অদৃশ্য ছায়া

আশরাফ জুয়েল

 

সদ্যপ্রসূত আরেকটি শুক্রবার অতিক্রমের প্রাক্কালে ঠিক এর বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার চেহারা জড়িয়ে রেখেছে বিছানা লেপটে থাকা আলস্য। বর্তমান থেকে ঘুমের কুঁড়েমিকে মুছে ফেলতে ব্যস্ত আমি। আমার খুলির ভেতরে বাস করা প্রায় সাড়ে বারোশো গ্রামের ঘিলু আলোড়িত হবার প্রবণতার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, অরক্ষিত ভাবনা-জগতে প্রবেশ করার জন্য সমস্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তারা।

‘গুড মর্নিং স্যার।’

‘গুড মর্নিং, হাউ আর ইউ?’ কৃত্রিম হাসির মুখোশটা চেহারায় ঠিকমতো সেঁটেছে কিনা তা যাচাই করতে করতে বললাম আমি।

‘স্যার, খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে।’ পুতুলের চেয়েও নিখুঁত সেজেছে মায়মুনা।

‘তাই নাকি মাইমুনা, থাঙ্ক ইউ।’ মায়মুনাও ইতোমধ্যে মুখোশ পরা শিখে নিয়েছে।

আঁধারভাঙা ভোরের মুখে লেগে আছে সৈকতধোয়া সূর্যরশ্মি। কাঁচের স্বচ্ছ বাধা উপেক্ষা করে অবজ্ঞা ভরে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সন্তর্পণে প্রবেশ করছে লবিতে। সেই আগুনভাষী সূর্যরশ্মি চোখের রেটিনাতে টোকা মারা মাত্র আমার দৃষ্টির সক্ষমতা সতর্ক কুকুরের মতো আনাচকানাচে ঘুরে বেড়াতে থাকল।

‘নাজিব কোথায়? ইটস এইট থারটি…’

‘স্যার ওকে ফোন করেছিলাম।’ মানুষের পক্ষে একনাগাড়ে কতক্ষণ হাসি ধরে রাখা সম্ভব? এ বিষয়ে কোনও স্টাডি আছে কিনা তার একটা খোঁজ নেয়া দরকার।

‘রিচ করতে পারেননি?’

‘না, স্যার। কিছু হলে ও-তো সাধারণত জানিয়ে দেয়। আজ ফোন রিসিভ করছে না।’ মানুষের পক্ষে যা অসম্ভব, মুখোশের পক্ষে তা সম্ভব। মায়মুনা গত সাত মিনিট তার মুখের মুখোশটাকে হাসাচ্ছে।

নাজিবের না আসার ব্যাপারটাকে স্মৃতিকোঠরের এক দিকে রেখে বাকি ভাবনাগুলোকেও তাগাদা দিতে থাকলাম। বিচক্ষণ শুকুরের মতো শুঁকে শুঁকে মার্বেল পাথরের তিন পায়া টেবিলটার উপর কোনও মিহি ধুলোর নিশানা দেখা যাচ্ছে কিনা তা খুঁজছে আমার চোখ। আর্টিফিশিয়াল ফুলগাছগুলোর নকল চেহারা ঢাকতে টবে দেয়া ছোট ছোট কুচি পাথরের রঙ ঠিকঠাক মতো জৌলুষ ছড়াতে সক্ষম কিনা, এ ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হচ্ছে আমাকেই। এও দেখে নিতে হচ্ছে, ক্লায়েন্ট কেয়ার এটেনডেন্টদের নির্ধারিত ড্রেসে কোনও অবাঞ্ছিত ভাঁজ বা ময়লার নিশানা দেখা যাচ্ছে কিনা? অতিথির জন্য সাজিয়ে রাখা ওয়েলকাম ড্রিংকসের বোতলের শরীর কোনও পরিচিত আঙুলের স্পর্শে পাপযুক্ত হয়েছে কিনা, সেখানেও মগজের ছড়ি ঘোরাতে হচ্ছে আমাকেই।

‘স্যার, এই দেখুন!’ মায়মুনার মুখে অমাবস্যা।

‘বলুন?’ মায়মুনার কণ্ঠ পড়ার চেষ্টা করলাম।

‘স্যার, খবর পেয়েই রওনা হয়েছে নাজিব। আমার মোবাইলে এই টেক্সট…’ মায়মুনা কাঁদছেন, কান্না আর মুখোশ মিলে একটা বিশ্রীভাব এসেছে তার মুখে।

