই কিছু দূরে, নাকি অনেকখানি দূরত্বে বসে থাকে এক অনন্ত কালো গহ্বর।

আজানের সুর ভেসে আসে এখনও সন্ধেবেলায়। শাঁখ বেজে ওঠে ঘরে। দ্বার বন্ধ মন্দিরের, মসজিদের, গির্জার। দুয়ার বন্ধ দেশে দেশে। অতিমারি জেগে উঠেছে। নৃত্যরত প্রবল জীবাণুর বেশে ধেয়ে এসেছে মৃত্যুর ছায়া। এও কি প্রলয় তাণ্ডব নয়? সেই নটরাজের? ধ্বংসের পরে তিনিই কি ফের খুলে দেবেন সৃষ্টির উৎসমুখ? বিপন্ন এই সময়ে আর্ত মানুষ। ক্ষুধার্ত, ভীত আর সন্ত্রস্ত তারা। এই বুঝি নৃত্যরত তাণ্ডবের আঁচড় লেগে যাবে তার গায়ে! এই বুঝি মুখোশ খুলে গেল তার! ব্যস্ত নগরী, বর্ধিষ্ণু রাজপাটে আজ শ্মশানের চামড়া পোড়া গন্ধ। একে একে দূরে চলে গেছে পরিজন। এই বুঝি ছুঁয়ে দিল কেউ, এই বুঝি বিষ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ল তার গায়ে! কোথা গেল লাস্য, হাস্য, প্রিয় নারী, প্রিয়তম, প্রিয় সন্তান? একেলা হতে থাক, নিঃসঙ্গ জীবনে নৃত্য নেই, নেই কোনও আশ্বাস। শুধু এক শূন্য কালো গহ্বর দূরে, নাকি নিকটেই ওত পেতে আছে, বিনাশকাল শেষ হলে পূর্ণ হবে বলে!

ডম্বরুর শব্দ শুনছ তুমি, হে মহাকাল? শুনছ কি গুরুগুরু ওই নাদ— পদধ্বনি? জটাজুট উড়েছে অশান্ত বাতাসে? নিদ্রাত্যাগী বিষধর ঢেলে দিল হলাহল ওই বাতাসেই! কম্পমান এই ভূমি, নদীর জলে অশান্ত ঢেউ, উত্তাল সমুদ্রের গর্জন— শুনতে পেয়েছ আজ? যেন এক মৃত্যুঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে ধরাধাম। সুষুপ্তির দেশে অতি জাগরুক কেবল ওই জীবাণু। বর্ধিত স্পর্ধায় বেড়ে চলেছে তার কণ্টক। বিদ্ধ করবে বলে অতিত্রস্ত সে। এও এক নৃত্যের ভঙ্গিমা, এও এক অদম্য কৌশল। তার সেই লাস্যের পরিক্রমা থেকে জেগে উঠবে বলে অপেক্ষারত আজ মৃত্যুর দূত। অবিচল দাঁড়িয়ে রয়েছে সে বন্ধ দরজার ওপারে। হে বিশ্বেশ্বর, কোথায় তোমার জ্ঞান ও অনন্ত স্বরূপ? কলা সৃষ্টিকারী হে মহা ঈশ্বর, ধ্বংস নয় আর, সৃষ্টির পথে এসো। দেখাও তোমার মধুর ছলাকলা, লাস্য, পরিহাস। তুমি তো সর্বজ্ঞ! দেখোনি কি ওই মহাকাশে নৃত্যরত তারাটিকে? ফুলের সম্ভার নিয়ে এসেছে সে। দেখোনি কি তার ওই রূপমাধুর্য্য, লাস্য ও ব্রীড়া? স্বয়ং পার্বতীই বুঝি তারার রূপ ধরে নেচে চলেছে সেখানে।

এই সেই অনন্ত ছায়াপথ। দুগ্ধফেননিভ শয্যা। নক্ষত্র সমাবেশে গভীর এক আলোচনাসভা বসেছে এখানেই। এখানেই আচম্বিতে ফুটে উঠেছে এক প্রজ্জ্বলিত, নৃত্যরত ফুল। কে দেখেছে তাকে? তারাদের চোখ নেই, অন্ধ কোটর থেকে জ্বলে ওঠা আলো দেখে তোমাদের মনে হতে পারে, আঁখির উপমাভ্রম। অন্ধ আর অন্ধকার গহ্বরে ওদের মুক্তি লেখা আছে, জানে ওরা। জানে ওই নৃত্যরত তারাটিও। তবুও সে ফুলের শোভা নিয়ে এসেছে, নাচের ভঙ্গিমায় এসেছে। লাস্যে, আস্যে তার এই নৃত্য মধুর থেকে মধুরতম হয়ে ব্যাপ্ত ওই মহাকাশে। ওই তারাদের মজলিশে সেই মধ্যমণি। পৃথিবীর ডিম্বাকার পথ সে চেনে না। তার পথ গোলাপের নকশায় আঁকা। নেচে নেচে, ঘুরে ঘুরে সে পাক খায় এক অন্ধকে কেন্দ্র করে। সুবৃহৎ সেই অন্ধকার কালো শূন্যের পরিমাপ করতে যেও না! অন্ধ সে নয় পুরোপুরি। আলোর অধিক আলো হয়ে আছে।

