নারীঅধিকার ভাবনায় কতটুকু এগিয়েছি আমরা?

নারীঅধিকার ভাবনায় কতটুকু এগিয়েছি আমরা? -- প্রহেলী ধর চৌধুরী

প্রহেলী ধর চৌধুরী

 

বেশ কিছু বছর আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। এক এনআরআই ছেলে দেশে এসেছে বিয়ে করতে। পাত্রী দেখে ছেলে মোহিত। প্রণয় নিবেদন করে সে বলেছে, “আমায় বিয়ে করো, আমি তোমায় পূর্ণ স্বাধীনতা দেব।” মেয়েটি প্রত্যুত্তরে বলেছে, “তুমি আমায় স্বাধীনতা দেওয়ার কে? স্বাধীনতা তো মানুষের জন্মগত অধিকার।”

আসলে স্বাধীনতা যে মেয়েদের অধিকারের মধ্যে পড়ে, একথা আজও আলাদা করে ভাবতে হয়, ভাবাতে হয়। অথচ বাস্তব তো এটাই যে স্বাধীন দেশের সব নাগরিকই জন্মসূত্রেই স্বাধীন। কিন্তু মেয়েদের স্বাধীনতার কথা পৃথকভাবে আলোচনা করতে হয়। আলাদা করে চাইতে হয়, দাবি জানাতে হয়। কিন্তু নাগরিক স্বাধীনতা আর নারীস্বাধীনতা যখনই আলাদা হয়, একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে আজও আমরা মেয়েদের প্রকৃত অর্থে দেশের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে গণ্য করে উঠতে পারিনি।

তাতে অবশ্য সাংঘাতিক অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ অতি প্রাথমিক যে নাগরিক অধিকার— ভোটদান; তাতেই বিশ্বজুড়ে মেয়েরা প্রথম আইনি অধিকার পেতে শুরু করে আজ থেকে মাত্র শ খানেক বছর আগে। যেমন, ১৯১৩ সালের নরওয়ের, ১৯১৭ সালে কানাডার, ১৯১৮ সালে ব্রিটেন ও জার্মানির, ১৯১৯ সালে অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডসের এবং ১৯২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহিলারা ভোটাধিকার পান। বিশ্ব জুড়ে রাষ্ট্রবর্গই যেখানে মহিলাদের নাগরিক মনে করেছে মাত্র শ খানেক বছর আগে, সেখানে ঘরে ঘরে মানুষের যে তা মনে হতে আরও বেশ কয়েক শত বছর লাগবে তা আর নতুন কী।

আজকের দিনে ঘরে ঘরে কেমন আছেন মেয়েরা? বলতে গেলে আবারও একেবারে প্রাথমিক ধাপ থেকে শুরু করতে হবে। আব্রাহাম মাসলো তাঁর আবশ্যকতা তত্ত্বে বলেছিলেন শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের আবশ্যিকতা মানুষের সর্বাঙ্গীণ আবশ্যিকতার প্রথম ধাপ। অথচ, বিশ্বজুড়েই মেয়েরা ঘরে ঘরে শারীরিকভাবে নির্যাতিত। ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরোর ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ৪.৪ মিনিটে একজন ভারতীয় মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হন। রবার্ট ম্যাকগি ২০১০-১৪ সালের মধ্যে বিশ্বের ৬০টি দেশের মধ্যে গার্হস্থ্য হিংসা বিষয়ে সমীক্ষা করে দেখান ভারতবর্ষ তাতে ৫৯তম স্থানে।

কোভিড পরবর্তী সময়ে লকডাউন ও “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” বা ঘর থেকে কাজ করার পরিমাণ বৃদ্ধি, পারিবারিক নৈকট্যের সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। সমস্যা হল এই নৈকট্য ঘরে ঘরে মেয়েদের ওপর নির্যাতনের পরিমাণও বাড়িয়ে তুলেছে। লকডাউনের প্রথম দু-মাসেই এদেশে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এবং শুধু এ-দেশেই নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন দেখিয়েছে, লকডাউনকালে ইউরোপেও টেলিফোন মারফৎ গার্হস্থ্য হিংসাজনিত ঘটনার নথিবদ্ধকরণের হার স্বাভাবিকের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এটা কিন্তু কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। কারণ তথ্য বলছে যে-কোনও মহামারি বা আর্থিক দুরবস্থার সময়ই মহিলাদের ওপর গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রকোপ যে সর্বপ্রথম সমাজ ও সংসারের মহিলাদের ওপরই আঘাত হানে এ-কথা গবেষণায় প্রমাণিত। সেই জন্যই, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশ, রাজ্য বা জনজাতির মধ্যেই গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা বেশি পরিলক্ষিত হয়; কিন্তু পাশাপাশি এও লক্ষ্যণীয় যে, পারিবারিক নৈকট্য ও একাত্মতার সময়সীমা বাড়লে, সুখের, এমনকি উৎসবের সময়েও মেয়েদের ওপর হিংসাত্মক ঘটনার বাড়বাড়ন্ত দেখা যায়। যেমন এদেশে দীপাবলি বা ইউরোপে থ্যাঙ্কস গিভিং, খ্রিস্টমাস, এমনকি পারিবারিক ছুটি কাটানোর দিনগুলিতেও গার্হস্থ্য হিংসা বৃদ্ধির খবর পাওয়া যায়।