সমবেদনা জানানোর জিনিস? ভুলে গেছি, ভুলে যাওয়া বিদ্যাটা মনে করার চেষ্টা করছিলাম। আমার কম্পমান দৃষ্টি হঠাৎ আটকে যায় হেলে পড়া একটা ছায়ার প্রতিকৃতিতে। আমার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি সেই ছায়াটাকে পড়বার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ছায়াটা একজন আতঙ্কগ্রস্ত নারীর। ছায়া দেখে কেউ একজন আতঙ্কিত — এটা বুঝতে পারা যায় কিনা তা নিয়ে বিস্তর তর্ক হতেই পারে। তবে এটা সুনির্ধারিতভাবেই বলে দেয়া যায়, সবার দেখবার সক্ষমতা এক মাত্রার নয়। আতঙ্কগ্রস্ত ছায়া শরীরটা হোটেলের একশো সাত নম্বর রুমে প্রবেশ করছে। ছায়াটি ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেও তার শরীরের শুক্রবারময় গন্ধ আশ্রয় নিয়েছে করিডোরের বাড়ন্ত চোয়ালে। আপাতদৃষ্টিতে ছায়াটাকে দুঃখদায়ক বলেই মনে হতে থাকে আমার। অপ্রাপ্তবয়স্ক রোদ ছায়াটাকে পূর্ণতা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে বলেই পুরোপুরি পড়তে পারছি না ছায়াটাকে। আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিজনিত সন্দেহ আমার দৃষ্টির সীমারেখা জুড়ে — হতে পারে চশমার বাইফোকাল লেন্স আর দৃষ্টির সামঞ্জস্যহীনতা। সম্ভবত নারীটির সাথে একজন পুরুষও প্রবেশ করেছে একশো সাত নম্বর রুমে। আমার ধারণার ঘ্রাণে উড়তে থাকা একজন আবছা পুরুষ একে সত্যতা দেবার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রুমের দরজাটা সদ্য মৃত বোয়ালের হা হয়ে থাকা মুখের মতো খোলা। অনায়াসে ইচ্ছা-তীর এর ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করতে পারে ঘরে। ছায়াটার অনুসারী হয়ে আমার দৃষ্টির সক্ষমতা একশো সাত নম্বর রুমে প্রবেশ করে পোষা খরগোশের মতো। পরক্ষণেই নিজেকে চতুর আইনজীবীর মতো জেরা করা আরম্ভ করলাম এই ভেবে যে, আমার লক্ষ্য শুধুমাত্র একশো সাত নম্বর রুম হওয়া উচিত নয়। এই বিভ্রান্তিকে মেনে নিয়েই অ্যালঝেইমার্স আক্রান্ত মনোযোগকে অঙ্ক ফেল করা ছাত্রের মতো প্রশ্নবিদ্ধ করে তুললাম। এখানেই আমার আইনজীবী মন এবং অঙ্ক ফেল করা নিউরনের ভেতর এক দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল হয়ে পরিস্থিতি আঁচ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল। বুঝতে পারছি না — আমি এখনকার কথা ভাবছি নাকি গতকাল সন্ধ্যার কথা?

স্মৃতি থেকে নাজিব এবং তার মায়ের মৃত্যু সংবাদটা ঘোলাটে হয়ে যেতেই মায়মুনা হাজির হলেন আমার চিন্তাপটে। আমার মস্তিষ্কের কোষগুলো কোনও ভাবনাতেই আমাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না, লাল কাপড়ের খোঁজে সদা দৌড়ানো রাগী ষাঁড়ের মতো ভাবনাগুলোকে গুঁতো দিতে থাকে সবসময়।

‘স্যার, নাজিবের গ্রামের বাড়ি যেতে হবে আমাকে, আই নিড টু ডেস লিভ।’ সম্ভবত নাজিবের সাথে মায়মুনার একটা সম্পর্ক আছে। ‘সম্পর্ক’। নাজিব। মা মারা যাবার আগের চেহারা আর মা মারা যাবার পরের চেহারা আমার মনে নাজিব সম্পর্কে দুই রকমের ধারণা তৈরি করে। আপাতত নাজিবের মায়ের মৃত্যুসংবাদজনিত ভাবনাটাকে স্থগিত রাখলাম — আমার স্পষ্ট মনে আছে, একশো সাত নম্বর রুমে চেক ইন করেছিল দুইজন মানুষ। কম্পিউটার স্ক্রিনের লেজার শিটে ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করলাম চেকআউটের কোনও লক্ষণ আছে কিনা। গত সন্ধ্যায় আমার ভালো ঘুম হয়েছিল এবং এর পূর্ব পর্যন্ত আমিই ছিলাম কর্তব্যরত ম্যানেজার। মাঝে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ফারাক। যদিও এই কয়েক ঘণ্টায় আস্ত পৃথিবীটা হারিয়ে যেতে পারে মহাবিশ্বের রহস্যময় গহ্বরে। মায়মুনার ছুটি মঞ্জুরের কাগজে সাক্ষর করা ব্যতীত কিছু করার থাকল না আমার। রুম নাম্বার একশো সাত অন্যান্য সমস্ত ভাবনা থেকে আমাকে প্রায় বিছিন্ন করে ফেলেছে। নিজেকে একশো সাত নম্বর রুম থেকে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। আমার সমস্ত প্রচেষ্টা ফুজি ফিল্মের সাঁইত্রিশতম স্ন্যাপের দূরতম সম্ভাবনার দিকে হেঁটে গেল।

