তিনটি অণুগল্প

দেবাশিস সেনগুপ্ত

 

শিক্ষক দিবস

২০০০ সাল।

স্বপ্নপুর হাইস্কুলে নিখিলের সহপাঠী ও প্রিয়তম বন্ধু ছিল বিজয়। নিখিলের বাবা বিপত্নীক দেবলবাবু ছিলেন প্রধান শিক্ষক। নিখিল থাকত প্রথম তিনের মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। বিজয়ও। তবে নীচের দিক থেকে। তবে দেবলস্যারের ক্লাসগুলো খুব ভাল লাগত ওর। পারতপক্ষে মিস করত না।

দেবলস্যারের একটা ক্লাসে বলা একটা কথা ওর মনে ঢুকে যায়— “শিক্ষককে ভাল না বাসলে কিছুই শেখা যায় না।” আর এইচএস তৃতীয় ডিভিশনে পেরোবার দিন দেবলস্যার আর একটা কথা বলেন— “শিক্ষার বিনিময়ে শিক্ষককে কিছু দিবি না কোনওদিন।”

এইচএসে স্কুলে প্রথম হয় নিখিল। ওকে রেজাল্টটা দেওয়ার সময়ে দেবলস্যারের ভেজা চোখ ও তারপর চশমা মোছাটা হঠাৎ দেখে ফেলে বিজয়।

 

(২)

জাম্পকাট। ২০১৫ সাল।

পনেরো বছর পরে। আইটি-তে অনেক অনেক উচ্চশিক্ষা শেষে নিখিল অবসৃত ও অসুস্থ বাবাকে ছেড়ে সস্ত্রীক কর্মরত ব্যাঙ্ককে (বিশাল অফার) গত চার বছর। তাদের বাড়িটাও বিক্রি হয়ে গেছে। দেবলবাবু নিখিলের নামে লিখে দেওয়ার একমাসের মধ্যেই, একবছর আগে।

অবসৃত ও অসুস্থ দেবলবাবু থাকেন স্বপ্নপুরেই, অন্য এক ছাত্রের বাড়িতে। পেনশন ছাড়া কপর্দকহীন তিনি আজ। জমানো ও অবসরকালীন টাকাপয়সা অসুস্থতার যূপকাষ্ঠে বলি হয়ে গেছে কবেই।

আর এইচএসের শেষে টেনেটুনে পাস গ্র্যাজুয়েট বিজয় দুবার জেল ঘুরে (মারপিটজনিত, স্বল্পমেয়াদি, দুবারই) পাকস্থলিতে বাঁধা দুটো জীবনের জন্য টুকটাক কিছু তথাকথিত সমাজবিরোধী কাজ করে স্বপ্নপুরে, নিজের টালির বাড়িতে থেকে। বাড়িওলা-ভাড়াটের ঝামেলা মেটানো, জমির ঝামেলা মেটানো, বাজারে তোলা তোলা, এসবই ওর পেশা এখন। ওর এক শিক্ষক থাকেন ওর সঙ্গে গত একবছর। তার ভরণপোষণের দায়িত্ব এখন বিজয়ের।

 

(৩)

আবার জাম্পকাট। চার বছর পরে। ৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৯।

আজ মারা গেলেন অসুস্থ দেবলবাবু। শ্মশানে বসে কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করে ফেলা বিজয় ভাবছিল গত রাতে খাবার সময়ে দেবলস্যারের কথাগুলো। “আমার প্রথম কথাটা শুনলি কিন্তু দ্বিতীয়টা মানলি না বিজয়।”

দেবলস্যারের মৃত্যুর পরে নিখিলকে খবর দিতে পারেনি বিজয়। দেবলস্যার বারণ করেছিলেন গতকালই। বলেছিলেন— “আমার একটাই ছেলে, আর তার নাম বিজয়।”

চিতার আগুনটা নিভে আসছে। বিকেল যাই যাই। আর সন্ধেটা ছুঁই ছুঁই। উঠে পড়ল বিজয়। শ্মশানের বাকি কাজ সেরে বাজারে তোলা তুলতে যেতে হবে ওকে।

দুপুরে তোলাটা তোলা হয়নি তার আজ …

 

অকপট

বৃষ্টিটা কমে এসেছে। বিশাল পার্কের বেঞ্চিটা থেকে উঠে পড়ল দেবা। ক্রাচটা নিয়ে। একঝাঁক তেরো-চোদ্দ রোজ এই পার্কের মাঠে ফুটবল খেলে। আর রোজ বিকেলে অলস দৃষ্টিতে ওদের খেলা দেখতে আসে দেবা। ক্রাচটা নিয়ে। অভ্যেসে খেলা দেখে দেবা। খেলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার অভ্যেসটা বাঁচিয়ে রাখতেই।

ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরতে হয় দেবাকে রোজ রোজ। ওটাই ওকে বাঁচিয়ে রাখে। আর ওই ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরতে এই খেলা দেখার চেয়ে ভালো মিডিয়াম আর নেই দেবার কাছে। অভ্যেসে খেলা দেখে দেবা। ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরতে। রোজ বিকেলে ফ্ল্যাশব্যাকে ফেরে দেবা ওদের নিষ্পাপ ফুটবল দেখতে দেখতে। কত বছর পিছনে যেতে হয় দেবাকে? বড়জোর পনেরো বছর। অভ্যেসে খেলা দেখে দেবা। নিজের কাছ থেকে পালাতে।

লিগের ম্যাচে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারের তাকে করা কড়া ট্যাকলটা এখনও স্পষ্ট চোখের সামনে। সিনবোন কয়েক টুকরো করে দেওয়া সেই ট্যাকল। প্রেমিকা স্মিতা, সরকারি চাকরি, কলকাতা প্রথম ডিভিশনে খেলা— সব ছেড়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যেতে বাধ্য করা সেই ট্যাকল। অভিমানে ছোটখাটো একটা চাকরি জুটিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়া। শুধু ক্রাচটা চিরসঙ্গী হয়ে যায় দেবার। পনেরো বছর পরে, তিনমাস আগে বাড়ি ফেরার বৃষ্টিভেজা দিনটাও মনে গেঁথে আছে।

সে বিদেশে চলে যাবার পরে বছরখানেক যোগাযোগহীন অপেক্ষার পরে স্মিতা বাধ্য হয় সুহৃদ নামের একটি ছেলেকে বিয়ে করতে, বাড়ির চাপে। এবং তার ফেরার দিন স্মিতা সব ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় দীর্ঘ রোগভোগের পরে। সুহৃদ এবং বারো বছরের ছেলে সুমনকে ফেলে। শ্মশানে গিয়েছিল দেবা। চুল্লিতে তোলার আগে একটা বড় মাদুলি স্মিতার গলা থেকে পড়ে যায়। সবার অলক্ষ্যে ওটা কুড়িয়ে নেয় দেবা। চোখ দিয়ে কেন যে অত জল বেরোল সেদিন, বোঝেনি দেবা।

রাতে বাড়ি ফিরে মাদুলিটা খুলে ফেলে দেবা। তারই একটি ছবি। উল্টোদিকে লেখা— “আমার সঙ্গেই রেখে দিলাম তোমাকে, সারা জীবন।”

গত তিনমাস রোজ বিকেলে চুপচাপ পার্কে বসে বারো বছরের সুমনের খেলা দেখে দেবা। নাকি নিজেকেই দেখে, স্মিতার চোখের সামনে? যেভাবে তার খেলা দেখত স্মিতা, এই পার্কেই।

অকপট জীবন কোথায় যে কখন হাফ টার্নে চকিত শটে গোল দিয়ে যায়, আজও বোঝে না দেবা।

 

বন্ধন

অফ স্টাম্পের ঠিক বাইরে পিচ পড়া বলটা আচমকা টার্ন নিল। এবং লাফাল। নিজেকে সরালেও ব্যাট সরানোর সময় পেল না গৌতম। ঘোরার পথে ব্যাটের কানা নিয়ে সিলি-মিডঅনে লোপ্পা ক্যাচ হয়ে গেল বলটা। শর্ট লেগ ধীরে সুস্থে আরামসে নিয়ে নিল ক্যাচটা। শেষ উইকেটের পতন। পার্টনারকে নিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরতে ফিরতে স্কোরবোর্ডে তাকিয়ে কেঁদে ফেলেছিল গৌতম। ১২ রানের জন্য নিজের শতরান মিস। এবং তার চেয়েও বেশি কষ্টটা হচ্ছিল মাত্র ১৫ রানে ম্যাচটা হেরে যাওয়ায়। ওই আচমকা বলটার জন্য।

আজকের তারিখটা এলেই পাড়ার ডন গৌতমের চোখদুটো কেমন ভিজে যায় ঘটনাটা মনে পড়লে। ওই ম্যাচটা জিতলেই বাংলার রঞ্জি টিমে ঢুকে পড়ার কথা ছিল গৌতমের। ‘ম্যাচ টেম্পারামেন্ট’ নেই, এই অপবাদে বাদ পড়ে গৌতম ওই সন্ধেতেই। এবং ওই রাতেই আচমকা টার্ন নেওয়া বলটার মতই আচমকা হার্ট অ্যাটাকে বাবার মৃত্যু। কাউকে কোনও সুযোগ না দিয়ে। পরিবারে একমাত্র উপার্জন ছিল বাবারই।

