সাধন দাস
ভোররাতের মতো নিঝুম দুপুরও ডেকে ওঠে, শুয়ে শুয়ে শুনতে পাই…
–শিইইল কাটাবেএ এ এন….
গাছ-গাছালির গলিপথে ধ্বনিময় মানুষটা চলে যায়। তখনও মা কলতলায় বাসি কাচেন। কাপড় থুপানো খানিক থামিয়ে শোনেন, উতল সুর। শিলকাটুনি মায়া জানে। উদাস করতালুর ফাঁক গলিয়ে ময়লা জল আপন মনে গড়িয়ে চলে নর্দমার দিকে। মা একদিন তাকে ডাকলেন। মিনতি করলেন সুর শোনাতে। সে বাটনাবাটা শিলের উপর ছেনি ঠোকার তালেতালে গান শুনিয়েছিল। আমরাও শুনেছিলাম। মা আর বাঁশঝাড় ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছিল লোকটির মগ্নতার ভিতর। শিলের পাটায় সে এঁকেছিল রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি। নোড়াতে আঁকতে চেয়েছিল মোহন বাঁশি। মা আর্তনাদ করে উঠেছিলেন — এ কী করলে কাটুনি। মশলার সাথে প্রাণের ঠাকুরকে পিষব? এ পাপ তুমি মুছে দাও।
কাটুনি করুণ মুখে বলেছিল — বৌঠান, আঁকতে পারি, মুছতে পারি না গো!
রাগে দুঃখে হতাশায় মা কাটুনিকে তাড়িয়ে দিলেন। নোড়াতে বাঁশি না এঁকেই সে চলে গেল। রাগের জন্যে মা আপশোষও করতেন। বলতেন, খুঁজে আনতে।
কাটুনিকাকার সুর যে পথে গড়িয়ে যেত, তাকে খুঁজে বেড়াতাম।
শেষরাতে ঘুমের মধ্যে শুনতাম, কানের ভিতর কেউ পাথর কুটছে, কারা যেন ঘরের আত্মায়, কোথাও সিঁদ কেটেই চলেছে।
চোখ মেলে দেখতাম, ঘরের মেঝেতে চাটাই পেতে কালিপড়া হেরিকেনের আলোয় বাবা লিখে চলেছেন। চাদর মোড়ানো পিঠে অন্ধকার ঝুঁকে আছে। অচেনা ছায়া পড়েছে দেওয়ালে। জানালার ফোকরে রাত পাতলা হয়ে এলে, হেরিকেনের কাচে জমে ওঠা কালি, বাবার ছায়া জমে পাহাড় তৈরি হত ঘরময়।
বাবা গল্প লিখতেন। শেষরাতে লেখা তাঁর অভ্যেস। দশফর্মা পরিমাণ তিনখানা গল্পের বই জমে আছে। প্রকাশক পাননি। লিখে লিখে তোরঙ্গ ভরে রাখেন। তোরঙ্গ থাকে তক্তপোষের নিচে। দু’ একদিন ভোররাতে, লেখার আগে বাবা ডেকে তুলতেন আমাকে, বলতেন — খোকা, বুকে একবার মাথা রেখে শোন তো…
ঘুমঘোরে হামাগুড়ি দিয়ে বুকে ওঠার সময় মনে হত পাহাড়ে উঠছি। বাবাকে জড়িয়ে বুকে কান পেতে শুনতাম…
–কুটকুট কুটকুট….
শিশুবেলা থেকেই বাবাকে মনে হত পাহাড়ের মতো। শিল নোড়া ছিল আমার পাহাড় ভাবনার উৎস।
হলুদ কুচিকুচি কাগজের টুকরোগুলো ঝাঁটের আগায় বেরিয়ে আসত। হাতের বাড়ুন সরিয়ে মা বাবু হয়ে বসতেন। কুচিকুচি কাগজ জোড়া দিয়ে পড়তেন। মা পড়তে ভালোবাসেন। এইসব গল্প তাঁর পড়া। কুচিকুচি অক্ষর জোড়া দিয়ে পুরো গল্প তৈরি করার চেষ্টা করতেন। ভাবতেন — কোন গল্প! কবে পড়েছিলাম! কান্না পেয়েছিল! না, সুখে বুক উথলে উঠেছিল! কারা কারা গল্পে আছে!