দুই।

লঘু ভাবনার চাপে নুয়ে পড়ছে আমার আত্মবিশ্বাসের দুর্বল দেহ। এভাবে আর নয়, সতর্ক হতেই হবে এবার। এতদিনের লব্ধ অভিজ্ঞতাকে আমি কিছুতেই একজন অপরিণত আঁকিয়ে কিম্বা সদ্য পাশ করা চিকিৎসকের ছুরির নিচে সমর্পণ করতে রাজি না। এতে দুঃখিত হবার সমূহ ঝুঁকি আছে। এ ঝুঁকির দিকে আমার চিন্তাকে কিছুতেই ঠেলে দিতে পারি না। পরবর্তী অধ্যায় আরম্ভ হবার পূর্ব পর্যন্ত আমার চিন্তার সমস্ত চেষ্টা রিসেপশনের টাইলস মোড়ানো টেবিলের উপর পড়ে থাকল উপুড় হয়ে।

‘এক্সকিউজ মি, হ্যালো? আর ইউ লিসেনিং?’

‘ইয়েস! ইয়েস স্যার প্লিজ, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ।’ কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনে সেঁটে থাকা অর্ধেক মনোযোগ একটা লিফটারের সাহায্যে শব্দের উৎসের দিকে তুলে ধরলাম।

‘ইজ দেয়ার এনি ভ্যাকান্ট রুম?’

‘স্যার, ইয়েস স্যার প্লিজ, হোয়াট টাইপ অফ রুম ইউ নিড?’

নিজের দায়িত্বের দিকে সরে আসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? আমার মগজ-ঘরে নচ্ছার মশার ডানার মতো কিছু বিরক্তিকর অনুভূতি উড়ে বেড়াচ্ছে। এতক্ষণ কী দেখলাম? একটা চার তারা হোটেলের ট্রেনিংপ্রাপ্ত রিসেপশনিস্ট কাম অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের ভাবনায় এতটা এলোমেলোভাব আসাটা সমীচীন নয়।

‘আমি মিন, কোনও রুম ফাঁকা আছে?’

‘ইয়েস স্যার, ইয়েস ওয়ান ও সেভেন…’ মনের অজান্তেই বলে ফেললাম একশো সাত। কিন্তু একশো সাত নম্বর রুম কি আদৌ ফাঁকা আছে? একটা ছায়াকে তাহলে কীভাবে একশও সাত নাম্বার রুমে ঢুকতে দেখলাম আমি? সবই কি মনের ভুল? না, তা হতেই পারে না। আমি কি কোনও ভ্রান্তিতে জড়িয়ে পড়ছি? মৃদু মিউজিকের সুরে দুলছে পুরো লবি।

‘ডাবল রুম?’ ঘাড়ে ঝুলে থাকা ব্যাকপ্যাকের ওজন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে করতে বললেন ক্লায়েন্ট।

‘হ্যাঁ স্যার, প্লিজ’ কিন্তু ডাবল রুম কেন খুঁজছেন তিনি। আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

নিজের মধ্যে ফিরে আসতে এতটা সময় লাগল দেখে কিছুটা বিচলিত হলাম। অফ সিজনের হোটেল লবিতে এই মুহূর্তে একজন পুরুষ ক্লায়েন্ট এবং আমি। একটু দূরে সাজিয়ে রাখা টবগুলোর মতোই দাঁড়িয়ে আছে দুইজন ক্লায়েন্ট কেয়ার অ্যাটেনডেন্ট। আবারও একশো সাত নম্বর রুমের ভ্যাকান্ট থাকাটা কনফার্ম করলাম। নিজের দিকে এক দলা ধিক্কার ছুঁড়ে মারলাম আমি। আমারই ভুল। সবই অলীক? এতক্ষণ যা ভেবেছি তা সব কিছুই ছিল আমার চিন্তার ভ্রান্তি? আমি কি এমন ভ্রান্তিতে জড়িয়ে পড়তে পারি? এইসব ভেবে এক ধরনের অপরাধবোধ আমাকে গ্রাস করেত থাকল। এই মুহূর্তে আমার সমস্ত মনোযোগ জুড়ে থাকা উচিৎ ছিল আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লায়েন্ট। নিজেকে একজন দাগী ক্রিমিনালের মতো কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখলাম আমি। শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছি আমি। পুনরায় নাজিবের মায়ের মৃত্যুসংবাদটা আমার ভাবনার নদীতে সদ্য জাগা চরের মতো ক্রমশই জেগে উঠতে থাকল।

