উস্তাদ রাশিদ খাঁ: এক স্বর্গীয় স্বরমণ্ডল

শোভন ভট্টাচার্য

 


কলকাতার শীত যাঁদের কাছে সাঙ্গীতিক উষ্ণতা পেয়ে আসছিল বহুকাল, রাশিদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কলকাতায় শীতকালীন অধিবেশনগুলির মঞ্চে আর তিনি কোনওদিন উঠে দাঁড়াবেন না, দর্শকদের প্রণাম জানিয়ে বসবেন না তাঁর আশ্চর্য স্বরমণ্ডলটি হাতে নিয়ে, ভাবতেই ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে উঠছে তাঁরই গাওয়া কোনও বেদনাময় বন্দিশের মতো

 

‘গানের ভুবন’ থেকে ইট-কাঠ-পাথরের এই কর্কশ জঙ্গলে উড়ে এসেছিল এক ‘পাখি’। ছিল তাঁর বুক ভরা অপার্থিব সুর। কণ্ঠে তাঁর বেজে উঠত আল্লাতালার হাতে তৈরি এক স্বর্গীয় স্বরমণ্ডল। সেই ছিপছিপে রোগা শরীর থেকে যে এমন মেঘগর্জনের স্বর, ক্রমশ এমন সূক্ষ্ম সুরে কেঁদে উঠতে পারে, তা, না দেখলে, না শুনলে, বিশ্বাস করা কঠিন।

পালকের মতো ভাসমান সেই ‘পাখি’, সেই সাক্ষাৎ ‘গন্ধর্ব’, চার-দশকের বেশি সময় এই শহরে থেকে, পৃথিবীবিখ্যাত শিল্পী হয়ে, খুব কমবয়সে, আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিলেন ‘বিরাট’। বিরাট উস্তাদ, বিরাট বাড়িগাড়ি, বিরাট বিষয়সম্পত্তি, বিরাট নামযশ, বিরাট মেদবহুল শরীর, বিরাট সেলিব্রিটিসুলভ স্ট্যাটাস, বিরাট ক্ষমতা নিয়ে তিনি অকালেই ইহলোকের আরও ‘বিরাট’ সব সম্ভাবনার মায়া কাটিয়ে সুরলোকে পাড়ি দিলেন।

তাঁর মরদেহ, জন্মের মাটির আদরে চিরকাল শায়িত থাকার বাসনায় কর্মের মাটি পিছনে ফেলে বিমানবাহিত হয়ে উড়ে চলল সেই ‘গানের ভুবন’ অভিমুখে, যেখান থেকে তিনি ১০/১১ বছর বয়েসে এখানে এসেছিলেন। তাঁর জন্মভূমি, সেই বদায়ুঁ। যার দশদিক বেষ্টন করে রয়েছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনেকগুলি প্রধান ঘরানার আদি পীঠস্থান। যার ঠিক পাশেই রামপুর, সহসওয়ান, বারেলি, মোরাদাবাদ, শাহজাহানপুর, ফারুকাবাদ, আলিগড় ইত্যাদি। আর খুব কাছেই কাসগঞ্জ, বুলন্দশহর, আগ্রা, ইটাওয়া, দিল্লি, গাজিয়াবাদ ইত্যাদি। সেই জন্মভূমিকে যদি ‘গানের ভুবন’ আখ্যা দেওয়া হয়, খুব ভুল হবে কি? সেই জন্মভূমি, সেই বাপ-দাদা চোদ্দোপুরুষের অশ্রু-ঘাম-শোণিতসিক্ত মাটিতেই এবার চিরতরে শায়িত থাকবে তাঁর মরদেহ।