সেই তৃপ্তি অনুভব করতেন।
বাবা বানিয়ে লিখতে পারেন না। নিজেদের সুখ, দুঃখ, কষ্ট, নিজেদের স্বপ্নের কথা লিখতেন। পড়েই মা চিনতে পারতেন, নিজেদের ঘর, বাড়ি, পাড়া, ঘাটে যাওয়ার রাস্তা, নালুর মার ঘুঁটে দিচ্ছে, চণ্ডীর ছেলে কাঁদছে। তেঁতুলগাছের মাথায় ছাদের মতো আকাশ। নাম পাল্টে পাল্টে লেখা, নামের আড়ালে আসলকে শুধু খুঁজে বের করা। মজার খেলা! একটা গল্পে শিলকাটুনি সুর করে ডাকতে ডাকতে চলে আসত। কিন্তু কিছুতেই এসে পৌঁছত না। দূরে কোথাও শিল কাটত। শুনতে পেতাম। সে একটা গল্পের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অন্য গল্পে ঢুকে পড়ত। বাবা একটা গল্পেই তাঁকে এনেছিলেন। তিনি জানতেন, শিলকাটুনির কাল শেষ হয়ে আসছে। তবু গল্পগুলোর পথ বেয়ে নাছোড় লোকটা নিজেকে বদলে বদলে সুর পাল্টে চলে আসত।
মায়ের শিল কাটিয়ে গেছে। নোড়া কাটেনি। ভাবতাম, কাজ অসম্পূর্ণ রাখবে না, আমাদের উঠোনে একদিন ফের চলে আসবে।
মা গল্পের ভিতর সবাইকে আপন করে দেখতে পেতেন। পড়তে পড়তে কবিতার মতো গল্পগুলো তাঁর মুখস্থ হয়ে যেত, তার পরেও পড়তেন। মুগ্ধ অহংকারে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। বাবা কোনও কোনও দিন গল্প পড়ে শোনাতেন। নিমপাতা, ন্যাপথলিন, স্মৃতি দিয়ে মুড়ে রাখা সে সব গল্প, মায়ের তোরঙ্গে জমা হয়ে থাকত।
২
তোরঙ্গটা ছিল মায়ের প্রাণ, গোপন দামি জিনিস রাখার জায়গা। রাখা থাকত তক্তপোষের নিচে। আপন মনেই পড়ে থাকত। কবে যেন তোরঙ্গটায় মরচে ধরে গেছে। ফুটোফাটা বেড়েছে। ইঁদুরের উৎপাতও। গল্পের টুকরোগুলোকেও রেহাই দিচ্ছে না। কুচি করতে করতে ধুলো করে ফেলছে। জিরে জিরে কুচিগুলো জোড়া দিয়ে পুরো গল্প আর তৈরি হয় না। নিরুপায় ঝাঁটের আগায় চলে যাচ্ছে আস্তাকুঁড়ে।
নির্জন দুপুরে তক্তপোষের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে, কিংবা উবু হয়ে আস্তাকুঁড়ে আবর্জনা ঘেঁটে টুকরোগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে জমা করা আর পাশাপাশি সাজিয়ে গল্প উদ্ধার ছিল মায়ের কাছে শেখা আমার শখ। হঠাৎ হঠাৎ এক আধটা ইঁদুর দেখে ফেলতাম। গাছ-গাছালির আড়াল-আবডালে শিলকাটুনি যেমন হারিয়ে যেত। বাড়ি থেকে প্রাণপনে ছুটে গিয়েও খুঁজে পেতাম না, ইঁদুরও তেমনি তোরঙ্গের ফুটো কিংবা আস্তাকুঁড়ের গর্তে কোথাও লুকিয়ে পড়ত।