ক্লায়েন্ট না দেখেই একশো সাত নম্বর রুম পছন্দ করলেন, এ থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায় — তিনি হয়ত এর আগেও এই হোটেলে এসেছেন। একশো সাত নম্বর রুম নিয়ে আমার এতক্ষণের সমস্ত ভাবনাপ্রবাহ অকালপক্ক বর্ষার ঝুম বৃষ্টির মতো ঝরে গেল। নিজেকে ক্ষমা করতে পারব কিনা এ নিয়ে একটা নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আমার দৃষ্টিরেখার সীমানা হোটেলের মেইন গেট পর্যন্ত ছিটিয়ে দিলাম। গেটে দাঁড়িয়ে আছে একটা চকচকে পার্ল কালারের এলিয়েন। সেখান থেকে লাগেজ নিয়ে আনার ইশারা করলেন ক্লায়েন্ট। ক্লায়েন্ট কেয়ার অ্যাটেনন্ডেন্ট পা ভর্তি সমীহ নিয়ে দৌড়ে গেল হোটেলের মেইন গেটে। ভাবসাবে যা মনে হচ্ছে, তাতে এই হোটেল আমাকে যতটা না চেনে তার চেয়ে বেশি চেনে এই ক্লায়েন্টকে। একটা হালকা বেগুনি রঙের লাগেজকে কোনও ধরনের ব্যথা না দিয়ে সেটা নিয়ে লবিতে ফিরে এল ক্লায়েন্ট কেয়ার অ্যাটেনন্ডেন্ট। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, ক্লায়েন্ট কেয়ারের পেছন পেছন হেঁটে আসছেন একজন নারী। তার চেহারা দেখা সম্ভব হচ্ছে না। তার মুখটা স্কার্ফে আবৃত। আবার পেছনের দিকটাও দেখতে পেলাম না, তাই যাচাই করা সম্ভব হল না — কিছুক্ষণ পূর্বে যে নারীর ছায়া আমি দেখেছিলাম, ইনিই তিনি কিনা। নিজের প্রতি আমার আস্থা কমে যেতে থাকল সদ্য আরম্ভ হওয়া ভাটার মতো।

তিন।

সোমবার গভীর রাতে হোটেল থেকে জরুরি ডাক আসে আমার। আমি প্রধান ম্যানেজার নই তবুও কোনও বড় ধরনের সমস্যা হলে হোটেল থেকে আমার ডাক পড়বেই। একটা পাঁচ তারা হোটেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের জন্য নির্ধারিত পোশাক পরে প্রস্তুত করলাম নিজেকে। ডরমিটরিতে গাড়ি এল। মিনিট তিনেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম হোটেলে। অনেক ডাকাডাকির পরও হোটেলের একটা রুমের দরজা খুলছে না কেউ। অথচ সেই রুমের বোর্ডার চেকআউট করেননি। রেজিস্ট্রি খাতায় বোর্ডার যে নাম্বার দিয়েছিল সেই নাম্বারে কল করেও পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন বন্ধ।

‘স্যার, স্যার… ওয়ান ও সেভেন রুম ভেতর থেকে লক। ডোরে ডোন্ট ডিসটার্ব ঝুলিয়ে রাখা আছে বলে রুম সার্ভিসের স্টাফরা কেউ নক করেনি।’

‘কী সমস্যা? নিশ্চয় উনারা রুমে নেই। বোর্ডার না চাইলে তো আপনি ঝামেলা করতে পারেন না। আর আপনি না নাজিবের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য ছুটি নিলেন?’

‘না স্যার যাইনি। স্যার নাজিবের মায়ের জানাজা হয়ে গেছে, সে আজকেই ফিরে আসছে। ফোন করেছিল। স্যার, আমার কিন্তু ভয় লাগছে। যদি অন্য কিছু হয়?’

‘আপনার কী মনে হয় নাজিবের আজকেই ফিরে আসা উচিৎ? যাহোক নাজিবের কথা বাদ দেন। আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন? অন্য কিছু কী হবে? আসুন দেখি।’ এই বলে আমার ভেতরের সমস্ত অবিশ্বাসকে সমুদ্রসৈকতের দিকে ছুঁড়ে মেরে এগিয়ে যেতে থাকলাম রুম নাম্বার ওয়ান ও সেভেনের দিকে।

‘স্যার?’