অবাক কথা এই যে ‘গার্হস্থ্য হিংসা’র বিষয়টি গত দেড় দশক ধরে প্রায়শই খবরের কাগজে বা বিভিন্ন গণমাধ্যমের শীর্ষস্থান পাচ্ছে, নিন্দিত-চর্চিত-আলোচিত হচ্ছে। অথচ সেই শব্দবিন্যাসের উৎপত্তি কিন্তু আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগে মাত্র। ‘গার্হস্থ্য হিংসা’ বলতে এখন আমরা যা বুঝি, সেই অর্থে এই শব্দদ্বয়ের প্রথম ব্যবহার হয় ১৯৭৩ সালে। ব্রিটিশ সাংসদ জ্যাক অ্যাশলে পার্লামেন্টে প্রথম ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ শব্দদ্বয়ের ব্যাবহার করেন এক গৃহ সদস্যের ওপর অন্য গৃহ সদস্যের হিংসাত্মক কার্যকলাপ বোঝাতে। এর আগে অবধি, ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ বলতে গৃহবিপ্লব বা বৈদেশিক শক্তির বিরুদ্ধে দেশের আভ্যন্তরীণ উত্তেজনা এবং শক্তি সংগঠনকেই বোঝানো হত!

অর্থাৎ সত্তরের দশকের আগে অবধি ‘গার্হস্থ্য হিংসা’ বিষয়টির সেই অর্থে মান্যতাই ছিল না। ষাটের দশক থেকে দেশে ও বিদেশে একের পর এক নারী আন্দোলন নারী অধিকারের নানা বিষয়গুলি ধারাবাহিকভাবে সামনে আনতে থাকে। তা নাহলে, যুগে যুগে মহিলাদের পুরুষের সম্পদ হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা শুধু ভিন্নমাত্রায় পরিবেশিত হয়েছে। যেমন ৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যারিস্টটল কিংবা ৫৫১-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কনফুসিয়াস যেভাবে প্রতিটি স্বাধীন পুরুষের জন্যে গৃহ, গৃহিণী ও গরুকে অপরিহার্য মনে করেছেন এবং দাসেদের মত নারীকে পরিবারের কর্তা হিসেবে পুরুষের কর্তৃত্ব মেনে নিতে পরামর্শ দিয়েছেন, পরবর্তীকালে ফরাসি বিপ্লবের পথিকৃৎ রুশো তা বলেননি। তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন কিন্তু তাঁর “এমিল” গ্রন্থে (১৭৬২) পুরুষের প্রতি নারীর অবিরাম আনুগত্যের বিষয়টিকে তিনি প্রবলভাবে সমর্থন করেন। শুধু তাই নয়, শুনলে অবাক লাগবে যে ১৮০০ শতকের আগে অবধি বেশিরভাগ দেশের আইনি ব্যবস্থাতেই ‘গার্হস্থ্য হিংসা’কে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে সংশোধনের নিমিত্তরূপে দেখা হত এবং সমর্থন করা হত এবং বিংশ শতকের আগে অবধি বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই এর প্রতিরোধে কোনও আইনি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।

এমনকি আজ থেকে মাত্র বছর দশেক আগে, ২০১০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির ফেডারেল সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে প্রহারের পুরনো পেনাল কোডটিকে আইনগতভাবে খারিজ করতে পারেনি। আজকের দিনেও রাশিয়া, মায়ানমার, ইরাক, ইরান, প্যালেস্তাইন, মালি, তিউনিশিয়া, মরক্কো, কুয়েত, লিবিয়া, সিরিয়া সহ বহুদেশেই এখনও গার্হস্থ্য হিংসার বিরুদ্ধে কোনও আইনানুগ ব্যবস্থা নেই। ভারতবর্ষেও গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধে আইন তৈরি হয়েছে আজ থেকে মাত্র বছর পনেরো আগে, ২০০৫ সালে।

অর্থাৎ যে সভ্যতা নিয়ে আমরা গর্ব করি তার অর্ধেকেরই জীবন এখনও মধ্যযুগীয় গ্লানি থেকে মুক্তির আলো খুঁজে পায়নি। আমরাও মধ্যযুগীয় কিছু নিয়মকে নিজেদের ঐতিহ্য ভেবে নিয়ে খুব সহজেই দিনের পর দিন বঞ্চনায় ব্রাত্য করে রেখেছি আমাদেরই ভালোবাসার প্রিয়জনদের। আর কত শতক লাগবে পুরুষের পৃথিবীর মানুষের পৃথিবীতে রূপান্তরের?

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...