বাবা কখনও সখনও নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়াতেন। মনে হত শেষরাতের সেই ছায়াপাহাড় এসে দাঁড়িয়েছে। আমার খেলা দেখতেন। ছেঁড়া টুকরো গল্পের ভিতর দিয়ে দেখতে পেতাম, বাবা, মা, আত্মীয়স্বজনের মতো আবছায়া মানুষেরা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, কথা বলছে, লোকালয়ে অস্পষ্ট গল্প তৈরি হচ্ছে। আমার আর মায়ের এই খেলা বাবা পছন্দ করতেন। প্রশংসায় তাঁর চোখ ছলছল করে উঠত। কোনও আস্ত গল্প কোনওদিনই উদ্ধার করতে পারিনি। যত ব্যর্থ হতাম, বুকে জড়িয়ে ধরে বাবা আমাকে উৎসাহ দিতেন। কপালে চুমো এঁকে পুরস্কৃত করতেন। তখন থেকেই আমি ব্যর্থ এবং পুরস্কৃত খেলোয়াড়।
বাবা ইতিহাসের চেয়ে কিংবদন্তি এবং আমাদের প্রতি ভালোবাসাকে চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেন। তাঁর প্রথমা পাঠিকা ছিলেন মা। পড়তে পড়তে তিনি আবিষ্ট হয়ে উঠতেন। গল্পে কোনও চরিত্রের মধ্যে তাঁর প্রতি বাবার প্রেমের ছদ্মবেশী প্রকাশ দেখে লজ্জা পেতেন। সে কারণে পড়ার চেয়ে শুনতে বেশি ভালোবাসতেন। চাঁদনি সন্ধেতে খেজুরপাতার চাটাই পেতে বাবা বসতেন সাদা গেঞ্জি গায়ে। লম্ফর আলোয় পড়তেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল নরম, গম্ভীর, জ্যোৎস্নাবিস্তারী। মনে হত, চাঁদের পাহাড়ে কোনও কলঙ্কিত গুহায় বসে পড়ছেন। খুব পাশে বসে মা কাস্তেবটিতে শানি কাটতেন। তিন ভাইবোন উঠোন জুড়ে খেলতাম ‘ও কুমির তোর জলকে নেমেছি’। মাঝেমাঝে খেলায় অনাচারের অভিযোগ জানাতে এসে, বাবার কাছে, মায়ের কাছে আমরা আদর খেয়ে যেতাম। আমাদের উঠোন জুড়ে তখন ভালোবাসা আর কিংবদন্তির জ্যোৎস্না নেমে আসত।
এবার ‘প্রেমের চৌম্বকত্ব’ বিষয়ে, বাবা নিজের জীবন এবং কিংবদন্তি মিশিয়ে একখানা ইতিহাস রচনা করেছেন। বলা যায় এটা তাঁর নিজেরই জীবনকাহিনি। ‘বিবাহপূর্ব’ প্রথম খণ্ড, ছ’ নম্বর হাতিমার্কা একখানা এক্সারসাইজ বুক। অন্যটি ‘বিবাহোত্তর’। ওজনে কেনা খাতায় ঠাসা লেখা। একই সমস্যা। প্রকাশক মিলছে না।
বাবার খুব ইচ্ছা, অন্তত এ বইখানা ছেপে বের হোক। মা বুঝিয়েছেন, গরিব মানুষের এসব অসুখ মানায় না। বাবা নাছোড়। আগের বইগুলোর দশা এটাকে কিছুতেই হতে দেবেন না। দ্বিতীয় খণ্ডটি পাতলা, কিন্তু টানটান। কেঁদে কঁকিয়ে, ধার-দেনা করে হয়তো ছাপতে পারেন। কিন্তু ‘বিবাহোত্তর’টি দাঁড়িয়ে আছে, ফেনিল ‘বিবাহপূর্ব’-এর স্তম্ভে। ফলে, ছাপা হয় না। সংসারের দিকে তাকিয়ে মা কিছুতেই ঘাড় কাত করেন না। অগত্যা প্রেমের পাণ্ডুলিপি, দেওয়ালের পেরেকে, একখানা সবুজ ব্যাগে ঝুলেই থাকে। মায়ের সাঁই না থাকলে ও সময়ের ফাঁকফোকর পেলে, বাবা ব্যাগখানা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়তেন প্রকাশকের খোঁজে।