মহেশ্বর জানে তাকে। এই মহাশুন্যের সেই অধীশ্বর। চল্লিশ লক্ষ সূর্যের সমান সে, ছাব্বিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরত্বে থাকে সে সূর্যের। আমাদের ক্ষুদ্র নৃত্যপর তারাটি তবুও এই অধীশ্বরকে ঘিরে পাক খায়। দুহাজার কোটি কিলোমিটার দূর থেকে কায়ক্লেশে ষোলো বছরে আবর্তন করে তাকে একবার। সামান্য সে, নিতান্তই এক বালিকার মতো টলমল পায়ে নেচে যায়, নেচে যায়… হেলে পড়ে উপকেন্দ্রের দিকে। সেই মহা ঈশ্বরের কোল লক্ষ্য করে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ফুলের আবেশ এনে আবর্তন করতে চায়। যত সে হেলে পড়ে তত তার প্রভা বিচ্ছুরিত হয়, রক্তবর্ণ কক্ষপথ ঘিরে আলোকিত মায়াময় নীল পাপড়ি মেলে ধরে একে একে। প্রস্ফুটিত হতে চায় পুরোপুরি। বালিকা মোটেও জানে না, প্রস্ফুটনের পরেই কালগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে হয়! অধোমতি, চপলা সে, অবোধ! পরিক্রমা সেরে ফেলতে চায় দ্রুত, অতি দ্রুততায়। জানে না সেও, ওই কালো গহ্বর তারার আধিক সমুজ্জ্বল আলো গর্ভে রেখেছে। ধনুরাশির মহানক্ষত্র সে!

দৃঢ় সংস্থাপিত তারাটির নৃত্যপথ। প্রতিটি পাপড়ি সে মেলে ধরে ডিগ্রির এক পঞ্চমাংশ তফাতে। সঙ্ঘবদ্ধ সেই ফুলের আদল কেঁপে ওঠে প্রস্ফুটিত হয়ে। ফুল কি জানে, ঝরে পড়াই তার নিয়তি? তারাটিও জানে না। অবিশ্রান্ত তার নৃত্য প্রদর্শন। কালোগহ্বরের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ এড়াতে পারে না সে। চঞ্চল, চপলমতি বালিকার এই মৃত্যুক্রীড়া দেখে বিস্মিত হয়েছে ছায়াপথ। স্তম্ভিত তার দুধের ধারা। স্থির হতে গিয়েও তিরতির কেঁপে যায় তরলস্বভাবদোষে। স্বভাবদোষে দুষ্ট সেই বালিকাও। নৃত্যের অছিলায় ধেয়ে চলেছে মহামৃত্যুর দিকে। ওই সেই মহানক্ষত্র, ওই সেই কালো মহাকূপ। হাজার, হাজার, লক্ষ, লক্ষ তারাদের মুক্তিস্থান। স্থানিকতা ভুলে সেও বুঝি নড়েচড়ে বসেছে আজ এই ক্ষুদ্র তারাটির নৃত্যমুগ্ধ হয়ে। মুগ্ধতায় কি সে তবে ভুলে যাবে স্বীয় ধর্ম? তার করাল গ্রাস থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে বালিকা? হেরা কি জেগে উঠে পুনরায় তার বুক থেকে ঠেলে দিতে পারবে ওকে? প্রশ্নের আড়ালে জেগে ওঠে আমাদের ইচ্ছা। আশ্চর্যের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকা আমাদের ধর্ম। সুন্দরের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিপাত আমাদের স্বভাব। অমোঘ নিয়তি এসবের ঊর্ধ্বে থাকে। একদিন নাচ থেমে যাবে কালের নিয়মে। ধনুরাশির মহানক্ষত্রটির গর্ভে বিলীন হবে এই ক্ষুদ্র তারাটির নাচ। মুক্তির স্বাদ পাওয়ার আগে সেও পূর্ণ হবে তার স্বভাবে। কালোগহ্বর গ্রাস করে নেবে আলো। আলোর আধার হয়ে জেগে থাকবে সে একাই নিয়তির মতো।

এই নৃত্য সৃষ্টির, এই নৃত্য ধংসের। মহেশ্বরের দুপায়ে দুরকম খেলা প্রত্যক্ষ করতে করতে এই মর্ত্যধাম ক্রমশ ঘুমের দিকে চলেছে। জীবাণুর নৃত্যপর ভঙ্গিমা অতিজাগ্রত হয়ে নেচে চলেছে তারই আঙিনায়। দুয়ারে জল দেওয়ার নেই কেউ, ধুলো ওড়ে তার বাসস্থানে। নদীও স্তব্ধ হয়ে দেখে চলেছে দুপাড়ের ছিন্ন বসতি। অতিদর্পিত মানুষের কলরব ভেঙে খানখান হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। এই সেই সর্বংসহা ভূমি। স্থিতি আর লয় একই বুকে স্থাপিত তার। কর্ষণে জেগে ওঠে আজ কিছু কাঁটার বীজ। হে, দয়াময়ী দেবী, গ্রহণ করো তবে এই অর্ঘ্য আমাদের। ধারণ করো মানুষের আগ্রাসন। সহ্যাতীত সহ্যে, স্বীয় স্বভাবে জেগে ওঠো, জেগে ওঠো। হে আকাশ, হে বাতাস, হে নদী, হে অগ্নি, বিনাশ কর ধূম। মৃত্যুর নাচ দুপায়ে মাড়িয়ে জেগে ওঠ, জেগে ওঠো মহা ঈশ্বর।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4877 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...