‘মনে হচ্ছে আপনি সব কিছুই জানেন? ব্যস্ত হবেন না। দেখা যাক।’ রুম নাম্বার ওয়ান ও সেভেনের সামনে দাঁড়ালাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে পুরুষটির বয়স ত্রিশ বা বত্রিশের মতো হবে। ছায়া দেখে যা আন্দাজ তাতে, নারীটির বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ। কয়েকবার মৃদু স্বরে ডাকলাম। নকও করলাম। না, সত্যিই কোনও সাড়া নেই। এবার একটু জোরেই নক করলাম। ভেতরে কেউ আছে কিনা তা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তাহলে কি এটাই সত্যি, যে ভেতরে যারা আছেন তারা কাউকে না জানিয়েই চলে গেছেন? না, এমন হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে এমনটাও হতে পারে, হয়ত বাইরে গিয়ে তারা আর ফেরত আসেননি। এ সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেটা করা যেতে পারে সেটা হল, হোটে্লের প্রত্যেকটা রুমের স্পেয়ার চাবি আছে, সেটা ইউজ করা। কিন্তু এটা কি ঠিক হবে? আমার ভাবনার ঘোড়ার পিঠে চাবুক চালালাম।

‘স্যার, মনে হচ্ছে সবাইকে বিপদে পড়তে হবে।’

‘না, না কী হবে? যা হোক চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। এখন অনেক রাত। আগামীকাল সকালে সবার উপস্থিতিতে রুম খুলে দেখা হবে।’

‘স্যার, লোকাল থানাকে ইনফর্ম করে রাখলে হয় না?’

‘দেখুন আমাদের হোটেলের একটা সুনাম আছে। ভেবে দেখেছেন, পুলিশকে জানানোর ফলে এটা সবাই জানবে, আর জানাজানি হলে আমাদের রেপুটেশনের কী অবস্থা হবে?’

‘কিন্তু স্যার?’

‘না, কোনও কিন্তু নয়। আগামীকাল দেখা যাবে। এখন যার যার কাজে যান। তবে খেয়াল রাখবেন, এই রুমে কেউ ঢোকে বা বের হয় কিনা?’

সবাইকে যার যার কাজে পাঠিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম রুম নাম্বার ওয়ান ও সেভেনের সামনে। এই রুমেই তো সেই অসমাপ্ত ছায়াটি প্রবেশ করেছিল। রাত সাড়ে তিনটার নিষ্ঠুরতা আমাকে অস্থির করে তুলছে। প্রশস্ত করিডোরের এক প্রান্ত থেকে বিপরীত প্রান্ত পর্যন্ত আমার অস্থির চিত্তকে বিছিয়ে দিলাম। ডরমিটরিতে ফিরেই বিছানায় যেতে হবে, এখন আমার বরফঠান্ডা দীর্ঘ ঘুম প্রয়োজন।

চার।

‘আপনি কেন এমন একটা কাজ করলেন?’

বারবার মনে হচ্ছে সেই ছায়ানারীর স্কার্ফ আবৃত মুখটার কথা। মনে হচ্ছে আশপাশ থেকে সেই ছায়ানারীমুখোশ প্রাচীন কোনও ভাস্কর্য দেখার বিস্ময়ে দেখছে আমাকে। সে এখানে আসবে কীভাবে? বরং আমিই নিজেকে খুঁজছি। পাচ্ছি না কোথাও। যেহেতু নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি না তাই কোনও কথা বলার প্রয়োজনবোধও করছি না। কার সাথে কথা বলব?

থানার ভেতরে কুয়াশাক্রান্ত অবিশ্বাসী সন্ধ্যার মতো অন্ধকার একটা ঘরে একাকী একটা টুলে বসিয়ে রাখা হয়েছে আমাকে। এই অন্ধকারটা আমার অচেনা। অচেনা জায়গায় নিজেকে চেনাও খুব মুশকিল। মাকে দাফন করে আসার পরপরই কি নাজিবকেও এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল? জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকেও? মায়মুনাও তার আটপৌরে সাজ নিয়ে এই ঘরে আগুন জ্বালাতে এসেছিল? বা বাকি সবাইকে?

‘কী করেছি? বেশি শব্দ অপচয় করার ইচ্ছা করছে না আমার। প্রতিটা শব্দের হিসাব তো আমাকেই দিতে হবে।’

‘রুম নাম্বার ওয়ান ও সেভেন থেকে আজ এক বোর্ডারের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।’

‘দেখুন এই খুনের সাথে আমাদের কারও জড়িত থাকার সম্ভাবনা নেই। খামোখা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন।’

‘কিন্তু আপনি নিজেই নিজেকে সন্দেহের তারে ঝুলিয়েছেন।’

‘নারী-টি…’ শব্দ বেরুনোর পূর্বেই ঢোক গিলে নিলাম আমি। নিজেকে নিজের সামনে দাঁড় করালাম, রাগী স্কুলশিক্ষকের মতো নিজেকেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকলাম আমি।

‘কিছু বললেন? আর তার সাথের নারী বোর্ডারকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এখন তাকে হাসপাতালে পুলিশী হেফাজতে রাখা হয়েছে। মিস্টার সাজিদ, মুখ খুলানোর জন্য আমাকে কি আরও খারাপ হতে হবে?’