তারপর ক্রিকেটটাই ছেড়ে দিতে হয় গৌতমকে। মা, ভাই, বোনের সংসার চালাতে ‘অন্য ব্যাটে’ খেলা শুরু করে সে। ছোটখাটো তোলা তোলা দিয়ে শুরু। সেখান থেকে রতন চিনে নেয় রাজনীতির দাদারা। তাদের সুনজরে এসে ভালই চলছিল তার। তারপর পট পাল্টায়। সেও দল পাল্টে নেয় সুযোগ বুঝে। এখন সে পাড়ার ডন। সামনের ইলেকশনে কাউন্সিলরের টিকিট পাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত তার। তার নোংরা উপার্জনেই ভাই আর বোন প্রতিষ্ঠিত এখন। নোংরা দাদার সংস্পর্শ বাঁচাতে তারা আলাদা থাকে মা-কে নিয়ে। একা থাকে গৌতম আর হাসে মাঝে মাঝে।

তবু এই তারিখটা কেন যে কাঁদায় তাকে? আজও বোঝে না গৌতম। যদিও সে এখন এক নবীন সঙ্গী পেয়ে গেছে বাঁচার জন্য, যার তিনকুলে কেউ নেই। সেই ট্যাক্সিতে যাওয়া, সেই সপুত্র দম্পতির বাইকের সঙ্গে তাদের ট্যাক্সির সংঘর্ষ, সেই দম্পতির মৃত্যু এবং সেই বাচ্চাটির প্রায় পাগল হয়ে যাওয়া এবং অতঃপর তার সঙ্গে থেকে যাওয়া, সব মনে পড়ে মাথাটা তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকে গৌতমের।

 

(২)

ফাঁকা মণ্ডপটার দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই চোখ দুটো জলে ভরে যায় সজলের। লোকচোখে পাগল সজল। রাতদিন ফুটপাথে সময় কাটানো বছর বাইশের সজল।

ফাঁকা মণ্ডপটার তাকে মনে পড়িয়ে দেয় বছর দশেক আগের পাড়ার ঠিক বাইরে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটার কথা। সেদিনও ছিল বিজয়া দশমী। ঠাকুর ভাসানের দিন। বাবা আর মা-র সঙ্গে কুড়ি কিলোমিটার দূরের মামাবাড়ি গিয়েছিল সজল সেদিন সকালে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরছিল সেদিন বিকেলেই বাবা আর মা-র সঙ্গে। সন্ধেবেলায় পাড়ার ঠাকুরের ভাসানে যায় তারা তিনজন প্রতিবার।

সেবার যেতে পারেনি তারা। ফেরার পথে তাদের বাইকে মুখোমুখি ধাক্কা দেয় একটা ট্যাক্সি, মাতাল ড্রাইভারের জন্য। স্পট ডেড হয়ে যান বাবা আর মা। অনেকটা দূরে নরম মাটিতে পড়ায় সজল বেঁচে যায়, মাথায় হেলমেট থাকায়।

তবু মাথায় লেগেছিল বারো বছরের সজলের। বেঁচে গেলেও সেই থেকে আজও সে ‘পাগল সজল’। আজও ফুটপাথেই বসে দিন কাটে তার। দুর্ঘটনার পরে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যান এক ভদ্রলোক, যিনি সেদিন যাত্রী ছিলেন ওই ট্যাক্সিতে। অনেক দূরের সেই ভদ্রলোকের ছোট্ট বাড়িতেই হাসপাতাল ফেরত বড় হয়ে ওঠা পাগল সজলের। কেননা নিজের বাড়িটা কোথায়, সে বলতে পারেনি। সেই বাড়িটা আজ ভূতের বাড়ির মত ভাঙাচোরা পড়ে আছে।

নতুন পাড়ার কেউ জানে না কী কারণে আজও পাড়ার পুজোয় ফাঁকা মণ্ডপটার দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই চোখ দুটো জলে ভরে যায় পাগল সজলের। যদিও সে এখন ওই ঘাতক ট্যাক্সির যাত্রীকেই অভিভাবক সঙ্গী পেয়ে গেছে বাঁচার জন্য, যারও তিনকুলে কেউ নেই।

 

(৩)

এখন শুধু একটাই বন্ধনে জড়িয়ে বেঁচে আছে ওরা। বাবা-মা-ভাই-বোন খোয়ানো গৌতম আর বাবা-মা হারানো সজল। গৌতমের মধ্যে বাবা-মা খুঁজে পাওয়া সজল আর সজলের মধ্যে বাবা-মা-ভাই-বোন মিলে যাওয়া গৌতম।

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4411 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...