৩
নিচু হয়ে উঠোনের মাটি মাথায় ঠেকিয়ে বাবা বাড়ি ছাড়তেন। মা তখন বাঁশঝাড় তলায়, ঘোমটার আড়ালে করজোড় তুলে বলতেন — দুগ্গা দুগ্গা।
তাঁর ছলছল চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসত। গুল্মলতার জংলি পানাপুকুরের পাশ দিয়ে, কুমোরকাকাদের চাক, গোবিন্দর মুদিখানা পেরিয়ে, আমবাগানের গলিপথে বাবা মিলিয়ে যেতেন।
অনেকদিন হল মাকে আর বাবার পিছুপিছু যেতে দেখি না। বাবার এই হুটহাট বেরিয়ে পড়া মা আর বরদাস্ত করছিলেন না। মুখে বারণ করতেন না। আপনমনে বিড়বিড় করতেন। ঘরের পিছন দেওয়ালে বেশি সময় ধরে ইচ্ছে করে ঘুঁটে দিতেন। যাওয়ার সময় যেন বাবাকে দেখতে না হয়। শেষদিকে বাবা নিজেই হাঁড়ি থেকে বেড়ে, পান্তাভাতে নুন লংকা খুসে খেয়ে, বেরিয়ে যেতেন। ভিতরে ভিতরে মা গুমরে মরতেন। বাবাকে ছাড়া থাকা আমাদের একেবারেই অভ্যেস ছিল না। বাবাহীন সময়টা আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়তাম। ঘরেদোরে যেখানে সেখানে কাজ করতে করতে মা থেমে যেতেন। আমরা অজানা কিছু ভয়ে মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করতাম। মা বকলে, এমন কি মারলেও শান্তি পেতাম। অন্তত মা যেন আমাদের দূরে ঠেলে না দেন। বাইরে না পেয়ে গল্পের ভিতরে বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি পালিয়ে যেতাম। এ পথ, সে পথ, জঙ্গল, পুকুর পাড়ের বটতলায় একা একা বসে থাকতাম। জঙ্গলের পিছনে দূরে, অনেক দূরে শিলকাটুনি কোথাও হাঁকতে হাঁকতে চলে যেত। বোনদুটো পালাতে শেখেনি। বকা খেয়ে, মার খেয়ে মরত মায়ের কাছে। বাসি উঠোন পড়ে থাকত। গোবর জমত গোয়ালঘরে। উনুনে আগুন বারবার নিভে, ভাত নামাতে বেলা গড়িয়ে যেত। বাধ্য হয়ে বোনদুটো ঘুঁটে দেওয়া, রান্না করা শিখে গেল। নিত্যদিনের খাদ্য হয়ে দাঁড়াল ফেনাভাত কলমিসেদ্ধ, কলমিসেদ্ধ আর ফেনাভাত। আধকোটা শিল-নোড়াতে বাটনা বাটাও যায় না, দরকারে লাগেও না। পড়ে থাকে। কবে শিলকাটুনি এসে পৌঁছায় সেই অপেক্ষায়। আমি অকম্মার ধাড়ি, পথে পথে খেলে বেড়াই, বাবাকে না পেয়ে শিলকাটুনিকে খুঁজি। নোড়াখানা কোটানো হয়নি, বাদ পড়ে আছে। কাটুনিকে যদি ধরে আনতে পারি, মা যদি গাইতে বলেন! একটু হলেও বাঁশঝাড়ের ছায়া শিলকাটুনি আর মায়ের গায়ে ঝুঁকে পড়বে। পাথরের নোড়ায় বেজে উঠবে গান।
বাবা এবার না খেয়েই বেরিয়ে গেছেন। পিছন ডাকতে নেই। ছুটতে ছুটতে অনেক দূর গেলাম। সবুজ ব্যাগখানা বাবার কাঁধে দুলতে দুলতে লুকিয়ে গেল আমবাগানের আড়ালে। প্রাণপণে ফিসফিসিয়ে উঠলাম…