যাঁরা গানবাজনার খবর রাখেন তাঁরা জানেন ভারতীয় সঙ্গীতের মানচিত্র আর ভারতীয় রাজনীতির মানচিত্র এক নয়। কেউ কেউ দেখলাম তাঁর এই ‘ইউপি’-তে সমাধিস্থ হওয়া নিয়ে বেশ উষ্মা প্রকাশ করছেন। তাঁদের বক্তব্য, তিনি বাংলায় থাকতেন, তাঁর পরিবার বাংলায় বহাল তবিয়তে রয়েছে, তারপরেও কেন তাঁর মরদেহ উত্তর ভারতের জন্মভূমিতে দাফন করা হবে, এই তাঁদের মূল অভিযোগ। এমনকী ‘বাংলা পক্ষ’-এর প্রতিষ্ঠাতা গর্গ চট্টোপাধ্যায় একে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন ‘পুরো হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল’। কিন্তু ভেবে দেখতে হবে যে, যে মাটিতে তাঁর দাফন হয়েছে তা কোনও রাজনীতির মাটি নয়। তা এমন এক মাটি যা তাঁর ঘরানার উৎপত্তিস্থল। সেখানকার সঙ্গীতসাধনার ধারা বেয়েই তিনি পৌঁছেছিলেন কলকাতা সহ সমগ্র বিশ্বে। তাই সেই মাটিকে বর্তমান রাজনৈতিক ভারতের মানচিত্র অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা, তা নিয়ে অকারণ হৈচৈ করা, নিতান্তই শিশুসুলভ।

যাই হোক, যাঁর কথা হচ্ছে, তিনি, উস্তাদ রাশিদ খান, ঘটনাক্রমে থাকতেন আমার নাকতলার বাড়ির খুব কাছাকাছি। বিরাট সাদারঙের বাড়িটি ততোধিক বিরাট প্রাচীর দিয়ে এমনভাবে ঘেরা, যে তা আসলে একটা বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড। বহুবার সেই প্রাচীরের পাশ দিয়ে যাতায়াতের পথে কান পাতার চেষ্টা করে দেখেছি, কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি। তাঁকে শোনার জন্য চিরকাল টিকিট কেটেই পৌঁছাতে হয়েছে কোনও না কোনও অডিটোরিয়ামে। আর তার বিনিময়ে যা পেয়েছি তা চিরকালই টিকিটমূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি। অন্তত পঁচিশ বছর যাবত অজস্র মঞ্চে তাঁকে শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। একবার মনে আছে যোগ-যুক্ত হওয়ার ব্যাপক ঝোঁক এসেছিল তাঁর। কোনও মঞ্চে রাগ যোগ গাইছেন, কোথাও যোগকোষ। কিংবা যে বছর কোনও মঞ্চে যোগ গাইলেন, তার পরের বছরই সেই মঞ্চে গাইলেন যোগকোষ। সেই সময় তাঁর বেশিরভাগ অনুষ্ঠানের সময় ছিল গভীর রাত। যেন এই রাগদুটির ভেতর দিয়ে তিনি কোথাও পৌঁছাতে চাইছেন। খুব অবাক হয়ে ভাবতাম— এমন তো হতে পারে না যে ওই একটা রাগ তৈরি আছে বলে ওটাই গেয়ে যাচ্ছেন। এটা উস্তাদ রাশিদ খানের ক্ষেত্রে অন্তত ভাবা যায় না। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তাঁকে বলতে শুনেছি— গান গাইতে গাইতে একটা ‘সোচ’-এর জন্ম হওয়ার কথা। হয়তো সেই ‘সোচ’ থেকে একপ্রকার খোঁজ-এরও জন্ম হয়েছিল তাঁর চেতনায়। প্রথম স্বরক্ষেপণ থেকেই তাঁর সেই অবগাহনের আস্বাদ পাওয়া যেত। তাঁর খেয়ালে যে আমেজ, যে রাজকীয়তা, আর কারও কণ্ঠেই তা শোনা যাবে না কোনওদিন। ছোট ছোট তান-সরগম করে গতের মুখে ফিরে ফিরে আসার যে রোমাঞ্চ তিনি সমগ্র রাত্রির শরীর জুড়ে জাগিয়ে তুলতেন, তা কোনও সাধারণ সঙ্গীতশিল্পীর কর্ম নয়। শুধু রাত্রির কথাই বা বলি কেন! তাঁর রাজকীয় কণ্ঠনিঃসৃত রাগ ললিতে পাপড়ি মেলেছিল যত ভোর, তাঁর আকুল আহির ভৈরবে যেসব প্রভাত ‘আলবেলা’ হয়ে উঠেছিল, তাঁর স্মৃতি, রসিকজনের শ্রুতি থেকে কোনওদিনই মুছে যাওয়া সম্ভব নয়।