ভাবছি। ভাবতে ভাবতেই অদৃশ্য আয়নাটাকে নিজের দোদুল্যমান ভাবনার সামনে তুলে ধরলাম। নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আরেকবার দেখে নেয়া প্রয়োজন। কী চাই আমি — সেটার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত মুখ খোলা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। তাতে যা হবার তাই হোক। কিন্তু নারীটি? আমার ব্যাক্তিগত আয়নার পুরোটা জুড়েই সেই নারীছায়া। নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না। অবশেষে ‘মুখ না খোলা’-র সিদ্ধান্তের জানালাটা খুলে দিলাম।

‘ওসি সাহেব, গত শুক্রবার হোটেলে এক দম্পতি চেক ইন করেছিলেন। রুম নাম্বার ওয়ান ও সেভেন। ওয়ান ও সেভেন রুম আমাকে বেদনাহত করে তুলেছিল। এমনই এক বিভ্রান্তিকর রবিবার সন্ধ্যায় ডিউটি শেষ করে ডরমিটরিতে ফিরে আসি। নিজের স্মৃতিশক্তিকে অবিশ্বাস করা আরম্ভ করেছিলাম আমি। সেই ছায়া আমার আয়রন করা আত্মবিশ্বাসে বিশ্রী রকমের ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। দোষটা সেই নারীর নয়, ছায়াটারও নয়। ডরমিটরিতে ফিরে আসামাত্রই আমার ব্যক্তিগত নাম্বারে একটা কল আসে। অপরিচিত নাম্বার। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলে আমি অ্যাটেন্ড করি না। সেদিন ফোনটা অ্যাটেন্ড করি আমি।’

‘তারপর?’

পাঁচ।

‘রুম নাম্বার একশ সাত থেকে বলছি, এই রুমে একটু আসতে হবে আপনাকে।’

‘ম্যাডাম! এনি প্রবলেম? ম্যাডাম আমি এখনই রুম সার্ভিসের লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি আমার ব্যক্তিগত নাম্বার কোথা থেকে পেলেন?’ তীব্র হোঁচট খেল আমার বিস্ময়বোধ। কোনওমতে পতন ঠেকালাম তাদের।

‘না, আপনাকেই প্রয়োজন, একটু আসবেন?’

‘কোনও সমস্যা ম্যাডাম? রুম সার্ভিসের…’ আমি আঁতকে উঠি। আমি তো নারীটির ছায়া দেখেছিলাম। সামনাসামনিও দেখেছিলাম — কিন্তু স্কার্ফ দিয়ে মুখ ঢাকা থাকায় সে দেখা না দেখার সমান। কিন্তু কণ্ঠটা? নাকি ছায়া দেখার মতোই পুরাতন ভ্রান্তিজালে জড়িয়ে ফেলছি নিজেকে।

‘একটু আসবেন প্লিজ।’

‘তুমি?’ আমার নিউরন আমার সাথে বিট্রে করছে। আমি কোনওভাবেই একজন সম্মানিত ক্লায়েন্টকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে পারি না।

‘হ্যাঁ আমিই। শুক্রবার উঠেছি। সেদিনই তোমাকে দেখেছি।’

‘কিন্তু!’ আমার বিস্ময় কিছুতেই কাটে না বরং মাকড়শার জালের মতো জড়িয়ে ধরছে আমাকে। ‘তুমি! এখানে এই হোটেল?’ একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

‘জানতাম না তুমি এই হোটেল চাকরি করো, ইনফ্যাক্ট তুমি দেশে এটাই জানা ছিল না আমার।’

‘আমার নাম্বার কোথা থেকে পেলে।’ হ্যাঁ। নিশ্চিত হলাম। আমি যা শুনছি তা ঠিক। আমি এতটা স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যাইনি যে, বারবার সে আমার সাথে প্রতারণা করবে আর আমি তা মেনে নেব।

‘তোমার হোটেলের রিসেপশন থেকে জোগাড় করেছি।’

‘আমার সাথে কী কথা তোমার?’ বাধ্য হয়েই নিজেকে খোলসের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম।

‘জানি, তুমি ঘৃণা করো আমাকে, করাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু শেষবারের মতো তোমার সাথে কথা বলতে চাই। আর কখনওই চাইব না।’

অতীত কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনে আমার ভেতরটা হুহু করে উঠল। কিন্তু আমি তার সাথে দেখা না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম, এমনকি তার সাথে কথা বলার কোনও ইচ্ছাও আমার ছিল না। কিন্তু সব ইচ্ছা ইচ্ছার ইচ্ছাধীন থাকে না।