–বাবা, যেও না।
কী একটা ছিল বাবার মধ্যে চেঁচিয়ে বারণ করতে পারতাম না, শুকনো ভাত আলুসিদ্ধ মেখে, ছোট বোনকে পাহারায় রেখে এসেছি। যদি ফিরতেন, শুধু খেয়ে যেতে বলতাম।
বাবা ছিলেন মৃদুভাষী, কোমল, স্নেহময়। অনড় পাহাড়ের মতো ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন দৃঢ়চেতা মানুষ। মা তীব্রস্বরে কিছু বললে, চুপ করে থাকতেন। এত তীব্র সে চুপ, মার কথা তখন চণ্ডীদের বাড়ি থেকে শোনা যেত। অতি ক্লান্তিতেও বাবার চোখদুটো প্রসন্ন থাকত।
অনেকদিন পর ফিরে, বারান্দায় এলিয়ে বসলে, আমরা তাঁকে ঘিরে বসতাম। আমাদের পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। ঘেঁষতে ঘেঁষতে আমরা তাঁর বুকের গুহায় মিশে যেতে চাইতাম। কোলকাতার আশ্চর্য গন্ধের বদলে ঘেমোবাবার বিটকেল গন্ধ বেরুত। তিনি আমাদের মুখে ধবলি গাইয়ের কালি পড়া চোখের মতো তাকিয়ে থাকতেন। কথা বলতেন খুব ধীরে।
আশ্চর্য শহর কোলকাতা। ছুটে যাওয়া জঙ্গলের মতো গাড়ির পাল। তালগাছের চেয়ে উঁচু উঁচু বাড়ি, বড় বড় লেখক, পেল্লায় ছাপাখানা, প্রকাশকদের মজার মজার গল্প। প্রকাশকদের কথা বললেই তাঁর চোখদুটো ছোট হয়ে আসত। চুপ করে যেতেন। অন্য কিছু ভাবতেন। কষ্ট, নিষ্ঠুরতা, কূট ব্যবহার, বিশ্বাসঘাতকতা চেপে রাখাই তাঁর অভ্যেস। বুকে মাথা রেখে বুঝতে পারতাম বাবা ছিলেন অচেনা পাহাড়ের মতো। ঘামের বিটকেল গন্ধটা হয়তো কোলকাতার গুহা থেকে বেরুচ্ছে।
রূঢ়ভাষায় মা কিছু জানতে চাইলেই, সন্ত্রস্ত হয়ে উঠতেন। নিজেকে যত দূর সম্ভব চেপে এককথায় উত্তর দিতেন। বাবা যদি ‘রা’টুকুও কাড়তেন, ‘রা’ এবং ‘কোলকাতা’র শ্রাদ্ধ করার জন্যে পাঁজি-পুঁথি, ঠাকুর, নুড়ি কিছু লাগত না। চোদ্দপুরুষ উদ্ধার হয়ে যেত। বাবার গা ঘেঁষে বসার ক্ষুধায় পিণ্ডির চটকানো গ্রাসে আমরাও ভাগ পেতাম।
বাবা বাড়িতে থাকুন আর নাই থাকুন, চটকানো পিণ্ডির ভাগ গিলতে গিলতে তিন ভাইবোনের সঙ্গে প্রতিবেশীদেরও অভ্যেস হয়ে গেছে। হজমে কারও আর গণ্ডগোল হয় না। মুশকিল হত বাবার, বিদেশ বিভুঁইয়ে অন্য কোনও খাবার জুটত কিনা বুঝতে না পারলেও বাড়িতে ফিরে মায়ের নাম-গান স্মরণে ঘনঘন বিষম খেতেন, চোখের সামনেই দেখতাম।
মায়ের চিল চিৎকারে, কোলকাতা শোনা ভেস্তে যেত। অন্ধকার বারান্দায় গল্পের চুম্বকে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাকে একা ফেলে রেখে পালিয়ে আসতাম। তড়িঘড়ি হেরিকেন জ্বালিয়ে বই খুলে বসতাম। মা পড়াশুনো পছন্দ করতেন। আমরা বাবা মায়ের উত্তরমুখী দক্ষিণমুখী প্রেমের মাঝখানে চৌম্বকশক্তি বিস্তারের ইচ্ছায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ক্লাসের গল্প পড়তাম। বাবা বুকে হাঁটু জড়িয়ে অন্ধকার দেওয়ালে ঠেসে ঘনঘন বিড়ি খেতেন। বিড়ির আগুন তীব্র হত আবার ম্লান হয়ে আসত।