আমার খুব প্রিয় একটা ঠুমরি আছে দেশ রাগে বাঁধা— ‘মোরা সাঁইয়া বুলায়ে আঁধিরাত কো…’। হীরাদেবী মিশ্র-র হিরণ্ময়ী কণ্ঠে সেই ঠুমরি এক অতুলনীয় উচ্চতায় বিরাজ করছে বহুকাল। এছাড়া আর কাউকে সেই ঠুমরি আমি সাহস করে গাইতে শুনিনি কোথাও। কিন্তু উস্তাদ রাশিদ খাঁ সেই একই বন্দিশ এমন অপূর্ব নিজস্বতায় পেশ করেছেন, যা কখনওই হীরাদেবীর অনন্যতাকে খর্ব না করেও নিজের পৃথক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। তাঁর গুরু অর্থাৎ দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ সাহেবের তারানা ছিল জগদ্বিখ্যাত। সেই তারানাগুলি রাশিদের মন্দ্র স্বরের ছোঁয়ায় এক জাদুবাস্তবতার জন্ম দিত যে কোনও মঞ্চে।

তিনি সেই শিল্পী, যাঁকে স্বয়ং ভীমসেন জোশি ‘ভারতীয় সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ’ বলে যথার্থই চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু বর্ষীয়ান ভীমসেন যে দূরদৃষ্টি নিয়ে শান্তভাবে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চেয়েছিলেন, রাশিদ সম্ভবত তাঁর তোয়াক্কা করেননি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে অবলম্বন করেই যে তিনি শেষপর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, একথা অস্বীকার করা যদিও অসম্ভব, তবু একথাও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না যে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর ধ্যান মাঝেমাঝেই ভেঙে ভেঙে যেত। তা না হলে গলা-ভেঙে-যাওয়া নচিকেতার রবীন্দ্রগানের সঙ্গে তাঁর রাগবিস্তার শোনার দুর্ভাগ্য হত না তাঁর দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ শ্রোতাদের। মাঝেমাঝেই তিনি মঞ্চে ‘আওগে যাব তুম সাজনা’ গানটিকে সেমিক্লাসিক্যাল হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। শেষমেশ, আমার পাড়ার পুজোর থিম সং-এও যখন তাঁর কণ্ঠ বেজে উঠতে শুনলাম, আর বেশি আশা রাখিনি তাঁর কাছে।

কয়েকবছর আগে যখন শোনা গিয়েছিল যে তাঁর ক্যানসার ধরা পড়েছে, ডোভারলেনে তাঁকে শুনতে গিয়েছিলাম পরপর দুবার। যেখানে সাদাচোখেও তাঁর মধ্যে এক অসহায় পিতাকে খুঁজে পেয়েছিলাম, যিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার আগে সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করে যেতে মরিয়া। ছেলে আরমানকে মঞ্চের অনেকটা সময় ছেড়ে দিয়ে তিনি ছেলের জন্য শ্রোতাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছিলেন। আজ সেই কথাগুলো বড় বেদনার মতো বাজছে আমার বুকে। কলকাতার শীত যাঁদের কাছে সাঙ্গীতিক উষ্ণতা পেয়ে আসছিল বহুকাল, রাশিদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কলকাতায় শীতকালীন অধিবেশনগুলির মঞ্চে আর তিনি কোনওদিন উঠে দাঁড়াবেন না, দর্শকদের প্রণাম জানিয়ে বসবেন না তাঁর আশ্চর্য স্বরমণ্ডলটি হাতে নিয়ে, ভাবতেই ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে উঠছে তাঁরই গাওয়া কোনও বেদনাময় বন্দিশের মতো। কিন্তু শিল্পীর মৃত্যুই তাঁকে নবজন্ম দান করে, একথা নিশ্চিত। এবার থেকে তাই উস্তাদ রাশিদ খাঁ চিরন্তন নক্ষত্রমণ্ডলে স্বর্গীয় এক স্বরমণ্ডল হয়ে বেজে চলবেন আবহমানকাল।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...