ছয়।

‘যে মেয়েটি পুলিশি হেফাজতে আছেন, সে আপনার পূর্ব-পরিচিত?’ ওসি হুমায়ূন চেহারায় আঁতকে উঠার ভান ধরে রাখার চেষ্টা করলেন।

‘হ্যাঁ।’ কম বয়সী ওসি নিজের চেহারায় বিস্ময়বিমূঢ় একটা ভাব আনার চেষ্টা করছেন।

‘কী বলছেন আপনি? আর সাথের ছেলেটি?’ আইনের মানুষ হুমায়ূন, কিছুতেই উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছেন না।

‘ঠিক জানি না।’

‘প্রেমঘটিত ব্যাপার? পুরনো প্রেমিকার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেননি, তাই না?’

‘ওসি সাহেব, বিবিএ পড়ার জন্য বাবা আমাকে মালয়েশিয়া পাঠান। বিবিএ পরীক্ষা শেষ, এমবিএ ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমি। এর মধ্যেই খবর গেল, বাবা গুরুতর অসুস্থ। দ্রুত দেশে ফিরলাম। আত্মীয়স্বজনেরা আমাকে বাবার অসুস্থতার খবর জানিয়েছিল। মালয়েশিয়া থেকে ফিরে এসে শুনি মারা গেছেন।’

ওসি সাহেব আমার মুখ পড়বার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পারছেন কিনা সেটাও বুঝতে পারছি না আমি।

‘আপনি তো আপনার পরিবারের ইতিহাস তুলে ধরছেন, এসবের সাথে এই খুনের সম্পর্ক কী?’

‘খুব ভেঙে পড়েছিলাম আমি। সম্পর্কের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মায় আমার।’

‘আপনাকে আগেও বললাম, আপনার পরিবারের গল্প শুনে আমার কোনও লাভ নেই।’

‘আমি মিথ্যা বলছি না।’

‘বলুন, সত্য গোপন করবেন না।’

‘একেবারেই ভেঙে পড়ি আমি। মালয়েশিয়া ফিরে যাই। সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। এমনকি রামিশার সাথেও ব্রেক আপ হয় আমার। এমবিএ করা হয় না। কোনও কিছুই ভালো লাগে না। আবার দেশে ফিরে আসি। এসে এখানে চাকুরি নেই, অন্য নামে। আমার নাম জুলফিকার হায়দার খান।’

‘রামিশা? তাহলে প্রেমিকার নাম রামিশা? গল্প ফাঁদছেন? সাজিদ সাহেব, সত্য স্বীকার করে নেন। আর কে কে আপনাকে এই কাজে সাহায্য করেছে? শোনেন, পুরনো প্রেমিকার ডাক কোনও প্রেমিকই অস্বীকার করতে পারে না। এই নিয়ে অনেক খুনখারাবির কেস আমরা পাই।’

সাত।

আজ সন্ধ্যার পূর্বেই নেমে এসেছে অন্ধকার। ভাতের মাড়ের মতো গাঢ় অন্ধকার। এই অন্ধকার হাতড়ে এগিয়ে যাচ্ছি সৈকতের নির্জনতম স্থানের দিকটায়। এই জায়গাটায় সচারচর কেউ আসে না। আর যে অন্ধকার, তাতে কেউ কাউকে চিনতে পারবার কথা নয়।

‘তুমি এসেছ? ভেবেছিলাম আমাকে এখানে ডেকে তুমি আসবে না।’

‘কেন ডেকেছ আমাকে। তোমাকে ঘৃণা করি আমি।’

‘আমি তো বলেছি কোনওদিন তোমাকে আমার এই মুখ দেখাব না।’

‘কেন ডেকেছ?’ রাগ আর ঘৃণামিশ্রিত কণ্ঠে কথাগুলো বললাম আমি।

‘জানি তুমি বিশ্বাস করবে না।’

‘আমাকে ডেকেছ কে-নো?’

‘খলিল বারবার আমাকে বাধ্য করে এই জঘন্য কাজে জড়াতে। তোমার হোটেলেই তার কয়েকজন ক্লায়েন্ট উঠেছে। আমি সহ আরও তিনজন মেয়েকে সে নিয়ে আসে এখানে। আমাদের মধ্য থেকে একেক সময় একেকজনকে…। তারাও আমার মতোই পরিস্থিতির স্বীকার। কাউকে ভয়ভীতি দেখিয়ে, কাউকে জোর করে, কাউকে নেশার জালে জড়িয়ে বাধ্য করে এইসব কাজ করতে। আমরা তার নামমাত্র ওয়াইফ।’

‘আমি কী করতে পারি?’ ভেতরে ভেতরে আমার বুকটা সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

‘থানা পুলিশ ওর হাতের মুঠোয়। অনেকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু মৃত্যুও আমাকে নেয়নি, মরতে মরতে বেঁচে গেছি।’ নির্লিপ্তভাবেই কথাগুলো বলে চলেছে সে।

‘সত্যি বলছ?’ আমি ঠিক কী বলব বুঝতে পারছি না।

‘আমি ঐ হারামিটাকে খুন করব। ওই শুয়োরের বাচ্চা আমার মতো কত মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে, আরও কতজন মেয়ের জীবন নষ্ট করতে চায় জানি না।’

‘তুমি কেন এমন করেছিলে?’