খিদের সময় পার হয়ে যেত, মা খেতে ডাকতেন না। সারা বাড়ি খুঁজে খুঁজে যখন মাকে পাওয়া যেত না, তক্তপোষের পাশে নিচু হয়ে ডাকলে, তিনি বেরিয়ে আসতেন। আমি জানতাম, অন্ধকারে, মা ঘাড় হেঁট করে, বুকের ভিতর রেখে তোরঙ্গখানা ঝাড়পোঁছ করেন। তবু বাইরের জল-হাওয়া ঠেকাতে পারেননি। জং ধরে ওটার ডালা ভেঙে গেছে। রান্নাঘরে শিল-নোড়া কাজে লাগে না। আকামের পাথরদুটো দিয়ে মড়মড়ে হলুদ গল্পগুলো চাপা রাখেন। তোরঙ্গের চারপাশে, ইঁদুর ঢোকার ফুটো-ফাটাতে বিষমাখা মুড়ি, ভাত ছড়িয়ে রাখেন। তবু কুটকুট কুটকুট শব্দ গল্পের ভিতর ছড়িয়ে পড়ে।
৪
সেবার ভাদ্রের শেষাশেষি, তীব্র দাবদাহে গ্রাম জুড়ে খরা। ফুটিফাটা মাঠঘাট। নিশ্চিহ্ন সবুজ, শস্যহীন চরাচর, নিষ্করুণ আকাশ মাথায় ফিরে এলেন বাবা। ঘরদোর খাঁ খাঁ করছে। একদিনের শুকনো ঝড়ে রান্নাঘরের দেওয়াল ধ্বসে গেছে। টালির চাল কেতরে পড়েছে। ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে আঁচলমাথায় মা ভাত ফোটাচ্ছিলেন। ব্রহ্মতালু ভেদ করে রোদ্দুর ঢুকছে।
বাবাকে দেখে ভাত টগবগিয়ে উঠল। মায়ের আঁচল খসে গেল।
কলমছে কাটা কঞ্চির মতো, অকম্মার ঢেঁকি, কুলাঙ্গার বাবার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মা। এক গেলাস জল এগিয়ে দিতে গেলাম। ছোঁ মেরে কেড়ে নিলেন। এমন সশব্দে বাবার পাশে রাখলেন, উঠোন শুষে নেওয়ার আগে, বাষ্প হওয়ার টানে অর্ধেক জল উপচে পড়ল। সাইডব্যাগখানা মা কেড়েই নিলেন। হন্যে কুকুরের মতো রোদ্দুর ঠেঙিয়ে ছুটলেন গোবিন্দর মুদিখানায়। ব্যাগ থেকে খুলে যাওয়া দেশলাইয়ের কাঠি, বান্ডিলখোলা বিড়ি, চিরুনি, আধখাওয়া লজেন্স, নষ্টের গোড়া প্রেমের পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো পথে ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছিল। ঘরে লবণ ছিল না। খাতাদুটো এক পোয়া লবণের বিনিময়ে গোবিন্দর হেফাজতে বিদেয় করে দিলেন। রঙচটা ব্যাগখানা উড়িয়ে দিলেন আগুনখেকো বাতাসের মুখে। ঝড়ে যেদিন রান্নাঘর ভেঙেছিল, ছাদে উঠে, হলুদ গল্পগুলো তোরঙ্গশুদ্ধু উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন তাঁর এলোচুল হা হা বাতাসে উড়ছিল। তক্তপোষের অন্ধকারে পড়েছিল দু’ টুকরো নিশ্চল পাথর। সবুজ রঙের মরা ব্যাগখানা উড়িয়ে দিলেন তোরঙ্গের সেই আকাশে। মা দেখছিলেন, ব্যাগখানা উড়ে উড়ে নেমে যাচ্ছে, খরায় চৌচির ফাটলের ফাঁকে, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ভাঙা তোরঙ্গের পাশে।
