এ এক অন্য অনলাইন ক্লাস

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

বেঙ্গালুরুর বছর বিরাশির বদ্রিনাথ বিট্ঠল। আলাপটা সেরে নিই। আইআইটি বোম্বের প্রাক্তন স্নাতকোত্তর এবং অবসরপ্রাপ্ত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বয়স। মেধা। পাশে স্ত্রী ইন্দিরা। বয়স ৭৭। জীবনসঙ্গিনী আক্ষরিক অর্থেই। যে ব্রত এই দম্পতি নিয়েছেন, তা দেশে এক দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে। কী সেই ব্রত?

শুরু থেকে শুরু করা যাক। বছর ছয়েক আগে তাঁদের বাড়ির পরিচারিকা তাঁর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মেয়েকে টিউশনে ভর্তি করবেন বলে কিছু সাহায্য চাইলেন বিট্ঠল দম্পতির কাছে। অন্য অনেক সহমর্মী মানুষ হলে কী করতেন? কিছু টাকা দিয়ে তাৎক্ষণিক সাহায্যে দায় সারতেন। বিট্ঠল দম্পতি অন্য ধাতুতে তৈরি। তাঁরা সেই সাহায্য করলেন না। বরং তাঁরা নিজেরাই কোনও বেতন ছাড়াই সেই শিশুকন্যাকে পড়াতে শুরু করলেন। বদ্রিনাথ বিজ্ঞান ও অঙ্কের দিকটি দেখলেন, অন্যদিকে ইন্দিরা ভাষা ও সমাজশিক্ষার দিকগুলি পড়ালেন। ক্রমশ সেই পরিচারিকার দ্বিতীয় কন্যাও ক্লাসে যোগ দিলেন। কুঁড়ি বড় হয়ে ফুল ফুটতে শুরু করল।

২০১৪। প্রতিবেশী কিছু এলাকা থেকে তাঁদের পরিবারের শিশুদের পড়ানোর জন্য দম্পতির কাছে অনুরোধ করা হল। সংখ্যা দুই থেকে আটে এল।

কারা এই শিশুরা? সমাজের একেবারে নিপীড়িত, কিছু না পাওয়া, জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করা সবহারা বাবামায়ের সন্তান সন্ততি, যাদের স্বাভাবিক খরচে পড়াশুনো করার সাধ্য নেই। অতিমারি এল। অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে এল। অবশ্য সেইসমস্ত বাচ্চারা ঘরে না এলেও কোনওভাবে কমদামি স্মার্টফোন জোগাড় করে পড়াশুনো চালিয়ে যেতে থাকল। বিট্ঠল দম্পতি শিক্ষাদান বন্ধ করলেন না। প্রযুক্তি পথ দেখাল।

আলো আসতে থাকল। ছড়াতে থাকল। স্থানীয় কিছু সংবাদপত্রে খবর ছড়িয়ে পড়তেই গোটা কর্নাটক থেকে অনুরোধ আসতে থাকল। বিট্ঠল দম্পতি না করতে পারলেন না। আর কেনই বা করবেন? তাঁরা তো চেয়েছিলেন তাই। ছাত্রের সংখ্যাটা ১০০য় পৌঁছল।

অন্ধকারের দিক কম নয়। কমদামি স্মার্টফোনটুকু জোগাড় করাও বহু পরিবারের কাছে অসাধ্য। হাভেরি, দোদ্দাবল্লভপুর, গঙ্গাবেথি ইত্যাদি বেশ কিছু অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগণিত পরিবার থেকে সেই স্মার্টফোন দেওয়া সম্ভব হল না বাচ্চাদের। বিট্ঠল দম্পতি তাঁদের আত্মীয়, বন্ধুদের দোরে দোরে ঘুরলেন। অনেকেই স্মার্টফোন কিনে দিলেন সেইসমস্ত ছেলেমেয়েদের। চেষ্টা ফলপ্রসূ হল। সেইসব অঞ্চলে ৩০ শতাংশের বেশি ঘরে এখন স্মার্টফোন পৌঁছে গেছে। কিন্তু তা শিক্ষার কাজে আসছে তো? বিট্ঠল দিম্পতি কিন্তু যোগাযোগ বন্ধ করলেন না। যাঁরা পেয়েছেন ফোন, তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখলেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর দিকগুলি খেয়াল রেখে গেলেন নিজের সন্তানের মতোই।

আরেকটি দিক আছে। ছাত্র হল। শিক্ষক হল। কিন্তু এই আলোর আরেক দিক? স্বেচ্ছাসেবী? এগিয়ে আসা আরও মানুষ? সংবাদপত্রে পড়ে বহু মানুষ বিনামূল্যে শিক্ষাদানে এগিয়ে এলেন। বিএমএস কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী, কিছু অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, এমনকী ইসরোর এক বিজ্ঞানীও এগিয়ে এলেন। দশেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক এই মুহূর্তে বিট্ঠলদের পাশে আছেন।

এমন স্বপ্নকণ্ঠীরা তো এটুকুতেই থেমে থাকেন না। আলো আসতে শুরু করলে, বদ্রিনাথ, ইন্দিরা দরিদ্র কলেজ স্টুডেন্টদের পড়ানোর কথা ভাবলেন। ভাবলেন, চাহিদা থাকা স্পোকেন ইংলিশ কোর্স শুরু করার কথা। ইংরাজির স্নাতকোত্তর বেঙ্গালুরুর জ্যোতি রমেশ কমবয়সী এবং বয়স্ক দরিদ্র মানুষদের স্পোকেন ইংলিশ পড়াচ্ছেন। গ্রামার, ইংরিজি বলার ধরন সবেতেই সেইসমস্ত মানুষদের চোস্ত করে তুলছেন ঝকঝকে তরুণী জ্যোতি। তাঁর চোখে যুদ্ধজয়ের আনন্দ। স্বপ্ন।

এখন বিট্ঠল দম্পতির অনলাইন ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা মোট ১৭০। দম্পতি প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রেখেছেন। যতদিন শরীর দেবে, তাঁরা এগোবেন। আলো দেখাবেন বাকি ভারতবর্ষকে।


(পাঠকের প্রয়োজনে দম্পতির ফোন নম্বর দেওয়া হল। প্রয়োজন আছে এমন কোনও পরিবার দেখলে, যোগাযোগ করতে পারেন। বদ্রিনাথ বিট্ঠল – ৯৯০১৮৪১৫০৮, ইন্দিরা বিট্ঠল – ৯৯০০৪০৮৭৬০।)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...