প্রায় চার বছর পর আমাদের দেখা। তবুও কারও মনে কোনও উচ্ছ্বাস নেই, আছে ক্রোধ, আতঙ্ক আর ঘৃণাবোধ। আমি বিস্ময়াহত দৃষ্টিতে খেয়াল করলাম, ছায়াশরীর থেকে বেরিয়ে এল এক নিশ্চিত মানবী, যাকে এখন আমি সজ্ঞানে অস্বীকার করছি।

আট।

‘ওসি সাহেব, রবিবার দুপুরে রুম নাম্বার একশো সাতের বোর্ডার ডাইনিং-এ লাঞ্চে এলে কৌশলে তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলাম। লাঞ্চ করে ডাইনিং থেকে বারে গিয়ে প্রচুর মদ খায় সে। রুমে ফিরে কিছুক্ষণের মধ্যেই গাঢ় ঘুমে ঢলে পড়ে। গভীর রাতে রুম নাম্বার ওয়ান ও সেভেনে ঢুকে ঘুমন্ত খলিলের মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করি তাকে। এর আগে সিসি টিভির সুইচটা বন্ধ করে নেই।’

‘তাই?’

‘হ্যাঁ।’

ওসি রহস্যময় হাসি হাসলেন। আসামির জবানবন্দি পেয়ে গেছেন সেই সাফল্যেই হাসছেন হয়ত।

‘মিস্টার জুলফিকার — এই মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে এই একদিনেই আমাকে অনেক খাটতে হয়েছে। আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পূর্বে সাজিদকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সাজিদের মা মারা গেছে বলে সে তো বাড়ি চলে গিয়েছিল তাই না? মায়মুনাও বাদ যাননি। বাকিদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।’

‘কী বলেছে ওরা?’

‘সেটা আপনার না জানলেও চলবে। কিন্তু মিস সিনথিয়া কি বলেছেন সেটা শুনতেই হবে আপনাকে। তিনি বলেছেন, আপনি তাকে বাঁচানোর জন্য এই খুনের দায় স্বীকার করে নিতে পারেন এবং তার সন্দেহই সত্য, আপনি সেটাই করছেন।’

‘আমি তাকে বাঁচাতে যাব মানে? খুনটা তো আমিই করেছি।’

‘জানেন আপনার এই স্বীকারোক্তি আপনাকে ফাঁসির মুখোমুখি দাঁড় করাবে?’

‘খুনটা আমিই করেছি।’

‘তাই!’

‘মানে?’

‘সিনথিয়া তার অতীতের সব ঘটনা আমাকে বলেছেন। তারও কোনও দোষ ছিল না, তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন ফিরে আসবার, পারেননি। খলিল প্রথমে তার সাথে প্রেমের অভিনয় করে, নামমাত্র বিয়েও করে। পরে ট্র্যাপে ফেলে তাকে এই পেশায় নিয়ে আসে। নাম পরিবর্তন করে তিনি হয়ে যান সিনথিয়া। সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করেন তিনি, পরিবারের মানমর্যাদার কথা ভেবে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন সিনথিয়া। নিজের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ তৈরি হয় তার। পিশাচ খলিলের কটুচালে ফেঁসে বাধ্য হন নিজেকে মৃত্যুখোঁয়াড়ে ছুঁড়ে মারতে।’

নিজস্ব আয়নাটা সন্তর্পণে খুলে ধরে বিস্ময়াহত দৃষ্টিতে আমি দেখতে থাকি — হাস্যোজ্জ্বল এক মায়াকিশোরী আমার দিকে ছুটে আসছে, যাকে মৃত্যুখোঁয়াড়ে ছুঁড়ে মেরেছিল খলিল নামক হিংস্র পশু, সেই মৃত্যুখোঁয়াড় থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে সে — তার মনশরীর থেকে একে একে খসে পড়ছে অবাঞ্ছিতভাবে তাকে পেঁচিয়ে রাখা ছায়াখোলসগুলো, যে কিশোরী দেখতে আমার একমাত্র আদরের বোন সাদিয়ার মতো। হঠাৎ লক্ষ করি বাবাও উঁকি দিচ্ছেন আমার অদৃশ্য আয়নায়, আলিঙ্গনের ইঙ্গিত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির উদ্দেশ্যে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...