বাবা জল খেলেন না। মুখের আধপোড়া বিড়িটা ভিটেয় খুসে, উঠে দাঁড়ালেন। আমাদের দিকে তাকাতেই, তিন ভাইবোন ছুটে গেলাম। সবাইকে আদর করলেন। আমাকে বুকের ভিতর টেনে কপালে চুমু খেলেন। বোনেদের চুলে নিজের অজান্তেই বিলি কেটে দিলেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন, কিছু বললেন না। ঝুঁকে পড়া বাঁশবন, কঞ্চির আকুতি, মুখ চোখ জামা টেনে ধরেছে। বাবা গ্রাহ্য করলেন না। পুকুর পাড় পর্যন্ত গিয়ে থামলেন। নেমে গেলেন আবক্ষ তৃষ্ণায় ফুটিফাটা পুকুরের বুকে। হাঁটু গেঁড়ে নিচু হয়ে ঘাড় উপর দিকে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখলেন। ঘাস, ফ্যানজল না পেয়ে আমাদের ধবলি মরে যাওয়ার আগে যেমন দেখেছিল। এক মুহূর্ত। ছুঁড়ে ফেলা ব্যাগ কাঁধে তুলে পুকুরের চড়াই ভাঙতে শুরু করলেন, মা তখন সংসারমুখো।
চিৎকার করে বললেন, এই যেন তাঁর শেষ যাওয়া হয়।
বাবা কুমোরদের চাক পেরিয়ে গোবিন্দর মুদিখানায় দাঁড়ালেন। দূর থেকে নির্নিমেষ চেয়ে আছি। গোবিন্দকাকা খাতা দু’খানা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করছেন। যার যতখানি পাওনা, জিরে, মরিচ, হলুদ, লংকার মোড়কে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন।
পথে পাশ কাটিয়ে শিলকাটুনি গ্রামে ঢুকল। বাবা তাকালেন না। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছেন চোখের বাইরে, কাঁধে সবুজ ব্যাগখানা দুলছে। একটা পাহাড় চলে যাচ্ছে। শেষরাতের দেওয়ালে জেগে থাকা পাহাড়, গ্রামের মেঝেতে গল্প লিখতে লিখতে চলে যাচ্ছে।
হঠাৎ নিঃসঙ্গ মায়ের কথা মনে মনে পড়ল। শিলনোড়া আধকোটা পড়ে আছে। শিলকাটুনি হনহন করে বাবার উল্টো দিকে এগিয়ে চলেছে। দু’জনের মাঝখানে হতভম্ব আমি। বললাম — কাটুনিকাকা, আমাদের নোড়ায় বাঁশি এঁকে দেবে না? মা তোমাকে খুঁজছে।
বাঁশঝাড়ের নিচে উপুড় হয়ে লুটিয়েছিল মা। কাকা মায়ের সিঁথেনে উবু হয়ে বসে মাথায় হাত রেখে বলল — কৃষ্ণ ফুঁ দিলে কী হবে বৌঠান, বাঁশি রাধার হাতেই বাজে।
উমনো ঝুমনো চুলে মুখ তুলে মা ফুঁপিয়ে উঠল — কাটুনি তুমি নোড়া কেটে বাঁশি এঁকে দিয়ে যাও।
কাটুনি হাসল। নিঝুম দুপুরের মতো সন্ধের আঁধারে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল।
–শিইইল কাটাবেএ এ এন….
গল্পটা অসাধারণ লাগলো।
অসম্ভব মায়াময় লেখা।